০৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস (পর্ব ১-২)

 ০৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস


পর্ব ১

উরুমচির ইবনে সাদ রোড ধরে পুর্বদিকে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে শক্ত সমর্থ একটা হাই ল্যান্ডার জীপ।
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন রাস্তায় নেমে এসেছে। রাস্তার বিজলিবাতিগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সৃষ্টি হয়েছে শহর-জীবনের এক সনাতন আলো আঁধারী। অভিজাত আবাসিক এলাকা এটা। রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। ফুল স্পীডে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার জীপ। জীপে মোট পাঁচটি সিট। সামনে দু’টা, পেছনে তিনটা। ড্রাইভিং সিটে বসেছে আহমদ ইয়াং তার পাশেই আহমদ মুসা। পিছনে হাসান তারিক এবং মা-চু বসেছে।
আহমদ মুসা ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে একনজর দেখলেন, সন্ধ্যা ৭ টা। আহমদ মুসা চিন্তা করলেন, ওয়াংহুয়া তার নতুন বসতিকামী কাফেলা নিয়ে নিশ্চয়ই দিনে রওয়ানা দিয়েছে। মধ্য রাত্রির নীরব প্রহরে শিহেজি উপত্যকায় পৌছতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং উরুমচিতে ওদের রাত দশটায় অবশ্যই পৌঁছা চাই। কিন্তু ওদের আটকাতে হবে উরুমচি থেকে অনেক দূরে বিজন পাহাড়ি অঞ্চলে।
কানশু প্রদেশ থেকে যে উরুমচি হাইওয়ে এগিয়ে এসেছে সেই পথেই ওয়াংরা আসছে।
আহমদ মুসার মানস দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে উরুমচি থেকে কানশু পর্যন্ত পথের দৃশ্য। কৈশোরে এই পথে সে একাধিকবার উরুমচি এসেছে। গোটা পথটাই তার চোখের সামনে এখনও জ্বল জ্বল করছে। পথটা তখনও পাকা হাইওয়ের রুপ নেয়নি। কাঁকর বিছানো সে পথে উট চলতো, ঘোড়ার গাড়িও চলতো অনেক। তখনকার চেয়ে এখনকার গতি অনেক বেড়েছে। ধীরে-সুস্থে গিয়েও একশ মাইল দূরের আল-খলিল উপত্যকায় রাত নটার মধ্যে তারা পৌছতে পারবে। তিয়েনশানের পাহাড়ের একটা ছোট দক্ষিণমূখী শাখায় এই আল-খলিল উপত্যকা। উরুমচি হাইওয়েটি পাহাড়ের একটি সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে এই উপত্যকা অতিক্রম করে এসেছে। ঐ গিরিপথ হাইওয়ে দুপারে কয়েক মাইল বিস্তৃত উঁচু পাহাড়ের দেয়াল। ওয়াংদের আগ্রাসী কাফেলাকে আটকাবার উপযুক্ত জায়গা এটাই। আহমদ মুসা ভেবে-চিন্তে এই স্থানটা নির্বাচন করেছেন। পরিকল্পনা অনুসারে রাত নটার মধ্যেই আল-খলিল উপত্যকায় তাদের পৌছতে হবে। ওয়াংরা ওখানে পৌছার আগে তাদের অনেক কাজ আছে সেখানে।
আহমদ মুসার চিন্তা হোঁচট খেল। পেছন থেকে মা-চুর বেসুরো কন্ঠ ধ্বনিত হলো, সামনেই বাঁ দিকে বাঁক নেবেন। বাঁ দিকের লেনটা হয়ে পিয়াও লিন রোডে পড়া যাবে।
তোমার পিয়াও লিন রোড কি আমাদের উরুমচি হাইওয়েতে নিয়ে যাবে? বললেন আহমদ মুসা।
না স্যার। পিয়াও লিন রোড থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে লিও শাও চি স্কোয়ার হয়ে আমরা পিং রোডে পড়ব, সেখান থেকে উংফু, তারপর…….
আহমদ মুসা তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, তারপর থাক। মাথায় ওসব থাকবে না। তুমি আহমদ ইয়াংকে সাহায্য কর।
একটু দম নিয়ে আহমদ মুসা বললেন, মা-চু তুমি আল-খলিল চেন?
চিনব না কেন? আল-খলিল তো উরুমচির দরজা। কিন্তু ওর নাম এখানে আল-খলিল নয়।
সাংস্কৃতিক বিপ্লব ওর নাম তো দিয়েছে ‘মাও ভ্যালি’ সেই কবে। আপনি আল-খলিলের নাম জানলেন কি করে?
জানব না কেন মা-চু? আমি কি সিংকিয়াং-এর মানুষ না?
মনে ছিল না স্যার। কিছুটা কাঁচু-মাচু হয়ে বলল মা-চু।
আচ্ছা মা-চু, আল-খলিল গিরিপথে আমরা ওয়াং হুয়ার মুখোমুখি দাঁড়ালে কেমন হবে?
খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মা-চুর। বলল ওখানে উপযুক্তভাবে দাঁড়াতে পারলে ওয়াং হুয়াদের কয়েকদিন তো ঠেকিয়ে রাখা যাবেই।
উপযুক্তভাবে বলতে তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছ?
স্যার, উরুমচি হাইওয়ের আল-খলিল গিরিপথ থেকে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের দেয়াল গেছে মাইল চারেকের মত, আর উত্তর দিকে গেছে পাঁচ মাইল। গিরিপথে বাধা পেলে খাড়া পাহাড় ডিঙিয়ে ওদের পক্ষে মালসামান নিয়ে আল-খলিল উপত্যকায় নামা সম্ভব নয়। বিকল্প হিসেবে ওরা চার-পাঁচ মাইল পথ অতিক্রম করে উত্তর বাঁ দক্ষিণ দিক দিয়ে পাহাড় ঘুরে এপারের আল-খলিল উপত্যকায় নামার চেষ্টা করবে। এ চেষ্টার পথ যদি বন্ধ করা যায় তাহলে ওয়া আটকা পড়ে যাবে। হতবুদ্ধি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে নতুন পথের সন্ধান করতে ওদের অবশ্যই কয়েকদিন কেটে যাবে।
চমৎকৃত হলেন আহমদ মুসা অভিজ্ঞ সমরকুশলীর মত মা-চুর কথায়।
বিস্ময় মানলেন যে, মা-চু তার মনের কথাই গড় গড় বলে যাচ্ছে ঠিক মাইক্রোফোনের মত।
মা-চু একটু দম নিলে আহমদ মুসা বলে উঠলেন, আচ্ছা, মা-চু, ওয়াং হুয়াদের পাহাড়ে ঘুরে আসা কি করে ঠেকাবে, চিন্তা করেছ?
ও তো সোজা স্যার। পাহাড় ঘুরে আমাদের উত্তর ও দক্ষিণের সংকীর্ণ পথ দুটার কৌণিক পরিমাপে কয়েক সারি বিস্ফোরক পাততে হবে। তাহলে ওদের গতি রুদ্ধ হয়ে যাবে।
মা-চু থামল। খুশিতে ভরে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। তিনিও তৎক্ষণাৎ কিছু বললেন না।
পাশে বসে অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল হাসান তারিক কিছু বলার জন্য। এবার সুযোগ পেয়ে বলল, মা-চু, আপনি তো সাংঘাতিক সমর প্রকৌশলী, আপনাকে সেনাবাহিনী থেকে ওরা ছাড়ল?
ছাড়েনি, পালিয়ে এসেছি। বে-দ্বীন শত্রুর সেনাদলে থেকে পরকাল খোয়াব নাকি?
বাসায় বসে বসে ভাল লাগে আপনার?
ভাল লাগে না, কিন্তু শান্তিতে ধর্ম-কর্ম করতে পারছি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। তারপর আল্লাহ নিজেদের কোন সৈন্যদল দিলে তাতে যোগ দেব। এসব ভাবি বলে আপনাদের আমার খুব ভাল লাগে।
কি ভাল লাগে আমাদের?
জাতির জন্য আপনারাই আসলে কিছু করেছেন, করছেন।
আপনি কি সব জানেন?
আপামনি আমাকে সব বলেছে।
মা-চু থামল। হাসান তারিকও আর কিছু বলল না। কথা বললেন আহমদ মুসা। বললেন, মা-চু, আমাদের সাথে তুমি নিজেই আসতে চেয়েছ, না তোমার আপা তোমাকে পাঠিয়েছে?
মাফ করবেন স্যার। আপনাদের সাথী হবার সাহস কি আমার আছে? আপাই আমাকে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, তোমার স্যার সুস্থ হয়ে উঠেননি, তার পাশে পাশে তোমাকে থাকতে হবে।
মা-চুর সরল সোজা এ ধরনের প্রকাশে আহমদ মুসা কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন। এক ঝলক রক্ত যেন তার মুখমণ্ডলকে মুহুর্তের জন্য লাল করে তুলে আবার মিলিয়ে গেল।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। এই সময়ে মা-চু বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, এই তো আমরা লিও শাও চি স্কোয়ারে প্রবেশ করছি। স্কোয়ারের বাঁ পাশের রোডটাই পিং রোড।
লিও শাও চি স্কোয়ারে এসে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে গাড়ি পিং রোডে প্রবেশ করল।
পিং রোড বাণিজ্যিক এলাকা। নিয়ন সাইনের সমারোহ। রাস্তায় প্রচুর লোকজন। গাড়িঘোড়াও প্রচুর। লিও শাও চি স্কোয়ারে এসেই গাড়ির স্পীড অনেকখানিই কমিয়ে দিতে হয়েছে। পিং রোড উরুমচির নতুন এলাকা। রাস্তাগুলো বেশ প্রশস্ত। মনে হয় পঞ্চাশ বছর সামনের প্রয়োজনকে লক্ষ রেখেই রাস্তাগুলো তৈরী হয়েছে। তাই খুব স্বচ্ছন্দ গতিতে গাড়ি এগুতে পারছে। পিং রোডে ঢুকে গাড়ির গতি আবার কিছুটা বাড়ানোও গেছে।
পিং রোড গিয়ে পড়েছে উংফু এভেনিউ-এ। উংফু উরুমচির সবচেয়ে অভিজাত বিপনী কেন্দ্র। দীর্ঘ এই এভেনিউরই শেষ প্রান্তে সরকারী রেসিডেন্সিয়াল ব্লক এবং সরকারী প্রশাসনিক ভবনসমূহ। প্রধান প্রশাসনিক ভবনের পরেই ছোট্ট একটি লেক এবং বিশাল একটি উদ্যান। এই সংরক্ষিত এলাকার মধ্যেই সিংকিয়াং- এর গভর্নর লি ইউয়ান এর বাস ভবন।
লি ইউয়ান জাতিতে হান। পৈত্রিক বাড়ি উরুমচিতে। তার শিক্ষা জীবন কাটে ব্যবসায়ী পিতার সাথে সাংহাইয়ে। কর্ম জীবন তার শুরু হয় পিকিং-এ। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় প্রতিক্রিয়াশীলতার অভিযোগে তার পিতা নিহত হয়। লি ইউয়ানও চাকুরী হারিয়ে উরুমচিতে তার পৈত্রিক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। লি ইউয়ান পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় সে উরুমচিতে সবজি ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। দুরের উপত্যকা অঞ্চল থেকে শাক সবজি কিনে মাথায় করে বয়ে এনে উরুমচির বাজারে বিক্রি করত সে।
লি ইউয়ান সম্পর্কে জনশ্রুতি হল, তার পিতামহ একজন কাজাখ মুসলমান। তার পিতামহী ছিল হান বংশীয়। তার পিতার জন্মের অল্পকাল পরে পিতামহ মারা গেলে মাতামহী শিশুপুত্রকে নিয়ে হান পরিবারে ফিরে আসে। অতঃপর হানদের একজন হয়ে লি ইউয়ানের পিতা বড় হয়। লি ইউয়ান এখন পুরোপুরি হান বংশীয় বলে পরিচিত। কিন্তু, চেহারা মেলে না। টানা নীল চোখ, উন্নত নাসিকা, দীর্ঘ দেহ তার দেহে তুর্কী রক্তের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
আহমদ মুসার জীপ পিং রোড থেকে উংফু এভিনিউতে এসে পড়ল।
উংফু এভিনিউ-এ জনসমাগম আরও একটু কম। গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল আহমদ মুসার জীপ।
বিপরীত দিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছিল দুটো হেডলাইট। গতিটা একটু যেন বেপরোয়া। একদম কাছে এসে গেছে হেডলাইট দুটো।
এ সময় দুটো কার ওভারটেক করল আহমদ মুসার জীপকে। ওভারটেক করতে গিয়ে কার দুটো ছুটে আসা গাড়িটির পথটা অনেকখানি দখল করে ফেলেছিল। স্লো হয়ে গিয়েছিল ছুটে আসা গাড়িটির গতি।
কার দু’টো ওভারটেক করে তাদের লাইন পেরিয়ে গেল। ছুটে আসা গাড়িটি তখন আহমদ মুসার গাড়ির সমান্তরালে। গাড়ী দুটোর মধ্যে দুরত্ব চার গজের বেশী নয়।
‘বাঁচাও’ নারী কন্ঠের একটা চিৎকার ভেসে এল ঐ গাড়ী থেকে। সেই সাথে গোঙানিও। মনে হল অনেক বাধা ডিঙিয়ে গোঙানি মিশ্রিত চিৎকারটি ভেসে এল।
তা ছিল শব্দের এক ঝলক মাত্র। গাড়িটি ছুটে বেরিয়ে গেল পেছনে চোখের আড়ালে। চিৎকার শুনেই আহমদ মুসা চোখ ফিরিয়েছিলেন। চঞ্চল হয়ে উঠেছিল চোখের দৃষ্টি। একটা উদ্বেগ ঝরে পড়ছিল সে দৃষ্টি থেকে।
দ্রুত ভাবছিলেন তিনি। না, তিনি একজন অসহায় নারীর ওই আবেদনকে মাড়িয়ে সামনে এগুতে পারেন না। সিদ্ধান্তের এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল তার চোখে মুখে।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াং- এর দিকে ফিরে বললেন, গাড়ি ঘুরাও আহমদ ইয়াং, ওই গাড়ীটাকে অনুসরণ কর।
আহমদ ইয়াং আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়েই গাড়িটি ঘুরিয়ে নিল। পেছনের সিটে বসা হাসান তারিক একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল: কিন্তু মুসা ভাই, আমাদের হাতে সময় তো কম।
জানি তারিক, কিন্তু কোন মজলুমের আবেদন কানে আসার পর তাকে তো আমরা উপেক্ষা করতে পারি না।
কিন্তু মুসা ভাই, যে দায়িত্ব আমাদের কাধে সেটা বড় নয়? সেটা বিবেচ্য নয়?
বড় অবশ্যই, কিন্তু একজন বিপদগ্রস্থা নারীর এই ‘বাচাও’ চিৎকার কানে আসার পর ওটা এখন আর প্রথম বিবেচ্য নেই।
হাসান তারিকের কাছ থেকে কোন উত্তর এল না। আহমদ মুসাই আবার কথা বললেন। বললেন, মনে কর তারিক, ওই মেয়েটি যদি আমার বোন হত, মেয়ে হত, তাহলে তার ঐ চিৎকার শোনার পর আমরা কি এক পা-ও সামনে এগুতে পারতাম? পারতাম না। একজন মুসলমানের কাছে আল্লাহর প্রতিটি মজলুম বান্দাই সমান।
ঠিক বলেছেন, মুসা ভাই, আমি ভুল করছিলাম।
ভুল নয় তারিক, তোমার যুক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা এই মুহুর্তে যা করণীয় তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আল্লাহ আমাদের সব ব্যাপারে সাহায্য করুন।
আহমদ মুসাদের জীপ ছুটছিল সামনের গাড়িটির পেছনে। সামনের গাড়ীটি একটি ছোট্ট মাইক্রোবাস।
গাড়িটির কাছাকাছি হবার জন্য আহমদ মুসাদের জীপকেও গতি বাড়াতে হয়েছে। ফলে দুটো গাড়ীই ছুটছিল বেপরোয়া গতিতে।
উংফু এভিনিউ রিং রোডের মত। এভিনিউটি শহরের পুর্ব প্রান্তে উরুমচি হাইওয়ে থেকে বের হয়ে প্রথমে উত্তর দিকে এগিয়ে গভর্নর ভবনকে ক্রস করে পশ্চিম দিকে বাক নিয়েছে। নতুন উরুমচি নগরীর গোটা উত্তরপ্রান্ত বেষ্টন করে পুরোনো উরুমচি নগরীর প্রধান সড়ক বাজার রোডে গিয়ে লম্বাভাবে পড়েছে।
মাইক্রোবাসটিকে অনুসরণ করে আহমদ মুসার জীপ বাজার রোডে এসে পড়ল।
বাজার রোডটি উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। উংফু থেকে অনেক খানি সরু। রাস্তার দু ধারে দোকান-পাট খোলা। কিন্তু, রাস্তায় লোকজন ও গাড়ী-ঘোড়ার সমাগম খুব বেশী নয়।
নতুন উরুমচির সাথে পুরাতন উরুমচির এটাই পার্থক্য যে, নতুন উরুমচির বিপনিগুলো সন্ধ্যার পর ঝলমলিয়ে ওঠে, কিন্তু পুরাতন উরুমচির বাজার-বিপনিগুলোতে লোকের সমাগম তখন কমতে থাকে। মাগরিবের আযানের আগে থেকে এই ভীড় কমা শুরু হয়, এশার পর বাজারগুলো যেন ঘুমিয়ে পড়ে। মুসলিম শহর উরুমচির এ ঐতিহ্য অনেক আগের। তা এখনও চলছে। কম্যুনিস্ট শাসন এবং তারপরে সাংস্কৃতিক বিপ্লব মুসলমানদের অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু, মুসলিম জনপদের অনেক অভ্যাসের মত এ অভ্যাসটিও দূর করতে পারেনি।
মাইক্রোবাসটি বাজার রোড ধরে সমান গতিতে এগিয়ে চলেছে।
আহমদ মুসা বললেন, ইয়াং ওরা আমাদের দেখতে পেয়েছে বলে মনে কর?
আমার মনে হয় না। ওদের গাড়ির স্পীডে কোন কমবেশি দেখছি না।
ঠিক বলেছ, বেশীক্ষণ আর গোপন থাকতে পারব না। উংফু এভিনিউতে প্রচুর গাড়ির ভীড়ে লুকানো গেছে। পুরানো উরুমচির ফাকা রাস্তায় আর তা সম্ভব নয়।
সত্তর কিলোমিটার গতিতে প্রায় দুশ গজের মত ব্যবধান রেখে এগিয়ে চলছিল গাড়ি দুটি। বাজার রোড ধরে কিছুক্ষণ চলার পর সামনের মাইক্রোবাসটির গতি হঠাৎ বেড়ে গেল।
আহমদ মুসা মুখ ফিরিয়ে আহমদ ইয়াং-এর দিকে তাকালেন।
আহমদ ইয়াং তার গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। স্পীডোমিটারের কাটা একলাফে নব্বইতে উঠে এল।
গাড়িটার আরও কাছাকাছি যাও ইয়াং।
স্পিডোমিটারের কাটা আবার লাফিয়ে উঠল। একশ বিশ কিলোমিটারে উঠল গাড়ির গতি।
বাজার রোডের মাঝামাঝি জায়গায় এসে হঠাৎ মাইক্রোবাসটি বা দিকে মোড় নিয়ে পুর্বমুখী একটি রাস্তায় ঢুকে গেল।
ওরা পালাচ্ছে মুসা ভাই। পেছনে থেকে বলে উঠল হাসান তারিক।
ওরা যেখানে ঢুকল ওটা ওলুগবেগ রোড তারপর সুলেমানিয়া রোড হয়ে উংফুতে যাওয়া যায়।বলল মা-চু।
মিনিট খানেকের মধ্যেই আহমদ মুসাদের গাড়ি ওলুগবেগ রোডে প্রবেশ করল। মাইক্রোবাসটি তখন চারশ গজের মত দূরে।
ওলুগবেগ রোডটি আবাসিক। রাস্তার দুধারে কিছু কিছু দোকান-পাটও আছে। রাস্তায় দুচারজন লোক দেখা যাচ্ছে। গাড়ির পাগলাগতি দেখে মানুষ একবার এদিকে তাকিয়েই ছিটকে সরে যাচ্ছে পাশে।
কয়েক মাইল চলার পর মাইক্রোবাসটি ডানদিকের একটা রাস্তায় ঢুকে গেল।
পেছন থেকে মা-চু বলল, ওরা বিবিখান রোডে ঢুকল। বিবিখান রোড দক্ষিণ দিকে মাইল তিনেক এগিয়ে চ্যাংচিন রোডে পড়েছে।
বিবিখান রোড ধরে চ্যাংচিন রোডের কাছাকাছি আসার পর সামনের মাইক্রোবাস থেকে একটা হর্ণ শোনা গেল। তারপরই সামনে থেকে আর একটা হর্ণ বেজে উঠল। পরের হর্ণ যে গাড়ি থেকে আসল তা দেখা গেল না।
মা-চু পেছন থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠল, স্যার ওদুটো হর্ণই রেড ড্রাগনের। আমি ওদের সংকেত জানি।
মুহুর্তের জন্যে কপালটা কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। কিছু যেন ভাবলেন তিনি। তারপর সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললেন, হাসান তারিক তৈরি থাক। আমার মনে হয় সামনের মাইক্রোবাস আরেকজন সাহায্যকারীকে ডেকেছে অয়্যারলেসে।
একটু থামলেন আহমদ মুসা। তারপর আহমদ ইয়াং-এর দিকে আরেকটু এগিয়ে একটা হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে বললেন, ইয়াং তুমি আমার সিটে চলে এস।
আহমদ ইয়াং পা দুটি সিটের উপর তুলে স্টিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত চলে এল আহমদ মুসার সিটে। আহমদ মুসা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলেন।
সামনেই মোড়। বিবিখান রোড গিয়ে পড়েছে চ্যাংচিন রোডে। চ্যাংচিন রোড পুর্ব পশ্চিম লম্বা।
সামনের মাইক্রোবাসটি মোড়ে গিয়ে পৌছেছে। মোড়ে গিয়ে বাক নিল বায়ে অর্থাৎ পুর্বদিকে।
এই সময় পশ্চিম দিক থেকে একটা ট্রাক এসে দাড়াল মোড়ে, একেবারে বিবিখান রোডের মুখে।
আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বুঝলেন, ওরা রাস্তা ব্লক করে মাইক্রোবাসটিকে সরে পড়ার সুযোগ করে দিতে চায়।
আহমদ মুসা মোড়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে পরিমাপ করে দেখলেন ট্রাকটা যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাতে রাস্তা ধরে বা দিকে মোড় নেবার যো নেই। তবে, ফুটপাথ ধরে যাবার মত জায়গা আছে, কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বেবিট্যাক্সি। আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
ট্রাকটা তখন একশ গজও দূরে নয়। আমহদ মুসা বললেন, তারিক আমি ফুটপাথে নামছি। ট্রাক ও লাইটপোষ্টের মাঝখানের ফাঁকা স্পেস দিয়েই আমরা স্লিপ করব। বেবিট্যাক্সির মতলব খারাপ না হলে আমাদের রাস্তা দিয়ে দেবে আর খারাপ হলে ওকে ধাক্কা দিয়ে আমাদের রাস্তা পরিস্কার করে নিতে হবে। তারিক তুমি ট্রাকের চাকা ফুটো করে দাও। ট্রাকের জানালা দিয়ে দুটি মাথা দেখা যাচ্ছে। ওদের হাত বের না হলে তাদের কিছু বলো না।
হাসান তারিক এম-১০ হাতে নিয়ে তাক করল ট্রাকের সামনের চাকায়।
আহমদ মুসা গিয়ার চেঞ্জ করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, জীপ লাফ দেবে সাবধান।
পরক্ষণেই প্রায় লাফিয়ে পড়ল জীপ ফুটপাথে। সেই সাথে গর্জে উঠল হাসান তারিকের হাতের এম-১০ মেশিন রিভলবার। প্রায় পাঁচ সেকেন্ড গুলি বৃষ্টি করল। এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেল ট্রাকের সামনের চাকা। ট্রাকের বাঁ দিকটা কাত হয়ে বসে গেল।
অভ্যস্ত হাইল্যান্ডার জীপ অবিশ্বাস্য গতিতে লাফিয়ে লাফিয়ে সামনে এগুলো। একজন লোককে স্টেনগান নিয়ে বেবিট্যাক্সি থেকে লাফিয়ে পড়তে দেখে আহমদ মুসা চিৎকার করে উঠলেন, তোমার সিটে শুয়ে পড়।
কিন্তু দরকার হলো না। তৈরী ছিল আহমদ ইয়াং। নজর ছিল তার বেবিট্যাক্সির দিকেই। লোকটি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে স্টেনগান সোজা করার আগেই গর্জে উঠল আহমদ ইয়াং-এর হাতের স্টেনগান। লোকটা স্টেনগান নিয়ে ঐখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। আর সেই সময়েই হাইল্যান্ডার জীপের এক ইঞ্চি পুরু ইস্পাতের এক্সিলেন্ট শিল্ডের বাঁ প্রান্ত প্রচন্ড বেগে আঘাত করল বেবিট্যাক্সিটাকে। বেবিট্যাক্সি পাঁচ-সাত হাত দূরে ছিটকে পড়ে ভেঙে-দুমড়ে উলটে গেল। জীপটা একটা বড় ঝাঁকুনি খেল। কিন্তু স্টিয়ারিং ধরা আহমদ মুসার হাত একটুও কাঁপলো না। স্থির থাকল জীপের মাথাও।
এ সময় স্টেনগানের শব্দ এল পিছন থেকে। কয়েকটা বুলেট এসে জীপের স্টীল বডিতে আঘাতও করল।
কিন্তু ঐ টুকুই। জীপ প্রচণ্ড গতিতে ভাঙা বেবিট্যাক্সিটাকে পাশ কাটিয়ে উঠে এল চ্যাংচিন রোডে। তারপর তীরের ফলার মত ছুটে চলল সামনে।
আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। বাধাটা পেরুতে তেমন একটা এক্সট্রা সময় ব্যয় করতে হয়নি। সামনে তাকিয়ে দেখলেন মাইক্রোবাসের হেডলাইট দুশ গজের মতই দূরে।
আহমদ মুসা মুখটা ঈষৎ ঘুরিয়ে বললের, তারিক, মা-চু সব ঠিক আছে তো?
জী, ঠিক আছে। হাসান তারিক প্রায় একসাথেই বলে উঠলেন।
ভাগ্যিস ওদের গুলিটা ওপর দিয়ে গেছে। টায়ারে লাগলে বিপদ হতো। বললেন আহমদ মুসা।
ঘটনা এইভাবে এত আকস্মিকভাবে ঘটবে তা তারা মনে করেনি। মনে হয় ওরা সম্মুখ যুদ্ধের জন্য তৈরী হয়ে এসেছিল। মনে করেছিল গাড়িটা আমাদের থামবে তারপর শক্তি পরীক্ষা হবে। বলল আহমদ ইয়াং।
তোমার ধারনা ঠিকই ইয়াং। ওদের অপ্রস্তুত অবস্থা দেখে তাই মনে হয়।
আবার দৃষ্টি সামনে ফিরিয়ে নিয়েছেন আমহদ মুসা। তার দৃষ্টি সামনের মাইক্রোবাসের পেছনের লাল আলোর উপর।
এসময় হঠাৎ লাইটটি নিভে গেল।
দ্রুত কণ্ঠে আহমদ মুসা বললেন, মা-চু গাড়িটা মোড় নিল? মোড় নেবার এখানে কি জায়গা আছে?
না স্যার কোন রাস্তা নেই।
তাহলে কি ওরা আলো নিভিয়ে দিয়েছে? ওরা কি জানতে পেরেছে বাধা ডিঙিয়ে আমরা ওদের পিছু নিয়েছি?
হতে পারে। ট্রাক থেকে অয়্যারলেসে ওদের জানিয়ে দেওয়া হতে পারে। বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করলেন, তারপর জীপের আলো নিভিয়ে দিলেন তিনি। বলল তারিক ইনফ্রারেড গগলসটা দাও।
ইনফ্রারেড গগলস চোখে লাগিয়ে জীপের গতি বাড়িয়ে দিলেন। বললেন ওদের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে।
স্পীডোমিটারের কাঁটা মূহুর্তে একশ চল্লিশ কিলোমিটারে উঠল। গতির প্রচণ্ডতায় থর থর করে কাঁপছে জীপ। আহমদ মুসার শ্যেন দৃষ্টি সামনে পাতা। গাড়ি কোথায় হোঁচট খেলে রক্ষা নেই। ইনফ্রারেড গগলস অনেক দূর পর্যন্ত অন্ধকারকে ফিকে করে দিয়েছে। রাস্তা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু উঁচু-নিচু আন্দাজ করা কঠিন। রক্ষা যে, চ্যাংচিন রাস্তাটা নতুন। কোন ভাঙা কাটা কোথাও নেই।
মিনিট খানেকের মধ্যেই একটা রোড সাইড লাইটের আলোতে মাইক্রোবাসটিকে এক ঝলক দেখা গেল। ঠিকই সামনে এগুচ্ছে। খুশি হল আহমদ মুসা। গাড়ির গতি আরও বাড়িয়ে দিল। একশ পঞ্চাশ কিলোমিটারে গাড়ির গতি। অল্পক্ষণ পরেই ইনফ্রারেড গগলসে কিছু দূরে একটা জমাট অন্ধকার দেখা গেল। বুঝলেন মাইক্রোবাসটি এখন নাগালের মধ্যে এসেছে। স্পীড কমিয়ে এনে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলেন। মাইক্রোবাসের চোখে তাঁরা ধরা পড়তে চান না। তারা বুঝুক আমরা তাদের হারিয়ে ফেলেছি। এটা ভাবা তাদের জন্য অনেকটাই স্বাভাবিক। কারণ যারা ধরতে আসে তারা সাধারনত আলো নিভায় না।
এলাকাটা নির্জন। রাস্তার দুধারে নতুন নতুন রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং সবে গড়ে উঠেছে। এলাকাটা অন্ধকারও। অনেক দূরে দূরে লাইট পোষ্ট। বড় ক্ষীণ সে সবের আলো।
বেশ কিছুক্ষণ এই ভাবে চলার পর হঠাৎ আহমদ মুসার নজরে পড়ল, কালো জমাট অন্ধকারের মাইক্রোবাসটি ডানদিকে চ্যাংচিন রোড পার হয়ে দক্ষিন দিকে যেতে শুরু করল। রাস্তার লাইটে তার পরিস্কার চেহারা দেখা গেল।
মা-চু, এখানে চ্যাংচিন থেকে কোন রাস্তা কি দক্ষিন দিকে গেছে? সামনে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করলেন আহমদ মুসা।
বাইরে একটু নজর বুলিয়ে মা-চু বলল, হ্যাঁ এখান থেকে একটা রাস্তা উত্তর দিকে, আর একটা দক্ষিন দিকে চলে গেছে। আর দক্ষিণের রাস্তাটা নতুন হান এলাকায় গিয়ে প্রবেশ করেছে।
মাইক্রোবাসটি তাহলে হান এলাকার দিকেই যাচ্ছে।
লিও শাও চি স্কোয়ার দিয়ে না এসে এতদূর ঘুরে এল কেন ওরা? বললেন আহমদ মুসা।
নিশ্চয় চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য। বলল হাসান তারিক।
আহমদ মুসা মোড়ে মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে দক্ষিনমুখি সেই রাস্তায় প্রবেশ করলেন। আহমদ মুসার জীপের আগে আরো একটা জীপ প্রবেশ করল সেই রাস্তায়। বেশ দ্রুত যাচ্ছিল জীপটা। আর মাইক্রোবাসটা আলো নিভিয়ে চলার কারণে অপেক্ষাকৃত একটু ধিরেই চলতে হচ্ছিল। তার হেড লাইটের আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সামনের মাইক্রোবাস।
মাইক্রোবাস ও জীপটির দূরত্ব তখন দশ গজেরও বেশি নয়। এ সময় সেদিক থেকে একপশলা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে টায়ার বার্ষ্ট হওয়ার শব্দ শোনা গেল। জীপটা এঁকে-বেঁকে কয়েক গজ এগিয়েই রাস্তার পাশের এক টিলার গোড়ায় মুখ থুবড়ে পড়ল।
মাইক্রোবাস মূহুর্তকালের জন্যে থেমেছিল। আবার দ্রুত চলতে শুরু করেছে। এবার আলো জ্বেলে দিয়েছে মাইক্রোবাস।
আহমদ মুসা বললেন, ভালই হল হাসান তারিক, মাইক্রোবাসটি ওই জীপটাকেই আমাদের জীপ মনে করেছিল। এখন ঐ জীপটাকে শেষ করে আলো জ্বেলে নিশ্চিন্তে এগুচ্ছে।
বিধ্বস্ত জীপটা অতিক্রম করার সময় আহমদ মুসা দেখলেন, জীপে একজন আরোহী ড্রাইভিং সিটে বসা। ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। আহমদ মুসাদের জীপ আলো নিভিয়েই এগিয়ে চলল মাইক্রোবাসটির আলো লক্ষ করে।
রাস্তার দুধারে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বাড়ি। কোনটা তৈরী হয়েছে, কোনটা তৈরী হচ্ছে। বুঝা গেল এ এলাকায় প্রচুর লোক বাস করে। হানদের নতুন কলোনী। কোত্থেকে এল এরা? নিশ্চয়ই টানা হান এলাকা থেকে এদেরকে সিংকিয়াং-এ আমদানি করা হয়েছে।
এখানে কি সবাই হান মা-চু? জিজ্ঞেস করলেন আহমদ মুসা।
জি স্যার। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় এ হান কলোনীর পরিকল্পনা হয়। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, উরুমচিতে এভাবে হানদের আমদানী করে মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হবে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিপ্লবীরা পরাজিত হবার পর উরুমচিতে অন্যান্য কলোনী তৈরীর কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু এই কলোনীতেই বসতি স্থাপিত হয়েছে।
এ রাস্তা দক্ষিণে কতদূর গেছে মা-চু?
অল্প দূরে একটা পাহাড়ের টিলায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
পাথরের টুকরোর সাথে পিচ মিশিয়ে রাস্তায় কার্পেট করা। বেশ মসৃন। সোজা রাস্তা। রাস্তায় দুএকজন লোক দেখা যাচ্ছিল। তাও এখন আর নেই বললেই চলে। অন্ধকার হলেও খুব নিশ্চিন্তেই গাড়ি চালাতে পারছে।
এক জায়গায় এসে মাইক্রোবাসটি বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে একটা সরু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে একটা মাটির টিলার গোড়ায় গিয়ে থামল। টিলার ওপরে একটা বাড়ি। আমরা প্রায় রাস্তার প্রান্তে এসে গেছি। ঐ তো দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের কালো টিলা দেখা যাচ্ছে। বলল মা-চু।
আহমদ মুসা কোন কথা বললেন না। চারদিকে একবার নজর বুলালেন। তারপর গাড়িটাকে রাস্তার ডানদিকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে বললেন, এস নেমে পড়ি।
সবাই নেমে পড়ল।
মাটির টিলা এবং বাড়িটি অন্ধকারে ঢাকা। মাইক্রোবাসের আলো নিভে গেছে। ওটাকে একটা জমাট অন্ধকারের মত দেখাচ্ছে।
আহমদ মুসারা গুটি গুটি পায়ে বিড়ালের মত ছুটলেন সেদিকে।
তিনদিকে খোলা গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে মাইক্রোবাসটি।
আহমদ মুসার চোখে তখন ইনফ্রারেড গগলস। তিনি মাইক্রোবাসের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখলেন, গাড়ি খালি। হঠাৎ মাঝখানের সিটে ছোট ব্যাগের মত কি একটা তার নজরে পড়ল। গাড়ির দরজা খোলাই ছিল। ভেতরে উঠে গেলেন আহমদ মুসা।
ছোট লেডিস একটা হ্যান্ড ব্যাগ। গাড়ির ভেতরেই ব্যাগটা খুলে দেখলেন আহমদ মুসা। বেশ কিছু টাকা এবং একটি আইডেনটিটি কার্ড। কার্ডে একটা মেয়ের ছবি। নাম ‘নেইজেন’। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী লাল একটা সিল কার্ডে।
গাড়ি থেকে নেমে ব্যাগটি আহমদ ইয়াং-এর হাতে দিতে দিতে বললেন, মেয়েটারই হবে এই ব্যাগ, আইডেনটিটি কার্ডও।
আহমদ ইয়াং তার পেন্সিল টর্চ দিয়ে আইডেনটিটি কার্ডটার ওপর চোখ বুলিয়েই বলে উঠল, মুসা ভাই, মেয়েটা একজন স্টেট ভিআইপি। নিশ্চয় খুব উঁচু সরকারী কেউকেটার সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ হেব।
কিছু লেখা আছে ?
লাল সিল আছে। এ সিল খুব উঁচু সরকারী কাগজপত্রেই শুধু ব্যবহৃত হয়।
আহমদ মুসা গাড়ি থেকে অন্ধাকরে দাঁড়ানো বিশাল গেটটার দিকে এগুলেন।
গাড়ি বারান্দা পেরিয়ে সিড়িঁর তিনটা ধাপ উঠলেই গেট। মাত্র এ গেটটা ছাড়া আর কোন দরজা এদিকে দেখা গেল না। বাড়িটি একেবারেই অন্ধকার। কোন জানালার কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে আলো দেখা যাচ্ছে না।
আহমদ মুসা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াংও।
পেন্সিল টর্চের আলো ফেলে দেখলেন কাঠের দরজা। হাত দিয়েই বুঝলেন খুব ভারী এবং মজবুত দরজা।
টর্চের ছোট্ট আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আহমদ মুসা দরজার কি হোলের ওপর দাঁড় করালেন। অটোমেটিক লক সিস্টেম।
লকটা ভাল করে দেখার জন্য আহমদ মুসা তর্জনী দিয়ে লকটা স্পর্শ করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে হাতটা তার ছিটকে সরে এল প্রবল এক ধাক্কায়। ঝিম ঝিম করে উঠল হাতটা। চমকে উঠে আহমদ মুসা দুকদম পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
পেছন থেক মা-চু প্রায় আর্তনাদ করেই বলে উঠল, স্যার লকে ডিসি চার্জ আছে, ভাগ্যিস এসি নয়।
বলে মা-চু এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। বলল, স্যার যা করতে হয় আমাকে হুকুম করবেন।
কিন্তু আহমদ মুসার এদিকে কোন খেয়াল নেই। তিনি উৎকর্ন হয়ে কি যেন শুনছেন। মুহুর্তকাল উৎকর্ন থাকার পর বললেন, হাসান তারিক, কিছু শুনতে পাচ্ছ ?
হ্যাঁ এই মাত্র কানে ঢুকেছে একটা চাপা মিনি সাইরেনের আওয়াজ। বলল হাসান তারিক।
ঠিক বলেছ ভেতর থেকে আসছে। সম্ভবত এটা ওদের বিপদ ঘন্টা। নিশ্চয় এই লক সিস্টেমের সাথে ঐ বিপদ ঘন্টার সংযোগ আছে।
একটু থেমেই আবার আহমদ মুসা বললেন, তোমরা তৈরি থাক। আমাদের অনুমান সত্যি হলে মুখোমুখি হবার সময় আসছে।
সবাই প্রস্তুত ছিল। হাসান তারিকের হাতে এম-১০ মেশিন পিস্তল, আহমদ ইয়াং একটা স্টেনগান বাগিয়ে ধরে আছে। আর মা-চুর হাত তার ব্যাগের ভেতরে। ওখানেই ওর সব অস্ত্র।
এই সময় ভেতর থেকে স্টেনগানের এক পশলা গুলির আওয়াজ ভেসে এল। ক্ষীণ আওয়াজ।
চঞ্চল হয়ে উঠলেন আহমদ মুসা। হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ল্যাসার পিস্তলটা?
হাসান তারিক এগিয়ে গেল। পকেট থেকে ক্ষুদ্র সাদা রঙের ল্যাসার পিস্তল উঁচু করল কী-হোল লক্ষ্য করে। পিস্তলের রক্ত রাঙা লাল ট্রিগারটায় চাপ দিল হাসান তারিক। মাত্র মুহুর্তের ব্যবধান। ইস্পাতের গোটা কী বোর্ডটাই হাওয়া হয়ে গেল। সুক্ষ্ম একটা ধাতব গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল শুধু চার দিকে।
মেশিন পিস্তলটা বাগিয়ে দরজা ঠেলে আহমদ মুসা ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। মা-চু লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে বলল, স্যার আমি আগে একটু দেখে নিই। যারা দরজায় বৈদ্যুতিক সাইরেন ফিট করতে পারে, তাদের প্রস্তুতি এ টুকুতেই শেষ হবার কথা নয়।
বলে মা-চু বাঁ হাতে দরজাটা একটু ফাঁক করে ডান হাতে তার ইলেকট্রো ম্যাগনেটো নিউট্রালাইজার মেলে ধরে চাপ দিল তার সাদা সুইচটায়। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটির ক্ষুদ্র চোখ থেকে বিপদ সংকেত জ্ঞাপক লাল আলো বেরিয়ে এল, তার সাথে ব্লিতস ব্লিতস শব্দ। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপরেই লাল আলো নিভে গিয়ে জ্বলে উঠল নীল আলো। থেমে গেল ‘ব্লিতস’ শব্দ। মা-চু’সহ সকলের চোখে-মুখেই স্বস্থি ফিরে এল।
ইলেকট্রো ম্যাগনেটো নিউট্রালাইজার চীনে উদ্ভাবিত সন্ত্রাস মুকাবিলার অত্যাধুনিক একটা যন্ত্র। পেতে রাখা বৈদ্যুতিক ও বিস্ফোরক জাল শুধু সে চিহ্ণিতই করে না, এর অতি শক্তিশালী ম্যাগনেটিক পাওয়ার বিদ্যুৎ সঞ্চালনের গতি এবং বিস্ফোরকের সুইচ বিকল করে দিয়ে ওগুলোকে নিউট্রাল করে ফেলে। নীল আলো জ্বলে উঠতেই বুঝা গেল বিপদ কেটে গেছে।
আহমদ মুসা মা-চুকে চাপড়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, শুকরিয়া মা-চু। মেইলিগুলি যা বলেছে তারচেয়েও অভিজ্ঞ তুমি।
আহমদ মুসার মুখে হাসি।
মা-চু বলল, লজ্জা দেবেন না স্যার, এ খুব ছোট ব্যাপার।
মা-চুর কথার দিকে আহমদ মুসার এখন কান নেই। তাঁর তখন অন্য ভাবনা। সাইরেন বেজেছে বেশ আগে। গেটের দিকে এখনও কেউ এল না কেন? ভেতর থেকে ব্রাশ ফায়ার কেন? কাকে কে গুলি করল? ওরা কি তাহলে মেয়েটাকে মেরে ফেলে পালাল?
কথাটা ভাবতেই চঞ্চল হয়ে উঠল আহমদ মুসার মনটা, তাদের মিশন কি তাহলে ব্যর্থ হল?
ভেতরে প্রবেশ করলেন আহমদ মুসা।
ঢুকতেই একটা করিডোর। উত্তর-দক্ষিণ লম্বা। অন্ধকার। আরেকটা করিডোর নাক বরাবর পশ্চিমে এগিয়ে গেছে। করিডোরটার ঐ প্রান্তে এক টুকরো আলো এসে পড়েছে।
আহমদ মুসা তার এম-১০ পিস্তলটি বাগিয়ে বিড়ালের মত নি:শব্দে সেদিকে এগিয়ে চললেন। তার পেছনে হাসান তারিক, আহমদ ইয়াং ও মা-চু।
আলোর কাছাকাছি গিয়ে আহমদ মুসা দেখলেন, ডান দিকের একটা খোলা দরজা দিয়ে আলোর টুকরোটি এসে পড়েছে করিডোরে।
কয়েক ধাপ এগিয়ে ঘরের দিকে চোখ পড়তেই আঁৎকে উঠলেন আহমদ মুসা। রক্তে ভাসছে অনেকগুলো লাশ। রক্তের স্রোত বেরিয়ে এসেছে দরজা দিয়েও।
ছুটে গেলেন আহমদ মুসা দরজার দিকে। তার পেছনে সবাই। দরজায় দাঁড়িয়ে চক্ষু স্থির হয়ে গেল সবার। মেঝেয় পড়ে আছে দশটি মেয়ের বুলেট ঝাঁঝরা দেহ। রক্ত ঝরছে তাদের অনেকের দেহ থেকে এখনো।
সম্ভবত পায়ের শব্দে লাশের সারি থেকে একটা মেয়ে মাথা তুলল। অতি কষ্টে ডান হাতের উপর মাথার ভারটি রেখে হাসান তারিক ও আহমদ ও আহমদ ইয়াং-এর দিকে চেয়ে বলল, আপনারা এলেন? এত দেরিতে?
মেয়েটার দিকে তাকাতেই চমকে উঠল হাসান তারিক ও আহমদ ইয়াং দুজনেই। তুরপান রোডের ‘ফ্র’ ঘাঁটিতে যে দশজন অসহায় মেয়েকে তারা পেয়েছিল, তাদেরই সে একজন। এর সাথেই তারা কথা বলেছিল।
দুজনেই ছুটে গেল তার দিকে। বলল, তোমরা এখানে কিভাবে? একি হয়েছে তোমাদের।
মেয়েটি তাদের কথার দিকে কান না দিয়ে ঘরের কোণায় দাঁড়ানো একটা আলমারির দিকে কাঁপা হাত দুলে ইংগিত করে বলল, ওরা ওদিক দিয়ে পালিয়েছে। একটা মেয়েকেও ধরে নিয়ে গেছে।
শোনার সাথে সাথে আহমদ মুসা বললেন, হাসান তারিক, মা-চু তোমরা এদের দেখ। আহমদ ইয়াং এস আমার সাথে।
বলে আহমদ মুসা ছুটে গেলেন আলমারির দিকে। এক টানে খুলে ফেললেন আলমারি। দেখলেন একটা কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে। দ্রুত তার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন।
সিঁড়িটা বাড়ির পেছনে একটা লনে এসে শেষ হয়েছে। লনে নেমেই তারা দেখলেন, একটা চীনা বেডফোর্ড কারকে তিনজন লোক পেছন থেকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত গাড়িটা স্টার্ট নেয়নি। তাই স্টার্ট নেয়ানো এবং তাড়াতাড়ি কিছুটা দুরে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা। লোক তিনজনের কাঁধে ঝুলছে স্টেনগান।
দাঁড়াও। চীনা ভাষায় চিৎকার করে উঠলেন আহমদ মুসা। সেই সাথে তিনি ছুটছিলেন তাদের দিকে।
লোক তিনজন চমকে উঠে পেছন ফিরল। চোখের পলকে স্টেনগানগুলো নেমে এল তাদের হাতে। কিন্তু তাদের তর্জনি স্টেনগানের ট্রিগারে পৌছার আগেই আহমদ মুসার মেশিন রিভলবার এম-১০ এবং আহমদ ইয়াং-এর স্টেনগান গর্জে উঠল।
তিনজনের দেহ গাড়ির পাশেই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াং ততক্ষণে গাড়ির পেছনে এসে পৌছেছিলেন।
ড্রাইভিং সিট থেকে একজন লোক বেরিয়ে ছুটে পালাচ্ছিল। সেও মারা পড়ল আহমদ ইয়াং-এর স্টেনগানের গুলীতে। গাড়ির পেছন থেকে গাড়ির দরজার দিকে এগুতে গিয়ে দেখল, স্টেনগানের একটি কালো নল বেরিয়ে এসেছে। চমকে দু’পা পিছিয়ে এলেন আহমদ মুসা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগান থেকে এক ঝাঁক গুলী বেরিয়ে এল। আহমদ মুসা দু’পা পিছিয়ে বসে না পড়লে দেহটা তাঁর এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেত।
আহমদ ইয়াং ততক্ষণে গাড়ির ওপাশের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মেয়েটা বসেছিল স্টেনগানধারী লোকটার এপাশে। তার মুখ কাগজের মত সাদা। আতংকে কাঁপছে সে।
আহমদ ইয়াং স্টেনগান ফেলে দিয়ে পিস্তল হাতে নিয়ে স্টেনগানদারী লোকটাকে বলল ফেলে দাও স্টেনগান।
অদ্ভুত ক্ষীপ্রগতিতে লোকটা আহমদ ইয়াং-এর কথা শেষ হবার আগেই স্টেগান সমেত এক ঝটকায় ঘুরে বসল। কিন্তু তার স্টেনগান থেকে গুলী বেরুবার আগেই আহমদ ইয়াং-এর প্রস্তুত রিভলবার থেকে একটি গুলী গিয়ে তার কপালটাকে তার গুড়ো করে দিল। গাড়ির সিটের উপর ঢলে পড়ল লোকটি। মেয়েটা ভীষণ কাঁপছিল।
আহমদ ইয়াং গাড়ির দরজা খুলে বলল, এস নেইজেন।
মেয়েটা কাঁপছিল। মনে হয় তার ওঠার শক্তি ছিল না। আহমদ ইয়াং-এর মুখে তার নাম শুনে একবার মুখ তুলে তাকাল।
আহমদ ইয়াং তাকে হাত ধরে টেনে বের করল। কিন্তু দেখল ঢলে পড়ে যাচ্ছে মেয়েটি।
মুসা ভাই। ডাকল আহমদ ইয়াং।
আহমদ মুসা গাড়ির ওপাশ ঘুরে ইয়াং-এর কাছে এলেন। বললেন, ওকে ভেতরে নিয়ে চল। অনেক ধকল গেছে, ও জ্ঞান হারাচ্ছে।
আহমদ ইয়াং ওকে পাঁজা-কোলে করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যাবার পর মেয়েটা ক্ষীণ কন্ঠে বলল, আমি হাঁটতে পারব।
আহমদ ইয়াং ওকে ছেড়ে দিল।
আহমদ মুসা বললেন, বোন আর ভয় নেই। এদের হাত থেকে তোমাকে উদ্ধার করার জন্যেই আমরা এখানে এসেছিলাম।
মেয়েটা একবার চোখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার নীল চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কিন্তু শরীরের কম্পন এখনো তার শেষ হয়নি। ভাল করে হাঁটতে পারছিল না সে। আহমদ মুসা বললেন, আহমদ ইয়াং বোনকে একটু সাহায্য কর।
আহমদ ইয়াং তার একটা হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল।
লালচে ফর্সা দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটার দেহে চীনা কোন বৈশিষ্ট্যই নেই। লাল স্কার্টটি হাঁটুর দু’ইঞ্চি নীচ পর্যন্ত নেমে এসেছে। লালচে গোলাপী শার্ট।
আরও কিছুদূর যাবার পর মেয়েটি নীরবে হাতটি ছাড়িয়ে নিল।
সেই সিঁড়ি দিয়েই উঠছিলেন আহমদ মুসারা। দু’ধাপ উঠেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে চলছিল আহমদ মুসা, মাঝখানে মেয়েটি, সবশেষে আহমদ ইয়াং। মেয়েটাকে দাঁড়াতে দেখে আহমদ মুসা বললেন, কোন অসুবিধা হচ্ছে বোন?
আহমদ মুসার দিকে একবার চোখ তুলে তাকাল তারপর চোখ নামিয়ে নিয়ে একটু নীরব থেকে বলল, উঠতে পারছি না।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াংকে বললেন, তুমি একটু সাহায্য কর ওকে উঠতে।
আহমদ ইয়াং তার পাশে এসে তার বাঁ বাহুটা ধরল। ধরেই অনুভর করল মেয়েটা কাঁপছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। সংকীর্ণ সিঁড়ি। কষ্ট হচ্ছিল পাশাপাশি উঠতে। মেয়েটির মাথা আহমদ ইয়াং-এর কাঁধে ঠেস দিয়ে আছে। বলতে গেলে তার দেহের গোটা ভারটাই আহমদ ইয়াং-এর ওপর।
সিঁড়ি দিয়ে আহমদ মুসারা সেই ঘরে এসে ঢুকলেন।
মেয়েটাসহ সবাইকে দেখে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করল হাসান তারিক। তারপর বলল, মুসা ভাই, মেয়েটাকে বাঁচানো গেল না। এই মাত্র মারা গেল। বড় হতভাগী এরা।
এরা কারা হাসান তারিক?
কেন আপনি তো জানেন, তুরপান রোডের ‘ফ্র’ ঘাঁটি থেকে সেই দশটি মেয়েকে উদ্ধার করে আমরা আমাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে রেখেছিলাম।
এরা তারা? তাহলে ‘ফ্র’ ওদের সন্ধান ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছিল?
তারপর কিছুক্ষণ কথা বললেন না আহমদ মুসা। কি যেন ভাবছেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত পরে অনেকটা ঘুম থেকে জেগে ওঠার মতই বললেন, জেনারেল বোরিস ফিরে না এলে ‘ফ্র’ তো এভাবে সক্রিয় হবার কথা নয় তারিক।
কপালটা কুঞ্চিত দেখাল আহমদ মুসার। হঠাৎ আলোকিত ঘরে নেইজেন-এর দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন আহমদ মুসা। তার শার্ট এবং স্কার্টের ডান দিকটা রক্তে ভেজা। তার দিকে দু’পা এগিয়ে বললেন তিনি, বোন তুমি আহত?
মেয়েটা মুখটা নিচু করে বলল, হ্যাঁ। গাড়িতে তোলার সময় আমি ধস্তাধস্তি করলে ওরা আমার ডান বাহুতে ছুরি মেরেছে।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াংকে বললেন, দেখ তো ক্ষতটা, মনে হয় এখনও রক্ত বেরুচ্ছে।
আহমদ ইয়াং আহত জায়গায় হাত দিতেই বেদনায় কঁকিয়ে উঠল মেয়েটা।
হ্যাঁ, এখনও একটু একটু করে রক্ত বেরুচ্ছে। বলল আহমদ ইয়াং।
এই সময় মা-চু তার ব্যাগ থেকে একটা ব্যান্ডেজ বের করে আহমদ ইয়াংকে দিয়ে বলল, বেঁধে দিন।
হ্যাঁ বেঁধে দাও। আপাতত রক্ত বন্ধ করা দরকার।
আহমদ ইয়াংকে এই নির্দেশ দিয়ে আহমদ মুসা হাসান তারিককে বললেন, চল আমরা বাড়িটি একটু ঘুরে দেখি। মেয়েটা আহত। এখনি ওকে পৌছে দিতে হবে। আমাদেরও অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মিনিট তিনেকের মধ্যেই আহমদ মুসারা ফিরে এলো বাড়িটা ঘুরে দেখার পর। আহমদ মুসাকে চিন্তান্বিত দেখাল। ততক্ষণে আহমদ ইয়াং-এর ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়ে গেছে। তারা সবাই বাড়িটি থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে এগুলেন।



পর্ব ২


উংফু এভেনিউ-এর দিকে আবার ছুটে চলেছে আহমদ মুসার জীপ।
ড্রাইভিং সিটে এবার হাসান তারিক। তার পাশের সিটে আহমদ মুসা পেছনের সিটে প্রথমে মা-চু, তারপর আহমদ ইয়াং, সবশেষে মেয়েটা, নেইজেন।
‘নেইজেন’- এর পরিচয় ওরা জেনে নিয়েছে। গভর্নর লিউয়ানের মেয়ে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-বিজ্ঞানের শেষ বর্ষের ছাত্রী নেইজেন। উংফু এভেনিউ-এর ‘শেনচিং’ শপিং সেন্টারে ঢোকার পথে তাকে কিডন্যাপ করেছে।
নেইজেন-এর পরিচয় পেয়ে আহমদ মুসা খুশি। নেইজেনের প্রপিতামহ যে কাজাখ ছিল সে কথাও আহমদ মুসারা জেনে নিয়েছেন নেইজেনের কাছ থেকে। জেনে আহমদ মুসা খুশি হয়েছেন। আবার ব্যাথা পেয়েছেন এই ভেবে যে এই ভাবে মুসলিম পরিবারের কত সন্তান যে মুসলমান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেও অবস্থার কারণে মুসলিম সমাজ থেকে ছিটকে পড়ে গেছে।
আহমদ মুসার জীপ চ্যাংচিং রোড থেকে বেরিয়ে উত্তর দিকের আরেকটা রোড ধরে লিউ শাও চি স্কোয়ারের দিকে ছুটে চলেছে।
সবাই নীরব। একক্ষণ নেইজেন একটানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেছে আহমদ মুসার।
সামনে চোখ মেলে সিটে হেলান দিয়ে বসে ছিল নেইজেন। তার মনেও নানা প্রশ্ন। এরা কারা? কেন তাকে উদ্ধান করতে ছুটে গিয়েছিল? লোকগুলো সবাই যে মুসলমান তা সে নাম থেকেই বুঝেছে। এ কারণেই তার প্রপিতামহও যে কাজাখ মুসলমান ছিল তা জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঐ প্রশ্ন তার মনে খচ খচ করে বিঁধছে। নেইজেন পাশের আহমদ ইয়াং- এর দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি সোজা। বুঝাই যাচেছ গাড়ির ঝাঁকুনিতে একটু তন্দ্রার ভাব এসেছে তার চোখে। তন্দ্রাচ্ছাদিত আলো আাঁধারে ঘেরা আহমদ ইয়াং- এর মুখের দিকে চেয়ে নেইজেনের মনে হল পবিত্র সুন্দর এক যুবক। কিছুক্ষণ আগের সবগুলো কথা তার এক এক করে মনে পড়ল। কিন্তু এই যুবকটির আচরণ, কথা এবং চোখের দৃষ্টিতে বাড়তি কোন আগ্রহ তার নজরে পড়েনি। গাড়িতে বসে একটি কথাও সে বলেনি, তাকায়নি সে একবারও নেইজেনের দিকে। মুসলিম নৈতিকতার কথা নেইজেন ইতিহাসে পড়েছে, চোখে দেখেনি। আজ যেন সশরীরে তা দেখছে।
এই সময় জীপ একটি টার্ণ নিতে গিয়ে বড় একটা ঝাঁকুনি খেল।
চোখ খুলল আহমদ ইয়াং। একটু নড়ে চড়ে বসল, দৃষ্টি তার নিচের দিকে।
আপনার বোধ হয় ঘুম পাচ্ছে? বলল নেইজেন।
না ঠিক তা নয়। কিভাবে যেন চোখটা একটু ধরে এসেছিলো। চোখ নিচু রেখেই জবাব দিলো আহমদ ইয়াং। আবার নীরবতা। নীরবতা ভেঙে নেইজেনই আবার প্রশ্ন করলো, আমার নাম জানলেন কি করে?
আপনার আইডেনটিটি কার্ড থেকে।
বলে আহমদ ইয়াং পকেট থেকে নেইজেন – এর কার্ড এবং মা-চুর কাছ থেকে সেই ব্যাগটা নিয়ে নেইজেনকে দিয়ে দিল। বলল, ব্যাগটা ওদের গাড়ী থেকে আমরা পেয়েছিলাম।
কেন, কিভাবে আপনারা আমাকে উদ্ধার করতে গেলেন ?
আমরা একটা গাড়ী থেকে ‘বাঁচাও’ চিৎকার শুনতে পাই। সংগে সংগে আহমদ মুসা ভাই এর নির্দেশে আমাদের গাড়ি ঐ গাড়িটিকে ফলো করে।
একটা ছোট্ট ‘বাঁচাও’ চিৎকার শুনেই আপনারা এতটুকু করলেন ?
আহমদ মুসা ভাই তখন বলেছিলেন এই ‘বাঁচাও’ চিৎকার ছোট কিন্তু এর আবেদন ছোট নয়। আর আল্লাহর মজলুম বান্দাদের পাশে দাঁড়ানোই তো মুসলমানদের কাজ।
সে যদি অমুসলমান হয় ?
‘মজলুম’ -এর একটাই পরিচয় সে মজলুম। আর আল্লাহর মনোনীত শ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে মুসলমানরা সকল জুলুমের বিরুদ্ধে, সকল মজলুমের পক্ষে।
‘নেইজেন’-এর চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, আমিও অনেক মুসলমান দেখেছি, সবাইকে তো এমন দেখিনি?
অবস্থা, পরিবেশ, অজ্ঞতা মুসলমানদের তাদের স্থান থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
আপনারা কারা? কি পরিচয় আপনাদের?
এ প্রশ্ন আপনি মুসা ভাইকে করবেন। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, আমরা মুসলমানদেরকে তাদের বর্তমান অবস্থা ও অজ্ঞতা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছি।
গভর্নর লিইউয়ানের মেয়ে নেইজেন বুদ্বিমতি, সচেতন। আহমদ ইয়াং-এর কথায় তার দৃষ্টিটা মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ম হয়ে উঠল। সে এটুকু বুঝল, এরা সাধারণের মধ্যে অসাধারণ।
একটুক্ষণ নীরব থেকে নেইজেন বলল, আমাকে আপনি প্রথম ‘তুমি’ বলেছেন, এখন ‘আপনি’ বলছেন কেন?
সেই অবস্থায় ভুল হতে পারে।
না ভুল নয় সেটাই ঠিক ছিল। আমাকে ‘তুমিই’ বলবেন। আহমদ মুসা সাহেব আমাকে বোন…………..
‘নেইজেন’- এর কথা শেষ হলো না একটা কড়া ব্রেক কষে জীপ দাঁড়িয়ে পড়ল পুলিশের সিগন্যাল পেয়ে।
লিও শাও চি স্কোয়ারে গাড়ি এসে পড়েছে। স্কোয়ারের প্রতিটি রোডের মুখে একেকটি করে পুলিশের গাড়ি। যাতায়াতকারী প্রতিটি গাড়ী তারা সার্চ করছে, জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
আহমদ মুসা বুঝলেন, নেইজেন-এর সন্ধানেই পুলিশের এই তৎপরতা। সম্ভবত গোটা শহরের প্রতিটি মোড় ও গলিমুখেই পুলিশ এই প্রহরা বসিয়েছে।
হাসান তারিক, ওরা বোধ হয় নেইজেনকেই খুঁজছে। বললেন আহমদ মুসা।
পুলিশকে পেয়ে আহমদ মুসা খুশিই হলেন। নেইজেনকে কোন দায়িত্বশীল পুলিশের হাওলায় দিয়ে তারা তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারবেন। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন রাত আট টা বাজে। সময় যদিও অনেক নষ্ট হয়েছে। তবু ফুল স্পীডে গেলে পৌনে নটার মধ্যে তারা আল-খলিল উপত্যকায় পৌছতে পারবেন। আহমদ মুসা চিন্তা করলেন। পুলিশ গাড়ি সার্চ করলে অসুবিধা সুতরাং ওদেরকে সার্চ করার সুযোগ দয়া যাবে না।
আহমদ মুসা জানালা দিয়ে হাত বের করে ইশারায় একজন পুলিশ অফিসারকে ডাকলেন। পুলিশ অফিসারটি এলে আহমদ মুসা বললেন, আপনারা কি গভর্নর লি ইউয়ানের মেয়ে ‘নেইজেন’কে খোঁজ করছেন?
হ্যাঁ, কেন?
আহমদ মুসার হাসি মাখা মুখের দিকে চেয়ে উদগ্র্রীব কন্ঠে বলল পুলিশ অফিসারটি।
অপহরণকারীদের হাত থেকে আমরা তাকে উদ্ধার করেছি।
কোথায় সে, কোনখানে? বলে পুলিশ অফিসারটি উত্তরের অপেক্ষা না করে দুই হাত তুলে তার বস অফিসারকে ডাকল। এ অফিসারের ব্যস্ত ডাকার ঢং দেখে বস অফিসারটিও ছুটে এল। ডি এস পি ইনসিগনিয়া তার কলার ব্যান্ডে। সে থামতেই এ পুলিশ অফিসারটি আহমদ মুসাকে দেখিয়ে বললেন, ইনি বলছেন ‘নেইজেন’কে এঁরা উদ্ধার করেছেন অপহরণকারীদের হাত থেকে।
ডি এস পি কিছু বলার আগে আহমদ মুসা বললেন, হ্যাঁ আমরা নেইজেনকে উদ্ধার করেছি। সে আমাদের গাড়িতে আছে।
ডি এস পি বিস্ফোরিত চোখে গাড়ির ভেতরে উঁকি দিল। নেইজেনকে দেখতে পেয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে একটা স্যালুট ঠুকে সোজা হয়ে দাঁড়াল পুলিশ অফিসার। তাঁর কাঁধে ঝুলে থাকা বাঁশীতে একটা হুইসেল বাজালো।
সংগে সংগে সমস্ত পুলিশ, পুলিশের গাড়ি ছুটে এল এদিকে। তারা আহমদ মুসার জীপটিকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের চোখ-মুখ ও ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছে, অপহরণকারীদের তারা ধরে ফেলেছে।
আপনারা নেইজেন এর দায়িত্ব নিয়ে নিন, আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে। পুলিশ অফিসার ডি এস পি কে উদ্দেশ্য করে বললেন আহমদ মুসা। নেইজেনকে আমরা তুলে নিচ্ছি, কিন্তু হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশ না পেলে আমরা আপনাদের ছাড়তে পারি না।
বলে পুলিশ আফিসারটি অয়্যারলেসে যোগাযোগ করল হেডকোয়ার্টার্সের সাথে। বলল সব কথা। আলাপ শেষ করে অয়্যারলেসটা মুখের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, আপনাদের হেডকোয়ার্টার্সে যেতে হবে। যা করার উনারাই করবেন।
বলেই পুলিশ অফিসারটি আর কোন কথা শোনার অপেক্ষা না করে গাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে নেইজেন- এর দিকে গেল।
পুলিশ অফিসারের কথা শুনে চোখটা মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠেছিল আহমদ মুসার। চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর। সেদিকে তাকিয়ে হাসান তারিক বলল, মুসা ভাই, নির্দেশ দিন। গাড়ি চালিয়ে দিই। ওরা আটকাতে পারবেনা আমাদের।
ততক্ষণে শান্ত হয়ে উঠেছিল আহমদ মুসা। বললেন, ওরা বোধ আমাদের সন্দেহ করছে কিছুটা বাজিয়ে দেখতে চায় সম্ভবত। কি আছে, দেখি আল্লাহ আমাদের কোথায়………..
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই নেইজেন বলল, না জনাব এটা হতে দেবনা। আমি সব জানি আমি বলছি ওদের।
বলে নেইজেন তার পাশে এসে দাড়ানো ডিএসপিকে বলল, এরা আমাকে উদ্ধার করেছেন। এদের কি আপনারা সন্দেহ করছেন?
সন্দেহ নয়, হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশ যা তাই করছি।
তাহলে হেড কোয়ার্টার্সে নয়, গভর্নর ভবনে নিয়ে চলুন।
ম্যাডাম, তাহলে খবরটা আমি হেড কোয়ার্টার্সে জানিয়ে দেই।
ডি এস পি অয়্যারলেসে হেড কোয়ার্টার্সের সাথে কথা বলল। কথা শেষ করে বলল, ঠিক আছে ম্যাডাম, আমরা গভর্নর ভবনেই যাচ্ছি। আপনি আমাদের গাড়িতে উঠুন।
বলে সে গাড়ির দরজা খুলে নেমে আসার অনুরোধ করল নেইজেনকে।
না, আমি এ গাড়িতেই যাব। বলে সে টেনে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিল। ডি এস পি মুখটা লাল করে গিয়ে তার গাড়িতে উঠল।
নেইজেন ও গাড়িতে গেলেই পারতে। বেচারার মুখের ওপর এভাবে দরজা বন্ধ করা ঠিক হয়নি। নরম কন্ঠে বললেন আহমদ মুসা।
সে আপনাকে অপমান করেছে।
না, জেন, তার দোষ নেই। ও তার দায়িত্ব পালন করেছে।
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মাঝখানে জীপ। তাকে ঘিরে পুলিশের গাড়ি সার বেঁধে এগিয়ে চলছে। আহমদ মুসা হাসলেন। বললেন , বেচারাদের ভীষণ সতর্কতা।
এ সতর্কতা কাজের বেলায় নেই, অকাজে। বলল নেইজেন। তার কথায় এখনও ক্ষোভ।
কিছুক্ষণ নীরবতা ভাঙল নেইজেন। আহমদ মুসাকে উদ্দেশ্য করে বলল, জনাব, আপনাদের কি পরিচয় আব্বাকে দেব?
পরিচয় দিয়ে আর কি করবে, পারলে তোমার আব্বার সাথে আমাদের দেখা করিয়ে দাও সত্ত্বর। রাত নটার মধ্যে আমাদের একশ মাইল দূরে এক জায়গায় পৌছতে হবে। বেশ দেরি করে ফেলেছি আমরা।
কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকল নেইজেন। তারপর বলল, নিশ্চয়ই আব্বার সাথে দেখা করিয়ে দেব।
একটু ঢোক গিলল নেইজেন। তাই বলে পরিচয় জানতে পারবনা? আপনারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।
শেষের কথাগুলো নেইজেনের ভারী হয়ে উঠল।
দু:খ পেলে বোন? আসলে অনেক পরিচয় আছে যা দুএক কথায় বুঝানো যায় না।
কিন্তু আমি এক কথায় আপনাদের পরিচয় বলতে পারি।
বল তো?
আপনারা মুসলমানদের একটা আদর্শ বিপ্লবী দল। নাম জানি না।
কি করে বুঝলে?
একদিকে মুসলমানদেরকে বর্তমান অবস্থা ও অজ্ঞতা থেকে আপনারা মুক্ত করতে চান, অন্যদিকে স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে সব মানুষকে আপনারা ভালবাসেন। যার জন্যে একজন অসহায় নারীকে বাঁচানোর জন্যে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে ছুটে গিয়েছিলেন। সবশেষে মুখোমুখি লড়াইয়ে যে অপুর্ব দক্ষতা আপনাদের আমি দেখেছি। সব মিলিয়েই আমি ওটা বলেছি।
তুমি কেমন করে জানলে মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা ও অজ্ঞতা থেকে আমরা তাদের মুক্ত করতে চাচ্ছি?
আহমদ ইয়াং বলেছে আমাকে। একটু দ্বিধা করে বলল নেইজেন।
আমাদের পরিচয়্টা তাকে জিজ্ঞেস করনি? হাসিমুখে বলল আহমদ মুসা।
জিজ্ঞেস করেছি। উনি আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছেন।
আহমদ ইয়াং এর মুখটা লাল হয়ে উঠছিল। বিব্রত বোধ করছিল সে। মুহূর্ত কয়েক নিরব রইলেন আহমদ মুসা। তারপর বললেন, তুমি খুব চালাক নেইজেন। তুমি সাইমুমের নাম শুনেছ?
কোন সাইমুম? মুসলিম মধ্য এশিয়ার সাইমুম?
হ্যাঁ।
তারা সেখানে ও ফিলিস্তিনে যে ইতিহাস সৃষ্টি করল যার আলোচনা পত্রপত্রিকায় এখনো হচ্ছে তার নাম জানবনা?
আমরা সেই সাইমুমের লোক।
আপনারা সাইমুমের লোক? আপনি আহমদ মুসা কি সেই আহমদ মুসা? বিষ্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে গেল নেইজেনের চোখ।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলনা নেইজেন। তারপর বলল, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
সিংকিয়াং-এর ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর সাথে আপনাদের সম্পর্ক আছে?
তুমি কি মনে কর?
সাইমুম সিংকিয়াং-এ এসেছে আর ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর সাথে তার সম্পর্ক থাকবেনা তা হয়না।
তাহলে আছে মনে কর। আহমদ মুসার মুখে হাসি। নেইজেন আবার কিছুক্ষণ কথা বললনা। তার বিষ্ময়ের ঘোর কাটেনি। সে বিশ্বাস করতে পারছেনা, পৃথিবীব্যাপী বহুল আলোচিত সাইমুম এর সাথে সে বসে আছে এবং কিংবদন্তির নায়ক আহমদ মুসা তার সামনে। তার মনের কোন গভীরে যেন কোন একটা অপরিচিত আনন্দ মাথা তুলছে। তার প্রপিতামহ যে কাযাখ ছিল, মুসলমান ছিল, সেজন্য মনটা যেন গর্ব করতে চাইছে। আনন্দ অছে এই ভেবে যে, তার দেহেও মুসলিম রক্ত আছে। পাশে আহমদ ইয়াং মূর্তির মত বসে আছে। সে মা-চুর গায়ের সাথে সেঁটে আছে। নেইজেনের কোন স্পর্শ যেন না লাগে এ জন্যে সব সময় নিজেকে আড়ষ্ট করে রেখেছে। সে একবারও ফিরে তাকায়নি। কথা বলার সময়ও না। হাসি পাচ্ছিল নেইজেনের তার অবস্থায়। তার মনে পড়ল সাইমুম এর বিপ্লবী ও আদর্শ চরিত্রের এটাও একটা দিক।
আহমদ মুসা আরবী ভাষায় হাসান তারিকের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি একবার থামলে সেই ফাঁকে নেইজেন বলল, আপনাদের পরিচয় সম্পর্কে যা শুনলাম আব্বাকে তার কিছুই জানাবনা।
জানি আমি।
কেমন করে জানেন?
অনেক সময় মনে এমন সব কথা উদয় হয়, কিন্তু কেমন করে হল তা জানা যায়না।
ঠিক বলেছেন।
গাড়ির গতি ধীর হয়ে গেল। নেইজেন সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, এসে গেছি আমরা।
সামনে ঐ যে লন, তারপরে ঐ তো গভর্ণর ভবনের গেট।
গেটের কয়েক গজ সামনের জীপ দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে একদল পুলিশ অফিসার এসে জীপ ঘিরে দাঁড়াল। একজন অফিসার এসে জীপের দরজা খুলে ধরে একটা স্যালুট ঠুকে নেইজেনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ম্যাডাম, নেমে আসুন।
নেইজেন তার ডান পাটা নিচে নামিয়ে দিল। মুখটা আহমদ মুসার দিকে ফিরিয়ে বলল, জনাব আমি আব্বার সাথে দেখা করে আসছি। আপনারা গাড়িতেই বসুন।
গাড়ি থেকে নেমে দরজা বন্ধ করে সামনেই পেল সিংকিয়াং-এর পুলিশ প্রধান চ্যাং ইউকে। নেইজেন নামতেই চ্যাং ইউ শশব্যস্তে বলল, কেমন আছ মা? ব্যন্ডেজের দিকে তাকিয়ে বলল আঘাতটা কিসের? বড় নয়তো?
না চাচাজান, আমি ভাল আছি। এঁরা ভাল করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন।
একটু থেমে আবার বলল, আব্বার সাথে দেখা করে না ফেরা পর্যন্ত এঁরা এ গাড়ীতেই থাকবেন। বলে গেটের দিকে এগুলো নেইজেন। তার পেছনে কয়েকজন পুলিশ অফিসার।
গেটের দুপাশে সৈনিকরা উদ্ধত স্টেনগান হাতে পাহারায়। গেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গভর্ণর লি ইউয়ান ও তার স্ত্রী ইউজিনা।
নেইজেনের মা খাস হান মেয়ে। উরুমচি আর্টস কলেজের সে ইতিহাসের অধ্যাপিকা।
নেইজেন গেটে পৌঁছুতেই বাপ-মা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল নেইজেনকে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠল মা ইউজিনা।
নেইজেনের ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের দিকে আগেই নজর পড়েছিল লি ইউয়ানের। সে মেয়েকে মায়ের হাওলা করে পাশে দাঁড়ানো মিলিটারী সেক্রটারীকে বলল, ওয়াং, গাড়ী বের করতে বল। মাকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে।
মাকে ছেড়ে নেইজেন পিতার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল। ব্যস্ত হবেন না। ওটা সিরিয়াস কিছু নয়।
একটু থেমে একটা ঢোক গিলে সে আবার বলল, আব্বা যারা আমাকে অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন তারা আপনার সাথে দেখা করতে চান এখনি। আপনি অনুগ্রহ করে সময় দিন।
গভর্ণর লি ইউয়ান একটু থমকে দাঁড়াল। চিন্তা করল। পরে বলল, তা অবশ্যি উচিত কিন্তু এখনি?
হাঁ, আব্বা ওরা অনেক দূর যাবেন।
তুমি পরিচয় জেনেছ তাদের?
পরিচয়ের কি প্রয়োজন। আপনি তাদের ধন্যবাদ জানাবেন।
তা তো অবশ্যই, ঠিক আছে।
মিলিটারী সেক্রেটারীর দিকে ঘুরে লি ইউয়ান বলল, আমি অফিসে বসছি, তুমি ওদের নিয়ে এস।
স্যার এত রাত্রে এই অবস্থায় সবকিছু না জেনে কয়েকজন অপরিচিতের সাথে দেখা করাটা . . . . . আপত্তি জানাতে চেষ্টা করল ওয়াং।
ওরা আমার মেয়েকে বাঁচিয়েছে, তাদেরকে ধন্যবাদ জানানো আমার দায়িত্ব। তুমি যাও।
আব্বা আমিও যাচ্ছি। বলল নেইজেন।
না জেন ওরাই নিয়ে আসবে। তুমি চল আমার সাথে, তুমি ক্লান্ত, আহত তুমি।
বলে মেয়ের হাত ধরে হাঁটা শুরু করল লি ইউয়ান গভর্ণর ভবনে তার প্রাইভেট অফিসের দিকে।

গভর্ণর লি ইউয়ানের বাস ভবনে তার প্রাইভেট অফিস। বাইরে অফিসটা প্রায় ঘিরে রেখেছে সৈনিকরা। অফিসের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিলিটারী সেক্রেটারী। দরজা বন্ধ।
আহমদ মুসা কথা বলছিলেন লি ইউয়ানের সাথে। তার পাশের সোফায় আহমদ ইয়াং। আহমদ মুসা হাসান তারিকের আরব চেহারা এবং অন্যান্য দিক চিন্তা করে হাসান তারিক এবং মা-চু কে গাড়ীতে রেখে এসেছেন।
পিতার পাশেই সোফায় বসেছিল নেইজেন। সোডিয়াম লাইটের সুন্দর আলোতে নেইজেনকে অপরূপ এক কাজাখ মেয়ে মনে হচ্ছে। তার দেহে চীনা কোন চিহ্নই নেই।
চোখ নিচু করে বসেছিল আহমদ ইয়াং। দেখে মনে হচ্ছে অতি শান্ত, ভদ্র যুবক। শিশুর সারল্য তার চোখে মুখে। নেইজেন-এর বিষ্ময়ভরা মুগ্ধ দৃষ্টি বার বারই ওর দিকে ছুটে যাচ্ছিল।
তখন কথা বলছিল গভর্ণর লি ইউয়ান। বলছিল, অশেষ ঋণে বেঁধে ফেলেছেন আপনারা আমাকে। আমি আপনাদের জন্য কি করতে পারি বলুন? জেনের কাছ থেকে শুনলাম, নটার মধ্যেই নাকি একশ মাইল দূরে কোথাও আপনাদের পৌঁছতে হবে?
জি হ্যাঁ। খুবই জরুরী।
কিন্তু এখনতো সাড়ে আটটা। জীপ নিয়ে কি পৌঁছতে পারবেন?
আমরা চেষ্টা করব।
গভর্ণর লি ইউয়ান কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। একবার সে চোরা দৃষ্টিতে আহমদ মুসার দিকে চাইল। তার চোখ দুটো কেমন যেন উজ্জ্বল, সেখানে যেন অনেক কথা।
আমি আপনাদের জন্য একটা হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু জানতে পারি কি সেখানে কি ধরনের প্রয়োজন আপনাদের? লি ইউয়ানের ঠোঁটে যেন একটা হাসির রেখা। আহমদ মুসা পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে লি ইউয়ানের দিকে তাকালেন। তার চোখে চোখ রাখলেন কয়েক মুহূর্ত। তাঁরও চোখে যেন একটা নতুন চিন্তা।
যা বলতে চান বলুন। চোখে চোখ রেখেই বলল লি ইউয়ান।
জি বলতে চাই।
অনেকটা স্বগত ধরনের এই কথাটা। আহমদ মুসার হৃদয়ের কোন গভীর থেকে যেন বেরিয়ে এল। একটা আবেগ, একটা ভাবালুতা এসে তাঁর চেহারাটাকেই যেন পালটে দিয়েছে। তিনি যেন একটা অন্য মানুষ। নেইজেনের দৃষ্টি এড়ায়নি। বিষ্ময় দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে আহমদ মুসার দিকে। কিন্তু লি ইউয়ানের কোন ভাবান্তর নেই। তার ঠোটে তখনও সেই হাসি।
মুখ খুললেন আহমদ মুসা। বললেন, শানসি এলাকার হান সর্দার ওয়াং হুয়া শিহেজী উপত্যকার মুসলিম স্বার্থ গলাটিপে মারার জন্যে দশ হাজার নতুন বসতি নিয়ে ছুটে আসছে। ভোরের মধ্যেই ওরা গিয়ে শিহেজীর নতুন কলোনীতে জেঁকে বসতে চায়। আমরা ওদের বাধা দেব।
আপনার এই চার জন?
চেষ্টা করব।
কেন ওদের বাধা দিতে চান, সরকার তো ওদের অনুমতি দিয়েছে?
এ অন্যায় অনুমতি।
কেমন করে?
মুসলমানদের সেখান থেকে উচ্ছেদ করে হানদের সেখানে আনা হচ্ছে।
আপনাদের এটা কি অসম্ভব মিশন নয়?
আমরা সফল হব কিনা জানি না, কিন্তু দুনিয়াতে অসম্ভব কিছু নেই। যিনি সব কিছুর স্রষ্টা, সেই আল্লাহর কাছে সব কিছুই সম্ভব। আমরা তাঁরই সাহায্য প্রার্থী।
আপনারা ওয়াংকে কি আল-খলিলে গিয়ে বাধা দিতে চান?
জি।
বাধা দিতে চান, মানে তাকে ওখানে আটকে দেবেন এই তো! আর ওদিকে উদ্বাস্তু মুসলমানরা যারা এসে শিহেজীতে জমা হয়েছে তারা গিয়ে সেই কলোনী দখল করবে এই তো?
আহমদ মুসা বিস্ময় বোধ করলেন বললেন, আপনি তো সব কিছুই জানেন, জানার কথা।
কয়েক মুহূর্ত কথা বলল না লি ইউয়ান। তার ঠোঁটে সেই হাসি।
আপনাদের একটু সুখবর দিই?
বলুন। আগ্রহের সাথে বললেন আহমদ মুসা। তার চোখে কি যেন একটা আলো।
আমি আজ বিকেলেই ওয়াংকে শিহেজীর পথ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছি। কেন্দ্রীয় সরকারকে ব্যাপারটা আমি জানিয়েছিলাম। পিকিঙ আজই নির্দেশ পাঠিয়েছে হানদের যেন শিহেজীতে আর না বসানো হয়। নতুন কলোনীয় মুসলমানরাই পাবে।
আহমদ মুসার চোখ দুটি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে তিনি বললেন, জনাব কি যে খুশি হয়েছি আমি বুঝাতে পারবো না। মনে হয় এত বড় উপকার আমি জীবনে পাইনি।
আরেকটা খুশির খবর আছে মহান যুবক। হাসি মুখে বলল লি ইউয়ান।
আহমদ মুসা শুধু মুখ তুলে চাইলেন। কিছু বললেন না। লি ইউয়ানই আবার মুখ খুলল। বলল, সেই সাথে পিকিং সরকার নির্দেশ দিয়েছে, সিংকিয়াং-এর কোন এলাকাতেই হানদের এনে বসানো হবে না আর আগের মত। এ অঞ্চলের মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষা ও দাবী পূরণের জন্যেই এই ব্যবস্থা।
আমি জানি, পিকিং-এর নতুন সরকার অনেক উদার অনেক বাস্তববাদী হয়েছে। কিন্তু তারা এতটা এগুবে তা আমি ধারণা করিনি। বিস্ময়ের সাথে বললেন আহমদ মুসা।
সৌদি আরব সরকারের সাথে পিকিং-এর সম্পর্ক-উন্নয়ন এবং মক্কা ভিত্তিক রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামীর চেষ্টা গভর্নমেন্টকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে। সম্ভবত আরও অনেক পরিবর্তন আসছে।
কিন্তু এসব কি স্থায়ী হবে মনে করেন? সরকারের যদি পরিবর্তন আসে?
তা আসতে পারে। কিন্তু বাস্তবতাকে কে অস্বীকার করবে?
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই লি ইউয়ান পুনরায় কথা বলে উঠল, ইয়াংম্যান, এবার আপনার পরিচয়টা বলুন।
লি ইউয়ানের মুখে সেই হাসি।
আমার পরিচয় আমি মুসলিম সমাজের একজন কর্মী।
আমি বলি পরিচয়?
আহমদ মুসা একবার সন্ধানী চোখ তুলে তাকালেন লি ইউয়ানের দিকে, তারপর নেইজেনের দিকেও । বললেন, বলুন।
লি ইউয়ান সোফা থেকে উঠে তার টেবিলের পেছনের ছোট্ট ফাইল ক্যাবিনেটটার সামনে দাঁড়াল। ফাইল ক্যাবিনেট খুলে একটা ফাইল বের করে ফিরে এল। ফাইল খুলে এগিয়ে দিল আহমদ মুসার সামনে।
আহমদ মুসা বিস্ময়ের সাথে দেখলেন তার একটা ফটো, তার সাথে তার একটা পূর্ণ বায়োডাটা। সেই সাথে রয়েছে ফিলিস্তিন, মিন্দানাও ও মধ্য এশিয়ায় তার তৎপরতার পূর্ণ বিবরণ।
বিস্ময়ের বশে নেইজেনও আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেও দেখছে।
ফাইল বন্ধ করে মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে রইলেন আহমদ মুসা।
ইয়াংম্যান, আপনাকে অভিনন্দন। আপনাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছি।
আহমদ মুসা তখনও নীরব। সম্ভবত ঘটনার আকস্মিকতা থেকে তখনো তিনি মুক্ত হননি।
লি ইউয়ানই আবার কথা বলল। বলল, আমি খুশি হয়েছি আহমদ মুসা। বলতে পারেন আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। আমি কোনদিনই ভাবিনি এভাবে আপনার মুখোমুখি হব।
একটু থেমেই সে আবার শুরু করল, সবচেয়ে আনন্দ লাগছে ‘ফ্র’ ও ‘রেড ড্রাগন’দের হাত থেকে আমার মাকে উদ্ধার করার জন্যে আল্লাহ আপনাকেই পাঠিয়েছেন।
লি ইউয়ানের শেষের কথাগুলো যেন একটু ভারী শোনাল।
আল্লাহকে আপনি এখনও মনে রেখেছেন জনাব?
তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিলনা লি ইউয়ান। শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। পরে ধীরে ধীরে বলর, আমার সব কথাই আপনি জানবেন এটাই স্বাভাবিক।
আবার মুহূর্তের জন্যে থামল সে। শুরু করল আবার ধীরে ধীরে, আমার দাদার কুরআন শরীফ আর জায়নামায আমি সযত্নে রেখেছি। মনে করি ওগুলো আমার পরিচয়ের প্রতীক। মুসলমান সমাজের সাথেও আমার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়েছে আমার অজ্ঞাতে রক্তের সাথেই যেন আল্লাহ নামটা মিশে আছে। আমি সরকারী কাজে একবার তুরস্ক গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম নীল গম্বুজ মসজিদ দেখতে। সেদিন ছিল শুক্রবার। জামায়াতে নামাজ হচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখ পানিতে ভরে গিয়েছিল। অতীতটা আমার সামনে এসে গিয়েছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল দাদাকে। মনে হয়েছিল আমি যেন আমার পরিচয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি।
থামল লি ইউয়ান। এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল নেইজেন পিতার দিকে। পিতাকে যেন সে নতুন করে দেখছে। তার চোখে বিস্ময় এবং একটা নতুনকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দ। আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াংও গোগ্রাসে গিলছিল লি ইউয়ানের হৃদয় থেকে নিঃসারিত কথাগুলো।
আবার কথা বলে উঠল লি ইউয়ান। নরম কণ্ঠ তার, আপনি একটা শক্ত প্রশ্ন করেছেন। এ প্রশ্ন আমি কোনদিন আমার নিজকে করিনি। কিন্তু একটা জিনিস, ফিলিস্তিন বা মিন্দানাওয়ের মুসলমানরা মুক্তি পেল, বিজয়ী হল, তখন আমার খুব ভাল লেগেছে। বলে বুঝাতে পারব না, মধ্য এশিয়ায় যেদিন আপনাদের বিপ্লব সফল হল সেদিন শুধু আনন্দিত হওয়া নয়, একটা তীব্র আবেগ যেন আমাকে অভিভূত করছিল। এখানকার ‘এম্পায়ার গ্রুপ’কে আমি সমর্থন করতে পারি না, কিন্তু ওদের কোন ক্ষতির খবর যখনই পাই, বুকের কোথায় যেন বেদনা বোধ হয়। শিহেজী উপত্যকাসহ অন্যান্য এলাকায় হান বসতি নিয়ে যা ঘটেছে তাকে কোন সময় আমার ভাল মনে হয়নি। সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত আমাকেই খুশি কেরেছে সবচেয়ে বেশি। তাই বাস্তবায়ন করতে আমি এক মুহূর্তও বিলম্ব করিনি। ‘ফ্র’ এবং ‘রেড ড্রাগন’রা এটা জানে বলেই ওরা আমার মাকে কিডন্যাপ করেছিল। জেনকে আটকে রেখে ওরা শিহেজী উপত্যকার বসতি নিয়ে আমার সাথে দর কষাকষি করতে চেয়েছিল।
থামল লি ইউয়ান। একটা আবেগ ও বেদনায় আচ্ছন্ন লি ইউয়ানকে এখন একজন নতুন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তার পাশে নেইজেন পুতুলের মত নির্বাকভাবে বসে আছে। তার চোখে একটা কিছু খুঁজে পাওয়ার আলো।
আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি জনাব। শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠে বললো আহমদ মুসা।
কি পেয়েছেন?
আপনার আল্লাহ বিশ্বাস, জাতি প্রেম এবং আপনার ঐতিহ্য আপনার সচেতন স্বত্তার গোটাটাই দখল করে আছে। প্রকাশের সুযোগ পায় না।
সামান্য সুযোগ পেলেই সচেতন স্বত্তার সাথে সংঘাত বাধে অবচেতন স্বত্তার।
কিন্তু প্রায় দুই পুরুষ ধরে অতীতের সাথে আমার বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা শুধু নয়, বিরোধিতা। বিশ্বাস বাঁচতে পারে কি করে?
বিশ্বাস মানুষের মনের নিজস্ব একটা প্রকৃতি। বাইরের ঘটনা- দুর্ঘটনার ঝড়ো হাওয়া এবং পরিবর্তন একে খুব কমই স্পর্শ করতে পারে। এ কারণেইতো সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগ যুগ ধরে চেষ্টা সত্ত্বেও মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে মেরে ফেলতে পারেনি। আজ বিশ্বাসকে তারা স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছে।
থামলেন আহমদ মুসা। লি ইউয়ানও কথা বলল না। নীরবতা কয়েক মুহূর্তের। ভাবনার গভীরে ডুবে আছে লি ইউয়ান। কয়েক মুহূর্ত পরে একটু নড়ে-চড়ে বসল সে। যেন জেগে উঠল এমন কণ্ঠে সে বলল, আপনার জন্যে আরেকটা সুখের খবর আছে আহমদ মুসা। কি? নতুন আগ্রহ ঝরে পড়ল আহমদ মুসার কণ্ঠে।
আজ সন্ধ্যার আগে মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্র ও ফিলিস্তিন সরকারের দুজন প্রতিনিধি এসেছে। তাদের সরকারের চিঠি নিয়ে এসেছে তারা। ঐ চিঠিতে জানতে পারলাম, আপনি এখন সিংকিয়াং-এ।
তারা কোথায়? তারা আর কি বলেছে?
চিঠিতে দুসরকারই বলেছে, আপনার সন্ধানে সাহায্য করার জন্যে। দূতাবাসের মাধ্যমে পিকিংকেও তারা এ অনুরোধ করেছে। আমাকে তারা বাড়তি অনুরোধ জানিয়েছে আন-অফিসিয়ালি। তারা আমাদের অতিথি ভবনে আছে।
আপনি কিছু মনে না করলে আমি এখুনি তাদের সাথে দেখা করতে চাই।
নিশ্চয়ই দেখা করবেন। এই প্রাসাদেরই উত্তর ভবনে অতিথি ভবন। উংফু এভিনিউ ঘুরে এদিক দিয়ে গেছে।
আপনি ব্যবস্থা করলে আমরা এখনই উঠতে পারি।
ঠিক আছে, বলে লি ইউয়ান কলিংবেলে হাত দিতে যাচ্ছিল। নেইজেন পিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু কথা বলল। লি ইউয়ানের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, বেশ তো যাও, নিয়ে এস।
হাসি ভরা মুখ নিয়ে নেইজেন ভেতরে চলে গেল। লি ইউয়ান আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আমার মা আপনাকে তার নিজস্ব রিভলবারটা উপহার দিতে চায়।
খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে জেন। কিছু না জেনেও শুধু ঘটনা বিশ্লেষণ করেই আমাদের পরিচয় প্রায় সে বলেই ফেলেছিল।
কি বলেছিল? আগ্রহের সাথে জানতে চাইল লি ইউয়ান।
জেন বলেছিল, আমরা একটা মুসলিম আদর্শবাদী বিপ্লবী দল।
লি ইউয়ান কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময় নেইজেন ঘরে ঢুকল। তার হাতে সাদা চামড়ার কেসে ভরা রিভলবার।
নেইজেন কেস থেকে রিভলবার বের করল। রিভলবারটাও সাদা ধপধবে। দেখেই বুঝা যায় একটা দুর্লভ সংগ্রহ।
লি ইউয়ান বলল, আমি জেনকে এ রিভলবার জার্মানী থেকে অনেক খুঁজে এনে দিয়েছিলাম।
নেইজেন পিতার হাতে রিভলবার দিয়ে বলল, আব্বা, আমার পক্ষ থেকে তুমি ওনাকে দিয়ে দাও।
কেন তুমিই দাও মা, উপহার নিজ হাতেই দিতে হয়। হেসে বলল লি ইউয়ান।
নেইজনের মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। পিতার হাত থেকে রিভলবারটা নিয়ে নিল সে। এগুলো সে আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালেন। লি ইউয়ানও উঠে এল। নেইজেন কম্পিত হাতে রিভলবারটা আহমদ মুসার হাতে তুলে দিতে দিতে বলল, এ রিভলবারটা বহুদিন আমার কাছে লুকিয়ে আছে। জাতির সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিকে আমি এটা উপহার দিলাম।
কথাগুলো তার কাঁপল অব্যক্ত এক আবেগে।
আহমদ মুসা রিভলবারটি নিয়ে একটু চুমু খেলেন তাতে। তারপর কেসে ভরতে ভরতে বললেন, আমার বোনের কাছ থেকে পাওয়া শক্তি ও সংগ্রামের এ প্রতীক উপহার আমার চিরদিন মনে থকবে।
মাথা নিচু করল নেইজেন। আনন্দ-আবেগে তার মুখটা লাল হয়ে গেছে। মুহূর্তকাল পরে মুখ তুলে নেইজেন পিতার দিকে চেয়ে বলল, আব্বা ওঁরা তো যাচ্ছেন, বোনের বাড়িতে ওঁদের দাওয়াত দাও না!
লি ইউয়ান হেসে উঠল। নিশ্চয়ই মা, ওঁদের ছাড়ছি না। নিশ্চয় আসবেন। একবার নয়, অনেক বার।
আহমদ ইয়াং আহমদ মুসার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল একটা শান্ত সুবোধ বালকের মত। তার মধ্যে কেমন একটা সংকোচ ও জড়তার ভাব। লি ইউয়ান তার দিকে চেয়ে বলল, মাই বয়, তুমি তো কিছু বলছ না?
জি মুসা ভাই বলছেন…..
তখন তোমার দরকার কি, বলার এই তো? হেসে বলল লি ইউয়ান।
আহমদ মুসা আহমদ ইয়াং-এর পিঠ চাপড়ে বললেন, আপনি একে চিনবেন হয়তো। কানশুর পিয়ং লিয়াং-এর হুই নেতা মা পেন চাই বংশের ছেলে।
কোন মা পেন চাই? ইস্পাত বাহিনীর?
জি। এ হুই নেতা ওয়াং চিং-এর ছেলে আহমদ ইয়াং।
লি ইউয়ান এগিয়ে এসে আহমদ ইয়াং-এর ঘাড়ে হাত রেখে বলল, তোমার আব্বা তিয়েনশান ভ্যালিতে না?
জি। বলল আহমদ ইয়াং।
লি ইউয়ান আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, এদের চিনব না! মা পেন চাই তো চীনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। আর ওয়াং চিং চাই এবং তাঁর পিতা স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্যের জন্য যে সংগ্রাম করেছে এবং পরাধীনতার সুখের চাইতে সর্বস্ব ত্যাগ করে স্বাধীনচিত্ততার যে নজীর স্থাপন করেছে তাও কোন দিন ভুলার নয়। ওরা আসলেই গর্বের বস্তু। আহমদ ইয়াং-এর দিকে ফিরে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, ইয়াং, খুশি হলাম তোমার সাথে পরিচিত হয়ে। তোমার পিতার সাক্ষাৎ পেলে আমি খুশি হতাম।
কথা শেষ করে লি ইউয়ান দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আসুন আমি বলে দিচ্ছি। ওরা অতিথি খানায় পৌঁছে দেবে আপনাদের।
চারজনেই লি ইউয়ানের প্রাইভেট অফিস থেকে বেরিয়ে এল। কড়া স্যালুট করল বাইরে দাঁড়ানো মিলিটারি সেক্রেটারী ও সৈনিকরা।
লি ইউয়ান মিলিটারী সেক্রেটারীকে বলল, এদের সবাইকে পৌঁছে দাও আজ মধ্য এশিয়া থেকে যে মেহমানরা এসেছে তাদের কাছে।
চারজনই অফিসের সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। নেইজেন আহমদ ইয়াং-এর পাশাপাশি চলছিল। তার হাতে একটা লাল গোলাপ। গোলাপটি আহমদ ইয়াং-এর হাতে গুঁজে দিল। সিঁড়ির নিচে গাড়িতে উঠতে গিয়ে বিদায় নেবার সময় আহমদ ইয়াং জেনকে কিছু বলল না, জেনও কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে গাড়ির জানালা দিয়ে এক পলক দেখে সরে দাঁড়াল জেন।
গেটের বাইরে দাঁড়ানো জীপে এসে উঠলেন আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াং। সামনে একটা আর্মির জীপ। তাকে অনুসরণ করে আহমদ মুসার জীপ ছুটে চলল অতিথি ভবনের দিকে।
এবার জীপের পেছনের সিটে বসেছিলেন আহমদ মুসা ও আহমদ ইয়াং।
আহমদ ইয়াং-এর হাতে ধরা সেই গোলাপ। গোলাপটি নাকের কাছে তুলে নিতে গিয়ে চমকে উঠল আহমদ ইয়াং। এ গোলাপ যেন গোলাপ নয়। এ যেন নেইজেনের সেই চোখ এবং কথা বলতে না পারা নেইজেনের সেই লাজ নম্র মুখ।
অদ্ভুত সুন্দর সুগন্ধ গোলাপটির। উরুমচির গোলাপে সুগন্ধ একটু বেশি নাকি? হতে পারে, আহমদ ইয়াং ভাবল।
পাশেই বসেছিলেন আহমদ মুসা। এক সময় বললেন, গোলাপটার খুব সুন্দর সুগন্ধ তো আহমদ ইয়াং।
আহমদ ইয়াং হাত বাড়িয়ে গোলাপটি দিতে গেল আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা একটু হেসে বললেন, না ইয়াং, এ গোলাপ তোমার জন্যই। আহমদ ইয়াং কিছু বলতে পারল না। লাল হয়ে উঠল সে লজ্জায়!



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.