০৭. তিয়েনশানের ওপারে (পর্ব ৭-৮)

 ০৭. তিয়েনশানের ওপারে


পর্ব ৭ 


হাসান তারিকরা গাড়ির কাছে এসে দেখল বেবী ট্যাক্সিটি নেই, আর তাদের গাড়ির সামনের চাকা জেনারেল বোরিস গুলি করে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তারা ভেবে পেল না, জেনারেল বোরিস এক হাতে বেবী ট্যাক্সি চালিয়ে নিয়ে গেল কি করে! হাসান তারিক পরিস্কার দেখেছে, রিভলভারের দু’টো গুলি গিয়ে বিদ্ধ হলো তার হাতে। সে যখন উঠে দাঁড়াল, কব্জি থেকে হাতের নিচের অংশটা তখন ঝুলছিল।
হাসান তারিক তাড়াতাড়ি এক্সট্রা চাকাটি গাড়িতে লাগিয়ে নিয়ে ছুটল। তাদের টার্গেট সেই বাড়ি যেখান থেকে ওরা পাঁচজন বেবীতে উঠেছিল।
বাড়িটির কাছাকাছি একটা অন্ধকার জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে চারজন ওরা গেল সেই বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনে গিয়ে দেখল প্রধান ফটকটি খোলা। ছ্যাঁৎ করে উঠল হাসান তারিকের মন। চিড়িয়া কি তাহলে উড়ে গেল! স্টেনগান বাগিয়ে ওরা প্রবেশ করল বাড়ির ভেতরে। এ চারটি স্টেনগান তারা যোগাড় করেছে জেনারেল বোরিসের ঐ চারজনের কাছ থেকে।
সব মিলিয়ে বাড়িতে দশটি ঘর। উপরে পাঁচটি, নিচে পাঁচটি। সবগুলি ঘর খোলা। কাপড়-চোপড় জিনিস পত্রের বিশৃংখল অবস্থা দেখে তারা বুঝল, বাড়ির লোকরা তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেছে। এমন কি সিগারেটের বাক্স এবং লাইটার পর্যন্ত নেবার সুযোগ পায়নি।
বিছানার তোষকের তল এবং টেবিলের ড্রয়ারগুলো তারা দেখল। কিছু নেই। সব শূন্য। হাসান তারিক জানে জেনারেল বোরিস যেখানে থাকে আট ঘাট বেধেই থাকে। কোন বাহুল্য জিনিস সে রাখে না। হঠাৎ শোবার ঘরের একটা বালিশ উল্টাতে গিয়ে একটা ছোট নোট বই পেয়ে গেল। নোট বইটি বালিশের কভারের মধ্যে লুকানো ছিল। বালিশ তুলতেই সেটা বেরিয়ে পডল। মনে হয় তাড়াহুড়ার জন্যে নোট বইয়ের মালিক এর কথা ভুলে গেছে। হাসান তারিক নোট বইটা পকেটে রাখল।
বাডি থেকে ওরা চারজন বেরিয়ে গাডির কাছে এল। ভাবছিল হাসান তারিক, জেনারেল বোরিস এখান থেকে কোথায় যেতে পারে। হঠাৎ হাসান তারিকের মনে হল সেই প্রথম বাড়িটার কথা। ওখান থেকেই ওরা স্টেনগান ভর্তি বাক্স এনে অভিযানে বেরিয়েছিল, এর অর্থ ওটাই তাদের মূল ঘাটি। একবার ওখানে গিয়ে দেখা যেতে পারে।
হসান তারিকের গাড়ি ছুটল ঐ বাড়ির উদ্দেশ্যে। গাড়িটি বড় রাস্তায় রেখে ওরা সে বাডির সামনে গিয়ে দাড়াল, দেখল এক বিরাট তালা ঝুলছে বাইরের গেটরুমের দরজায়।
হাসান তারিক একটু ভাবল। তারপর বলল, চল ঐ চোরা দরজা একবার দেখব।
দক্ষিণ রাস্তাটা ঘুরে প্রাচীরের পাশ দিয়ে তারা চারজন পশ্চিম দিকে আগ্রসর হলো। সামনে হাসান তারিক। পেছনে ওরা তিন জন। আকাশে জোৎস্না নেই, অন্ধকার । কিন্তু স্বচ্ছ আকাশের তারার আলো অন্ধকারের কাল রূপকে কিছুটা যেন ফিকে করে দিয়েছে। হাসান তারিক তার দু’চোখ সামনের কালো অন্ধকারের বুকে স্থির রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনের অন্ধকারে একটা অংশ নড়ে উঠল। হাসান তারিক চাপা কণ্ঠে চিৎকার দিল, শুয়ে পড়, তোমরা।
হাসান তারিক শুয়ে পডেছিল, তার সাথে সাথে ওরা তিনজনও।
ওরা শুয়ে পড়ার সাথে সাথে এক ঝাক গুলি ওদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল।
হাসান তারিক শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার রিভলভারটা নড়ে ওঠা অন্ধকারটিকে তাক করেই ছিল। হাসান তারিক শুয়ে পড়েই ট্রিগার টিপেছিল ঐ অন্ধকার লক্ষ্য করে।
অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ উঠল এবং ওদিক থেকে গুলি বর্ষণও বন্ধ হয়ে গেল।
হাসান তারিক পেছনের দিকে লক্ষ্য করে বলল, তোমরা সব ঠিক তো?
-হ্যা। ইউসুফ জবাব দিল।
-ক্রলিং করে দ্রুত আমাদের এগুতে হবে। গুলির শব্দে অন্যেরা এখনি ছুটে আসবে। এ লোকটাকে নিশ্চয় ওরা পাহারায় বসিয়ে রেখেছিল।
হাসান তারিকরা দ্রুত এগিয়ে প্রাচীর যেখানে উত্তর দিকে বাঁক নিয়েছে তার কাছাকাছি গিয়ে পৌছল।
এমন সময় হাসান তারিক দেখল, একটা চলন্ত অন্ধকার এগিয়ে প্রাচীরের বাঁকের এপারে এসে চাপা কণ্ঠে ডাকল, ব্যাং কোথায় তুমি?
কোন সাড়া না পেয়ে আবার ডাকল ব্যাং।
চাপা ফিস ফিসে কণ্ঠ তার।
এরপর লোকটা এক পা দু’পা করে সামনে এগুলো। অন্ধকারেও তার উদ্যত স্টেনগানের অস্তিত্ব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
লোকটা আরও কয়েক ফুট এগিয়ে এল।
হাসান তারিক হাত দিয়ে পরীক্ষা করল তার রিভলভারের সাইলেন্সার ঠিক আছে কি না। তারপর ধীরে সুস্থে শুয়ে থেকেই একটা গুলি করল সে।
নিরব অন্ধকারে ‘দুপ’ করে একটা শব্দ উঠল। আর লোকটার মুখ থেকে বেরুল একটা ‘আ-আ’ শব্দ। পেছন দিকে উল্টে পড়ে গেল লোকটা।
হাসান তারিকরা আরেকটু এগিয়ে প্রাচীরের কোণায় গিয়ে অবস্থান নিল। এই কোণা থেকে বিশ গজ উত্তরে এগুলেই সেই চোরা দরজাটা।
হাসান তারিক দেহটাকে দক্ষিণ দেয়ালের সাথে সেঁটে রেখে একটু মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে উত্তর দিকে দেখল, চোরা দরজার সামনে মাইক্রোবাস সাইজের একটা গাড়ি কালো দৈত্যের মত অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা ও গাড়ির কাছ থেকে ঠুক-ঠাক, টুং-টাং শব্দ ভেসে আসছে। মনে হয় গাডিতে কিছু উঠছে।
প্রায় এক মিনিটের মত অপেক্ষা করল হাসান তারিক। কিন্তু আর কেউ এল না। পাশেই এসে বসেছিল ইউসুফ চিয়াং। হাসান তারিক তাকে বলল, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগছে না। একজন লোককে তারা খোঁজ নিতে পাঠাল, নিশ্চয় তার শেষ আর্তনাদটা তাদের কানে পৌছেছে। কিন্তু এর পরেও আসছে না কেন?
হঠাৎ হাসান তারিকের খেয়াল হল বইয়ে পড়া বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘের চরিত্রের কথা। বাঘ চলার এক বৃত্ত রচনা করে শিকারীকে সেই বৃত্তে ফেলে পেছন থেকে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। তাহলে কি সামনে দিয়ে না এসে বাড়ি ঘুরে পেছন দিক দিয়ে ঘিরে ফেলার ষড়যন্ত্র এঁটেছে ওরা?
হাসান তারিক তাড়াতাড়ি ইউসুফ চিয়াংকে বলল, তুমি আব্দুল্লায়েভকে নিয়ে ক্রলিং করে নিঃশব্দে পূর্ব দিকে একটু এগোও। আমার মনে হয় ওরা পেছন থেকে আসছে।
ইউসুফ চিয়াং আব্দুলায়েভকে নিয়ে দ্রুত এগোতে লাগল পূর্ব দিকে।
হাসান তারিক প্রাচীরের কোণা থেকে মুখ একটু বের করে উত্তর দিকে তার শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখল। যাতে অন্ধকারে সামন্য নড়া চড়াও তার দৃষ্টি এড়িয়ে না যায়।
তখন পাঁচ মিনিট পার হয়েছে। এমন সময় প্রাচীরের পূর্ব কোণ থেকে এক সাথে একাধিক স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের শব্দ ভেসে এল। পেছন ফিরে তাকাল হাসান তারিক। আহমদ ইয়াং ফিস ফিস করে বলল, ফায়ার এদিক থেকেই করা হয়েছে মনে হল।
‘আল্লাহ্‌ সহায়’ বলল হাসান তারিক।
কথা শেষ করেই হাসান তারিক তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল আগের জায়গায়। দৃষ্টি ফিরিয়েই তার নজরে পড়ল, তিনটি ছায়ামূর্তি শরীর বাঁকিয়ে মাথা নিচু করে গুটি গুটি এগিয়ে আসছে।
আহমদ ইয়াংকে সাবধান করে হাসান তারিক স্টেনগান বাগিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রাচীরের কোণায় তিন-চারটা ছোট ছোট গাছ ছিল। গাছগুলো ফুট খানেক করে লম্বা। এতে সুবিধা হলো হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং এর।
ওরা তখন পঁচিশ গজ দূরে। হাসান তারিক মাথা তুলল। তাক করল স্টেনগান। তারপর ‘ফায়ার’ বলেই ট্রিগার চেপে ধরে ষ্টেনগানের মাথা ঘুরিয়ে নিল কয়েকবার। একই সাথে আহমদ ইয়াং-এর স্টেনগানও গর্জে উঠেছিল।
তিনটি ছায়ামূর্তি ঢলে পড়ল মাটিতে।
হাসান তারিক অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু ওপার থেকে কোন জবাব এলনা। এমন সময় ইউসুফ চিয়াংরা ফিরে এল। ওরা বলল, ওখানে জেনারেল বোরিসের চারজন লোক খতম হয়েছে।
অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল ওদিক থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই।
হাসান তারিক ইউসুফ চিয়াং কে বলল, তুমি আব্দুল্লায়েভকে নিয়ে ঐ গাড়ি ঘুরে দরজায় এস। আমরা এদিক থেকে যাচ্ছি। ওরা চলে গেলে হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং সাপের মত গড়িয়ে চলল ঐ দরজার দিকে।
দরজায় পৌছে গেল হাসান তারিকরা। ওদিকে থেকে ইউসুফরাও এল। না কোন বাধা এল না। তাহলে ওরা সবাই শেষ হয়েছে?
দরজার গোড়ায় কয়েকটা টর্চ পেল। টর্চের আলো ফেলল প্রথমে ভেতরের করিডোরে। দেখল পাঁচটি ট্রাংক পডে আছে। তালাবদ্ধ। এরপর টর্চ নিয়ে গাড়িতে উঠল। ওখানেও অনুরূপ আটটি ট্রাংক।
গুলি করে একটি ট্রাংকের তালা ভেঙ্গে ফেলল হাসান তারিক।
ট্রাংকের তালা খুলে চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেল তাদের সকলের। সোনার তালে ভর্তি ট্রাংক।
বাড়িটি সার্চ করে কয়েক বাক্স অস্ত্র-শস্ত্র ছাড়া তেমন আর কিছুই পেল না।
সোনা ও অস্ত্রের বাক্সগুলো তারা গাড়িতে তুলল। যারা মারা গেছে তাদের স্টেনগান গুলোও কুড়িয়ে আনা হলো। অস্ত্র কুড়াতে গিয়ে আরেকটা বিষয় তারা নিশ্চিত হল যে, জেনারেল বোরিস নিহতের মধ্যে নেই।
তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল। যখন ঘাটিতে পৌছল, তখন রাত চারটা।
জিনিস পত্র সামলিয়ে যখন তারা হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রামের জন্য বিছানায় এল, তখন উরুমচির ইবনে সাদ মসজিদে ফজরের আযান দিল।
চারজনই উঠে দাঁড়াল মসজিদে যাবার জন্যে। অন্যদেরও ডেকে দিল।
নামাজ পড়ে এসে বিছানায় গা এলিয়েই হাসান তারিকের খেয়াল হল সেই নোটবুকের কথা। তাড়াতাড়ি উঠে নোটবুক নিয়ে টেবিলে বসল। নোটবুক খুলতেই তার ভেতর থেকে বাড়ি ভাড়ার দু’টি রশিদ বের হয়ে এল। আরবী মিশ্রিত টার্কিশ ভাষায় লেখা রশিদ। পড়ে বুঝল মাত্র ছয় দিন আগে এ দু’টি বাড়ি ভাড়া নেয়া হয়েছে। রশিদ দু’টি নিয়ে ছুটল ইউসুফ চিয়াং এর কাছে।
ইউসুফ চিয়াং রশিদ দু’টো পড়ে লাফিয়ে উঠল। ওদের আরেকটা ঘাটির সন্ধান পাওয়া গেল।
উদগ্রীব হাসান তারিককে ইউসুফ চিয়াং বুঝিয়ে বলল, এ দু’টো বাড়ির একটিকে আমরা দেখে এসেছি। আরেকটা বাড়ি তুবপাস রোডে। এখান থেকে দু’মাইল হবে।
হাসান তারিক বলল, ওদের জানা জানির কোন সময় না দিয়ে আমাদের তো তাহলে এখনই বের হওয়া দরকার।
-ঠিক বলেছেন তারিক ভাই।
বলে ইউসুফ চিয়াং উঠে দাঁড়াল। বলল তারিক ভাই আপনি তৈরী হন। আমি ওদের বলে আসি তৈরী হওয়ার জন্য।
হাসান তারিক, ইউসুফ চিয়াং, আব্দুল্লায়েভ ও আহমদ ইয়াং যখন সেই বাড়িটির সামনে গিয়ে পৌছল তখন চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে।
বাডিটি দু’তলা। আশে পাশে লাগা কোন বাড়ি নেই। বাড়িটির নিচের তলা ও দু’তলার কোন জানালা তখনও খোলেনি। বাড়ির সামনে সামান্য একটু ফাকা জায়গা পেরুলেই বাড়িতে প্রবেশের একটি মাত্র দরজা।
রাস্তা দিয়ে পায়চারি করতে করতে বাড়ির দিকে লক্ষ্য করছিল হাসান তারিকরা।
এই সময় একটা বেবী ট্যাক্সি ঐ বাড়িটার সামনে এসে দাড়াল। ট্যাক্সি থেকে একজন লোক নেমে ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির দরজার দিকে হাঁটা দিল।
হাসান তারিক ইউসুফ চিয়াং কে বলল, তুমি যাও ওর কাছে। জিজ্ঞেস করলে প্রথমে বলবে, আমরা আলেকজান্ডার বোরিসভের পরিচিত। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।
ইউসুফ চিয়াং ওদিকে ছুটল।
এদিকে বেবী ট্যাক্সিটি ঘুরে দাড়িয়েছিল ফিরে যাবার জন্য।
হাসান তারিক হাত তুলে বেবী ট্যাক্সিকে থামতে বলল। থামল বেবীটি। ড্রাইভারের চোখে নতুন ভাড়া পাওয়ার উৎসুক দৃষ্টি।
হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, কোথেকে এলে?
-এয়ারপোর্ট থেকে।
-কখন গিয়েছিলে এয়ারপোর্টে?
-চারটার পিকিং এর ফ্লাইট ধরার জন্য।
-কিছু মনে করো না, কাকে নিয়ে গিয়েছিলে?
-যে গাড়ি থেকে নামল তার সাথে হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন আহত লোক ছিল। কেন সাব, কি হয়েছে?
-কিছু না। সেই লোক আমাদের পরিচিত ।তারই খোঁজে এসেছিলাম তো! ঠিক আছে তুমি যাও।
এদিকে ইউসুফ চিয়াং বাড়িটির লোহার রেলিং এর কাছে পৌঁছতেই লোকটি ভেতর ঢুকে গিয়েছিল। ইউসুফ চিয়াং ডান হাত পকেটে রিভালভারের ওপর রেখে বাম হাতে নক করল দরজায়। থেমে থেমে কয়েকবার নক করার পর দরজার ওপারে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সেই সাথে সিঁড়ি দিয়ে কাউকে নেমে আসারও শব্দ সে পেল।
দরজাটি খুলে গেল। একটি মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে পাশে সরে গেল।
দরজার মুখেই একটা খাড়া সিঁড়ি দু’তলায় উঠে গেছে। সিঁড়ির মাঝখানে বাইরে থেকে আসা সেই লোকটি দাঁড়িয়ে। তার একটা হাত পকেটে।
ইউসুফ চিয়াং এর দু’টো হাতই জ্যাকেটের পকেটে। দরজা থেকে দু’ধাপ ভেতরে প্রায় সিঁড়ির গোড়ায় এখন সে দাঁড়িয়ে। সিঁড়ির লোকটিকে লক্ষ্য করে সে বলল, আলেকজান্ডার বরিসভ আমার পরিচিত, তার খোঁজে এসেছি।
লোকটির ঠোঁটে চিকন হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। ইউসুফ চিয়াং এর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই সে বাঘের মত সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ল তার ওপর।
ইউসুফ চিয়াং লোকটির চোখে চোখ রেখেছিল। সে সিঁড়ির ওপর লাফ দিতেই ইউসুফ চিয়াং বিদ্যুৎ গতিতে দরজার একপাশে সরে গেল। লোকটি মুখ থুবরে পড়ে গেল দরজার ওপর। কপালের একপাশ তার থেতলে গেল। রক্ত বেরিয়ে এল সেখান থেকে।
অদ্ভুত ক্ষীপ্রগতি লোকটির। পড়ে গিয়ে ঐ অবস্থাতেই পকেট থেকে রিভলবার বের করে তাক করল ইউসুফ চিয়াং এর দিকে।
ইউসুফ চিয়াং সরে আসার সময়ই জ্যাকেটের পকেট থেকে রিভলবার সমেত হাতটা বের করে নিয়েছিল। সুতরাং লোকটির রিভলবার অগ্নিবৃষ্টির আগেই গর্জে উঠল ইউসুফ চিয়াং এর রিভলবার।
হাসান তারিকরা এসে দরজায় দাঁড়াল এ সময়।
আহমদ ইয়াং এবং আব্দুল্লায়েভ লোকটাকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে এল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিল।
ইউসুফ চিয়াং এবং হাসান তারিক রিভলবার বাগিয়ে লক্ষ্য রেখেছিল সিঁড়ি ও নিচের তলার দরজার দিকে।
সেই মেয়েটি একটু ভেতরে দাড়িয়ে কাঁপছিল। সে যেন নড়া-চড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। হান গোষ্ঠীর চীনা মেয়ে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে।
ইউসুফ চিয়াং তার রিভলবার মেয়েটির দিকে তুলে ধরে বলল, আর কে আছে ভেতরে?
-আমরা দশজন আছি।
-আর কেউ?
-না কোন পুরুষ নেই।
ইউসুফ চিয়াং হাসান তারিকের দিকে তাকাল। হাসান তারিক বলল, মেয়েটিকে নিয়ে তুমি ও আব্দুল্লায়েভ নিচের তলাটা দেখে এস। আমরা সিঁড়ির দিকে লক্ষ্য রাখছি।
মিনিট পাঁচেক পর ইউসুফ চিয়াং ফেরত এল। সবটা দেখেছি, নিচে কেউ নেই।
এরপর হাসান তারিকরা ওপরে উঠে এল। ওপরে সিঁড়ির মুখে বসার ঘরটায় নয়টি মেয়ে জড়-সড় হয়ে বসেছিল। তাদের চোখে-মুখে ভয়-বিহবলতা। তারা সকলেই চীনা হান। বয়স একই রকমের-চব্বিশ পঁচিশ।
আহমদ ইয়াংকে ওদের কাছে দাঁড়িয়ে রেখে ওপর তলাটাও তন্ন তন্ন করে দেখল হাসান তারিকরা। নিচের তলার মত উপরেও ছয়টি ঘর। কেউ নেই।
হাসান তারিকরা ফিরে এল সেই বসার ঘরে মেয়েগুলির কাছে।
হাসান তারিক ওদের জিজ্ঞেস করল, আলেকজান্ডার বোরিসভকে তোমরা চিন?
সামনে বসা একটি মেয়ে বলল, চিনি?
-সেই কি আজকের ফ্লাইটে পিকিং গেছে?
-হ্যাঁ।
-কেন?
-এখানকার ডাক্তার বলেছে নাকি যে আজকের মধ্যেই ওর ডান হাতটা কেটে ফেলতে হবে। তাই পিকিং অঞ্চলের কোন হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
-এ বাড়ির আর লোক কোথায়?
-দেংশিয়াং রোডের বাড়িতে থাকতে পারে।
-ওরা কতজন লোক ওখানে?
-দেংশিয়াং রোডের বাড়ি ও এ বাড়ি মিলে আলেকজান্ডার বোরিসভ সহ ওরা চৌদ্দজন থাকে।
হাসান তারিক বিস্মিত হলো, মেয়েটি মিথ্যে বলার চেষ্টাও করছে না। বলল, তোমরা কারা? এদের দলের?
মেয়েটি কেঁদে উঠল। বলল, আমরা সব হতভাগিনী। আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ওরা আমাদের এনে আটিকে রেখেছে। দাসিবৃত্তি ও ভোগের সামগ্রী হিসেবে ওরা আমাদের ব্যবহার করে।
সব মেয়েদেরই চোখে পানি।
হাসান তারিক বলল, আমরা মুসলমান। আমরা সব রকম জুলুম নির্যাতনের বিরোধী। এ জন্যেই এদের সাথে আমাদের বিরোধ। তোমরা কি চাও বল?
সেই মেয়েটি চোখ মুছে বলল, আমরা বাইরে বেরুলেই ওরা মেরে ফেলবে। যেখানে যাব সেখান থেকেই ওরা ধরে আনবে। কত মেয়েকে কত কষ্ট দিয়ে যে ওরা মেরেছে।
হাসান তারিক হাসল, বলল, বোনরা তোমাদের ভয় নেই। ওদের সে শক্তি আর হবে না।
ওদের সকলের চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কয়েকটা মেয়ে ছুটে এসে পা জড়িয়ে ধরল হাসান তারিকের। বলল, আমরা বড় দুঃখী, আমাদের কেউ এমন করে বোন বলে ডাকেনি। আমাদের আপনি বাঁচান।
হাসান তারিক পা টেনে নিয়ে ওদের শান্তনা দিয়ে বলল, মানুষ মানুষের পায়ে পড়ে না বোন, আল্লাহ সকল মানুষকে সমান মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। তাদের মধ্যে বড় ছোট থাকতে পারে না।
হাসান তারিক একটু থেমে বলল, আমরা এখন চলে যাচ্ছি। তোমরা দরজা বন্ধ করে এ বাড়িতেই থাক। আমরা পরে ফিরে আসছি। কি ব্যবস্থা করা যায়, তখন দেখা যাবে।
হাসান তারিকরা ফিরে দাঁড়াল চলে আসার জন্য। চলতে গিয়ে আবার ফিরে দাড়াল হাসান তারিক। ওদের লক্ষ্য করে বলল, আমরা গিয়ে দ’জন লোক পাঠাচ্ছি। ওরা দরজার বাইরে পাহারায় থাকবে। ওদের টুপির সামনে দেখবে লাল অর্ধচন্দ্র। আমরা না ফেরা পর্যন্ত ওরা থাকবে, তোমাদের ভয় নেই।
হাসান তারিকরা বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে। মেয়েরা খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে থাকল ওদের দিকে। ওদের চোখে নতুন আনন্দ ও আস্থার আলো।
হাসান তারিকরা চলে গেলে ওরা দরজা বন্ধ করে ফিরে দাঁড়াল। ওরা কি মানুষ? মানুষ কি এত ভাল হয়?
আরেকজন বলল, নারে ওদের একটা বই পড়েছিলাম আমি, ওরা সত্যিই আলাদা।

রাত দু’টায় আহমদ মুসার কাছে থেকে চলে যাবার পর যা যা ঘটেছে তা খুঁটে খুঁটে সব আহমদ মুসাকে জানাল হাসান তারিক।
সব শুনে আহমদ মুসার মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে সকলের পিঠ চাপড়ে দিল। বলল, তোমাদের সাফল্যের জন্যে মোবারকবাদ। আজকের রাতটা আন্দোলনের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আহমদ মুসা তার চোখ ইউসুফ ও আহমদ ইয়াং এর দিকে নিবদ্ধ করে বলল, আমার তরুণ দুই ভাই, তোমরা আমাকে মুগ্ধ করেছে, তোমরা তোমাদের ঐতিহ্যের সার্থক প্রতিনিধিত্বকারী।
ইউসুফ চিয়াং ও আহমদ ইয়াং এর চোখে মুখে একরাশ লজ্জা নেমে এল।
ইউসুফ চিয়াং বলল, না মুসা ভাই, আজ রাতে আমাদের কিছু করার ছিল না, ছিল শেখার এক দুর্লভ সুযোগ। আজ রাতের ঘটনা আমাদের শুধু অমূল্য অভিজ্ঞতা দান করেনি, আত্মবিশ্বাসও জাগিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে, অনেক কিছু করার শক্তি আমাদের আছে।
আহমদ মুসা বলল, ইউসুফ, আমার মনে হচ্ছে এখানে সবকিছুই তোমাদের হাতের মুঠোয়। মধ্যে এশিয়ায় সাইমুম থেকে ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ অনেক ভালো পরিবেশে রয়েছে। মুসলমানরা তাদের ভাষা তাদের শিক্ষা সংক্রান্ত তাদের বেশ কিছু অধিকার পিকিং এর নতুন সরকারের কাছ থেকে ফিরে পেয়েছে। আমার মনে হয়েছে, অবশিষ্ট অধিকার মুসলমানরা ফিরে পাবে।
ইউসুফ চিয়াং বলল, কিন্তু মুসা ভাই, বিরুদ্ধ শক্তির ঐ কিছুটা আপোশকামী ভূমিকা এখানকার কিছু মুসলমানের মধ্যে এমন একটা আত্মপ্রসাদ এনে দিচ্ছে যা এম্পায়ার গ্রুপের আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে।
আহমদ মুসা বলল, ঠিক বলেছ ইউসুফ, কিন্তু সমস্যা এত বেশী আছে। মুক্তির পথে এত বাধা ও জটিলতা আছে যে আত্মপ্রসাদ সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই। এখানকার বিধ্বস্ত মুসলিম সমাজের পুনর্গঠন এবং মুসলমানদের সকলের মুখে মুক্তির হাসি ফুটানোর পথ অনেক দীর্ঘ।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে চাইল। বলল, জেনারেল বোরিসের কাছ থেকে যে আধ টন স্বর্ণ তোমরা উদ্ধার করেছ তা এম্পায়ার গ্রুপের জন্য ইউসুফ চিয়াং এর তত্ত্বাবধানে দিয়ে দাও। এ থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ এম্পায়ার গ্রুপ খরচ করবে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদ, মাদ্রাসার পুনর্গঠন এবং মুসলিম, এতীম, বিধবাদের পুনর্বাসনের কাজে। অবশিষ্ট সব অর্থ ব্যয় হবে এম্পায়ার গ্রুপকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করার জন্যে। আর এক লাখ ইউয়ান যে নগদ অর্থ পেয়েছ ওটা ঐ দশটি অসহায় মেয়েকে দিয়ে ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
হাসান তারিক উজ্জ্বল চোখে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
কথা বলে উঠল ইউসুফ চিয়াং। বলল, মুসা ভাই, আপনি যেভাবে কথা বলেছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনারা যেন ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর কেউ নন।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, বিশ্বের যেখানে যে নামেই ইসলামী আন্দোলন হোক, আন্দোলন একটাই। এম্পায়ার গ্রুপ আমার, আমি এর সাথে আছি।
ইউসুফ চিয়াং এর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, মুসা ভাই, একটা সমস্যার কথা বলি। গতকাল একটা খবর এসেছে। শিহেজি উপত্যকায় দুই একর জমি মুসলমানদের কাছ থেকে সরকারী কাজের জন্যে একোয়ার করা হয়েছিল। কিন্তু এখন সেখানে সরকারী তত্ত্বাবধানে সিংকিয়াং এর বাইরে থেকে অমুসলিম হান গোষ্ঠীর লোক এনে বসানো হচ্ছে। মুসলমানরা এতে প্রতিবাদ করতে গেলে সংঘর্ষ হয় এবং বিশজন মুসলিম যুবককে গ্রেফতার করা হয়। এখন আমাদের কি করণীয়? আমরা সম্প্রতি এ ধরনের যে কোন নতুন বসতি ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরকম বেশ কিছু পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। এতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন বসতি আর পুনঃস্থাপনে তারা সাহস পায়নি। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের কাজের দায়দায়িত্ব স্থানীয় মুসলমানদের ওপর পড়ে এবং তারা পাইকারীভাবে নির্যাতনের শিকার হয়।
থামল ইউসুফ চিয়াং। আহমদ মুসা তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে থামলে আহমদ মুসা বলল, বর্তমান ক্ষেত্রে তোমাদের ইচ্ছা কি?
-আমরা আমাদের সিদ্ধান্তের বিকল্প দেখি না। একটা বিকল্প হলো চুপ করে থাকা। কিন্তু চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। এক দুই করে তারা পঞ্চাশ লাখ-অমুসলিম হান গোষ্ঠীর লোককে সিংকিয়াং-এ এনে ঢুকিয়েছে। তার ফলে নিজ দেশেই আমরা পরবাসী হবার উপক্রম। আমরা এ অবস্থা চলতে দিতে পারি না।
-বুঝেছি তোমরা কথা। তোমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ওদেরকে একটা সময় দেবে না?
-না মুসা ভাই, ওটা করতে গেলে পদক্ষেপ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আর স্থানীয় মুসলমানদের উপর জুলুম-অত্যাচার হয়রানি এখনই শুরু হয়ে যাবে।
-বুঝলাম! ঠিক আছে, তাহলে সিদ্ধান্ত অনুসারেই কাজ করতে হবে।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, বলত, তোমাদের সামনে আশু সমস্যা কি?
-সমস্যা আছে অনেক। তবে দু’টো বিষয়কে আমরা জরুরী ভিত্তিতে হাতে নিয়েছি। এর প্রথমটি হল মসজিদ-মাদরাসাকে কম্যুনিষ্ট খবরদারী থেকে মুক্ত করা। আর দ্বিতীয় হল, মুসলমানরা কম্যুনিষ্ট পার্টির সদস্য না হলে পিওন-ক্লার্কের ওপরের পদে চাকুরী না পাওয়ার যে ব্যাপার চলছে তার প্রতিরোধ করা। বাইরের অন্যায় বসতি বিস্তারের প্রতিরোধের কথা তো আগেই বলেছি। অসহায় মুসলমানদের অভিভাবকত্ব দান এবং ইসলামী চিন্তা ও জ্ঞানের প্রসার প্রচেষ্টার বাইরে এই তিনটি কাজই আমাদের মুখ্য।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিছু বলতে যাচ্ছিল সে। এমন সময় মা-চু এসে বলল, মেহমানদের নাস্তা দেয়া হয়েছে।
হাসান তারিক বলল, তোমরা সবাই খেতে থাক। আমি মুসা ভাইকে আরেকটা কথা বলে আসি।
মা-চু’র সাথে ওরা তিনজন চলে গেল।
ওরা চলে গেলে হাসান তারিক পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার আহমদ মুসার দিকে তাকাল। মুখটি আবার একটু নিচু করল সে।
-বলবে কিছু নিশ্চয়, বলে ফেল। আয়েশা কেমন আছে তাতো জানাওনি আমাকে? আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি।
হঠাৎ হাসান তারিকের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল। দু’হাতে চোখ ঢাকল হাসান তারিক।
-তুমি কাঁদছ হাসান তারিক? তাহলে আয়েশা আলিয়েভার কিছু…….. বিস্ময় ও উদ্বেগ ঝরে পড়ল আহমদ মুসার কন্ঠে।
-না আয়েশার কিছু হয়নি। আমাদের ফারহানা আপা নেই।
-কি বলছ তুমি হাসান তারিক? বিস্ময়ের এক বজ্রপাত হল আহমদ মুসার কন্ঠে।
হ্যাঁ মুসা ভাই, তিনি নেই। জেনারেল বোরিসের লোকরা তাঁকে হত্যা করেছে।
-হত্যা করেছে? ফারহানা নিহত হয়েছে?
বেদনায় শক্ত হয়ে উঠেছে আহমদ মুসার মুখ। কিছুক্ষণ তার যেন বাক স্ফুরণ হলো না। তার শক্ত এবং স্থির দৃষ্টি হাসান তারিকের দিকে।
হাসান তারিক মুখ নিচু করে আছে।
নিজেকে সামলে নিয়েছে আহমদ মুসা। ধীর গম্ভীর কন্ঠে বলল, কিভাবে এটা ঘটল হাসান তারিক?
হাসান তারিক সেদিনের সব ঘটনা খুলে বলল।
শুনে আহমদ মুসা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। তার শুন্য দৃষ্টিটা জানালা দিয়ে বাইরে নিবদ্ধ ছিল। তার চোখের দু’কোণায় দু’ফোটা অশ্রু চিকচিক করছিল।
অনেকক্ষণ পর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, যাও ভাই খেয়ে এস।
মনে হল আহমদ মুসা অনেক দূর থেকে কথা বলছে।
হাসান তারিক তার দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ওরা খেয়ে ফিরে এল।
আব্দুল্লায়েভ আহমদ মুসার দিকে লক্ষ্য করেই বলে উঠল, মুসা ভাই কেমন লাগছে আপনার, খারাপ বোধ করছেন আপনি?
আব্দুল্লায়েভ তখন দাঁড়িয়েছিল। আহমদ মুসা উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আব্দুল্লাহ, তুমি আমাকে ফারহানার কথা জানাওনি, তোমার আতিয়ার কথাও জানাওনি।
-মুসা ভাই, অনেকবার মুখে এসেছে, কিন্তু বলতে পারিনি। কথা বের হয়নি।
তার চোখে অশ্রু টলটল করে উঠল। আহমদ মুসার চোখের কোণ দু’টিও আবার ভিজে উঠল।
এই সময় মা-চু ঘরে ঢুকল। বলল, ডাক্তার সাহেব এসেছেন।
আহমদ মুসা ফিরে দাঁড়িয়ে তার বিছানায় বসতে বসতে ধীর কন্ঠে বলল, তাহলে তোমরা রেস্ট নাও। বিকেলে এস, আমি তোমাদের সাথে একটু বেরুব।
আর মা-চু’র দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, নিয়ে এস ডাক্তারকে।
হাসান তারিক চলে গেল। ডাক্তার এসে প্রবেশ করল ঘরে। ডাক্তার ব্যান্ডেজ পরীক্ষা করে বলল, আর দু’দিন পরে এসে ব্যান্ডেজ পাল্টে দিয়ে যাব।
-আর কয়দিন বাণ্ডেজ রাখতে হবে?
-বাণ্ডেজ পাল্টাবার পর ধরুন আর সাত-আট দিন।
-আমি কি বাইরে টাইরে বেরুতে পারি?
-বাড়ির বাইরে?
-হ্যাঁ।
-গাড়ি করে বাইরে বেরুতে পারেন। তবে এক সাথে বেশী হাঁটা ঠিক হবে না।
হঠাৎ মেইলিগুলির কথা খেয়াল হল আহমদ মুসার। বলল, মেইলিগুলিকে কেমন দেখলেন ডাক্তার সাহেব?
-দু’ আঙুলের মাঝখানে আঘাত। জায়গাটা সেনসেটিভ। একটু সময় নেবে। তাছাড়া কবজি থেকে একটু ওপরে যে আঘাত সেটাও বড়। হাড় কাটেনি বটে, কিন্তু বেশ আহত হয়েছে। এখন আবার আসতে দেখে এলাম জ্বর উঠেছে।
-জ্বর? জ্বরের কারণ কি?
-বুঝতে পারছিনা বিকেলে আবার দেখব।
ডাক্তার বেরিয়ে গেল।
একটু গড়িয়ে নেবার জন্যে শুয়ে পড়ল আহমদ মুসা। কিন্তু শুয়েই মনে পড়ল মেইলিগুলিকে দেখে আসা দরকার।
উঠে বসল আহমদ মুসা।
মা-চু’কে ডেকে বলল, তুমি মেইলিগুলিকে বল আমি আসতে চাই।
মা-চু চলে গেল। অল্পক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, চলুন।
মেইলিগুলির ঘর। খুব বড় নয়। একপাশে শোবার ডিভান। আর একপাশে পড়ার টেবিল। এপাশেই কোণায় একটি টেলিভিশন। পুরো ঘরটাই লাল কার্পেটে মোড়া।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকল।
মেইলিগুলি শুয়ে ছিল। আহমদ মুসা ঘরে ঢুকতেই সে উঠে বসল।
ডিভানের পাশেই একটা চেয়ার রাখা ছিল। ওখানে গিয়ে বসল আহমদ মুসা। চেয়ারে বসতেই মেইলিগুলির বালিশের পাশে ভাজ করে রাখা একটা জায়নামায আহমদ মুসার নজরে পড়ল।
মেইলিগুলির মুখ শুকনো। নীল চোখ দু’টির মধ্যে একটা ক্লান্তি। একটা বড় চাদরে মাথা ও গা ঢাকা। মেইলিগুলির জন্যে এটা নতুন একটা পরিবর্তন মনে হল আহমদ মুসার কাছে। মেইলিগুলির চুল উস্কো-খুস্কো। চাদরের প্রান্ত পেরিয়ে কিছু চুল এসে কপালে পড়েছে।
চেয়ারে বসতে বসতে আহমদ মুসা বলল, কেমন আছ?
-ভাল
-ডাক্তার বলল, গায়ে তোমার জ্বর উঠেছে। খুব জ্বর?
মেইলিগুলি চোখ তুলল। আহমদ মুসার চোখে চোখ পড়ল। চোখ নামিয়ে নিল আহমদ মুসা।
-খুব জ্বর নয় বোধ হয়।
-ডাক্তার বলল, তোমার কব্জির ওপরে আর এক স্থানেও নাকি একটা বড় আঘাত আছে?
-জ্বি আছে।
-ওটা কিসের আঘাত?
-পেছন থেকে জেনারেল বোরিস ওখানে প্রথম আঘাত করে।
-গুলি করে কখন?
-রিভলভারের বাট দিয়ে আঘাত করার পর আমার হাত থেকে রিভলভার পড়ে যায়। আমি রিভলভার কুড়িয়ে নিয়ে যখন তাকে গুলি করতে যাই, তখন সে গুলি করে।
-তুমি সেদিন জেনারেল বোরিসদের আসা কখন কিভাবে টের পেলে?
মেইলিগুলি উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে থাকল সে।
-তুমি জেনারেল বোরিসদের আসার আশংকা করেছ, একা একা রাতে পাহাড়া দিয়েছ, আমাকে জানাওনি কেন?
-আপনি এসব কার কাছে শুনলেন? দাদী?
-হ্যাঁ।
-আমি এখন বুঝতে পারছি, না বলা আমার ভুল হয়েছে অপরাধ হয়েছে।
-না এমন করে ভাবা আবার তোমার ঠিক নয়।
-কিন্তু এ রাতে যদি কিছু ঘটে যেত তাহলে অপরাধ বোধের যন্ত্রণা থেকে কোন দিনই বাঁচতে পারতাম না।
বলার সময় গলা যেন মেইলিগুলির কিছুটা কেঁপে উঠল।
-এসব ভেবে মন খারাপ করো না, আমাদের সাধ্য কতটুকু। আল্লাহই আমাদের ভরসা।
কথা বলল না মেইলিগুলি।
আহমদ মুসাও কি কথা বলবে আর ভেবে পেল না।
মেইলিগুলিই মুখ খুলল। বলল, আজ তো ডাক্তার আপনার ব্যাণ্ডেজ দেখার কথা ছিল?
-হ্যাঁ দেখেছে।
-কি বলেছে?
আরও সাত-আট দিন ব্যাণ্ডেজ রাখতে হবে। আর ডাক্তার বলেছেন, আমি বাইরে একটু করে বেরুতে পারি।
-বলেছেন ডাক্তার এটা?
-হ্যাঁ।
মেইলিগুলি মাথা নেড়ে বলল, না, হাঁটাহাঁটি করলে সেলাই-এ টান পড়বে, ক্ষতি হবে তাতে।
-গাড়ি করে বেরুনো যাবে ডাক্তার বলেছেন। বেশী হাঁটাহাঁটি তিনিও নিষেধ করেছেন।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, আজ বিকেলে একটু বেরুব।
-একা?
-না, হাসান তারিকরা থাকবে।
-মেইলিগুলি চুপ করল। কথা বলল না। মনে হল আহমদ মুসার এ সিদ্ধান্ত তার মনঃপুত হয়নি। আহমদ মুসাও এটা বুঝল। বলল সে, না হাঁটাহাঁটি করব না। গাড়ি করে একটু এদিক সেদিক ঘুরে আসব মাত্র।
আহমদ মুসা থামল।
মেইলিগুলি বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
-কি কথা?
-হাসান তারিকরা রাতে বেরিয়েছিল, কোন খারাপ খবর কি তারা এনেছে?
-না তো, তোমাকে বলা হয়নি। তাদের অভিযান আশাতীত সফল হয়েছে। জেনারেল বোরিসের শেষ দু’টো ঘাটিও আমাদের দখলে এসেছে, তার সঙ্গী-সাথী সব শেষ হয়েছে। সে পিকিং চলে গেছে তার আহত হাতটি কেটে ফেলার জন্য।
মেইলিগুলির চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ কোন কথা বলল না সে। কি যেন ভাবছিল। অবশেষে বলল, কিছু মনে করবেন না, কোন দুঃসংবাদ কি আজ পেয়েছেন আপনি?
-কেন, এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছ কেন?
মেইলিগুলি বলল, প্রশ্ন করার অনুমতি আগেই চেয়ে নিয়েছি।
একটু থামল মেইলিগুলি। তারপর বলল, আপনার চেহারার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখছি। আর মা-চু বলল, আপনার চোখে সে অশ্রু দেখেছে।
মেইলিগুলির কথার তখনই কোন উত্তর দিতে পারলো না আহমদ মুসা। চোখ বুজল সে। তার মুখ একটা বিষাদ বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
মেইলিগুলি আহমদ মুসার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আহমদ মুসার এই বেদনার্ত পরিবর্তন মেইলিগুলির দৃষ্টি এড়াল না। আহমদ মুসার এভাবে চোখ বুজাটাও তার কাছে বিস্ময়কর লাগল। তাহলে কি বড় ধরনের দু:খজনক কিছু ঘটেছে। আহমদ মুসার মত পর্বত প্রমাণ ব্যক্তিত্ব কোন ধরনের ঘটনায় এমন হতে পারে? বুঝতে পারল না, প্রশ্ন করাই তার ভুল হয়েছে কিনা!
মেইলিগুলি মুখ তুলল। তার বিষণ্ন দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে তুলে ধরে বলল, আমি আপনাকে ব্যথা দিয়েছি?
-না মেইলিগুলি। তুমি ঠিকই ধরেছ, আমি একটা দু:সংবাদ পেয়েছি।
-জিজ্ঞেস করতে পারি কি? সেটা কি?
আহমদ মুসা তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। একটু ভাবল। তারপর বলল, ব্যাপারটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মেইলিগুলি। আমাকে অপহরণ করে নিয়ে আসার পর যার সাথে আমার বিয়ে স্থির হয়েছিল, সে মেয়েটিকেও জেনারেল বোরিসের লোকেরা হত্যা করেছে।
এমন খবর শোনার জন্যে মেইলিগুলিও প্রস্তুত ছিল না। সে সংকুচিত হয়ে পড়ল। বেদনায় বিবর্ণ হয়ে গেল তার মুখ। বুকের কোথায় যেন একটা অস্বস্তিকর খোঁচাও অনুভূত হতে লাগল তার।
দু’জনেই নিরব।
নিরবতা ভাঙল মেইলিগুলিই প্রথম। বলল, মাফ করুন আমাকে, আমি বুঝতে পারি নি।
মেইলিগুলি আর চোখ তুলতে পারলো না।
আহমদ মুসা একটু হাসতে চেষ্টা করল। বলল, ও কিছু না মেইলিগুলি। তুমি ঠিকই ধরেছ। ভাগ করে নিলে দু:খ কমে। দু:খের সাথী থাকলে সান্ত্বনা পাওয়া যায়।
মেইলিগুলি চোখ তুলে চাইল। ওর নীল চোখে যেন এক সাগর বেদনা, আকাশের মত নিসীম এক মমতা।
চমকে উঠল আহমদ মুসা। তার চোখের সামনে ভেসে উঠল, ফারহানার অশ্রু ধোয়া এমনি চোখ, বহুদিন আগে ফেলে আসা হিমালয়ের বরফ রাজ্যের বরফ গুহার মুমূর্ষ ফারহানার প্রেম-মমতা-বেদনার সাগর গভীর কালো এমনি এক চোখ।
সম্বিত ফিরে পেয়ে চোখ নামিয়ে নিল আহমদ মুসা। উঠে দাঁড়াল সে।
‘আসি মেইলিগুলি’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা।
দরজায় গিয়ে ডিভানের ওপর রাখা হাতের ম্যাগাজিনটা নেবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। কিন্তু দেখল, মেইলিগুলি বালিশে মুখ গুঁজেছে। তার দেহটা ফুলে ফুলে উঠছে। কাঁদছে সে।
আহমদ মুসা আর ঘরে না ঢুকে চলে এল।
ঘরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা। সব চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন বিশ্রাম নেবার জন্যে চোখ বুজল সে। কিন্তু তবু মেইলিগুলির ঐ নিশব্দ কান্নার দৃশ্য ঘুরে ফিরে তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল।



পর্ব ৮ 


বিকেলে আহমদ মুসা হাসান তারিক, আবদুল্লায়েভ, ইউসুফ চিয়াং ও আহমদ ইয়াংকে নিয়ে বাইরে বেরুল।
ইউসুফ চিয়াং তার নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারা যখন বেরুতে যাবে এই সময় মা-চু মেইলিগুলির গাড়ির চাবি এনে হাসান তারিকের হাতে দিল।
হাসান তারিক আহমদ মুসার দিকে তাকাল। আহমদ মুসা তাকাল ইউসুফ চিয়াং এর দিকে।
ইউসুফ চিয়াং বলল, ঠিক আছে, ওঁর গাড়িই নেয়া যাক।
মেইলিগুলির দামী এয়ারকণ্ডিশন গাড়ি।
ইউসুফ চিয়াং ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলল, এই গাড়ি উরুমচিতে আর মাত্র দুটি আছে। সত্যিই মেইলিগুলির মত অর্থ, সম্মান ও নামের অধিকারী এর আগে কেউ হতে পারেনি।
-কেমন জানো তোমরা মেয়েটাকে? জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
-নিকট থেকে তাকে জানার সুযোগ হয়নি। তবে তার সম্বন্ধে আলোচনা হল, তাঁর মত ব্যক্তিত্ব ও আত্ম-মর্যাদাবোধ সম্পন্ন কেউ অভিনয়ের জগতে আর আসেনি।
-এই আলোচনার পক্ষে যুক্তি কি দেয়া হয়?
-তাঁর সম্বন্ধে কথা হলো, বইয়ের কাহিনী এবং দৃশ্য তিনি নিজে বাছাই করেন। কোন অশ্লীল দৃশ্যে কখনও তাকে দেখা যায়নি। আর বাইরের শুটিং এর সময় তিনি সব সময় তাঁর মা ও পরিবারের লোকদের সাথে থাকেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, গত তিন বছরে পত্র পত্রিকায় তাকে ঘিরে কোন কাহিনী তৈরী হয়নি। অথচ অন্যদের বেলায় এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। খবরের কাগজের আরেকটা আলোচনা পড়েছি, শুটিং এর সময় ছাড়া অন্য কোন সময় ক্যামেরার সামনে তিনি দাঁড়ান না।
থামল ইউসুফ চিয়াং। হাসান তারিক এর সাথে আরও যোগ করল। বলল, আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে কি যে বিপদে পড়েছিলাম! তার এ্যাটেনড্যান্টের এক কথা, উনি কারও সাথে তেমন দেখাই করেন না, অপরিচিত লোকের সাথে তো নয়ই। তার এ্যাটেনড্যান্ট তার যুক্তিকে পাকাপোক্ত করতে গিয়ে বলেছিল, অন্য নায়িকার অফিস যখন হাসি তামাশায় গোলজার থাকে, তখন তিনি নিরবে বই পড়েন, স্ক্রিপ্ট পড়েন। আর যখন তার দেখা পেলাম, বুঝলাম তার একটা ভিন্ন মনও আছে তাঁর সহযোগিতা আমরা পাব। জেনারেল বোরিসের হাতে বন্দী মুসা ভাই এর প্রতি গভীর সহানুভূতি এবং বিপুল শ্রদ্ধাবোধ সেদিনই আমি তাঁর মধ্যে দেখেছিলাম। থামল হাসান তারিক।
-তাহলে আহমদ ইয়াংরা তাঁকে কিডন্যাপ করেছিল কেন? বলল আহমদ মুসা।
-জনপ্রিয় ভাল একটি মুসলিম মেয়েকে গণ-আলোচনার অশ্লীল আসর থেকে সরিয়ে আনার জন্যে। এর পারিবারিক ঐতিহ্যের বিবেচনাও এখানে ছিল। আরো অনেক বখে যাওয়া মেয়ে আছে, তাদের ব্যাপারে এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আহমদ ইয়াং বলল।
আহমদ মুসা কোন কথা বলল না। জানালা দিয়ে তার দৃষ্টিটা বাইরে নিবদ্ধ। তারও চোখে ভেসে উঠেছে, কাশগড়ে থানার সামনে মেইলিগুলির কথা বলার দৃশ্য। এরপর সেদিন আহত আহমদ মুসাকে তার গাড়িতে তুলে নেয়া এবং তার পরবর্তীকালের সব ঘটনা, সব কথা।
একটু নিরবতা। তারপর আহমদ মুসা ইউসুফের দিকে চেয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছি আমরা ইউসুফ?
-আমরা ঠিক করেছি, প্রথমে আমরা আমাদের শহীদ পার্কে যাব।
-কতদূর এখান থেকে?
-বেশী দূর নয়। এসে গেছি। আর কয়েক মিনিট।
-শহরের এই এলাকা নতুন বোধ হয় না?
-হ্যাঁ কম্যুনিষ্টরা এই অভিজাত এলাকাটা গড়েছে তাদের ওপরতলার লোকদের জন্যে।
গাড়ি উরুমচির নতুন এলাকা পেরিয়ে পুরাতন এলাকায় প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা চোখ ভরে যেন দেখছিল চারদিকটা। বলল, ইউসুফ পুরানো উরুমচির তো দেখছি কোন পরিবর্তন হয়নি?
-আপনি এসেছেন উরুমচিতে মুসা ভাই? বলল ইউসুফ।
-কেন আসব না? দু’বার এসেছি। আব্বা সরকারী কাজে উরুমচি এসেছিলেন। তার সাথে আমি এসেছিলাম।
-মনে পড়ে বাড়ির কথা মুসা ভাই? বলল আহমদ ইয়াং
-সে স্মৃতি কি ভুলবার মত ইয়াং! কিন্তু দু’চোখে সেই বাড়ি, সেই পরিবেশ তো আর দেখতে পাবে না। আমরা যখন সেখান থেকে হিজরত করি, তখন আমাদের জনপদ, ছোট্ট নগরী একটা ভাঙ্গা ইট পাথর আর ছাই- এর স্তুপে পরিণত হয়েছিল। জানি না সেখানকার অবস্থা কিরূপ আজ!
-যেতে ইচ্ছে করে না সেখানে?
-অবশ্যই। মাঝে মাঝে ভাবি ওখানে গেলে ওখানকার পাহাড়, উপত্যকা আর ফসলের মাঠে বোধ হয় আমার বাল্য ও কৈশোরকে দু’চোখ ভরে আমি দেখতে পাব।
আহমদ মুসার কন্ঠস্বরটা গম্ভীর শোনাল। তার চোখের দৃষ্টিটা শূন্যে। মনে হল স্মৃতির পাতা হাতড়াতে গিয়ে মনের কোন গহনে হারিয়ে গেছে সে।
শহীদ পার্কে এসে গাড়ি প্রবেশ করল।
নাম পার্ক কিন্তু যাকে পার্ক বলে তার কোন চিহ্ন নেই। উন্মুক্ত একটা মাঠ। মাঠের চারদিক দিয়ে কাঁটা গাছের বেষ্টনী। মাঠের মাঝখানে নানা রকমের পাথর সাজিয়ে একটা মিনারের মত দাঁড় করানো হয়েছে। মিনার থেকে কয়েকগজ পশ্চিমে একটা বিল্ডিং এর ধ্বংসাবশেষ। সে ধ্বংসাবশেষের উপর বেড়া ঘেরা টিনের একটা মসজিদ। এর সামনে মানুষ সমান উঁচু হয়ে একটা মিনারের ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে।
শহীদ পার্কে, পার্কের কিছুই নেই বটে, কিন্তু উরুমচি এবং এই এলাকায় মুসলমানদের জন্যে এই পার্ক সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন মানুষ এখানে আসে। ঐ ভাঙ্গা মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে। তারপর পাথরের ওপর পাথর রেখে তৈরী মিনারের মত সেই পাথরের স্তুপটার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ মৌনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। কারো চোখে মুখে বিস্ময়, কারো চোখে জ্বলে ওঠে প্রতিশোধের আগুন এবং কারও চোখ থেকে গড়াতে থাকে অশ্রু। কুখ্যাত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ইতি ঘটার পর থেকে উরুমচির সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত এই শহীদ পার্কেই অনুষ্ঠিত হয়।
আহমদ মুসাদের গাড়ি গিয়ে পাথর সাজিয়ে গড়া সেই মিনারটার কাছে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নামল সবাই। গাড়িটা বন্ধ করে ইউসুফ চিয়াং নামল সবার পরে।
ততক্ষনে আহমদ ইয়াং আহমদ মুসা ও আবদুল্লায়েভকে নিয়ে মিনারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহমদ ইয়াং বলল, মুসা ভাই, পাথরের ওপর পাথর দিয়ে গড়া এই এবড়ো-থেবড়ো স্তুপটাকেই সকলে শহীদ মিনার বলে। এখানেই আমাদের ইউসুফ চিয়াং এর আব্বা কাজাখ নেতা ওসিমানকে কম্যুনিষ্টরা ফাঁসি দেয়। আপনি নিশ্চয় দেখেছেন, ঐ যে সামনে ওখানে উরুমচির সবচেয়ে বড় মসজিদ ছিল এবং এই উন্মুক্ত স্থান ও এর আশে পাশে ছিল কাজাখ ও উইঘুর মুসলমানদের এক বিরাট বসতি। কম্যুনিষ্টরা সেদিন এলাকার মুসলিম নারী, শিশু ও বৃদ্ধের কোমরে দড়ি বেঁধে সবাইকে এই মসজিদের সামনে হাজির করেছিল এবং তাদের চোখের সামনে তাদের মুক্তি আন্দোলনের নেতা ওসিমানকে এই জায়গায় ফাঁসি দেয়। যুবকরা সবাই তখন পাহাড়ে পালিয়ে মুক্তি আন্দোলনে শরিক হয়। এই মর্মান্তিক হত্যাকান্ড দেখে অসহায় বৃদ্ধ, নারী, শিশুরা ডুকরে কেঁদেছিল। ফাঁসি দিয়ে হত্যার পর ওসিমানের লাশ তারা একটা লম্বা কাঠের দন্ডে এখানেই টাঙ্গিয়ে রাখে। সেদিন সন্ধ্যা নামলে মুক্তি সংগ্রামীরা পাহাড় থেকে নেমে আসে এবং লাশ নিয়ে ঐ পাহাড়ে দাফন করে। থামল আহমদ ইয়াং।
সবাই নিরব। সবার বিষন্ন চোখে যেন একটা শুন্য দৃষ্টি। সবারই মন যেন হারিয়ে গেছে কোন দূর অতীতে।
ওসিমান চীনা মুসমানদের একটা প্রিয় নাম, সংগ্রামী চেতনার একটা প্রতীক। সিংকিয়াং যখন কম্যুনিষ্ট কবলে চলে গেল, উরুমচির ওপর যখন তাদের বিষাক্ত থাবা এসে চেপে বসল, তখন শেষ প্রতিরোধের জন্যে সংঘবদ্ধ হলো এলাকার কাজাখ ও উইঘুর মুসলমানরা। এদের নেতৃত্ব দিলেন ঈমান দীপ্ত, নির্ভীক কাজাখ নেতা ওসিমান। ওসিমানের ফাঁসি আন্দোলনের ক্ষতি করেছিল, কিন্তু আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে পারেনি। বহু বছর কম্যুনিষ্টরা শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। কার্যকর কোন শাসন কাঠামো দাঁড় করাতে পারেনি। ওদের হিসেবেই কম্যুনিষ্টদের দুই শ’ চারটি নির্বাচন প্রচেষ্টা মুক্তি সংগ্রামীরা নস্যাত করে দেয়।
আহমদ ইয়াং সবাইকে নিয়ে চলল ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশাল মসজিদ বিল্ডিং এর কোণে দাঁড়ানো বেড়া দিয়ে তৈরী সেই মসজিদের কাছে।
আহমদ ইয়াং বলল, ওসিমানকে ফাঁসি দেয়ার দু’দিন পর বিদ্রোহীদের আড্ডা আখ্যা দিয়ে কম্যুনিষ্টরা মসজিদ বিল্ডিংটি ভেঙ্গে সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। মসজিদের গগণভেদী বিশাল মিনার আপনি দেখেছেন, দেখুন এখন ঐটুকু অতীতের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে।
মসজিদ ভাঙ্গা এবং এর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় মুসলমানদের মধ্যে। বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরাও পাগলের মত রাস্তায় নেমে আসে। সেই রাতেই কম্যুনিষ্টরা জ্বালিয়ে দেয় গোটা জনপদ। অনেকেই পুড়ে মারা যায়। গোটা উরুমচি যেন তারপর এক বিরাণ প্রান্তরে পরিণত হয়। সেই থেকে এই মাঠে কোন জনপদ গড়ে ওঠেনি। হান গোষ্ঠীর জনপদ গড়ে তোলার চেষ্টা কম্যুনিষ্টরা বারবার চালায়, কিন্তু মুসলমানদের অব্যাহত প্রতিবাদের মুখে কোন বসতিই এখানে তাদের স্থায়ী হয়নি। অবশেষে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরে কিছু অধিকার ফিরে পাওয়ার পর মুসলমানরা এই শহীদী ঈদগাহকে একটি পার্কের রূপ দিয়েছে।
সেই ভাঙ্গা টিনের মসজিদে সকলে দু’রাকাত নফল নামায পড়ল। সবাই একসাথে হাত তুলল দোয়ার জন্য। দোয়া করল তারা শহীদ ওসিমান এবং জানা-অজানা সব শহীদানদের জন্যে। দোয়া করল তারা মুসলমানদের মুক্তির জন্যে এবং তাদের মুক্তি সংগ্রাম ‘এম্পায়ার গ্রুপ’কে মনজিলে মকসুদে পৌছার তৌফিক দেয়ার জন্যে।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে তারা গোটা মাঠটা একবার ঘুরল। তারপর ফেরার সময় আবার সেই ভাঙ্গা মসজিদের কাছে এসে দাঁড়াল। আহমদ মুসা বলল, তোমরা মসজিদটিকে তার সাবেক ভিত্তির ওপর পুনর্ণির্মান কর। এ সমজিদের নাম হবে ‘শহীদ ওসিমান মসজিদ’। শহীদের জন্য আলাদা কোন শহীদ মিনারের প্রয়োজন নেই। শহীদ মিনারের স্থানসহ মসজিদের সামনে একটা ফুলের বাগান করে দাও।
ইউসুফ চিয়াং বলল, অতীতে অনুমতি লাভ একটা সমস্যা ছিল বটে, কিন্তু টাকাও একটা সমস্য ছিল। ইনশাআল্লাহ মসজিদটি গড়তে এখন আর আমাদের কোন অসুবিধা হবে না।
আহমদ মুসারা তাদের গাড়িতে উঠে বেরিয়ে এল শহীদ পার্ক থেকে।
গাড়ি এগিয়ে চলছিল তখন মার্কস এভিনিউ দিয়ে। এ রাস্তাটির নাম আগে ছিল ‘সাতুক বোগরা খান রোড’। কম্যুনিষ্টরা এ মুসলিম নাম পরিবর্তন করে এই নতুন রাম রাখে। এ রাস্তারই শেষ মাথায় সিংকিয়াং এ প্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল করিম সাতুক বোগরা খানের প্রাসাদ। প্রাসাদটি এখন উরুমচি কম্যুনিষ্ট পার্টির ফার্ষ্ট সেক্রেটারীর বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাড়িটি দেখার জন্যেই যাচ্ছিল আহমদ মুসারা। ড্রাইভ করছিল ইউসুফ চিয়াং।
শহরের এই এলাকাটা জনবিরল। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছিল আহমদ মুসাদের গাড়ি।
অনেকক্ষণ ধরেই ইউসুফ চিয়াং গাড়ির রিয়ার ভিউ এর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল। রিয়ার ভিউ-এ অনেকক্ষণ ধরে একটা গাড়িকে সে দেখছে। গাড়িটি সমান দুরত্ব বজায় রেখে আসছিল। গাড়ির গতি বাড়িয়ে, কমিয়ে সে দেখল ও গাড়িটারও গতি সমানতালে বাড়ছে, কমছে। তাহলে ওরা কি আমাদের অনুসরণ করছে?
আরও একটু পর্যবেক্ষণ করার পর ইউসুফ চিয়াং আহমদ মুসাকে বলল, মুসা ভাই, মনে হচ্ছে একটা গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।
– কি গাড়ি?
– ফোর্ড কার।
– সরকারী, না বেসরকারী?
– সরকারী নয়।
আহমদ মুসা চারদিকে একবার দৃষ্টি ফেরাল। দেখল মার্কস এ্যাভিনিউ থেকে একটা রাস্তা ডানদিকে বেরিয়ে উপত্যকার দিকে চলে গেছে। আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল, ডানদিকের রাস্তাটা কোথায় গেছে ইউসুফ?
– মাইল পাঁচেক ঘুরে একটা খামার ঘুরে রাস্তাটা আবার এই মার্কস এভিনিউ এর গোড়ায় গিয়ে মিশেছে।
– ঠিক আছে গাড়ি তুমি ডান দিকে ঘুরিয়ে নাও। গাড়ী ধীরে চালাও। লোকালয় থেকে সরিয়ে নিয়েই দেখতে হবে ওকে।
ইউসুফ গাড়ি ঘুরিয়ে ডাইনের রাস্তা দিয়ে চলল। রাস্তাটা খুব প্রশস্ত নয়। খুব বেশী হলে তিনটা গাড়ি পাশাপশি চলতে পারে।
গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার পর অনুসরণকারী গাড়িটি রিয়ার ভিউ থেকে হারিয়ে গেল। কিন্তু মিনিট তিনেক পরই আবার রিয়ার ভিউ-এ ধরা পড়ল গাড়িটি।
ইউসুফ চিয়াং খবরটা জানাল আহমদ মুসাকে।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, সামনে রাস্তা মোড় ঘুরেছে দেখতে পাচ্ছি। ওখানে গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে চল।
আর কিছুটা এগিয়ে মোড়ে গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল ইউসুফ। তারপর আবার মার্কস এ্যাভিনিউ এর দিকে ফিরে চলল।
ইউসুফের গাড়ি ঘুরিয়ে নিলে অনুসরণকারী গাড়িটি মহূর্তের জন্যে থেমে গিয়েছিল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যেই। তারপর আবার সমান গতিতে চলতে শরু করল।
আহমদ মুসা পেছনের গাড়িটির দিকে তাকিয়েছিল। বলল ইউসুফ, আর কোন সন্দেহ নেই ওটা ফেউ গাড়ি।
তারপর হাসান তারিকের দিকে চেয়ে বলল, তোমার এম-১০ রেডি?
-হ্যাঁ।
-ওরা দু’জন লোক। সামনেই বসেছে। অফেনসিভে নাও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ওদের গাড়ি অতিক্রম করার পর ওদের চাকা ফাটিয়ে দেবে, এবং সংগে সংগে আমাদের গাড়িও থেমে যাবে এবং আমরা নেমে পড়ব। ওদের মারা নয় ধরতে চাই। আর যদি ওরা আক্রমণ করতে চায় তোমার এম-১০ যেন ওদের সে সুযোগ না দেয়। ওদের গাড়ির যে পজিশন তাতে ওদের ডান দরজা দিয়ে গুলি আসবে না। আসলে তা বাম জানালা দিয়ে ড্রাইভারের হাত থেকেই আসবে। তোমার এম-১০ তৈরী রেখে খেয়াল রাখ ওদের বাঁ জানালার দিকে।
বলে আহমদ মুসা ছোট দূরবীন তুলে দিল হাসান তারিকের হাতে।
হাসান তারিক ওটা চোখে লাগাল।
আহমদ মুসাদের গাড়ির মাথা যখন অনুসরণকারী সামনের গাড়িটার পয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে গিয়ে পৌঁছল, তখন হাসান তারিকের চোখে ধরা পড়ল ও গাড়ির ড্রাইভারের ডান হাতটা ষ্টিয়ারিং হুইল থেকে নিচে নেমে গেল, তারপর তা উঠে এল জানালায়। একটি রিভলভারের কালো নল তার চোখে ষ্পষ্ট হয়ে উঠল।
হাসান তারিক আর দেরী করা ঠিক মনে করল না। হাসান তারিকের ডান হাতে এম-১০ রেডি ছিল। গর্জে উঠল তার এম-১০। ওপক্ষের রিভলভারও গর্জে উঠেছিল। কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টির মত এক পশলা গুলি গিয়ে ঘিরে ধরেছিল ঐ গাড়িটিকে। গুড়ো হয়ে গিয়েছিল ওদের গোটা উইন্ড শিলড।
আর ওপক্ষের গুলিটি এসে বিদ্ধ হয়েছিল আহমদ মুসাদরে গাড়ির এক ইঞ্চি ওপরে। বোঝা গেল ড্রাইভিং সিটের ইউসুফ ছিল ওদের প্রথম টারগেট।
হাসান তারিকের গুলি বৃষ্টি যখন থামল, তখন আহমদ মুসাদের গাড়ি সামনের গাড়ির সমান্তরালে এসে গেছে। দেখা গেল, ওদের ড্রাইভার তার সিটেই ঢলে পড়ে গেছে। আর অন্যজনের দেহের অর্ধেকটা গড়িয়ে পড়ে গেছে বাইরে। বোধ হয় সে দরজা খুলে জাম্প দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সময় হয়নি।
গাড়ি থামিয়ে ইউসুফ নেমে পড়ল। তাড়াতাড়ি ওগাড়ির দরজা খুলে ইউসুফ ড্রাইভার লোকটার কলার ব্যান্ড উল্টিয়ে এক নজর দেখেই আহমদ মুসার দিকে ফিরে তাকাল। আহমদ মুসারাও তখন গাড়ি থেকে নেমেছে। ইউসুফ বলল, এরা ‘রেড ড্রাগন’ এর সদস্য।
-এরা আমাদের পিছু নিল কেন? বলল আহমদ মুসা।
-এরা একই সাথে সরকার এবং ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ তখা মুসলিম স্বার্থের বিরোধী। এ ছাড়া ‘ফ্র’ এবং ‘রেড ড্রাগন’ এরা এখন ঘনিষ্ঠ মিত্র।
তাড়াতাড়ি গাড়ি এবং তাদের পকেট সার্চ করে যে কাগজপত্র পেল, তা নিয়ে আহমদ মুসারা গাড়িতে উঠল।
গাড়িতে উঠে আহমদ মুসা বলল, পুলিশ এসে কিছু কি বুঝবে?
-বুঝবে। ওদরে জামার কলার ব্যান্ডে রেড ড্রাগন-এর প্রতীক রেড ড্রাগনের মুখ আঁকা আছে।
-আচ্ছা, ওদের মতলবটা কি ছিল আঁচ করতে পার?
ইউসুফ চিয়াং এর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
-আমার মনে হয় এটা ওদের কোন পরিকল্পিত ব্যাপার নয়। শহীদ পার্ক থেকেই ওরা আমাদের পিছু নিয়েছে। সম্ভবত আমাকে ওরা চিনতে পারে এবং ঠিকানা উদ্ধারের জন্যে পিছু নেই।
-আমারও তাই ধারণা। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা আর কোন কথা না বলে ওদের কাছ থেকে পাওয়া কাগজের দিকে মনোযোগ দিল।
অধিকাংশ কাগজই অপ্রয়োজনীয়। এ সবের মধ্যে রয়েছে পরিবারিক হিসেব-নিকেশ, সিনেমার টিকেট, গোপন লটারীর কুপন, ইত্যাদি। কাগজপত্রের মধ্যে মুখবন্ধ নয়- পোষ্টাল একটি ইনভেলাপ এবং ছোট একটি চিরকুট পেল। চিরকুটটিতে একটি মাত্র লাইন শুধু। বলা হয়েছে, ‘লেলিন স্কোয়ারের দশ নম্বরে বৈঠক রাত বারটায়।’ আর ইনভেলাপটি ফেড়ে পাওয়া গেল একটি চিঠি। ঠিক চিঠি নয় রিপোর্টের মত। বক্তব্যের শেষে ‘সু সাং’ নামের একটি দস্তখত ছাড়া কোন সন্ধান নেই।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “শিহেজী উপত্যকার অবস্থা ভাল নয়। সরকার ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর সাথে রক্তপাত এড়িয়ে চলতে চায়। আমরা লোক পাঠিয়েছি, আমরা ছাড়ব না। এদিকে, ‘ফ্র’ এর সব ঘাঁটি ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ ধ্বংস করে দিয়েছে। জেনারেল বোরিসের সব সোনা এখন তাদের দখলে। আহমদ মুসাও মুক্ত। মুশকিল হয়েছে আমাদের কোন লোক আহমদ মুসাকে দেখেনি, জেনারেল বোরিস দেখাননি। তাই আমাদের কোন করণীয় দেখছি না। কিন্তু ‘এম্পায়ার গ্রুপে’র সাথে আহমদ মুসার সম্মেলন আমাদের বিপদ ঘটাবে। আমি চেষ্টা করছি এম্পায়ার গ্রুপ-এর ঠিকানায় পৌছার জন্যে। শহীদ পার্ক, ইবনে সাদ মসজিদ, ইমাম বোখারী মাদ্রাসা সহ তাদের আসা যাওয়ার সব জায়গায় সার্বক্ষণিক লোক বসিয়েছি। কিন্তু মুশকিল হয়েছে মুসলমানদের মধ্যে অমুসলমান চীনাদের অবস্থান খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যায়।” আহমদ মুসা চিঠি ও চিরকুট ইউসুফ চিয়াং এর হাতে দিল। ইউসুফ চিয়াং গাড়ি চালানোর ফাঁকে চিরকুট ও চিঠিটা পড়ে নিল। পড়ে বলল, মুসা ভাই, চিরকুটটা আমরা পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেই। রেড ড্রাগনকে শায়েস্তা করার জন্য পুলিশই যথেষ্ট, ওরা হন্যে হয়ে ওদের খুঁজছে।
আহমদ মুসা বলল ঠিক আছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার পলিসি মন্দ নয়।
-মুসা ভাই, ইবনে সাদ মসজিদে আমাদের মাগরিবের নামায পড়ার ইচ্ছা বোধ হয় পরিত্যাগ করতে হয়। বলল ইউসুফ চিয়াং।
-জানতাম তুমি এ কথা বলবে। ঠিক আছে।
-আমরা ওদেরকে অন্ধকারেই রাখতে চাই। শহীদ পার্ক, ইবনে সাদ মসজিদ এবং ইমাম বোখারী মাদ্রাসা এলাকা থেকে ওদের ফেউদের পাকড়াও করার ব্যবস্থা আজকেই করছি।
-তাহলে চল এখন ফেরা যাক ইউসুফ।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, শিহেজী উপত্যকার যে কথাটা লিখেছে তা পড়েছ তো?
-পড়েছি। গন্ডগোল ওখানে একটা হবেই। চিন্তান্বিত কন্ঠস্বর ইউসুফ চিয়াং এর।
গাড়ি ছুটে চলল ইবনে সাদ রোডের দিকে। গাড়ি যখন মেইলিগুলির বারান্দায় প্রবেশ করল, তখন দূরের মসজিদে মাগরিবের আযান হচ্ছে। নামায পড়া শেষে জায়নামায তুলতে তুলতে মা-চু বলল, মা মনি বলেছেন সবাই না পারলেও অন্তত দু’জন মেহমানকে এখানে থাকতে। পাশের ঘরে ওঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আহমদ মুসার খুব ভালো লাগল এই প্রস্তাবটা। মনটা যেন তার এর অপেক্ষা করছিল।
আহমদ মুসা তাকাল ইউসুফের দিকে।
ইউসুফ বলল, মুসা ভাই এ রকম কিছুর কথা আমিও চিন্তা করছিলাম। এভাবে একা একা থাকা আপনার ঠিক নয়।
-কে কিংবা কারা এখানে থাকবে বল।
-আমি মনে করি, হাসান তারিক ভাই এবং আহমদ ইয়াং এখানে থাকুক।
-ইউসুফ চিয়াং এর প্রস্তাব ভাল। বলল আবদুল্লায়েভ।
-ঠিক আছে, রাত্রে এসে থাকা যাবে, কিন্তু এখন তো আমাদের বাইরে বেরুতে হবে ইউসুফ, বলল হাসান তারিক।
-হ্যাঁ তারিক ভাই, যে তথ্যগুলো পাওয়া গেছে, ওগুলোর ব্যাপারে একটু মনোযোগ দেয়া দরকার। এ সময় নাস্তার খবর এল।
হাসান তারিকরা চারজন নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে গেল।
আহমদ মুসা তার ঘরে ফিরে এল। দেখল তার বিছানার ওপর এক সেট কাপড়।
মা-চু’র দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, এগুলো এখানে কেন মা-চু?
-আপনার পোশাক পাল্টাবার জন্যে।
-কেন?
-বাইরে থেকে এসেছেন, ওগুলোর মধ্যে ইনফেকশনের কিছু থাকতে পারে।
-কে বলেছে?
-মা মনি বলেছেন।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। বলতে চাইল, তোমার মা মনি কি আমাকে ননির পুতুল মনে করে? কিন্তু তার মনে একটি জিনিস বিধল, সব দিক পাহারা দেবার, সবদিকে নজর রাখার অদ্ভুত যোগ্যতা ওর আছে।
আহমদ মুসা ড্রেসিং রুম থেকে পোশাক পরে ফিরে এসে বলল, তোমার মা মনি কেমন আছে মা-চু?
-বিকেলে জ্বর ছেড়ে গেছে। আজ সারা বিকেল মা মনি খালাম্মার কাছে কোরআন শরীফ পড়েছে। জানেন, মা মনি নামাজও পড়ে?
-তোমার মা মনি বোধ হয় খুব ভাল তাই না?
-না খালাম্মার এ সব কথায় সে কোনই পাত্তা দিত না। আপনি আসার পর ভাল হয়ে গেছে।
-কেন?
-আপনাকে ভয় করে।
-ভয় করবে কেন?
-করে, এই দেখুন, বিকেলে মা মনি এসে এ ঘর ঠিকঠাক করে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমকে নিষেধ করেছে আপনাকে বলতে।
-আমি যদি এখন বলে দিই তোমার মা মনিকে?
-বলবেন না আমি জানি।
-কেমন করে জান?
-আপনি খুব ভাল, মা মনি বলেছে।
-তোমার মা মনি বললেই হল?
-আমার মা মনি অনেক জানে। মা মনি মিথ্যা বলে না।
-ঠিক আছে। শোন, তোমার মা মনিকে বলো, ওর গাড়ির উইন্ড শিল্ডের ওপরে একটা গুলি লেগে কিছু ক্ষতি হয়েছে।
মা-চু দু’চোখ ওপরে তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় বাইরে তার ডাক পড়ল। গলাটা মনে হল মেইলিগুলির।
মা-চু ছুটে বাইরে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর ফিরে এল মা-চু।
আহমদ মুসা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ঘরে ঢুকে মা-চু বলল, স্যার খালাম্মা এখানে আসবেন।
আহমদ মুসা উঠে বসল। বলল, খালাম্মা মানে দাদি?
-হ্যাঁ।
-হাঁটতে কষ্ট হয় তাঁর। আমিই তাঁর কাছে যাব। উনি ঘরে আছেন এখন?
-হ্যাঁ।
আহমদ মুসা উঠল। মা-চুকে সাথে নিয়ে বেরুল ঘর থেকে।
দাদির ঘরে সুন্দর একটি শোবার ডিভান। ডিভানের সামনে দু’পাশে দু’টি করে চারটি সোফা।
একপাশে দু’টি করে চারটি সোফা।
একপাশে দু’টি সোফায় দাদি এবং মেইলিগুলি পাশাপাশি বসে গল্প করছিল। এমন সময় দরজায় এসে দাঁড়াল মা-চু। বলল, স্যার ঘরে আসবেন।
-দাদি তোমাকে বলেছেন না, দাদিই ওখানে যাবেন? বলল মেইলিগুলি।
-সেটা বলেছি আমি স্যারকে, বলল মা-চু।
ইতিমধ্যে দাদি উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভাই, এস ঘরে এস।
আহমদ মুসা ঘরে ঢুকে সালাম দিল। মেইলিগুলিও উঠে দাঁড়িয়েছিল। একরাশ লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে তার মুখ। সে তার গায়ের চাদর টেনে নিয়েছে মাথার উপর। কপালও ঢেকে গেছে সে চাদরে।
সে সরে গিয়ে ডিভানের কোণায় জড়সড় হয়ে বসে পড়ল।
আহমদ মুসা গিয়ে আরেক পাশের সোফায় দাদির মুখোমুখি হয়ে বসল। দাদীই প্রথম কথা বলল, কেমন আছ ভাই?
-ভাল আছি, দাদী।
-খারাপ থাকলে কি তোমরা বলবে, বল?
-আল্লাহ মানুষকে কোন সময় খারাপ রাখেন না, দাদী।
-কেন মানুষতো দুঃখ-কষ্ট ও রোগ শোকে পড়ে।
-তা পড়ে, কিন্তু ওটা তার জন্যে খারাপ অবস্থা নয়। দুঃখ-কষ্ট রোগ-শোকের মধ্যেও মানুষের মঙ্গল নিহিত থাকতে পারে সে কথা আমি যদি নাও বলি, তবু এ কথা বলা যায়, জীবন-নাট্যের এ গুলো বিভিন্ন দৃশ্য। জীবনের সাথে এর প্রয়োজন অবিচ্ছেদ্য। দুঃখ না থাকলে সুখ হতো না দাদী।
-তাই বলে দুঃখকে বরণ করে নেয়া যায়?
-মানুষ ভালোর জন্য চেষ্টা করবে এটাই আল্লাহর ইচ্ছা। দুঃখ যেহেতু ‘ভাল নয়, তাই একে স্বাগত জানানোর প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ‘ভাল’র জন্য চেষ্টা সত্বেও দুঃখ যদি আসেই এবং তাকে সানন্দে বরণ করে নেবার মত ধৈর্য যদি থাকে তাহলে দুঃখকেও এক প্রকার সুখে পরিণত করা যায়।
দাদী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আহমদ মুসার দিকে। বলল, এ জ্ঞানের জন্য অনেক বড় হওয়া প্রয়োজন। এ সৌভাগ্য ক’জনের আছে।
আহমদ মুসা মাথা নেড়ে বলল, না দাদী তা ঠিক নয়। কুড়েঘড়ে মাটিতে শুয়ে একজন অজ্ঞ মানুষ ভাবনা-চিন্তাহীন নির্মল হাসি হাসতে পারে, অন্যদিকে একজন বালাখানার বাসিন্দার জীবনে নির্মল হাসির সুযোগ নাও ঘটতে পারে। আসলে প্রকৃত সুখ হৃদয় নির্ভর, বাইরের অবস্থার নির্ভর করে না। আর এ হৃদয়ের মালিক তো সকলেই।
আহমদ মুসা দৃষ্টি নিচু রেখে কথা বলছিল। দাদি তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়েছিল। মেইলিগুলির উজ্জ্বল দৃষ্টিও ছিল ওর প্রতি নিবদ্ধ।
আহমদ মুসা থামলেও দাদী কিছু বলল না। ভাবছিল। একটু পরে বলল, ঠিক বলেছ ভাই।
দাদী আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় কাজের ছোট মেয়ে দরজায় আবির্ভূত হয়ে বলল, দাদী গরম পানি রেডি।
দাদী আহমদ মুসাকে বলল, একটু বস আমি এখনই আসছি
বলে উঠতে উঠতে দাদী মেইলিগুলি বলল, ওভাবে কোণায় ঢুকছিস কেন? একটু কথা বল আমি আসছি।
দাদী বেরিয়ে গেল।
দু’জনেই নিরব। আহমদ মুসার মুখ নিচু, মেইলিগুলিরও।
অস্বস্তিকর নিরবতা ভেঙ্গে আহমদ মুসাই প্রথম কথা বলল। বলল সে, তোমার গাড়ির ক্ষতি হয়েছে দেখেছ?
মেইলিগুলি মাথা নিচু করে দু’হাতে ওড়নার খুট ধরে নাড়া চাড়া করছিল। আহমদ মুসার কথা শেষ হবার একটু পর বলল, আপনার এভাবে বাইরে যাওয়া ঠিক নয়।
-বাইরেইতো আমার কাজ।
-আপনি আগে সুস্থ হোন।
একটু দম নিল মেইলিগুলি। তারপর বলল, আজ সেখানে যদ বেশি হাঁটা কিংবা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার প্রয়োজন হতো, তাহলে কি…
কথা শেষ করতে পারলো না মেইলিগুলি। ভারী হয়ে ওঠা কন্ঠটি তার রুদ্ধ হয়ে গেল। মুখটা তার নিচু ছিল, আরও নিচু হয়ে গেল।
আহমদ মুসা তার মুখটা মেইলিগুলির দিকে তুলতে গিয়েও আবার নামিয়ে নিল।
তার হৃদয়ের অন্তঃপুরে এক নরম অনুভুতি হঠাৎ করে মাথা জাগাল। এমন সহৃদয় নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি সেতো কোন দিন হয়নি। তাকে নিয়ে এমন সজল উদ্বেগও তার কাছে অপরিচিত।
আহমদ মুসা মেইলিগুলির কথার কোন জবাব দিতে পারলো না।
মেইলিগুলি মুখ নিচু করে বসেছিল।
আবার নিরবতা।
মেইলিগুলিই আবার মুখ খুলল। স্বগতঃ উক্তির মত ধীর কন্ঠে বলল, আমি আর স্টুডিওতে ফিরে যাব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আহমদ মুসা আবার মুখ তুলতে গিয়ে পারল না। মেইলিগুলির কথার শেষ ধ্বনিও অনেকক্ষণ মিলিয়ে গেছে বাতাসে। আরও পরে আহমদ মুসা ধীরে ধীরে বলল, কিন্তু অনেক কন্ট্রাক্ট তো তোমার রয়েছে।
-সব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সবটার জন্যে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব আমি।
-সেত বিরাট অংক।
-যে কোন ক্ষতি আমি স্বীকার করে নেব।
আহমদ মুসার চোখ যেন তার অজ্ঞতেই ওপরে উঠে গেল। পারবে তুমি এত সহজে তোমার ঐ জীবন থেকে ফিরে আসতে, মেইলিগুলি।
-আমি আর মেইলিগুলি নই আমি……. আমি `আমিনাগুলি’।
শেষ কথাগুলো তার প্রায় ভেঙ্গে পড়েছিল। মেইলিগুলির দু’চোখের কোণায় চকচক করছে অশ্রু।
এ সময় দাদি এসে ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল।
বসতে গিয়ে মেইলিগুলিকে চোখ মুছতে দেখে বলল, তোর আবার কি হল? চোখ মুছছিস যে?
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি বলল, দাদি, আপনার নাতনি স্টুডিওর কাজ ছেড়ে দিল।
‘ছেড়ে দিল, সত্যি?’ বলে দাদি মেইলিগুলির কাছে গিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরে বলল, সত্যি বোন ছেড়ে দিলি তুই?
-হ্যা দাদি। মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলল মেইলিগুলি।
দাদি মেইলিগুলিকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে অনেক চুমু খেয়ে বলল, বোন তোকে দোয়া করি, তুই আরও বড হ, তোকে আল্লাহ্‌ আরও সৌভাগ্য দান করুন।
দাদি এসে সোফায় বসতে বসতে বলল, জান ভাই, আমার এ বোনটির মন এত ভাল, এত বুদ্ধি ওর। আমার একটাই রাগ ছিল ওর ওপর। আজ থেকে তাও …..
দাদি তার কথা শুরু করলে মেইলিগুলি উঠে দাঁড়িয়েছিল। বেরিয়ে যাচ্ছিল সে।
দাদি তার কথা শেষ না করেই বলল, যাচ্ছিস কোথায় আমিনা শোন। ভাইটিকে তো ও কথা বলাই হয়নি।
মেইলিগুলি কান দিল না এদিকে। ছুটে বেরিয়ে গেল।
ওর বেরিয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে দাদি বলল, লক্ষ্মী বোন আমার। যতখানি বেপরোয়া ছিল ততখানিই বদলে গেছে। এখন তোমার সামনেও বেরুতে চায় না।
তার পর মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, জান ও বোরখা তৈরী করতে দিয়েছে?
-খুশি হলাম। আহমদ মুসা বলল।
-খুশি হবেই এ কৃতিত্ব তোমার।
দাদির ঠোঁটে হাসি। আহমদ মুসা মুখ নামিয়ে নিল।
দাদিই আবার কথা বলল, শুন, আজ তুমি বাইরে গেলে পথে কি ঘটেছিল?আমিনা সেটা জানতে চেয়েছিল। এ জন্যই আমি তোমার ওখানে যেতে চেয়েছিলাম।
-না তেমন কিছু নয় দাদি। দু’জন শত্রু গাড়ি নিয়ে আমাদের গাড়ি ফলো করেছিল। ওদের সাথেই সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ওরা দু’জনই মারা গেছে।
-এত বড় ঘটনা, তবু কিছু না বলছ? তুমি জীবনের ভয় কর না?
-না দাদি, মুসলমানরা জীবনের ভয় করেনা। মৃত্যুর ফায়সালা তো আল্লাহ্‌র হাতে।
-ঠিক বলেছ ভাই। আমাদের অতীত তো এটাই।
একটু থামল দাদি। তারপর বলল, তবু আমিনাগুলি আনুরোধ করেছিল তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে বাইরে না যেতে।
-ঠিক আছে, ওকে বলবেন দাদি ওর কথা আমার মনে থাকবে। বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তাহলে আনুমতি দিন দাদি, আমি যাই। ‘বেশ এস’ বলে দাদিও উঠে দাঁড়াল।

শিহেজী উপত্যকা। সবুজ এক খণ্ড চাদর যেন। তিয়েনশান থেকে নেমে আসা একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে উপত্যকার মধ্য দিয়ে। নদীর দু’পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সবুজ গমের ক্ষেত। উপত্যকার প্রান্ত দিয়ে উইঘুর ও কাজাখ মুসলমানদের বসতি। দু’হাজার পরিবার এই উপত্যকায় বাস করত।
উপত্যকার মুখে অনেকখানি উপরে সবুজ বনানী ঘেরা পাহাড়ের কোলে বিরাট একটা হ্রদ। সেই হ্রদ থেকে প্রস্রবণ আকারে পানির স্রোত আছড়ে পডছে নিচের উপত্যাকায়। বলা যায় মিনি জলপ্রপাত। ওপরে তিয়েনশানের বরফমোড়া সফেদ শিরপা, তার নিচে সবুজ বনানীর অপরূপ বেষ্টনির মধ্যে বিশাল হ্রদ, হ্রদ থেকে সবুজ উপত্যকায় ঝরে পড়া রূপালী প্রস্রবণ। সব মিলিয়ে শিহেজী উপত্যকা সিংকিয়াং এর আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি। হ্রদ ঘিরে একটা পর্যটন কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। সবুজ বনানী ঘেরা কালো হ্রদে নৌবিহার এক আকর্ষণীয় বিষয়।
সবুজ শিহেজী প্রাচুর্যের দিক দিয়েও উল্লেখযোগ্য। পাহাড়ের কোলে হওয়া সত্তেও এর ভূ প্রাকৃতি এমন যে এখানে প্রচুর গম উৎপাদন হয়ে থাকে। এখানকার চাহিদা মিটিয়েও প্রচুর গম দেশের অন্যান্য অঞ্চলে পাঠানো হয়।
এই শিহেজী উপত্যকায় স্মরণাতীত কাল থেকে উইঘুর এবং কাজাখরা বাস করছে। এখানে শতকরা এক’শ ভাগই মুসলমান। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রের নামে এখানে কম্যুনিস্ট সরকার হান গোষ্ঠীর বহু অমুসলমান লোককে এনে বসিয়েছে। তাদের বসাবার জন্যে জমি এ্যাকুয়ারের মাধ্যমে যে উইঘুর ও কাজাখ মুসলমান পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদেরকে আর শিহেজি উপত্যকায় বসতি স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়নি। এইভাবে এখানে একদিকে মুসলমানদের সংখ্যা কমানো হয়েছে অন্যদিকে অমুসলমান চীনাদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পর্যটন এলাকাসহ শিহেজী উপত্যাকায় হানগোষ্ঠীর পাঁচ’শ পরিবার আসন গেড়ে বসেছে।
এরপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নাম দিয়ে উপত্যকার ওপর এলাকায় প্রায় দু’হাজার একর ফসলি জমি এ্যাকুয়ার করা হয়েছিল। শত প্রতিবাদ সত্তেও জাতীয় স্বার্থের নাম দিয়ে এই এলাকা থেকে মুসলমানদের জোর করে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অতীতের মত তারাও এই উপত্যকার অন্য কোথাও বসতি স্থাপনের অধিকার পায়নি, এমনকি তাদেরকে উপত্যকার আত্মীয় স্বজনদের আশ্রয়েও থাকতে দেয়া হয়নি। বাস্তুহারা হয়ে শত শত মুসলিম পরিবার অতি কষ্টের যাযাবার জীবন যাপন করছে।
কিন্তু সেই দু’হাজার একর জমিতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হলো না। গড়ে উঠতে লাগল বসতবাটি। আধুনিক প্যাটার্নের সুন্দর বাংলোতে ভরে গেল ঐ এলাকা। জানা গেল পাঁচশ হান পরিবার আসছে ওখানে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য। এই খবরে ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেল উপত্যকার মুসলিম অধিবাসিদের। এই হানরা এখানে এসে বসলে অমুসলমানদের সংখ্যা উপত্যকার মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হয়ে যাবে। উপত্যকার মুসলমানদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গেল, উপত্যকার গোঁটা জনপদ থেকেই এলাকার কম্যুনিস্ট সরকার মুসলমানদের তাড়াতে চায়।
উপত্যকার মুসলমানরা সম্মিলিতভাবে সরকারের এই উদ্যোগের প্রতিবাদ করল এবং দাবী করল যে, যেহেতু এখানে জল বিদ্যুৎ প্রকল্প হলো না, তাই এই জমি যাদের ছিল সেই বাস্তুহারাদের এনে এখানে পুনর্বাসন করা হোক? সেই সাথে তারা ঘোষণা করল, কিছুতেই আমরা এখানে হানদের বসতি স্থাপন করতে দেব না।
কিন্তু তাদের প্রতিবাদ ও দাবীর কোনই জবাব দিল না সরকার। বরং তারা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হলো আর সরকার পরিকল্পনা নিল সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে হানদের এনে এখানে বসানোর।
ওদিকে যে হান গোষ্ঠীর লোকরা এখানে আসবে তাদের সর্দার ওয়াংহুয়া এ এলাকা দেখে গেছে। এখানে সবুজ ফসলের হাতছানিতে তাদের চোখে লোভের আগুন চিকচিক করে উঠেছে। সেই সাথে তারা উইঘুর ও কাজাখদের ক্ষোভের আগুনও প্রত্যক্ষ করেছে। সব দেখে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুধু সরকারের উপর নির্ভর করলে তাদের তাদের চলবে না। মুসলমানদের সম্মিলিত দাবীর মুখে বর্তমান সরকারের গণতন্ত্রমুখী কেন্দ্র দুর্বল হয়ে পড়তে পারে, সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ফেলতেও পারে। সুতরাং ওয়াংহুয়া চরম মুসলিম বিদ্ধেসী কট্টর কম্যুনিস্ট ‘রেড ড্রাগনের’ সাহায্য প্রার্থনা করল। ‘রেড ড্রাগনের’ চোখ আগে থেকেই নিবদ্ধ ছিল। তারা এবার প্রস্তাব পেয়ে লাফিয়ে উঠল।
তারপর তারা উপত্যকার এক হাজার মুসলিম পরিবার কে কিভাবে মুঠোয় এনে হানদের নিরাপদে বসানো যাবে তার একটা পরিকল্পনা দাড় করাল।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়ে গেল তাদের।
সে দিন কয়েকটি ছায়ামূর্তি শিহেজী উপত্যকার মুসলিম জনপদে প্রবেশ করল। শিহেজী গ্রামের পাশ দিয়ে একটি পাকা রাস্তা শিহেজী লেকের দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তার ধারেই শিহেজীর জামে মসজিদ। এ জামে মসজিদ ছাড়াও কয়েকটি ওয়াক্তিয়া মসজিদ আছে উপত্যকার চারদিকে ছড়ানো শিহেজী গ্রামে। জামে মসজিদের পেছনে একটা গম ক্ষেতে গাড়ি লুকিয়ে রেখে তারা প্রবেশ করল গ্রামে।
ছায়ামূর্তি ছয়টি গ্রামের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের কয়েকটা নির্দিষ্ট বাড়ির সামনে গিয়ে ওঁৎ পাতল তারা। বাড়িগুলো কাজাখ ও উইঘুরদের উল্লেখযোগ্য কয়েক ব্যাক্তির, তারা শিহেজী উপত্যকায় হানদের পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম জনসাধারণকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তখন আযান হয়ে গেছে। ফজরের নামাজের জন্যে মানুষ উঠেছে। পুরুষরা নামাজের জন্য তৈরী হয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছে। গাছ-পালা ঘেরা জনপদে তখনও বেশ অন্ধকার।
ছয়টি ছায়ামূর্তি ওঁৎ পেতে আছে সেই ছয়টি গলির মুখে। তাদের হাতে রিভলভার। সাইলেন্সার লাগানো।
সব বাড়ি থেকেই মানুষ মসজিদে এল ঐ ছয়টি বাড়ি ছাড়া। নিঃশব্দ ছয়টি গুলির আঘাতে বাড়ির উঠানে ওদের লাশ লুটিয়ে পড়েছিল। মসজিদে মানুষ যখন নামাযে দাড়াচ্ছিল। রক্তাত্ত লাশ নিয়ে ছয়টি বাড়িতে তখন মাতম।
ছায়ামূর্তি ছয়টি পরে এসে জমা হল সেই মসজিদের সামনে। রিভলভার পকেটে রেখে ওরা কাঁধে ঝুলানো স্টেনগান তুলে নিল হাতে।
মসজিদে তখন জামায়াত শুরু হয়ে গেছে।
ছয়জনের চারজন মসজিদের উঠানে পাহারায় থাকল। আর দু’জন উঠে গেল মসজিদে। তখনও চারদিকটা স্বচ্ছ হয়ে উঠেনি। জনমানবহীন পথ।
একজন মুসল্লী জামায়াত ধরার জন্য দ্রত মসজিদের দিকে আসছিল। স্টেনগানধারী চারজন চীনাকে মসজিদের উঠানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে আঁৎকে উঠল।
মসজিদের দিকে সে আর না গিয়ে পেছন ফিরে দৌড় দিল এবং চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগল।
ঠিক এ সময় চারদিকের নিরবতা ভেঙ্গে পড়ল ব্রাস ফায়ারের শব্দে।
লোকটির চিৎকার এবং ব্রাস ফায়ারের শব্দে চারদিকে একটা আতংক ছড়িয়ে পড়ে। জামে মসজিদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় নারী ও বালক শিশু ছাড়া বড়দের প্রায় সবাই গিয়েছিল মসজিদে। যারা ছিল তারা মসজিদের দিকে ছুটল।
কিন্তু তারা যখন মসজিদের উঠানে পৌছল তখন গম ক্ষেতের সেই গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। কেউ কেউ ছুটে গেল গাড়ির দিকে। কিন্তু গাড়ি তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে তখন উত্তর দিকে, উরুমচির পথে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা গ্রাম এসে যেন ভেঙ্গে পড়ল জামে মসজিদে।
মসজিদের মেঝে রক্তে ডুবে গেছে।
ত্রিশটি লাশ এনে সারি করে রাখা হয়েছে মসজিদের চত্বরে। আহতের সংখ্যাও প্রায় পঞ্চাশের মত।
সেই ছয়টি লাশও মসজিদের চত্বরে আনা হল।
শোকের মাতম চারদিকে।
মসজিদের বারান্দায় ফেলে যাওয়া একটা চিঠি পাওয়া গেল, তাতে লেখাঃ ‘নতুন হান বসতির দিকে বাঁকা চোখে তাকালে এমনিভাবে দুনিয়া থেকেই উচ্ছেদ হয়ে যেতে হবে’। চিঠির শেষে স্বাক্ষর নেই, শুধু ‘লাল ড্রাগন’ আঁকা।

ইউসুফ চিয়াং শিহেজী উপত্যকার রক্তাক্ত ঘটনার বিবরণ শেষ করার পর চুপ করল।
সবাই চুপচাপ।
মসজিদের মেঝেতে জমে থাকা পুরু চাপ চাপ রক্তের জমাট স্রোতটা যেন তাদের সবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। ভেসে উঠেছে স্বজনহারা শত মানুষের বিলাপ ধ্বনি।
হাসান তারিক, আব্দুল্লায়েভ, আহমদ ইয়াং সবারই মাথা নিচু। আহমদ মুসার শূন্য দৃষ্টি বাইরে নিবদ্ধ।
মেইলিগুলির দু’তলার পারিবারিক ড্রইংরুমে বসে তারা কথা বলছে।
তখন বেলা আড়াইটা। আহমদ মুসা খেয়ে এসে এই ড্রইংরুমে দাদির সাথে আলাপ করছিল। সাথে ছিল হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং। এই সময়ই শিহেজী উপত্যকার দুঃসংবাদ নিয়ে ইউসুফ চিয়াং ও আব্দুল্লায়েভ প্রবেশ করে।
কথা শুরু হলে দাদি উঠে গেছে। ইউসুফ চিয়াং ও আব্দুল্লায়েভের চোখ-মুখ দেখেই বুঝেছে বড় ধরণের কিছু ঘটেছে।
দাদির কাছে খবর শুনে মেইলিগুলি এসে দাঁড়িয়েছে ড্রইংরুমের উত্তর পাশের পার্টিশন ডোরের ওপারে। ইউসুফ চিয়াং এর সব কথা তার কানে গেছে। আহমদ মুসার বেদনার্ত শূন্য দৃষ্টি সে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে। তার বুকটা কাঁপছে।
নির্বাক নিরবতার অবসান ঘটিয়ে আহমদ মুসাই প্রথম কথা বলল। সে বাইরে থেকে তার শূন্য দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে ইউসুফ চিয়াং এর উপর নিবদ্ধ করল। শুকনো মুখ, উস্কো-খুস্কো চেহারা ইউসুফ চিয়াং ও আব্দুল্লায়েভের।
আহমদ মুসা বলল, তোমরা এখন কোথেকে আসছ?
ইউসুফ চিয়াং বলল, মুসা ভাই, ইবনে সাদ মসজিদ এবং ইমাম বোখারী মাদ্রাসার সামনে থেকে ‘রেড ড্রাগনে’র যে দু’জন ধরা পড়েছে, ওদের কাছ থেকে রেড ড্রাগনের দু’টো ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছিলাম। মনে করেছিলাম ধীরে সুস্থে আজ রাতে সেখানে অভিযানে যাব। কিন্তু শিহেজীর খবর পাওয়ার পর আর থামতে পারিনি। আপনার অনুমতি নেবার সময় পাইনি। আব্দুল্লায়েভ ও লোকজনসহ সেখানেই গিয়েছিলাম।
-কি খবর?
-দুই ঘাটিতে মোট চৌদ্দজনকে পাওয়া গেছে! তার মধ্যে পাঁচজন মারা গেছে। অবশিষ্টদের ধরে ঘাটিতে পাঠিয়ে দিয়েছি। যারা ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে শিহেজীর অপারেশনে অংশ নেয়া লোকও আছে।
আহমদ মুসার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, মুবারকবাদ তোমাদের, ইউসুফ।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, তোমরা তো দুপুরে খাও নি?
-মুসা ভাই, অনেক জরুরী কথা আছে।
-হবে। আগে খেয়ে নাও।
আহমদ মুসা মা-চু কে ডাকল।
মেইলিগুলি দরজা থেকে সরে গেল রান্না ঘরের দিকে।
অল্পক্ষণ পরে মা-চু এসে ইউসুফ চিয়াং ও আব্দুল্লায়েভকে নিয়ে গেল খাবার ঘরে।
ওরা খেয়ে এলে আহমদ মুসা প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, আহতদের চিকিৎসার কি ব্যবস্থা হয়েছে?
-আহতদের মধ্য থেকে সকালতক আরো বিশজন মারা গেছে। সকালে সরকারী এম্বুলেন্স যায়। ওতে করে কিছু পাঠানো হয়েছে শিহেজী ট্যুরিস্ট হাসপাতালে, কিছু আনা হয়েছে উরুমুচিতে। বলল ইউসুফ চিয়াং।
কথা শেষ করে একটু থামল ইউসুফ চিয়াং। তারপর বলল, অবস্থা খুব ভয়াবহ, মুসা ভাই। আগামীকাল সকালে হানদের শিহেজীর ঐ পাঁচশ’ বাড়িতে এনে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। আমরা কি করব?
-তোমরা এখন কি চিন্তা করছ? আহমদ মুসা জিজ্ঞেস করল।
-হানদের কিছুতেই ওখানে বসতি স্থাপন করতে দেয়া যাবে না। যে হানদের ওখানে আনা হচ্ছে তারা রাজনৈতিক চরিত্রের। রেড ড্রাগনের যারা ধরা পড়েছে তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, ঐ হান গোষ্ঠী ও রেড ড্রাগনের যৌথ পরামর্শক্রমেই শিহেজী উপত্যকার হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে।
-মুকাবিলার কোন পথ চিন্তা করেছো?
-শিহেজীর যারা এসেছিল তাদের সাথে আলোচনা করেছি, আজ রাতে আমরা হানদের জন্যে গড়া ঐ নতুন জনপদ উড়িয়ে দিব। তাহলে ওদের আসাটা সাময়িকভাবে বন্ধ হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ পরে চিন্তা করা যাবে।
আহমদ মুসা ইউসুফ চিয়াং এর কথা শুনল। কোন কথা বলল না। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, শিহেজী উপত্যকা থেকে যারা এ পর্যন্ত উদ্বাস্তু হয়েছে তারা কোথায়?
-আশেপাশের উপত্যকায় তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
-আজ দিনের মধ্যে তাদের শিহেজী উপত্যকায় একত্রিত কর।
-রাতের মধ্যে তারা হানদের জন্যে তৈরী বাড়িতে উঠে যাবে।
ইউসুফের চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল সে আনন্দে লাফিয়ে উঠল আসন থেকে। সে ছুটে গিয়ে আহমদ মুসার একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, এই কথা আমাদের কারো মাথায় আসেনি, মুসা ভাই।
ইউসুফ চিয়াং সিটে গিয়ে বসতে বসতে বলল, তারপর আমরা এক সাথে হয়ে মুকাবিলা করব সরকারী বাহিনীর এবং বসতির জন্যে আসা হানদের।
-ঠিক বলেছ, তবে হানদের ঐ শিহেজী উপত্যকা পর্যন্ত আসতে দেয়া যাবে না।
-তাহলে?
-পথেই ওদের আটকাতে হবে আজ রাতে। খোঁজ নাও কোন পথে তারা আসছে।
-ঠিক বলেছেন মুসা ভাই।
ইউসুফ চিয়াং এর চোখে আর এক দফা আনন্দের ঢেউ খেলে গেল।
-ভাবছিল আহমদ মুসা।
চোখ দু’টি তার বোজা।
একটু পর চোখ খুলে সে বলল, ইউসুফ, তুমি এবং আব্দুল্লায়েভ রাতে শিহেজীর ঘটনা সামলাবে। আমি হাসান তারিক ও আহমদ ইয়াংকে নিয়ে হানদের অগ্রযাত্রার সামনে দাঁড়াব।
ইউসুফ চিয়াং এবং আহমদ ইয়াং এক সাথে বলে উঠল, আপনি অসুস্থ মুসা ভাই।
-না আমি অসুস্থ নই, সম্পূর্ণ সুস্থ।
একটা আবেগ জড়িত ধমকের সুর আহমদ মুসার কন্ঠে।
আহমদ মুসা একটু থামল। তারপর বলল, যে জাতির মানুষ এক হাত কাটা গেলে আরেক হাতে পতাকা ধরে রাখে, সে জাতির কারো অসুস্থতার অজুহাত খাটে না ইউসুফ, আহমদ ইয়াং।
সবাই নিরব। সবার মুখে দৃঢ় এক শপথের ছাপ।
মেইলিগুলি দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল তখনও। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল। অজ্ঞাতেই কখন যেন দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছে সে। ‘আমি অসুস্থ নই, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ’-আহমদ মুসার এই উক্তি তার বুকে বেজেছে, কিন্তু বীরোচিত এই বক্তব্য আরো ভাল লেগেছে তার। আর আহমদ মুসার শেষ কথাগুলো তার চোখের সামনে জাতির এক নতুন রূপ তুলে ধরল।
নিরবতা ভেঙ্গে আহমদ মুসাই প্রথম কথা বলল। বলল যে, ইউসুফ হাসান তারিকদের নিয়ে তুমি যাও। সব ব্যবস্থা করে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে।
আর কোন কথা না বলে সালাম জানিয়ে সবাই বেরিয়ে গেল। আহমদ মুসাও চলে গেল তার কক্ষের দিকে।

আহমদ মুসার কক্ষ। সময় সন্ধ্যা।
ইউসুফ চিয়াং সারাদিনের সব কাজ, গৃহীত সব ব্যবস্থার বিবরণ দিয়েছে আহমদ মুসার কাছে। আহমদ মুসা সব শুনে প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিয়ে দিয়েছে ইউসুফ চিয়াং এবং আব্দুল্লায়েভকে।
তারপর শিহেজী উপত্যকায় যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল ইউসুফ চিয়াং এবং আব্দুল্লায়েভ।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে ওদের জড়িয়ে ধরে দোয়া করল, আল্লাহ তার সৈনিকদের সাহায্য করুন!
ওরা বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যা তখন পেরিয়ে গেছে।
হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং তাদের কক্ষে তৈরী হচ্ছে আহমদ মুসার সাথে আজকের অভিযানে বেরুবার জন্যে।
আহমদ মুসাও তৈরী হচ্ছে তার ঘরে। এমন সময় ঘরে ঢুকল দাদি।
আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি দাদিকে বসতে দিয়ে বলল, এই অসময়ে দাদি?
-আমিনা এসেছে, সে কথা বলতে চায়।
-কোথায় ও?
-দরজার বাইরে।
আহমদ মুসা দরজার দিকে চেয়ে বলল, বল আমিনাগুলি, কি বলতে চাও।
-আমি একটা অনুরোধ…
-কি?
-আপনি মা-চু’কে সাথে নিন। মা-চু’ সেনাবাহিনীর বিস্ফোরক ইউনিটে চাকুরী করেছে। তাকে নিরীহ দেখালেও সে ভাল কারাতে ও কুংফুও জানে।
-তাকে কষ্ট দেয়ার প্রয়োজন আছে কি?
-সে আপনার সাথে থাকবে। আমার অনুরোধ…
আর বলতে পারলো না মেইলিগুলি। কন্ঠ তার রুদ্ধ হয়ে গেল।
বুকের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠল আহমদ মুসার। মেইলিগুলির উদ্বেগটা কি, কেন সে মা-চু’কে সাথে দিতে চায় আহমদ মুসা বুঝে। আহমদ মুসা পারল না একটি হৃদয়ের এই আকুল আকুতি প্রত্যাখ্যান করতে। শুধু বলল, ও রাজি তো?
দাদি বলল, তুমি সাথে থাকলে মা-চু আগুনে ঝাঁপ দিতেও রাজি।
-ঠিক আছে মা-চু’কে আমার কাছে আসতে বল আমিনা।
বাইরে পায়ের শব্দ হলো। মেইলিগুলি চলে গেল। তার সাথে দাদিও।
সন্ধ্যার অন্ধকার তখন নেমে এসেছে।
মেইলিগুলির বাড়ির গেট দিয়ে ওরা চারজন বেরিয়ে এল। সামনে আহমদ মুসা। তার পেছনে হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং। সবার পেছনে মা-চু বড় বড় ধাপে সে এগিয়ে চলেছে।
তার কাঁধে বড় একটি ব্যাগ। দোতলার ব্যালকনিতে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মেইলিগুলি। ছোট্র বুকটি তার তোলপাড় করছে। ওদের যখন আর দেখা গেল না, তখন মেইলিগুলির মাথা নুইয়ে পড়ল ব্যালকনির রেলিং এর ওপর। মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল ‘আল্লাহ হাফিজ’।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.