০৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস (পর্ব ৩-৪)

 ০৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস

পর্ব ৩

যুবায়েরভ এবং আবুল ওয়াফা আহমদ মুসা এবং হাসান তারিককে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল। তারপর সামনে এগিয়ে দুজন দুজনকে পাগলের মত জড়িয়ে ধরল।
যুবায়েরভ মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান কর্নেল কুতাইবার এবং আবুল ওয়াফা ফিলিস্তিন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান কর্নেল মাহমুদের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে এসেছে। আবুল ওয়াফার সাথে আহমদ মুসা ও হাসান তারিকের কয়েক বছর পর দেখা। আর যুবায়েরভের সাথে এই সেদিন বিপ্লব পর্যন্ত এক সাথে করেছে তারা। আনন্দে ও আবেগে যুবায়েরভ ও আবুল ওয়াফার দুচোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল।
আলিঙ্গন শেষে দুজনের একসাথে প্রশ্ন আপনারা তো ভাল ছিলেন? ভাল আছেন?
হ্যাঁ আমরা ভাল আছি। বললেন আহমদ মুসা।
মুসা ভাইকে কোথায় পেয়েছিলেন, কীভাবে পেয়েছিলেন?
যুবায়েরভ হাসান তারিকের দিকে এক সাথে প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দিল।
সব শুনবেন, মুসা ভাই-ই সব বলবেন। তার আগে ওদিকে সবাই কেমন আছে?
কেমন থাকবে, সবার অবস্থা পাগলের মত। সবাই সব কাজ করে কিন্তু যেন প্রান নেই কারও। কুতাইবা ভাইকে দেখলে চিনতে পারবেন না। একদম অর্ধেক হয়ে গেছে। আহমদ মুসা আলাপ করছিলেন আবুল ওয়াফার সাথে। যুবায়েরভের এ কথা তার কানে যেতেই তিনি বলে উঠলেন, কেন কি হয়েছে তার, কোন অসুখ-বিসুখ?
না কোন অসুখ নয় মুসা ভাই। আপনাকে হারাবার পর থেকেই উনি যেন কেমন হয়ে গেছেন। একদম নিরব। সারাদিন নীরবে কাজ করে যান। আর রাতের সাথী জায়নামায। রাতে চোখের পানি তার বোধ হয় শুকায় না।
ওখানে কি সবাই পাগল হয়ে গেছে? কোন কিছুর অভাবে বা কোন ব্যাথায় মুষড়ে পড়া তো ইসলামী চরিত্র নয়।
অনেকেই তাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু তিনি বলেন, আমি তো মুষড়ে পড়িনি, আমি তো গাফলতি করছি না কোন কাজে? তার বার বার একটাই কথা, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি মুসা ভাইয়ের প্রতি।
পাগল, পাগল। আল্লাহর যে কি পরিকল্পনা এতে ছিল তা তো সে ভেবে দেখেনি।
একটু থামলেন আহমদ মুসা। তারপর হাসান তারিকের দিকে ফিরে বললেন, তুমি আয়েশার খবর নিয়েছ? হাসান তারিকের মুখ লাল হয়ে উঠল। মাথা নিচু করল। বলল, ঠিক আছে, নেব পরে।
যুবায়েরভ এই কথা শুনেই উঠে দাড়াল। বলল, ওরা সবাই ভাল আছেন মুসা ভাই। আয়েশা ভাবী একটা চিঠি দিয়েছিল। এনে দিচ্ছি।
সুটকেস থেকে চিঠি এনে যুবায়েরভ হাসান তারিকের হাতে দিল। হাসান তারিক চিঠিটা নিয়ে পকেটে রেখে দিল। তা দেখে আহমদ মুসা বললেন, তারিক যাও পাশের ঘরে, চিঠিটা পড়ে এস। জরুরী খবর থাকতে পারে।
হাসান তারিক একটু দ্বিধা করল। তারপর নির্দেশ মেনে চলে গেল পাশের ঘরে।
আহমদ মুসা বললেন, দেখ কি ভুল। আমাদের এ ভাইয়ের সাথে তোমাদের পরিচয় করে দেয়া হয়নি।
আহমদ ইয়াং পাশে একটা চেয়ারে বসে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপের মত অপলক কোছে এই মিলন দৃশ্য দেখছিল।
আহমদ মুসা তাকে দেখিয়ে বললেন, এ আহমদ ইয়াং। এখানকার ইসলামী আন্দোলন অর্থাৎ ‘টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপের’ একজন সিপাহসালার ও আমার একজন অতি প্রিয় সাথী।
যুবায়েরভ ও আবুল ওয়াফা এসে জড়িয়ে ধরল আহমদ ইয়াংকে।
আলাপ পরিচয় শেষে সবাই স্হির হয়ে বসল। হাসান তারিক ফিরে এল পাশের রুম থেকে।
কোন ম্যাসেজ যুবায়েরভ? বললেন আহমদ মুসা।
আপনার জন্য একটা চিঠি আছে। একটা চিঠি গভর্নর লি ইউয়ানকে আমরা দিয়েছি। আমাদের প্রথম দায়িত্ব ছিল সিংকিয়াং প্রশাসনের সহযোগিতায় আপনাদের খুজে বের করা।
কুতাইবা – মাহমুদরা কিভাবে নিশ্চিত হল যে, লি ইউয়ানের সাহায্য তারা পাবে।
পিকিংস্হ দুতাবাসের মাধ্যমে তার সাথে এ ব্যাপারে প্রাথমিক আলাপ হয়েছিল। বিস্তারিত না জানিয়ে শুধু বলা হয়েছিল ‘ফ্র’ এর লোকেরা আমাদের একজন লোককে কিডন্যাপ করে এনেছে। গভর্নর এতে সহযোগিতা করতে রাজি হন। তারপরই বিস্তারিত প্রস্তাব নিয়ে আমরা তার কাছে এসেছি। মিন্দানাও প্রজাতন্ত্রের সরকারও পিকিং- এর উপর চাপ দিচ্ছে। তারাও দেখা করেছে গভর্নর লি ইঊয়ানের সাথে সিংকিয়াং-এর মুসলমানদের ব্যাপারে।
থামল যুবায়েরভ। তারপর সুটকেসটা টেনে একটা সিল করা বড় ইনভেলপ তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা উল্টে-পাল্টে খামটার উপর নজর বুলালেন। মুসলিম মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের নামাংকিত সরকারী ইনভেলপ।
খামটার উপর চোখ বুলাতে বুলাতে চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল আহমদ মুসার। অনেকটা স্বগতঃই উচ্চারণ করলেন, কত ত্যাগ, কত সাধনা, কত লড়াই এর ফসল এই স্বাধীনতা। তিনি প্রশ্ন করলেন যুবায়েরভকে, সংস্কার-কাজ, মানুষের দুঃখ-মোচনের কাজ কেমন চলছে যুবায়েরভ?
শিক্ষা, মটিভেশন এবং তার সাথে সংস্কারের কাজ পাশাপাশি চলছে। প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
খুশি হলেন আহমদ মুসা। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, ঠিক করছ তোমরা। শুধু নাম বদল, পতাকা, মানুষ বদল ইত্যাদিতে কোন লাভ নেই যদি না আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যা চান তার ব্যবস্থা না করা যায়।
আহমদ মুসা ইনভেলপের একটা প্রান্ত ছিড়ে ফেললেন। বের করলেন বড় ধরনের একটা চিঠি। সুন্দর কাগজে লেখা। কাগজটা রুশ আমলের। লেটার হেডে ছাপা সোভিয়েত কম্যুনিস্ট প্রজাতন্ত্রের নাম কেটে তার পাশে মুসলিম মধ্য এশিয়ার নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছে।
কাগজগুলো নষ্ট না করে এই ভাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করে তোমরা ঠিক করেছ যুবায়েরভ। শিশু রাষ্ট্রের সৌখিনতার চেয়ে অস্তিত্ব বহুগুণ বড়। বললেন আহমদ মুসা।
চিঠিটা তার চোখের সামনে মেলে ধরলেন আহমদ মুসা। দীর্ঘ চিঠি পড়তে শুরু করলেন তিনি।

আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ভাই,
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আপনাকে এই সালাম পাঠাতে গিয়ে বেদনায় মনটা মুষড়ে পড়ছে। আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন আমরা জানি না। আমাদের সালাম আপনার কাছে কবে পৌছবে, আদৌ পৌছবে কিনা তাও জানি না। এই না জানার বেদনা আমাদে ক্ষত বিক্ষত করে চলছে। জেনারেল বোরিসের পেছনেই গেছে হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ। তাদেরও কোন খোঁজ আমরা পাইনি। পিকিং সরকার এবং সিং কিয়াং এর প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা শুরু করেছি। ফিলিস্তিন ও মিন্দানাও সরকারও চেষ্টা করছে। সৌদি সরকারকেও অনুরোধ করা হয়েছে। তারা চেষ্টা করছে। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে আমাদের আকুল প্রার্থনা, আল্লাহ আপনাকে নিরাপদে রাখুন, সুস্থ রাখুন।
এই চিঠি আপনার কাছে পৌঁছবে কিনা নিশ্চিত নই, তবু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এক বিষয়ে আপনাকে লিখছি যদি চিঠিটা আপনার কাছে পৌঁছে এই আশায়।
ককেশাস অঞ্চল নিয়ে ভয়ানক এবং জঘন্য এক ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে। আপনি জানেন, পামির থেকে কাস্পিয়ানের উত্তর তীর এবং আফগান সীমান্ত থেকে কাজাখস্থানের শেষ প্রান্ত ইউরাল পর্বতমালা পর্যন্ত এলাকা নিয়ে মুসলিম মধ্য এশিয়া সাধারণতন্ত্র গঠিত হয়েছে। আর নতুন রাশিয়ার রিপাবলিকের একটা সীমানা মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্র, ক্রিমিয়া এবং তাতারিয়া স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের উত্তর বরাবর এসে শেষ হবার কথা। এখান থেকে ইরান ও তুরস্কের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্রিমিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান এবং তাতারিয়া এক কালের এই চার অঞ্চল নিয়ে গঠিত মুসলিম অধ্যুষিত ককেশাস অঞ্চল আজ মারাত্মক ষড়যন্ত্র ও সংঘাতের শিকার। সেখানে চেষ্টা হচ্ছে একটা খালেস খৃষ্টান রাষ্ট্র কায়েমের। কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরের মধবর্তি এশিয়া ও ইউরোপকে সংযোগকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই অঞ্চলে তারা চাচ্ছে পশ্চিমী স্বার্থের আজ্ঞাবহ একটা খৃষ্টান রাষ্ট্র কায়েম করতে। এ রাষ্ট্রের দুপাশে থাকবে দুই সাগর, পশ্চিম পাশে তুরস্ক, দক্ষিনে ইরান এবং উত্তর সীমান্ত গঠিত হবে ককেশাস পর্বত মালা দিয়ে। রাষ্ট্রটা হবে অবস্থান ও সমৃদ্ধির দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এখান থেকে শুধু দুই সাগর নিয়ন্ত্রন নয়, চারপাশের গুরুত্বপূর্ন মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর উপরও খবরদারীর একটা পথ হবে। ওরা চেয়েছিল লেবাননকে দিয়ে এশিয়ায় একটি খৃষ্টান রাষ্ট্রের অভাব পূরণ করতে। কিন্তু সে আশা পূরন হয়নি। এখন ককেশাসকে দিয়ে সে সাধ পূরণ করতে চাচ্ছে। উত্তরের রাশিয়ান রিপাবলিক, যা মূলত খৃষ্টান জনঅধ্যুষিত, এতে তাদের লাভই দেখছে। তারা মনে করছে ককেশাসের ঐ অংশ যদি খৃষ্টানদের হাতে চলে যায়, তাহলে তাতারিয়া ও ক্রিমিয়াকে স্বাধীনতা না দিয়ে সে বাঁচতে পারে। এতে করে রাশিয়ান রিপাবলিকের সীমানা একদিকে ককেশাস পর্বতমালা পর্যন্ত পৌঁছবে, অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগর ও কাস্পিয়ান সাগরে নামার পথ পাবে যা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। অতএব রাশিয়ান রিপাবলিক এবং পশ্চিমা কয়েকটি খৃষ্টান দেশ আজ এক জোট হয়ে ককেশাসের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। ১৯১৭ সালে লেনিনের পাঠানো কম্যুনিষ্ট রেড আর্মি আর্মেনিয় খৃষ্টান শামিউনের নেতৃত্বে ককেশাসের মুসলমানদের উপর গনহত্যা চালিয়ে অঞ্চলটিকে যেভাবে তাদের দখলে নিয়েছিল, সেভাবেই তারা এখন এগুচ্ছে। মুসলিম এলাকায় খৃষ্টান ও কম্যুনিষ্টদের মদদপুষ্ট গেরিলা সন্ত্রাস শুরু হয়েছে এবং মুসলিম নেতৃবৃন্দের অপহরণ ও হত্যার কাজও শুরু হয়ে গেছে। সুযোগ পেয়ে সন্ত্রাসী ‘ফ্র’রাও জুটেছে এখানে এসে। ইরান ও তুরস্ক নানা কারনেই এ ব্যাপারে মাথা ঘামাতে নারাজ। হয়তো সে সুযোগ ও সামর্থ্যও তাদের নেই। এ অবস্থায় আমরা চোখে অন্ধকার দেখছি। সেখানকার মুসলমানরা চরম আতংক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অবিলম্বে যদি তাদের ব্যাপারে কিছু না করা হয়, তাহলে ১৯১৭ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটবে আবার।
এই বিপদ আমরা বুঝতে পারছি, কিন্তু আমরা কিভাবে কি করণীয় তা বুঝতে পারছি না। ফিলিস্তিনের মাহমুদ ভাইয়েরও এই কথা। আমরা আপনার পরামর্শ ও পরিচালনা চাই।
সবশেষে আল্লাহর কাছে আমাদের আকুল প্রাথর্না এই চিঠি যেন অতি সত্ত্বর আপনার হাতে পৌছে।
ওয়াসসালাম-
আপনার স্নেহ ধন্য কুতাইবা।

চিঠি পড়া শেষ করে আহমদ মুসা নীরবে তা তুলে দিলেন হাসান তারিকের হাতে।
একটি কথাও বললেন না তিনি। তার শূন্য দৃষ্টিটা সামনে দেয়ালে নিবদ্ধ। ওখানে একটা বড় ল্যান্ডস্কেপ। ল্যান্ডস্কেপের দিগন্ত পেরিয়ে হারিয়ে গেছে তার দৃষ্টি। কপাল তার কুঞ্চিত। মুখে বেদনার কালো ছায়া।
সবাই নীরব। পল পল করে বয়ে যাচ্ছে সময়।
এক সময় আহমদ মুসার চোখ ধীরে ধীরে নীচু হল। যেন জেগে উঠলেন তিনি। একটু নড়ে বসলেন চেয়ারে। যুবায়েরভের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন তোমাদের কেউ গিয়েছিল ওখানে?
গিয়েছিল। একটা তথ্যানুসন্ধান দল পাঠনো হয়েছিল। আর ককেশাস থেকে কয়েকটা প্রতিনিধি দল এসেছে। কোন উত্তর এলোনা আহমদ মুসার কাছ থেকে। তাঁর দৃষ্টি আবার ফিরে গেছে সেই দেয়ালে। দৃষ্টিটা আবার কোথায় যেন হারিয়ে গেছে তাঁর।
হাসান তারিক চিঠি পড়া শেষ করে ভাঁজ করতে করতে বলল, আরেক ফিলিস্তিন, আরেক মিন্দানাও মুসা ভাই।
আহমদ মুসা মখটা ঘুরিয়ে হাসান তারিককে বললেন, মিন্দানাও ও ফিলিস্তিনে খৃষ্টান ও কম্যুনিষ্ট স্বার্থের এমন সম্মেলন ঘটেনি তারিক।
ঠিক বলেছেন মুসা ভাই।
আহমদ মুসা কোন কথা বললেন না। হাসান তারিকই আবার বলা শুরু করল। বলল, এটা ঠিক ইহুদী–ইসরাইলের মত খৃস্টানরাও এশিয়ায় একটি খৃষ্টান-ইসরাইল চায়। ককেশাস তাদের একটি সুচিন্তিত সিলেকশন।
এতে বিস্ময়ের কিছু আছে হাসান তারিক? উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও বিজ্ঞানের উন্নতি দিয়ে খৃষ্টানরা বহুদুর এগিয়েছে। শুধু ককেশাস কেন প্রতিটি দেশেই তাদের অবস্থান নিয়ে তারা ভাবছে। আর এটা শুধু ভাবা নয়। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রতিটি দেশ, গোটা বিশ্বকেই তারা একটি প্রতিষ্ঠানিক আওতার মধ্যে নিয়ে আসছে। ধীর কন্ঠে বললেন আহমদ মুসা।
কিন্তু কম্যুনিষ্ট ও খৃষ্টান স্বার্থের এই সম্মেলনের তা‍‌‌‌‍ৎপর্য কি? যোবায়েরভ প্রশ্ন তুলল।
ধর্মকে বাদ দিয়ে স্থায়ী কোন জাতি গঠন হয় না, সোভিয়েত জাতি গঠনের ব্যর্থতা কম্যুনিষ্টদের তা পরিষ্কার করে দিয়েছ। তাই এখন রাশিয়ান রিপাবলিক যদি কোন ধর্মের আশ্রয় নিতে আগ্রহী হয় তাহলে বিস্ময়ের কি আছে। আর রাশিয়ার জন্যে স্বাভাবিক ভাবেই সে ধর্ম হবে খৃষ্টান ধর্ম।
আবার নীরবতা।
আহমদ মুসা একবার ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন, অনেক রাত। বাইরে সরকারী লোকরা কষ্ট পাচ্ছে। যুবায়েরভের দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বললেন, তোমরা থাক এখানে। এখনকার মত উঠি। কাল দেখা যাবে।
কোথায় যাবেন? যুবায়েরভের কন্ঠে যেন উদ্বেগ।
এক শুভাকাঙ্ক্ষীর বাসায়। চলবার শক্তিহীন আহত অবস্থায় আমি যখন একটা রাস্তায় পড়েছিলাম তখন ওরাই আমাকে নিয়ে আসে।
জানে আপনাকে?
জানে। ওখানে হাসান তারিক ও আহমদ ইয়াং ও আমার সাথে থাকবে। আবদুল্লায়েভ আমাদের ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর হেড কোয়ার্টার্সে থাকে। কোন চিন্তা নেই।
কিন্তু আপনাকে ছাড়তে মন চাইছে না। হয় আপনি এখানে থাকুন না হয় আমাদের নিয়ে চলুন।
আহমদ মুসা হেসে ফেলে বললেন, পাগল। তোমাদের নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু তোমরা যার মেহমান তার অনুমতি না হলে পারি না। বলে আহমদ মুসা উঠে দাড়ালেন। তার সাথে হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াংও।
মুখ ভার করে যুবায়েরভ বলল, আপনার কিছুই আমরা শুনতে পারলাম না।
যুবায়েরভের পিঠ চাপড়ে আহমদ মুসা বললেন, হবে, কালকে সব শুনবে। আসি। তোমরা ঘুমাও।
বলে আহমদ মুসা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। তার পিছনে হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং। মা-চু গাড়িতে বসেছিল। মা-চুকে আহমদ মুসাদের সাথে আসতে বলা হলে বলেছিল, বড় ধরনের কোন কথা আমি কিছু বুঝি না। তার চেয়ে আমি গাড়ি পাহারা দিই।
আহমদ মুসা বুঝেছিল, মা-চু তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। গাড়িতে থাকাই তার জন্য বেশি প্রয়োজন। তবু আহমদ মুসা হেসে বলেছিলেন, তোমার আপামনি না তোমাকে আমার পাশে পাশে থাকতে বলেছেন।
মা-চু তৎক্ষণাৎ জবাব দিয়েছিল, তা বলেছেন। কিন্তু আপনি তো এখন লড়াই-এ যাচ্ছেন না।
মা-চুর জবাবে আহমদ মুসা হেসে উঠেছিলেন। মনে মনে বুঝেছিল মা-চুকে বোকা মনে হলেও খুব চালাক সে।
বাইরে করিডোরে একটা চেয়ারে বসেছিল সেনাবাহিনীর একজন অফিসার। আহমদ মুসারা বেরুতেই সে উঠে দাড়িয়ে স্যালুট দিল।
আহমদ মুসা বললেন, খুব কষ্ট দিয়েছি আপনাদের। এখন আসুন। আমরা চলে যাচ্ছি।
সেনা অফিসারটি বলল, স্যার আপনাকে বাসায় পৌছে দিতে চায়।
এই-ই কি হুকুম?
গভর্নর সাহেবের এটা নির্দেশ।
ঠিক আছে। বলে আহমদ মুসা অতিথি ভবন থেকে বেরিয়ে তাদের জীপে এসে উঠলেন।
তাদের জীপের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল সেনাবাহিনীর একটি জীপ।

আহমদ মুসার জীপটি মেইলিগুলিদের গেটের মুখোমুখি হতেই বিস্ময়ে আঁতকে উঠলেন আহমদ মুসা। দেখলেন গেটটা হা হয়ে আছে। আরো দেখলেন একটা মাইক্রোবাস দ্রুত বেরিয়ে আসছে।
ছ্যাৎ করে উঠল আহমদ মুসার মনটা। নেইজেনকে উদ্ধার করতে গিয়ে আজ কিছুক্ষণ আগে ‘ফ্র’র ঘাঁটিতে দেখা আলামতের কথা তার মনে পড়ল। ঘাঁটির ঘরগুলো দেখতে গিয়ে একটা ঘরে হ্যাঙ্গারে একটা স্যুট সে দেখেছে। স্যুটটা জেনারেল বোরিসের। চীনে আসার সময় জেনারেল বোরিসের পরিধানে এই স্যুটটাই ছিল। কিন্তু বিশ্বাস হয়নি তার, জেনারেল বোরিস তার হাতটা সুস্থ না করেই ফিরে আসবে? কিন্তু এখন মেইলিগুলির বাড়ি থেকে এই মধ্যরাতে গাড়ি বেরুতে দেখে সেই আশংকা তার কাছে বাস্তবরূপ নিয়ে সামনে এল।
আহমদ মুসার জীপটি গেট থেকে রাস্তায় বেরুবার যে প্যাসেজে একদম গেটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। আর মাইক্রোবাসটি তখনো গেট থেকে পাঁচ-ছয় গজ ভিতরে।
মুহুর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন আহমদ মুসা। কিন্তু মাইক্রোবাস থেকে স্টেনগান হাতে একজনকে লাফিয়ে পড়তে দেখেই আহমদ মুসা বললেন, ‘সাবধান তোমরা’ কথাটা বলতে বলতেই গাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলেন আহমদ মুসা।
ব্যাপারটা আহমদ ইয়াং ও হাসান তারিকের নজরে পড়েছিল। আর তার প্রায় সাথে সাথেই বৃষ্টির মত এক পশলা গুলী এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল জীপটার উপর। গুলী বন্ধ হলো না। পাগলের মত কে যেন স্টেনগান চালাচ্ছে।
সেনা অফিসারটির জীপ ও গেট বরাবর রাস্তার উপর এসে দাঁড়িয়েছিল। ফলে এ জীপও গুলীর মুখে পড়ল। অপ্রস্তুত ড্রাইভার সৈনিকটি গুলী বিদ্ধ হয়ে তার সিটেই ঢলে পড়ল। সেনা অফিসারটি তার আগেই লাফিয়ে পড়েছিল নিচে। পেছনের সিটে বসা দুজন লেফটেন্যান্ট পেছনের দরজা দিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
আহমদ মুসার জীপের চেহারার একদম পাল্টে গেছে। উইন্ড স্ক্রিনের কোন চিহ্ন নেই। জীপের সামনের দিকটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। দুটো হেড লাইটও গুড়ো হয়ে গেছে।
আহমদ ইয়াং এবং দুজন লেফটেন্যান্টের স্টেনগানও উঁচু হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আহমদ মুসা হাত তুলে তাদের নিষেধ করেছে। ওরা নিশ্চিন্তে বেরিয়ে আসুক।
কর্ণেল সেনা অফিসারও আহমদ মুসার সাথে একমত হয়েছে। বলেছে, আমরা এবার আক্রমণের পজিশনে, ওদের বিভ্রান্ত করা এবং একটু আশ্বস্ত করে বন্দুকের নলের সামনে বের করে আনাই আমাদের প্রধান কাজ।
কর্ণেল, আপনারা এই কাজটি করুন। আর আহমদ ইয়াং, এদের সাথে এখানে দাঁড়িয়ে গেট থেকে কেউ যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে তা নিশ্চিত করা তোমার দায়িত্ব। বলে আহমদ মুসা হাসান তারিককে বললেন, চল আমরা পেছন দিক দিয়ে বাড়িতে ঢুকব। পালাবার ওদিকের পথও বন্ধ করতে হবে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই আহমদ ইয়াং উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, মা-চু কোথায় মুসা ভাই? সে তো গাড়ি থেকে নামেনি।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, চিন্তা করো না ইয়াং, আত্মরক্ষা ও আক্রমণ দুটি কৌশলই মা-চুর জানা আছে।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক প্রাচীর ঘুরে দ্রুত চলে এলেন বাড়ির পেছনে।
অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। করিডোরের ও বাড়ির পেছনের যে আলোটা সব সময়ই থাকে তাও নেই। আহমদ মুসার মনে পড়লো গেটের শেডেও কোন আলো দেখা যায়নি। তাহলে কি বিদ্যুত লাইন ওরা কেটে দিয়েছে? টেলিফোন লাইনও? এত বড় আয়োজন! বিস্ময় বোধ করলেন আহমদ মুসা। হঠাৎ মনে পড়লো, জেনারেল বোরিস তো কোন ছোট্ট মিশনে আসেনি। আহমদ মুসাসহ সবাইকে ধরার মত আঁট-সাট বেঁধেই সে এসেছে। ভাবতে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো আহমদ মুসার। আল্লাহই জানেন, মেইলিগুলির কি হয়েছে! দেহের স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে একটা জ্বালা ছড়িয়ে পড়ল তার। প্রাচীরের পেছনে অপেক্ষাকৃত একটি অন্ধকার জায়গায় এসে তারা দাঁড়ালেন।
পেছনের দিকে প্রাচীরটা আট ফিট উঁচু। আহমদ মুসা হাসান তারিককে বললেন, তুমি আমার কাঁধে পা টা রেখে প্রাচীরে উঠে যাও। হাসান তারিক একটু ইতস্তত করে বলল, আপনি কিভাবে উঠবেন?
এখন নষ্ট করার মত সময় নেই হাসান তারিক। যা বলছি কর। প্রায় ধমকে উঠলেন আহমদ মুসা। হাসান তারিক প্রাচীরে উঠে গেল। নেমে গেল ওপারে।
আর আহমদ মুসা প্রাচীরের প্রায় দশ গজ দূর থেকে তীব্র গতিতে ছুটে এসে অদ্ভূত দক্ষতার সাথে প্রাচীরের অর্ধেকটা দৌড়ে উঠে গেলেন এবং ওই অবস্থায় দুই হাত দিয়ে প্রাচীরের মাথাটা ধরে প্রাচীরে উঠে পার হয়ে গেলেন ওপারে।
প্রাচীর টপকে তারা বাড়ির পেছনের বাগানে এসে দাঁড়ালেন। এই বাগানটাই ঘুরে বাড়ির সামনে চলে গেছে।
আহমদ মুসা পকেট থেকে বের করে ইনফ্রারেড গগলসটি চোখে পরে নিলেন। তারপর বিল্ডিংয়ের পাশ ঘেঁষে সামনে এগুলেন। তাঁর পেছনে হাসান তারিক। হাতে তাদের এম-১০ মেশিন রিভলভার। তাদের লক্ষ্য বাগান ঘুরে সেই মাইক্রোবাসটির পেছনে গিয়ে পৌঁছা।
বিল্ডিং এর দক্ষিণপাশ ঘুরে উত্তরমূখী হয়ে চলতে শুরু করেছেন এমন সময় আবার গুলি শুরু হল। গুলি শুরু হয়েছে এ পাশ থেকে।
বিল্ডিংটা উত্তর দক্ষিণ লম্বা। মাঝখানে গাড়ি বারান্দা। গাড়ি বারান্দারও প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে মাই্ক্রোবাসটি।
বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে দ্রুত আহমদ মুসা ও হাসান তারিক গাড়ি বারান্দায় উঠে দুই থামের আড়ালে দুজন বসে পড়লেন। এখান থেকে মাইক্রোবাসের পূব পাশ দিয়ে গেটের পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। দেখলেন, স্টেনগানধারী ছয়জন লোক গুলি করতে করতে সামনে এগুচ্ছে। গেটের গজ দুয়েক ভেতরে থাকতেই বিকট শব্দে একটা হাত বোমা এসে বিস্ফোরিত হল তাদের উপর। তার ইনফ্রারেড গগলসে তিনি বিস্ময়ের সাথে দেখলেন, বোমাটি ছুটে এল আহমদ মুসার সেই বিধ্বস্ত জীপ থেকে। তাহলে মা-চু এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল।
চারজন লোক ঢলে পড়লো ওখানেই। অন্য দুজন দুপাশে ছিটকে পড়েছিল। হামাগুড়ি দিয়ে ওরা সরে আসতে চেষ্টা করল এ দিকে।
এই সুযোগে গুলি করতে করতে গেট দিয়ে ছুটে এল আহমদ ইয়াং এবং অন্যরা।
মাইক্রোবাসের ড্রাইভিং সিট থেকে লাফ দিয়ে একজন নেমে এল এ সময়। টেনে নামাল সে আরেকজনকে। তারপর সেই লোক চিৎকার করে উঠল, আহমদ মুসা তোমরা আর এক পা এগুলে এবং গুলি করা বন্ধ না করলে মেইলিগুলির মাথা গুড়ো হয়ে যাবে।
দেখা গেল সেই লোকটা গাড়ি থেকে যাকে টেনে নামাল তাকে সামনে রেখে তার গা ঘেঁষে পেছনে দাঁড়িয়ে। আহমদ মুসা বুঝলেন সামনের জনই তাহলে মেইলিগুলি। তাকে বোরিস এখন ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে।
জেনারেল বোরিসের কণ্ঠ ধ্বনিত হবার সাথে সাথে আহমদ ইয়াংরা থমকে দাঁড়াল, গুলিও বন্ধ হয়ে গেল তাদের।
জেনারেল বোরিস হো হো করে হেসে উঠল। বলল, আহমদ মুসা, জেনারেল বোরিসের হারাবার কিছূ নেই। আমি মৃত্যুকে ভয় করি না। কিন্তু আজ তোমার প্রিয়তমা আগে মরবে তারপর আমি মরব।
একটু দম নিল জেনারেল বোরিস, তারপর আবার চিৎকার করে উঠল, তোমরা স্টেনগান ফেলে দিয়ে গেটের পূবপাশে গিয়ে দাড়াও। এক মুহূর্ত দেরি করলে মেইলিগুলির মাথা গুড়ো করে দেব।
আহমদ ইয়াংরা মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর স্টেনগান ফেলে দিয়ে গেটের বাঁ পাশে চলে গেল।
আহমদ মুসা ততক্ষণে বিড়ালের মত নিঃশব্দে জেনারেল বোরিসের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। শেষ মুহূর্তে টের পেল জেনারেল বোরিস। চমকে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল।
কিন্তু ব্যাপারটা বুঝে উঠার আগেই আহমদ মুসা রিভলবারের বাট দিয়ে তার কানের ঠিক উপরটায় প্রচন্ড একটা আঘাত করলেন। ঘুরে পড়ে গেল জেনারেল বোরিস একপাশে ।
হঠাৎ আহমদ মুসার নজর পড়ল মেইলিগুলির উপর। মেইলিগুলি টলছে। ঠিক পড়ে যাবার মুহূর্তে তাকে গিয়ে ধরলেন আহমদ মুসা। বললেন, কি হয়েছে মেইলিগুলি? অসুস্থ বোধ করছো? আহমদ মুসার কাঁধের উপর ঢলে পড়ল মেইলিগুলি। বলল, একটা গুলি লেগেছে।
গুলি লেগেছে? কোথায়?
পাঁজরে।
আহমদ মুসা তাকে পাঁজাকোলা করে হাতে তুলে নিলেন। ডাকলেন হাসান তারিককে।
আমি এখানে। পাশ থেকে বলে উঠল হাসান তারিক। এই সমায় আহমদ ইয়াং, মা-চু, সেনা অফিসারসহ সৈনিকরা সেখানে এসে দাঁড়াল।
মেইলিগুলিকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। রাস্তা থেকে জীপটা সরিয়ে ফেল। এই মাইক্রোবাসটা নিয়েই যেতে হবে।
বলে আহমদ মুসা মেইলিগুলিকে নিয়ে মাইক্রোবাসের দিকে এগুলেন। মাইক্রোবাসে উঠে সিটের উপর তাকে শুইয়ে দিলেন।
মেইলিগুলি ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমার দাদী, আমার দাদীকেও ওরা গুলি ….. কান্না এসে কথা তার রুদ্ধ করে দিল।
দাদীকেও। বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হলো আহমদ মুসার চোখ। আহমদ ইয়াং ও অন্যরা চলে গিয়েছিল গেটের সামনে থেকে জীপটি সরিয়ে দিতে। হাসান তারিক ও মা-চু মাইক্রোবাসের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। মা-চু বাকরুদ্ধ প্রায়।
আহমদ মুসা ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসান তারিক তুমি ও মা-চু ওপরে যাও। দাদী কি অবস্থায় দেখ। ওঁকেও হাসপাতালে নিয়ে এস সৈনিকদের ওই জীপে করে। আহমদ ইয়াং ও মা-চু এখানেই থাকবে।
লেফটেন্যান্ট দুজনকে হাসান তারিকের সাথে জীপে আসার জন্য রেখে আহমদ মুসা মেইলিগুলিকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। ড্রাইভিং সিটে বসে সেই সেনা কর্ণেল অফিসারটি।
আহমদ মুসা সিটের সামনে গাড়ির ফ্লোরে বসে মেইলিগুলির দেহকে ধরে রেখেছিলেন সিটের সাথে। আহমদ মুসার সামনের দিকটা রক্তে ভিজে গেছে।
শংকিত হয়ে উঠলেন আহমদ মুসা। কখন থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে মেইলিগুলির?
মেইলিগুলি নিঃসাড়ভাবে শুয়ে আছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেনি তো? আহমদ মুসা আস্তে ডাকলেন, আমিনা?
জ্বি। একটু সময় নিয়ে দুর্বল কণ্ঠে উত্তর দিল মেইলিগুলি।
কখন গুলি লেগেছে তোমার আমিনা?
আমি স্টেনগান দিয়ে ওদের ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। একটা গুলি এসে লাগলে আমার হাত থেকে স্টেনগান পড়ে যায়।
ধীরে ধীরে বহু কষ্টে উচ্চারণ করল মেইলিগুলি। ক্রমেই সে দুর্বল হয়ে পড়ছে।
আহমদ মুসা মাথাটা খাড়া করে বললেন, হাসপাতাল আর কতদূর কর্ণেল?
আর দুমিনিট স্যার, বলল কর্ণেল। আবার নীরবতা।
মেইলিগুলি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল? উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন আহমদ মুসা। আবার ডাকলেন, আমিনা?
জ্বি। অস্ফুট একটা জবাব এল বেশ দেরীতে।
কেমন বোধ করছ?
কোন জবাব দিল না মেইলিগুলি। মেইলিগুলিকে ধরে রাখা আহমদ মুসার একটা হাতের উপর অতি ধীরে উঠে এল মেইলিগুলির একটি হাত। চমকে উঠলেন আহমদ মুসা। অপরিচিত অস্বস্তির একটা ঢেউ যেন খেলে গেল তার গোটা দেহে। মেইলিুগলির দুর্বল হাত কাঁপছিল।
এই সময় হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ঢুকে গেল মাইক্রোবাসটি।
কর্ণেলের ইঙ্গিতে দ্রুত ছুটে এল ইমার্জেন্সির লোকরা রোলিং স্ট্রেচার নিয়ে। কর্ণেলের হাঁক ডাকে পাশের রুম ইনচার্জ ডাক্তারও বেরিয়ে এসেছিল। কর্ণেল তাকে কানে কানে কি যেন বলল।
ডাক্তারও ছুটে এল মাইক্রোবাসের গেটের দিকে স্ট্রেচারের কাছে। আহমদ মুসাকে হাত তুলে একটা স্যালুট দিয়ে বলল, কোন অসুবিধা হবে না স্যার।
বলেই সে পেশেন্টকে সোজা অপারেশন কক্ষে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়ে ছুটল ইমার্জেন্সি কক্ষের দিকে।

অপারেশন কক্ষের বাইরে উদ্বিগ্নভাবে অপেক্ষা করছিলেন আহমদ মুসা ও হাসান তারিক। কর্ণেল চলে গিয়েছিল।
আহমদ মুসা ঘড়ি দেখলেন। রাত আড়াইটা। হাসপাতালে আসার পর প্রায় দেড় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আরও পনের মিনিট পরে অপারেশন কক্ষের দরজা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো সিংকিয়াং এর শ্রেষ্ঠ অস্ত্রোপচারবিদ ডাক্তার চ্যাং। তার মুখ গঙ্ভীর। বলল, অপারেশন সফল, কিন্তু কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে। আগামী বার ঘন্টা খুবই গুরুত্বপূর্ন।
আর দাদী, মানে বৃদ্ধা মহিলাটির খবর? বললেন আহমদ মুসা।
স্যরি। মাথা নিচু করে বলল ডাক্তার।
সঙ্গে সঙ্গেই একটা অন্ধকার নেমে এল আহমদ মুসার মুখে। বেদনায় নীল হয়ে এল তার মুখটা। কয়েক মুহুর্ত কথা বলতে পারলেন না তিনি।
অপারেশন কক্ষের দরজা আবার বন্ধ হয়েছে। ডাক্তার চলে গেছে।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে কিছু বলার জন্য মুখ তুললেন, এমন সময় করিডোর দিয়ে একজন হন্ত-দন্ত হয়ে ছুটে এল। বলল, আহমদ মুসা কে?
আমি। বললেন আহমদ মুসা।
শীগ্রি আসুন, গভর্ণর সাহেবের টেলিফোন।
আহমদ মুসা টেলিফোন ধরতেই ওপার থেকে লি ইউয়ান বলল, আমি সব শুনেছি মি. আহমদ মুসা। ডাক্তারের কাছ থেকে মেইলিগুলির কথাও শুনলাম। চিন্তার কিছু নাই। আমি নির্দেশ দিয়েছি, এই কেস টপমোস্ট প্রাইওরিটি পাবে।
শুকরিয়া মি. গভর্নর।
আমি মেইলিগুলির বাড়িতে পাহারা বসাবার নির্দেশ দিয়েছি। আর মেইলিগুলির আব্বা-আম্মা সরকারী সফরে এখন জেনেভায়। সেখানেও খবর পৌছাচ্ছি।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জনাব।
আমি কাল নেইজেনকে নিয়ে একবার মেইগুলিকে দেখতে যাব। একটু থেমে গভর্ণর আবার বলল, আপনি বাসায় চলে আসুন। বিশ্রাম প্রয়োজন আপনার। হাসপাতালের জন্য কোন চিন্তা নেই।
টেলিফোনে কথা শেষ করে আহমদ মুসা বললেন, এখানে আর কোন কাজ নেই হাসান তারিক। চল বাসায় ফিরি। ‘ফ্র’র যে দু’জন লোক ধরা পড়েছে তাদের নিয়ে আহমদ ইয়াং কি করছে চল দেখি।
সেই মাইক্রোবাসে আহমদ মুসারা মেইলিগুলির বাসায় ফিরে এল।
গেট বন্ধ করে দিয়ে আহমদ ইয়াং ও মা-চু গাড়ি বারান্দাতেই বসেছিল। তাদের সামনে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে বোমার স্প্লিন্টারে আহত ‘ফ্র’র দুজন লোক।
প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ আহমদ ইয়াং মোটামোটি সেরেই ফেলেছে। মা-চু কাটা বিদ্যুত সংযোগে জোড়া লাগিয়েছে। আলোয় ঝলমল করছে এখন বাড়ি।
আহমদ মুসা ও হাসান তারিক আসতেই উৎসুকভাবে মুখ তুলল আহমদ ইয়াং এবং মা-চু দুজনেই।
আহমদ মুসা গঙ্ভীর কন্ঠে বললেন, খবর ভাল নয় মা-চু। দাদী নেই, মেইলগুলি এখন ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে।
শুনে মা-চু মাথা নিচু করল। দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকল সে।
কিছুক্ষন কেউ কিছু বলতে পারল না। অবশেষে মুখ খুললেন আহমদ মুসা। বললেন, এ দিকের খবর কি ইয়াং?
কিছু খবর নিয়েছি। এখানে এবং নেইজেনকে অপহরণ করার অভিযান এক জায়গা থেকেই হয়েছে।
হ্যাঁ, সেটা আগেই বুঝতে পেরেছি।
এই অভিযান ছিল ‘ফ্র’ এবং ‘রেড ড্রাগনের’ সম্মিলিত। নেইজেনকে কিডন্যাপ করে গভর্ণরকে শিহেজী উপত্যকায় হান বসতির পক্ষে ওরা বাধ্য করতে চেয়েছিল।
হ্যাঁ, ওটা তো গভর্ণরও বলেছেন।
আর এখানে জেনারেল বোরিসের অভিযানের লক্ষ্য ছিল আপনাকে অপহরণ করা। আপনাকে না পেয়ে প্রতিশোধ স্পৃহায় অন্ধ বোরিস বাড়িতে যাকেই পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছ। মেইলিগুলিকে নিয়ে যাচ্ছিল জিম্মি হিসাবে আপনাকে ধরার জন্য।
জেনারেল বোরিস পিকিং থেকে কবে ফিরেছে?
আজ সকালে। সব প্ল্যান ঠিক করে পিকিং থেকে প্রস্তুত হয়েই সে ফেরে।
একটু থেমে আহমদ ইয়াং বলল, জেনারেল বোরিসের ফেলে যাওয়া মানিব্যাগে একটা টেলেক্স পেয়েছি। টেলেক্সটি এসেছে আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেন থেকে। পাঠিয়েছে জনৈক মাইকেল পিটার। বলেছে, চুড়ান্ত প্রস্তুতি এগুচ্ছে। জেনারেল বোরিসকেও সেখানে প্রয়োজন। স্ট্যালিনের জন্মভূমি জর্জিয়া এবং তার সাথে আর্মিনিয়া তাকে স্বাগত জানাবে।
থামল আহমদ ইয়াং।
কি যেন চিন্তা করছিলেন আহমদ মুসা। একটু পরে বললেন, মনে হয় চীনে জেনারেল বোরিসের এটাই শেষ অভিযান ছিল। আহমদ মুসার ওপর প্রতিশোধ নেয়া শেষ করে সে নতুন ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ককেশাসে পাড়ি জমাতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর চেয়ে তো বড় পরিকল্পনাকারী আর কেউ নেই। জেনারেল বোরিসের যেখানে ককেশাসে যাবার কথা সেখানে যাচ্ছে আহমদ মুসা।
শেষের কথা ছিল ধীর স্বগত কন্ঠের…….
কি মুসা ভাই, আপনি কোথায় যাবেন? চমকে উঠেই যেন বলল আহমদ ইয়াং।
আহমদ মুসা হাসলেন। কোন জবাব দিলেন না। তার দৃষ্টি বাইরে অন্ধকারের বুকে নিবন্ধ কোন ভাবনায় যেন ডুব দিয়েছে আবার আহমদ মুসা।



পর্ব ৪


মেইলিগুলির চোখ ধরে এসেছিল। পায়ের শব্দে সে চোখ খুলল। দেখল মা-চু রুমে ঢুকছে। মেইলিগুলির গোটা দেহ, মুখ পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা। খুব দুর্বল মেইলিগুলি। নড়া-চড়া তো নিষিদ্ধই। উঠে বসারও অবস্থা নেই। ভিআইপি পেশেন্টদের জন্য নির্ধারিত সবচেয়ে মূল্যবান রুমটি দেয়া হয়েছে মেইলিগুলিকে। বিরাট ঘরের এক পাশে পেশেন্ট সিট অন্য পাশটা সোফা দিয়ে সাজানো। মাঝখানে সুন্দর একটা সাদা স্ক্রীন। প্রয়োজন হলে গুটিয়ে নেয়া যায়। বেলা তখন বিকেল তিনটা।
মা-চুকে ঘরে ঢুকতে দেখে খুশি হয় মেইলিগুলি।
কেমন আছ মা-চু তোমরা?
ভাল
খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে না তো? যেভাবে বলে দিয়েছি তা হচ্ছে তো?
জ্বি। মাথা দুলিয়ে বলল মা-চু।
তোমার স্যার কোথায়? কালকে আসেননি, আজকেও আসেননি।
আজ ভোরে শিহেজী উপত্যকায় গিয়েছেন। কিন্তু কাল এসেছিলেন।
এসেছিলেন?
এসেছিলেন, কিন্তু রুমে ঢুকেননি। দর্শনার্থীর নাকি ভীড় ছিল। খোঁজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।
আসলে মেইলিগুলির রুমে স্রোতের মত লোক আসছে প্রথম দিন থেকেই। এমনকি পিকিং থেকেও লোক এসেছে।
মেইলিগুলি এতে অস্বস্তিই বোধ করেছে। অনেকদিন থেকে সে সবার সামনে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এখন তো সে কাউকে নিষেধ করতে পারে না। আহমদ মুসা কি এটা ভালো চোখে দেখেনি? না, উনি তো সব বুঝেন, সব জানেন।
আপা, স্যার যেন কেমন হয়ে গেছেন? মা-চুই অবশেষে নীরবতা ভাঙল।
কেমন হয়ে গেছেন মানে? মেইলিগুলির চোখটা চঞ্চল হয়ে উঠল।
আগের চেয়ে কথা কম বলেন, হাসি-খুশি তো দেখিই না।
কেন মা-চু? মেইলিগুলির কন্ঠে যেন উদ্বেগ।
জানিনা, সেদিন দেখলাম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আমি ঘরে ঢুকলে ধীরে ধীরে উঠে বসলেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, কিছু বলবেন স্যার? তিনি ধীরে ধীরে গঙ্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘মা-চু এই পরিবারটা কত শান্তিতে ছিল তাই না? আমি এসে সব ভেঙে দিয়েছি।
দাদী নিহত হলেন, মেইলিগুলি মারাত্নক আহত। বলতে বলতে স্যারের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। মা-চু থামল।
তুমি কিছু বললেন না? মেইলিগুলির মুখ ম্লান হয়ে উঠেছে।
না, আমি কিছু বলতে পারিনি। স্যারের এ অবস্থা কখনও দেখিনি।
তাঁকে কিছু বলার যোগ্যতা আমার আছে?
মেইলিগুলি কথা বলল না। চোখ বুজেছে সে। তার গোটা হৃদয়টা আলোড়িত হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছে মেইলিগুলি আহমদ মুসার মনের অবস্থা। কি যন্ত্রনা তাঁর মনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠল মেইলিগুলির কাছে।
মা-চু উঠে গিয়েছিল। অনেকক্ষন পর চোখ খুলল মেইলিগুলি। তার চোখের কোণটাও মনে হল সজল হয়ে উঠেছে।
মা-চু তোমার স্যার শিহেজী উপত্যকা থেকে কখন আসবেন?
মা-চু দরজার ওদিক থেকে মেইলিগুলির দিকে সরে এসে বলল, আমি জানি না, আপা। মেইলিগুলি আবার নীরব হল।
এই সময় ঘরে ঢুকল নেইজেন। গভর্নর লি ইউয়ানের মেয়ে। রোজ বিকেলে সে মেইলিগুলির কাছে আসে। ঘন্টাখানেক থাকে। মেইলিগুলির সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল তার।
মা-চু বেরিয়ে গেল।
নেইজেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে মেইলিগুলির সামনে বসল।
কি ব্যাপার আপা, তোমার মুখটা খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে? খারাপ লাগছে না তো?
না জেন। তুমি কেমন আছ? হাসতে চেষ্টা করে বলল মেইলিগুলি।
ভাল। আচ্ছা আপা, আমি শুনলাম ফিল্ম লাইন নাকি তুমি একেবারেই ছেড়ে দিয়েছ?
ওটা তো পুরানো খবর।
আমি ভেবেছিলাম তোমার সিদ্ধান্তটা সাময়িক।
জেন, মুসলিম মেয়েদের জনে তো একাজ নয়।
হঠাৎ এ সিদ্ধান্তে তুমি কেমন করে পৌঁছলে? সবাই কিন্তু অবাক হয়েছে। অনেকে বিশ্বাসই করতে চায়না।
মুসলিম মেয়ে হয়েও আমি আগে আমি অন্ধ ছিলাম, আহমদ মুসা আমার
চোখ খুলে দিয়েছেন।
ও বুঝেছি, বুঝেছি। আচ্ছা আপা, ওরা যাদু জানে নাকি?
কেন?
যে কথা তোমাকে বলেছিলাম, সেদিন রাতে আহমদ মুসার সাথে দেখা হওয়ার পর আব্বা যেন বদলে গেছেন। জান, আব্বা নামায পড়া শুরু করেছেন। কুরআন শিখছেন আহমদ মুসার কাছে গোপনে।
ওরা যাদু নয় নেইজেন, সত্যের শক্তি। সত্যের শক্তি অপরিসীম। দেখ না, মুসলমানরা যতদিন সত্যের উপর ছিল, ইসলাম কিভাবে বিস্তার লাভ করেছে। এরা সত্যের উপর, সঠিকভাবে ইসলামের উপর আছেন বলেই ওদের কথার শক্তি অপরিসীম।
তাই হবে হয়তো। তবু আমার বিস্ময়ই লাগে।
কিন্তু পরিবর্তনটা কি শুধু তোমার পিতারই, তোমার পরিবর্তন আসেনি?
হঠাৎ মুখটা লাল হয়ে উঠল নেইজেনের। তারপর সামলে নিয়ে বলল, কি পরিবর্তন?
কেন তোমার মাথায় গায়ে তো কোনদিন চাদর দেখিনি, কিন্তু কদিন থেকে তো……
ঠিক বলেছ আপা। আমার কিন্তু খুব আনন্দ লাগছে। আমি মুসলিম মেয়ে এই অনুভূতি ফিয়ে পেয়ে আমার গর্ববোধ হচ্ছে।
আসলে কি জান জেন, মুসলমানদের ঈমান, ধর্ম বিশ্বাস একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। প্রতিকুল পরিবেশ বা অজ্ঞতার কারনে তা কোন সময় চাপা পড়ে গেলেও সুযোগ পেলেই জেগে উঠে।
সে রাতের ঘটনা এবং সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়, ওরা আল্লাহর একটা রহমত হিসেবে এসেছেন।
ঠিক বলেছ জেন।
কিন্তু একটা খবর শুনেছ? মুসা ভাই নাকি চলে যাচ্ছেন?
ভীষনভাবে চমকে উঠল মেইলিগুলি। মূহুর্তেই তার মুখের উপর থেকে একটা অন্ধকার নেমে এল। কিছুক্ষন কথা ফুটল না তার মুখে।
ব্যাপারটা নেইজেনের নজর এড়াল না। একটা প্রশ্ন তার মুখ থেকে উচ্চারিত হতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মেইলিগুলি নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, তুমি কার কাছে এ খবর শুনলে জেন?
আব্বার কাছ থেকে শুনেছি। মধ্য এশিয়া এবং ফিলিস্তিন থেকে যে দুজন মেহমান এসেছেন তারা কি যেন চিঠি এনেছেন। ককেশাসের কি নাকি খারাপ অবস্থা। কি খবর যেন এসেছে সেখান থেকে?
হৃদয় কেঁপে উঠল মেইলিগুলির। সমগ্র দেহটা তার একটা অবশ স্রোতে আচ্ছন্ন হলো। নেইজেনের প্রত্যেকটা কথা বিশ্বাস হলো তার।
আর কথা বলতে পারল নয়া মেইলিগুলি। সামনের সাজানো দুনিয়াটা তার সামনে যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। একটা আবেগ যেন তার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলো। গোপন করার জন্যে নেইজেনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল মেইলিগুলি।
নেইজেন বিব্রত হয়ে পড়ল। আহমদ মুসার এই খবর যে মেইলিগুলিকে এই ভাবে আঘাত করবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। পারলে সে অসুস্থ মেইলিগুলির কাছে কিছুতেই এ খবর জানাতো না।
নেইজেন একটু ঝুঁকে পড়ে মেইলিগুলির কপালে হাত রেখে বলল, আপা, আমি বুঝতে পারিনি, এভাবে বলা ঠিক হয়নি।
মেইলিগুলি মুখ ফেরাল। তার চোখে পানি। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে আছে সে। কিন্তু কথা বলতে পারলো নয়া মেইলিগুলি।
নেইজেন মেইলিগুলির মাথার কাছে বসে তার মাথায় হাত রেখে বলল, আপা আমি যা শুনেছি তা সত্য নাও হতে পারে।
মেইলিগুলি চাদরটা মুখের উপর টেনে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
নেইজেনের চোখেও পানি এসেছে। কি বলে মেইলিগুলিকে শান্তনা দেবে তা ভেবে পেলনা নেইজেন। নীরবে মেইলিগুলির মাথায় হাত বুলাতে লাগল।
এক সময় নেইজেন মেইলিগুলির কপালে কপাল রেখে ফিসফিসিয়ে বলল, আপা সব কিছু কি মুসা ভাই জানেন?
জানি না।
অনেকক্ষন পর জবাব দিল মেইলিগুলি।
এই সময় এটেনডেন্ট মেয়েটা ঘরে ঢুকল। একটা স্লিপ দিল নেইজেনের হাতে।
মেইলিগুলি চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়েছিল।
নেইজেন স্লিপটা হাতে নিয়ে দেখল, স্লিপটা আহমদ মুসার।
নেইজেন স্লিপটা মেইলিগুলির হাতে দিল। স্লিপের উপর চোখ বুলিয়ে মুহুর্তের জন্য চোখ বুজল মেইলিগুলি। তারপর এটেনডেন্ট কে বলল স্ক্রিনটা টেনে নিয়ে ওকে বসতে দাও সোফায়।
আহমদ মুসা সোফায় এসে বসলেন। এটেনডেন্ট দরজা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। স্ক্রিনের এপারে মেইলিগুলি ও নেইজেন। নেইজেন বলল, আমি একটু ঘুরে আসি আপা।
মেইলিগুলির মুখটা লাল হয়ে আসল লজ্জায়। সে নেইজেনের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখল।
আজ কেমন আছি আমিনা, তুমি? স্ক্রিনের ওপার থেকে বললেন আহমদ মুসা।
ভাল।
নেইজেন মেইলিগুলির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, উনি বুঝি তোমাকে আমিনা বলে ডাকেন? আন্ডার গ্রাউন্ড নামটা, যা আমরাও জানিনা, তা ওকে জানিয়েছ?
দাদী ওকে বলেছিলেন। বলল মেইলিগুলি।
ডাক্তার বলেছেন, আর দিন চারেকের মধ্যেই তুমি একটু করে চলাফেরা করতে পারবে। বললেন আহমদ মুসা।
মেইলিগুলি নীরব। কি বলবে ভেবে পেল না। নেইজেন বলল, কিছু বলছ না যে, উনি কি মনে করবেন।
মেইলিগুলি কিছু বলার আগেই আহমদ মূসা বললেন, তোমার আব্বা-আম্মা আসছেন আজ সন্ধায়। মা-চু এয়ারপোর্ট থেকেই সোজা ওঁদের এখানে নিয়ে আসবে।
একটু থেমে আহমদ মূসা বললেন, আমি সম্ভবত দুতিন দিন থাকবো না।
কেন?
ত্বরিত প্রশ্ন করল মেইলিগুলি। তার মুখ বিষণ্ন হয়ে উঠল।
আমি আজ কানশুতে যাচ্ছি। কিছুই নেই সেখানে। তবু জন্মভূমিকে দেখতে চাই।
মেইলিগুলির মুখটা ভারি হয়ে উঠল। মাথা নিচু করল সে। তখনই কোন কথা সে বলল না। একটু পরে মেইলিগুলি মুখ তুলে বলল, আমার পরিবারে যা ঘটেছে তার জন্য কি আপনি নিজেকে দায়ী করছেন?
এ প্রশ্ন কেন আমিনা?
আমি জানতে চাই।
মা-চু তোমাকে কিছু বলেছে নিশ্চয়ই। তার ঠিক হয়নি বলা। এসব কথা নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। তুমি সুস্থ হয়ে ওঠ।
না আমি জানতে চাই। মেইলিগুলির কথাটা কাঁপল।
আহমদ মুসা কথা বললেন না। মুখটা তার গম্ভীর হয়ে উঠল। সোফায় হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, আমিনা, আমাকে দায়ী মনে করি না, কিন্তু আমাকে উপলক্ষ করেই সব কিছু ঘটল -এমন চিন্তা অবশ্যই সংগত।
কিন্তু চিন্তাই তো প্রমাণ করে আপনি নিজেকে দায়ী মনে করছেন। অর্থাৎ আমাদের পরিবারের জন্যে যেটা গৌরব তাকে আপনি কেড়ে নিতে চাইছেন নির্মমভাবে।
আমিনা তুমি কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়েছ, আমি এভাবে কথাটা বলিনি।
মেইলিগুলি উত্তরে কিছু না বলে ছুপ করে থাকল। একটু ভাবলো। আমার অনুরোধ কানশুর প্রোগ্রাম আপনি বাতিল করুন।
কেন আমিনা?
আব্বা আম্মা আসছেন।
আহমদ মুসার মুখে এক টুকরা হাসি ফুটে উঠলো। বললেন ঠিক আছে করলাম।
নেইজেন মেইলিগুলির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, প্রথম বিজয় মেইলিগুলি। দেখ আমি বলে রাখলাম যিনি সব মানুষকে ভালোবাসতে পারেন তিনি হৃদয় ভাংতে পারেন না।
মেইলিগুলি নেইজেনের দিকে মুখ তুলে চাইল শুধু। কোন কথা বলল না।
আমিনা, আমি এখনকার মত উঠি। নীরবতা ভেঙ্গে কথা বললেন আহমদ মুসাই।
এখানে নেইজেন আছে। মেইলিগুলি বলল।
নেইজেন এখানে? বিস্ময় প্রকাশ করলেন যেন আহমদ মুসা।
নেইজেন মাথায় চাদরটা ভালো করে টেনে নিয়ে স্ক্রীনের দিকে মুখটা বের করে সালাম দিল আহমদ মুসাকে। বলল ভাইয়া কেমন আছেন?
সালাম নিয়ে আহমদ মুসা বলল, বোনটি, এতক্ষন যে কথা বলনি?
কথা শুনছিলাম তাই।
ভালই হল, শোন তুমি আমিনাকে ভারি বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ কর। ওর স্নায়ুগুলো শান্ত থাকা দরকার।
ভাইয়া একটা কথা বলব?
বল।
মানবতা বড় না কর্তব্য বড়?
মানবতা এবং কর্তব্যকে যদি প্রতিদ্বন্দ্বী ধর, তাহলে প্রশ্ন কঠিন। আমি কিন্তু মনে করি দুটা দুই জিনিস নয়, এক জিনিস। মানবতা যেখানে কর্তব্যও সেখানে।
কিন্তু ধরুন দুটা যদি দুই প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায়?
তাহলে কর্তব্যই আগ্রাধিকার পাবে। কারন মানবতা যদি কর্তব্যবোধ থেকে দূরে সরে যায়, তাহলে তার পিছনে কোন ‘রিজন’ বা যুক্তি থাকে না এবং তাকে তখন সুস্থও বলা যাবে না।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা বললেন হঠাৎ এই দার্শনিক প্রশ্ন কেন নেইজেন?
প্রশ্নের দিকে কান না দিয়ে নেইজেন বলল, কর্তব্যের বাহিরে হৃদয়বৃত্তি বলে কিছু নেই?
আহমদ মুসা থামলেন। বললেন, কর্তব্য হলো যা করনীয়। হৃদয়বৃত্তি বিষয়টা তা থেকে বাহিরে হবে কেন? যদি তা কখনো হয়, তাহলে তা হবে অসংগত এবং তা-ই অবিবেচ্য।
আর একটা প্রশ্ন করব ভাইয়া ?
কর।
আপনাকে নিয়ে আপনি কখন ভাবেন না?
ভাবি। আনন্দিত হলে হাসি, দুঃখ পেলে কাঁদি, বিরক্ত হলে রেগে যাই। এই তো আমাকে নিয়েই তো আমি আছি।
তা নয় ভাইয়া আমি বলতে চাচ্ছি…………।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালেন। তোমার আর কোন প্রশ্ন নয় যেতে হবে আমাকে।
নেইজেন একেবারে পর্দার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। বলল না আরেকটা প্রশ্ন জবাব দিতেই হবে।
আহমদ মুসা পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলেন। বলল ঠিক আছে বল কি তোমার প্রশ্ন।
নেইজেন বলল, আপনাকে নিয়ে আপনি আছেন, ঠিক আছে। কেউ আপনাকে নিয়ে থাকতে পারে তা আপনি দেখবেন না?
আহমদ মুসা বললেন, বোনটি আল্লাহ আমাকে দুচোখ দিয়েছেন দেখার জন্যই তো।
বলেই আহমদ মুসা বেরিয়ে এলেন রুম থকে।
নেইজেন স্ক্রীন ঠেলে চলে গেল ওপারে।
মেইলিগুলি গোগ্রাসে গিলছিল কথা গুলো। নেইজেন গিয়ে মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে মেইলিগুলির মুখের কাছে মুখ নিয়ে বলল, শুনেছ তো আপা ভাইয়া কি বললেন?
থাক ওসব কথা। তুমি ওঁর সাথে এইভাবে কথা বলতে পার? ভয় করে না? জান উনি কত বড়?
মেইলিগুলির কাছে অবশ্যই উনি অনেক বড়, কিন্তু আমার কাছে ভাইয়া।
নেইজেনের মুখে দুষ্টামির হাসি।
এই সময় ঘরে একজন ডাক্তার এবং একজন নার্স প্রবেশ করলো।
নেইজেন ঘড়ির দিকে তাকালো। বেলা চারটা।
আপা তাহলে আজকের মত আসি, বলে মেইলিগুলির কপালে একটা চুমু খেতে গিয়ে ফিসফিসিয়ে আবার বলল, তোমার কপালটা ভাগ্যবান আপা। তারপর ফিরে দাঁড়িয়ে ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

গভর্নর লি ইউয়ানের পারিবারিক ড্রয়িং রুমের সামনে গাড়ি থেকে নেমে আহমদ মুসা ঢুকে গেলেন ভিতরে। আহমদ ইয়াং গাড়িটা পার্ক করে এসে সিড়ি দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল ড্রয়িং রুমে। এমন সময় সেখানে নেইজেনের গাড়ি এসে থামল।
নেইজেন গাড়ি থেকে নেমে পেছন থেকে ডাকল, শুনুন।
আহমদ ইয়াং থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল।
আপনি একা?
মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল নেইজেন।
নেইজেন সেলোয়ার কামিজ পরেছে। সাদা। আর বড় সাদা চাদর জড়িয়েছে গায়ে। চাদরটা কপাল পর্যন্ত নেমে এসেছে।
না মুখ নিচু করে জবাব দিল আহমদ ইয়াং।
কে এসেছেন, মুসা ভাই?
হ্যাঁ । নেইজেন হঠাৎ কিছু যেন বলতে পারলোনা। দুজনেই নীরব।
আহমদ ইয়াং ঘুরে দাঁড়াতে গেল চলে যাবার জন্যে। নেইজেন আবার বলল, শুনুন।
আহমদ ইয়াং ফিরে দাঁড়াল আবার। তার চোখ নিচু। চোখে-মুখে লজ্জা জড়ানো একটা বিব্রত ভাব।
আমার কি অপরাধ হয়েছে?
আহমদ ইয়াং চকিতে একবার চোখ তুলে বলল, কি অপরাধ, না তো।
আপনিতো সে থেকে আর আসেন নি।
প্রয়োজন তো হয় নি।
নেইজেন একটু থেমে বলল, আপনি ফুলটা ফেলে দিয়েছেন না?
না।
এখনও রেখেছেন?
হাঁ।
কেন?
আহমদ ইয়াং-এর মুখটা লাল হয়ে উঠল। কঠিন প্রশ্ন নেইজেন-এর। এ প্রশ্নের জবাব তো আহমদ ইয়াং চিন্তা করে নি। ওয়েল পেপারের ইনভেলাপে তুলে কেন সে ফুলটা সযতনে তুলে রেখে দিয়েছে।
নেইজেন দুষ্টামি ভরা হাসি নিয়ে আহমদ ইয়াং-এর এই বিব্রত অবস্থা উপভোগ করছিল।
আহমদ ইয়াং একটু নীরব থেকে বলল, আমি প্রশ্নটির জবাব ভেবে দেখিনি।
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে ড্রয়িং রুমে উঠে গেল আহমদ ইয়াং।
ড্রয়িং রুমে আহমদ মুসা কথা বলছিলেন লি ইউয়ানের সাথে। নেইজেনের মা মিসেস লি ইউয়ানও তার পাশে বসেছিল।
কথা বলছিল লি ইউয়ান, তুমি যাবে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি?
আজকে আরেকটা খবর পেলাম পিকিং থেকে। মধ্য এশিয়া মুসলিম প্রজাতন্ত্রের দুতাবাস থেকে পাঠানো কাগজ পত্রে দেখলাম, খুব খারাপ অবস্থা ককেশাসে।
মেইলিগুলিদের বলেছ?
সিদ্ধান্তটা এই মাত্র নিলাম। ওদের বলব।
একটু থেমে আহমদ মুসা বললেন, আমি আপনার কাছে দুটা জরুরী বিষয় নিয়ে এসেছি।
বল। বলল লি ইউয়ান।
এম্পায়ার গ্রুপ যে কাজ করছিল, তার দায়িত্ব এখন আপনাকে নিতে হবে। অর্থাৎ সিংকিয়াং-এর মুসলমানদের দায়িত্ব এখন আপনার।
আমি বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করেছি আহমদ মুসা। আমার মত হল এম্পায়ার গ্রপ তাদের কাজ করে যাক। তারা প্রেসার গ্রুপ হিসাবে কাজ করবে। সে প্রেসারে পিকিং সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় আমার পক্ষে সহজ হবে। এই ভাবে একটা পর্যায় শেষ হবার পর আমরা যখন মঝবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছি ভাবব, তখন একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। আমি এম্পয়ার গ্রুপকে আমার সংগঠন হিসাবে সাধ্যমত সব রকম সাহায্য দিয়ে যাবো।
আপনার পরিকল্পনার সাথে আমি একমত। আজ রাতে এম্পায়ার গ্রুপের একটা মিটিং ডেকেছি। সেখানে আপনাকে আমরা চাই।
কোথায় হবে?
আপনি যেখানে চান।
আমার মিটিং রুমে?
হ্যাঁ।
ব্যাপারটা এই রকম হবে, দেশের মুসলিম সংগঠন গুলোর একটা প্রতিনিধিদল আমার সাথে দেখা করতে এসেছে বেসরকারীভাবে। সেখানে আমি ছাড়া সরকারী কেউ থাকবে না।
খুব ভাল আইডিয়া।
খুশি হলেন আহমদ মুসা।
বল, এবার তোমার দ্বিতীয় কথা কি?
আহমদ মুসা পাশে বসা আহমদ ইয়াং-এর দিকে চেয়ে বললেন, তুমি একটু বাইরে বস ইয়াং।
আহমদ ইয়াং উঠে বাইরে গেল।
আহমদ মূসা একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, আমার বোন নেইজেনের একটা বিয়ের কথা চিন্তা করছি।
আহমদ মুসার মুখে এক টুকরো হাসি।
কোথায়?
মিঃ ও মিসেস ইউয়ান এক সাথেই বলে উঠল।
আহমদ ইয়াং-এর সাথে। তার সব কিছুই তো আপনারা জানেন।
মিঃ ও মিসেস লি ইউয়ান দুজনেরই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
মিসেস লি ইউয়ান বলল, আমার অনুমান ঠিক হয়েছে, এই প্রস্তাবের কথাই আমি ভেবেছিলাম।
মিঃ লি ইউয়ান বলল, তোমার প্রস্তাবে আমরা খুশি হয়েছি আহমদ মুসা। কিন্তু ওদের মতটা? নেইজেনকে ডাকি?
ডাকুন। তবে আমার মনে হয় ডাকার দরকার হবে না। আমি ওদের দুজনকে বুঝার পরেই এ প্রস্তাব দিয়েছি।
ঠিক আছে, ডেকে আর লজ্জা দিয়ে লাভ নেই।
এ সময় ড্রইং রুমে প্রবেশ করল নেইজেন। বলল, মুসা ভাই,
আপনি বোধ হয় কাউকে না বলে খুব ভোর বেলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
হ্যাঁ। কাউকে পাইনি। কিন্তু গেটম্যান তো দেখার কথা। কেন কি হয়েছে?
আপা টেলিফোন করেছিলেন? ওরা ভয়ে আতংকে একদম সারা। নাস্তাও হয়নি ওদের। চাচাজান তো কয়েকবার থানায় গেছেন, আইজিকে টেলিফোন করেছেন। চাচিমা তো কেঁদেই সারা।
আমার ভুল হয়েছে নেইজেন। এভাবে কখনও আমি বের হই না। আজ মা-চু ছিল না, তাই অসুবিধায় পড়েছিলাম।
একটু থেমেই আবার বললেন আহমদ মুসা, তাহলে এখন উঠি চাচাজান?
বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালেন।
লি ইউয়ান বলল, একটু দাঁড়াও আহমদ মুসা।
বলে নেইজেন-এর দিকে ফিরে লি ইউয়ান বলল, মা খবর জান, তোমার ভাইয়া তোমাকে বিয়ে দিচ্ছে ?
বাজে কথা।
বলে নেইজেন আহমদ মুসার দিকে তাকাল।
বাজে কথা নয়, আহমদ ইয়াংকে আজ এ জন্যেই সাথে করে এনেছিলাম। হেসে বললেন আহমদ মুসা।
লজ্জায় লাল হয়ে উঠল নেইজেন-এর মুখ। সে ছুটে পালাতে যাচ্ছিল। আহমদ মুসা বললেন, শোন নেইজেন, আমি কাল চলে যাচ্ছি, তাই তাড়াহুড়ো করে এই ব্যবস্থা।
নেইজেন থমকে দাঁড়াল। তার চোখটি বিস্ময়ে বিস্ফারিত। এক পা দুপা করে ফিরে এল। বলল, কাল যাচ্ছেন আপনি ভাইয়া?
হ্যাঁ।
কালই যাচ্ছেন।
প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করল নেইজেন। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, বিশ্বাস করতে যেন চাইছে না সে।
হ্যাঁ বোন কাল যাচ্ছি।
আপা জানেন?
না।
‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল নেইজেন। তারপর বাইরের দরজা দিয়ে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। নেইজেনের আব্বা-আম্মাকে বিস্মিত-বিব্রত মনে হল। আহমদ মুসা আবার বসে পড়েছিলেন সোফায়। তার মুখটা নত। আহমদ ইয়াং এর আগেই ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছিল আহমদ মুসার আহ্বানে। লি ইউয়ান তাকে লক্ষ্য করে বলল, বাবা দেখতো, নেইজেন কোথায় গেল।
আহমদ ইয়াং বেরিয়ে গেল।
কয়েক মুহূর্ত পরে ফিরে এসে বলল, গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে।
পাগল মেয়ে, কোথায় গেল! বলল ইউজিনা, নেইজেনের মা।
ও মেইলিগুলির কাছে গেছে। মুখে ঈষৎ হাসি টেনে বললেন আহমদ মুসা।
কেন?
বোধ হয় আমার যাওয়ার খবরটা দিতে।
দেখতো কি দরকার ছিল, তুমি তো যাচ্ছই!
আহমদ মুসা কোন কথা বললেন না এর উত্তরে। লি ইউয়ান কোন কথা বলেনি। সে যেন কি চিন্তা করছে।
এখন উঠি চাচিমা, চাচাজান, আবার দেখা হবে। বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালেন।
লি ইউয়ান উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এস।
আহমদ মুসা হ্যান্ডশেক করে বেরিয়ে গেলেন।
আহমদ মুসা বেরিয়ে গেলে লি ইউয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল, বলতো আমরা কি মেইলিগুলির বাড়িতে যাব, না মেইলিগুলির আব্বাকে ডাকব।
তোমার আবার কি হল, এ কথা বলছ কেন?
তুমি কিছুই বুঝনি তাহলে?
কি বুঝব?
তোমার মেয়ে আহমদ মুসা চলে যাওয়ার কথায় কেন অমন করে অস্বাভাবিক হয়ে গেল, কেনই বা খবরটা জানাতে মেইলিগুলির কাছে ছুটল, এসব থেকে কিছু বুঝনি?
আচ্ছা ব্যাপারটা তাহলে আহমদ মুসা ও মেইলিগুলি……
একটু চিন্তা করে বলতে শুরু করল ইউজিনা।
ঠিক বুঝেছ, এবার বল কি করব? আমার মনে হচ্ছে দুজনার মধ্যে ইনফরমেশন গ্যাপ আছে।
কিন্তু তুমি আহমদ মুসাকে না জেনে মেইলিগুলির আব্বা-আম্মার সাথে কি আলোচনা করবে? আহমদ মুসা তো আর সাধারণ লোক নয়, গোটা বিশ্বজোড়া তার ঘর। তাকে বাঁধা সহজ নয়।
শোন ইউজিনা, আমার চুল পেকেছে। অভিজ্ঞতা কম হয়নি।
নেইজেন যখন কথা বলছিল, তখন আহমদ মুসার চেহারায় অসহায়ত্ব দেখেছি। মনে হয় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে ।
এখানেই তো সমস্যা। তার সিদ্ধান্ত বা কথা না জেনে এগুনো কি ঠিক হবে?
ইউজিনা, আহমদ মুসা বিশ্ববরেণ্য একজন বিপ্লবী নেতা। কিন্ত সে মানুষ। বিশেষ করে এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রত্যেকেরই একটা দুর্বলতা থাকে। সুতরাং এই ব্যাপারটা তার ওপর ছেড়ে দিয়ে রাখা ঠিক নয়।
মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ। ইয়াং এবং নেইজেনকেও তো আমাদের কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি।
তাহলে……
কিছু বলতে গিয়েছিল লি ইউয়ান। এমন সময় বাইরের দরজা ঠেলে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল মেইলিগুলির আব্বা এবং আম্মা।
লি ইউয়ান ও ইউজিনা বিস্ময় ও আনন্দের সাথে স্বাগত জানাল ওদের।
এই মাত্র আহমদ মুসা গেলেন। আমরা তোমাদের কথাই বলছিলাম। তোমরা বাঁচবে বহুদিন। বলল লি ইউয়ান।
মেইলিগুলির পিতা ঝাও জিয়াং ইবনে সাদ বলল, বাঁচার জন্যে দোয়া করনা ভাই, মুনাফেকী থেকে উদ্ধার যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় ততই মঙ্গল।
মেইলিগুলির পিতা ইবনে সাদ পিকিং-এর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের ডিরেক্টর। লম্বা-চওড়া চেহারা। চেহারার মধ্য দিয়েই তার একটা ঐতিহ্যের ইংগিত পাওয়া যায়। বিখ্যাত সাদ পরিবারের সন্তান হিসেবে সবার বিশেষ একটা সম্মানের পাত্র সে।
আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া কর ইবনে সাদ, মুনাফেকী বেশি দিন করতে হবে না। আহমদ মুসা কিছুদিন মাত্র হলো এসেছে, কিন্তু মনে হচ্ছে আন্দোলন পঞ্চাশ বছর সামনে এগিয়ে গেছে।
আসলেই ওঁর একটা যাদুকরী শক্তি আছে, গোটা দুনিয়ায় ওঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। ও পরাধীন মুসলমানদের মুক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কথা শেষ করে একটু যেন ঢোক গিলল ইবনে সাদ। তারপর বলল, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি বড় ভাই।
কি সমস্যা?
সমস্যা মেইলিগুলিকে নিয়ে।
লি ইউয়ান ও ইউজিনা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর লি ইউয়ান বলল, কেন কি হয়েছে?
কি ভাবে ব্যাপারটা বলব বুঝতে পারছি না। আমরা বুঝেছি মেইলিগুলি আহমদ মুসাকে ভালবেসে ফেলেছে।
কিন্তু সমস্যা কি?
সমস্যা নয়, এটা কি ছোট ব্যাপার? আহমদ মুসার কথা কি আমরা চিন্তা করতে পারি? কত বড় সে! কত কাজ তাঁর। কত বিরাট তাঁর মিশন!
তাহলে?
এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্যেই তো আমরা আপনার কাছে ছুটে এসেছি। জানতে পেরেছি, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই চলে যাবে সে ককেশাসে। তাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি মেয়েটার কথা ভেবে। কিছু হলে বাঁচবে না মেয়েটা।
সাদ, আহমদ মুসা আগামীকাল চলে যাচ্ছে।
কাল?
ইবনে সাদ এবং ফাতিমা, মেইলিগুলির মা, আব্বা-মার সবার এক সাথে একরাশ বিস্ময় ঝড়ে পড়ল।
হ্যাঁ কালই। গুরুত্বপূর্ণ কি খবর এসেছে ককেশাস থেকে।
ইবনে সাদ এবং ফাতিমা কারো মুখেই কোন কথা জোগাল না। বিস্ময়, বেদনা, কিংকর্তব্যবিমুঢ়তা তাদেরকে যেন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।
লি ইউয়ান কিছুক্ষণ আগে যা ঘটেছে সব কথা ইবনে সাদকে জানিয়ে বলল, বিষয়টা আমরাও চিন্তা করছি।
তোমরা না এলে আমরাই তোমাদের কাছে যেতাম। চল গিয়ে চা খাই, পরে কথা হবে। বলে উঠে দাঁড়াল লি ইউয়ান। তাঁর সাথে সকলে।

আহমদ মুসা সিড়ি দিয়ে উঠেই দেখতে পেলেন নেইজেন ও মেইলিগুলি দুজন জড়াজড়ি করে বসে।
আহমদ মুসাকে দেখে দুজনেই তাদের চাদর ঠিক করে নিল। নেইজনে উঠে দাঁড়াল। মনে হল সে কেঁদেছে। কিন্তু ঝগড়াটে দৃষ্টি নিয়ে সে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। আর মেইলিগুলি ভালো করে চাদরটা টেনে দিয়ে অন্য মুখো হয়ে মাথা এলিয়ে দিয়েছে সোফায়।
চাচাজান, চাচিমা কোথায় নেইজেন?
আমি এসে ওঁদের পাইনি, বাইরে গেছেন।
আহমদ মুসা একটু চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, মেইলিগুলির সাথে কথাটা সেরে নিই। বলে আহমদ মুসা এ প্রান্তের একটা সোফায় বসলেন। তাঁর মুখটা উত্তরমুখী। মেইলিগুলি বসে আছে পশ্চিম প্রান্তের একটা সোফায়। নেইজেন চলে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা বললেন, তুমিও বস নেইজেন।
আসছি ভাইয়া, কথা বলুন।
বলে নেইজেন কিচেনের দিকে চলে গেল।
‘আমিনা’ শুরু করলেন আহমদ মুসা। আজ ভোর চারটায় টেলিফোন পেয়েছিলাম হাসান তারিকের। জরুরী একটা পরামর্শ বৈঠক ছিল সাড়ে চারটায়। আমি চলে গিয়েছিলাম। জানিয়ে যেতে পারিনি। তোমরা কষ্ট পেয়েছ, এ জন্য আমি দুঃখিত।
মেইলিগুলি কিছু বলল না।
আবার শুরু করলেন আহমদ মুসা। বললেন, ককেশাস থেকে খারাপ খবর আগেই পেয়েছিলাম। কিন্তু মারাত্মক খবর এসেছে গত রাতে।
আহমদ মুসার সামনে এক কাপ চা রেখে নেইজেন গিয়ে বসেছে মেইলিগুলির পাশে। আহমদ মুসা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, গত কয়েক মাস ধরে ককেশাসে হত্যাকান্ড চলছে, মুসলমানদের অনেক গ্রাম উজাড় হয়েছে। অনেক মুসলমান এলাকা ছেড়া আশ্রয় নিয়েছে শহরে। এতদিন এসব ছিল অনেকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা উপলক্ষ্যে সংঘটিত এসব ঘটনার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দুর্বল ছিল। গত পনের দিন ধরে ঘটনা ভয়াবহ মোড় নিয়েছে। পনের দিনে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের পঁচিশজন প্রভাবশালী মুসলিম নেতা হারিয়ে গেছে। শত চেষ্টাতেও কোথাও কোন চিহ্ন তাদের পাওয়া যায়নি। মধ্য এশিয়া থেকে সাইমুমের একটি ইউনিট সেখানে গেছে কিন্তু তারা ঘটনার কোন কুল কিনারা করতে পারেনি। একটা অদৃশ্য আতংক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা মুসলিম সমাজে। এই সন্ত্রাস পরিকল্পনায় সাহায্য করছে শক্তিশালী ক্লু-ক্লাক্স-ক্লান, ফ্র, এবং রাশিয়ান রিপাবলিক এবং পশ্চিমের কয়েকটি দেশ। গ্রোজনিতে ঘাঁটি করে বসে রাশিয়ান রিপাবলিক বাহিনীর সতর্ক প্রহরাধীন আজার বাইজানের দুর্বল আধা মুসলিম সরকার এই সন্ত্রাস এবং বাইরের চাপের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। ভেতর থেকেও মীরজাফরদের মাধ্যমে এই সরকারকে ধ্বংস করার চেষ্টা চলছে। সরকার ভেঙ্গে পড়লে সেখানকার মুসলমানরা আজ যে বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে তাতে সম্মিলিত চক্রান্তের মুখে মুসলমানদের অস্তিত্ব হয়তো তৃণের মত ভেসে যাবে। এই অবস্থায় সব দিক বিবেচনা করে আমরা সেই মজলুম ভাইদের কাছে ছুটে যাবার সিদ্ধান্ত না নিয়ে পারিনি।
থামলেন আহমদ মুসা।
কিন্তু ভাইয়া……………
কথা শেষ করতে পারলো না নেইজেন। একটা বাঁধ ভাঙ্গা আবেগ এসে তার কন্ঠ ভেঙে দিল। দুহাতে মুখ ঢাকল সে।
তুমি যা বলতে চাচ্ছ আমি তা জানি। হয়ত আমি অবিচারও করছি। কিন্তু……..
অবিচারকে অবিচার বলে বুঝার পর কি সে অবিচার আর করা যায়?
আহমদ মুসাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল নেইজেন।
যায় না কিন্তু অনেকগুলো অবিচার যদি এক সাথে সামনে এসে যায় তাহলে বড় অবিচারকেই প্রথম মোকাবেলা করতে হয়।
ভাইয়া, আপনাকে যুক্তি দিয়ে আটকাতে পারবো না কিন্তু আপনি আপার জায়গায় একটু দাঁড়িয়ে বলুন, আপনি আপা হলে কি করতেন?
নেইজেনের প্রশ্নের ঢংয়ে এই অবস্থাতেও আহমদ মুসার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললেন, তোমার আপা আমি হলে কোন যাযাবরের দিকে চোখ তুলেই চাইতাম না। বিশ্বে যার কোন ঘর নেই তাকে ঘরে বাধাঁর চেষ্টাই করতাম না কিন্তু থাক এসব কথা।
‘না থাকবে না’। আহমদ মুসাকে বাধা দিয়ে বলল নেইজেন, ‘এই চাওয়াটাকে কি সব সময় মানুষের ইচ্ছাধীন বলে মনে করেন ভাইয়া?
না করি না।
আরকটা প্রশ্ন ভাইয়া, যাযাবরের কি মন নেই? যার দুনিয়াতে কোন ঘর নেই তার কি ঘর বাঁধার কোন স্বপ্ন থাকতে পারে না?
নেইজেন, এসব কথা থাক। একটা সমস্যায় আমি পড়েছি। মেইলিগুলির কাছে আমি তা তুলে ধরেছি।
‘বেশ আপনারা কথা বলুন’ বলে নেইজেন কৃত্রিম রাগের সাথে বেরিয়ে গেল ড্রয়িং রুম থেকে।
নীরবতা। আহমদ মুসা ও মেইলিগুলি দুজনেই নীরব।
আমি কি অন্যায় করেছি। মেইলিগুলিই প্রথম নীরবতা ভাঙল।
না তা আমি বলিনি।
আপনি কি একে কোন অবাঞ্ছিত, অহেতুক শৃঙ্খল বলে মনে করেছেন?
না তা মনে করিনি।
আপনি যে সমস্যা তুলে ধরলেন, তার সমাধান কিভাবে চাইছেন?
ককেশাসে আমাকে যেতে হবে, কিন্তু আমার হৃদয় বলছে, তোমার সম্মতি নিয়ে আমার যাওয়া উচিত।
মেইলিগুলির মুখ মনে হলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কিছুক্ষণ কথা বলল না। তারপর বলল, যদি সম্মতি না পান?
আমিনার কাছ থেকে সম্মতি পাব না এটা কোন সময়ই আমার মনে আসেনি।
কেন?
আমাদের প্রয়োজন তুমি বুঝবে।
মেইলিগুলি কোন কথা বলল না। দুজনেই নীরব। অবশেষে কথা বলল মেইলিগুলি। বলল, জানি আমি, দায়িত্ব আপনাকে নিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়, ফিলিস্তিন থেকে মিন্দানাও, মিন্দানাও থেকে মধ্যে এশিয়া, তারপর চীন। আর এ গতি আমি রোধ করতে পারব না।
একটু থামল, একটা ঢোক গিলল মেইলিগুলি। তারপর আবার বলতে শুরু করল, যাওয়ার আগে আমার প্রতি আপনার কি কোন নির্দেশ নেই?
কেঁপে উঠলেন আহমদ মুসা। বুঝতে পারলেন যে, মেইলিগুলি স্পষ্টভাবে কোন কথাটা জানতে চায়।
কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না আহমদ মুসা। তারপর বললেন, আমিনা, আমি অনেকটা স্রোতে ভাসা পানার মত। তার পর আমি যাচ্ছি জীবন-মৃত্যুর এক লড়াইয়ে। তোমাকে কোন নির্দেশ দিয়ে যাবার মত নিশ্চয়তা আমার কি আছে? না তা ঠিক হবে?
মেইলিগুলী কিছু বলল না। তার দুচোখ দিয়ে নেমে এল অশ্রুর দুটি ধারা। নীরব কান্নায় তার মাথাটা এলিয়ে পড়ল সোফার দেয়ালে। কাঁপতে থাকল তার দেহটা।
আহমদ মুসা কোন কথা বললেন না। কান্নায় বাধাও দিলেন না। অনেক্ষণ পর মেইলিগুলি থামল। চোখ মুছল। সোজা হয়ে বসে ধীর কন্ঠে বলল, একটা অনুমতি চাই।
কি?
যতদিন না ফেরেন ততদিন আপনার পথ চেয়ে বসে থাকব।
যদি না ফিরি?
যিনি সব দায়িত্ব পালন করেন তিনি আরেকটা দায়িত্ব অস্বীকার করবেন না আমি জানি।
কি‍‌‌‌‌‌ন্তু এভাবে রাখা তোমার প্রতি আমার একটা জুলুম হবে।
তাই যদি বলেন, আমিও তো আপনার প্রতি জুলুম চাপিয়ে দিচ্ছি।
একটু থামল মেইলিগুলি। তারপর আবার বলল, আপনি যাকে আমার উপর জুলুম বলছেন সেটা আমার জন্য আনন্দ, আমার জীবনের সম্বল। কিন্তু জনাব, আমি আমার জুলুম থেকে আপনাকে মুক্তি দিচ্ছি। আমি আপনাকে বিয়ের অনুমতি দিলাম।
আমিনার কথাগুলো অত্যন্ত শান্ত। একটুও কাঁপলো না তার কন্ঠ। আহমদ মুসা মাথা নিচু করে বসেছিলো। মেইলিগুলির স্থির, শান্ত কথাগুলির এক অশরীরি শক্তি তার সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে দিল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, আমিনা দোয়া করো, যে আস্থা তুমি আমার ওপর রাখলে তার সামান্য অবমাননা যেন আমার দ্বারা না হয়।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালেন। বেরিয়ে গেলেন ড্রইং রুম থেকে।
নেইজেন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। সে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মেইলিগুলিকে। অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলল, এ তুমি কি করলে আপা ? আমি এ হতে দেব না।
মেইলিগুলির দুচোখ দিয়ে নিঃশব্দে জলের দুটি ধারা নেমে এল। সে বলল, নেইজেন, একটি বড় মিশন নিয়ে উনি যাচ্ছেন। নিশ্চিন্ত মন নিয়ে ওঁর যাওয়ার দরকার। তাঁর কাজ আমাদের সবার কাজ। ওঁকে আর বিরক্ত করো না। দোয়া কর ওঁর জন্যে।
আপা আপনি ভাই্য়ার মধ্যে হজম হয়ে গেছেন। তাই তাঁর মত করেই কথা বলছেন। কিন্তু আমি এ হতে দেব না।
কি করবে তুমি?
অস্ত্র আমার হাতেও আছে।
কি অস্ত্র?
টের পাবে, ভাইয়াকে কাবু করার মত অস্ত্র।
দুপুর বারটায় উরুমচি থেকে আহমদ মুসার বিমান উড়বে আকাশে।
বিমান যাবে পিকিং, সেখান থেকে তাসখন্দে। বিয়ের আয়োজনটা খুব সিম্পলভাবে হলেও সময় তাতে লাগলোই। লি ইউয়ান তার প্রথম মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে, ঘটনা খুব ছোট নয়। লি ইউয়ান তার গভর্নর ভবনে এ বিয়ের আয়োজন করেনি। যথা সম্ভব হৈ চৈ এড়ানোর জন্যে উরুমচিতে তার পৈত্রিক বাসভবনেই বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যবস্হা করেছে।
লি ইউয়ান আহমদ ইয়াং-এর পিতা ওয়াং চিং চাইকে বিমানে করে আনার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তিনি অসুস্হতার জন্য আসতে পারেননি। তিনি সব ভার আহমদ মুসার উপর দিয়ে দিয়েছিলেন।
সব আয়োজন ঠিকঠাক করে বিয়ের সময়টা দশটার আগে নির্ধারণ করা কিছুতেই সম্ভব হয়নি। লি ইউয়ান এতে কিছুটা বিব্রত বোধ করেছে। কিন্তু আহমদ মুসা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে, না কোন অসুবিধা নেই। তারা শুধু যাবার আগে এই নতুন দম্পতিকে দোয়া করার সুযোগ চায়।
বিয়ের সব আয়োজন সম্পূর্ণ।
লি ইউয়ানের বাড়ির বাইরের ঘরটায় বর বসেছে। তার সাথে আছে আহমদ মুসা, হাসান তারিক, আবদুল্লায়েভ এবং এম্পায়ার গ্রুপের নেতৃবৃন্দ ও কর্মী। এ ছাড়াও আছে লি ইউয়ানের আত্মীয়-স্বজন।
আর মেয়েরা বসেছে বাড়ির ভেতরে পারিবারিক ড্রইংরুমে। সেখানে নেইজেনকে ঘিরে মেইলিগুলি এবং অন্যান্য আত্মীয়। নেইজেনের মা ইউজিনা এবং মেইলিগুলির মা ফাতিমা ব্যবস্হাপনা নিয়ে ছুটাছুটি করে বেড়াচ্ছে।
দশটা এক মিনিটে মেয়ের ‘এজেন’ নেবার সময় নির্দিষ্ট হয়েছে। তখন নটা পঞ্চাশ মিনিট। বিয়ে মজলিস থেকে মেয়ের ‘এজেন’ নেবার জন্যে যারা যাবে তারা তৈরি। লি ইউয়ান শেষ প্রস্তুতিটা দেখার জন্যে একটু আগে ভেতরে গেছে।
লি ইউয়ান দেরি করে ফিরে এল। তার মুখটা শুকনো। এসেই সে আহমদ মুসাকে ডাকল। আহমদ মুসা তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন তার কাছে।
লি ইউয়ান বলল, নেইজেন ভয়ানক মুশকিল বাঁধিয়েছে।
কি মুশকিল? উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন আহমদ মুসা।
নেইজেন বলছে, আমি বিয়ে এখন করব না। ভাইয়া এলে তার সাথে একসাথে বিয়ে করব।
এই কথা এখন বলছে সে?
হ্যাঁ।
আপনি তাকে বুঝাননি যে, সব আয়োজন কমপ্লিট, বিয়ের আসরে সবাই বসে গেছে, এখন আর ফেরার কোন উপায় নেই।
এতক্ষণ ধরে বুঝালাম, কিন্তু তার ঐ এক কথা। সে আরো বলছে বাইরের লোক তো ডাকা হয়নি, সবাই আত্মীয়-স্বজন এবং নিজেদের লোক। কোন ক্ষতি হবে না বিয়ে স্হগিত রাখলে।
আহমদ মুসা মাথা নিচু করে চিন্তা করছিলেন। গত কয়েকদিন নেইজেনকে যতটুকু জেনেছে, তাতে বুঝেছে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ সে। জেদ আছে বটে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে এমনটা করার মত অবিবেচক তো তাকে মনে হয়নি।
মুখ তুলে আহমদ মুসা বললেন মেইলিগুলি কোথায়?
ওখানেই আছে।
ওকে একটু ডেকে দিন।
আহমদ মুসা ও লি ইউয়ান দুজনেই ভেতরে গেলেন। একটা কক্ষে আহমদ মুসাকে রেখে মেয়েদের বিয়ের আসরে গেল মেইলিগুলিকে ডাকতে। মেইলিগুলি এসে দরজার আড়ালে দাঁড়াল। বলল, আমাকে ডেকেছেন জনাব?
হ্যাঁ আমিনা। নেইজেন কি পাগলামী শুরু করেছে বল তো?
সে কারো কথাই শুনছে না। চাচি আম্মা তো বসে বসে কাঁদছেন।
তুমি তাকে বুঝিয়েছ?
শুধু বোঝানো সহজ নয়। আমি তার হাত ধরে অনুরোধ করেছি সকলের মান-সম্মান রক্ষা করার জন্যে। কিন্তু তার কথা থেকে সে একটুও নড়েনি।
তাহলে?
একমাত্র আপনিই তাকে রাজি করাতে পারেন বলে মনে হয়। তাকে আপনি একটু বলুন।
পিতা-মাতা, মেইলিগুলি সবাই যদি ব্যর্থ হয়ে থাকে তার কথা কি আর থাকবে,আহমদ মুসা ভাবলেন। তিনি মেয়েটাকে বোন ডেকেছেন।
এমনি অনেককেই তো আহমদ মুসা বোন ডাকেন। কিন্তু ডাকের সাথে সাথেই নেইজেন যেন আহমদ মুসার বোন হয়ে গেছে। ওর ‘ভাইয়া’ ডাকে কোন কৃত্রিমতাই আহমদ মুসা দেখেন না। বোনের মত সে ভাইয়ার সাথে কথা বলে আবদার জানায়। আহমদ মুসার ছোট বোন নেই। ছিল লায়লা, মারা গেছে সে ছয় বছর বয়সে। তার ভাইয়া ডাক এখনও তার কানে বাজে।
নেইজেনর ভাইয়া ডাকের মধ্যে লায়লার কন্ঠই যেন শুনতে পায়। ইতিমধ্যেই অপরিসীম একটা স্নেহের সৃষ্টি হয়েছে নেইজেনের জন্যে তার মনে।
আহমদ মুসা পাশে দাঁড়ানো লি ইউয়ানকে বললেন, নেইজেনকে একটু ডাকুন, আমি কথা বলে দেখি।
নেইজেন এল। বিয়ের সাজ তার গায়ে। সে এসে দরজার বাইরে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়াল।
বলুন ভাইয়া। কথা শুরু করল নেইজেন।
কি পাগলামী তুমি শুরু করেছ বলতো?
পাগলামী নয়, খুব সামান্য কথা বলেছি।
এটাকে তুমি সামান্য বলছো?
কেন বিয়ে স্থগিত হয় না?
হয়, কিন্তু স্থগিত হওয়ার মত কোন অসুবিধা-গণ্ডগোল কিছুই তো এখানে নেই।
কিন্তু আমি তো আমার অসুবিধার কথা বলেছি।
কি অসুবিধা?
আমার ভাইয়া একটা বড় মিশনে যাচ্ছেন, আমি এখন বিয়ে করব না। ভাইয়া ফিরে এলে বিয়ে করব।
কিন্তু তোমার ভাইয়াই তো চেয়েছেন এখনই বিয়ে হোক।
কিন্তু আমি চাচ্ছি না।
তোমার ভাইয়াকে অপমান করবে?
এত ক্ষুদ্র ঘটনায় অপমানিত হবার মত ছোট আমার ভাইয়া নন।
তোমার ভাইয়া তোমাকে যদি এখন নির্দেশ দেয়?
অন্য সকলের কাছে ভাইয়া নেতা, সুতারাং তার নির্দেশ সকলের শিরোধার্য। কিন্তু আমার কাছে ভাইয়া ভাইয়াই। বোনের ওপর ভাইয়ার অধিকার আছে, সেই অধিকারে ভাইয়া নির্দেশ দেবেন। বোনেরও তো ভাইয়ার ওপর অধিকার আছে, সেই অধিকারে বোন নির্দেশ অমান্য করবে। আমার পরিষ্কার কথা। ভাইয়া ফিরে এলে ভাই বোন এক সাথে বিয়ে করব।
নেইজেনের শেষ কথায় হঠাৎ তার মনোভাব আহমদ মুসার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে চমকে উঠলেন আহমদ মুসা। এটা কি সম্ভব এখন? আর দুঘণ্টা সময় আছে, এর মধ্যে মেইলিগুলির সাথে তার বিয়ের আয়োজন কি সম্ভব, না উচিত! কিন্তু পরিষ্কার হয়ে গেছে নেইজেন তার শর্ত থেকে সরে দাঁড়াবে না। সে ভেবে চিন্তেই এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে। যাতে আর কোন বিকল্প না থাকে।
তবু আহমদ মুসা বললেন, বোন নেইজেন, তুমি কি বলতে চাও এতক্ষনে আমি বুঝেছি। এই জেদ কি তোমার ঠিক হচ্ছে? তুমি তো জান, আমি আমিনার সম্মতি নিয়েছি।
আমি এই সম্মতি মানি না, মানবো না।
নেইজেনের শেষের কথাগুলো ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়। সে কান্না জড়িত কন্ঠে বলতে লাগল, ভাইয়ার ভালমন্দ চিন্তা করার অধিকার বোনের আছে। আমার ভাইকে আর এক মুহূর্ত আমি যাযাবর থাকতে দেব না, ঘরহীন থাকতে দেব না, তার ঠিকানা অবশ্যই একটা থাকবে।
তোমার কোন কথাই আমি অস্বীকার করছি না নেইজেন। কিন্তু এর একটা সময় তো আছে। নরম কণ্ঠে বুঝাতে চেষ্টা করলেন আহমদ মুসা নেইজেনকে।
কোন সময় অসময় নয়। আমি জিজ্ঞেস করি ভাইয়া, বিয়ে করে যুদ্ধ যাত্রার ইতিহাস কি ইসলামে নেই?
আহমদ মুসা কথা বললেন না। মাথাটা একটু নিচু করলেন। একটু চিন্তা করলেন। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন দশটা বাজে। আহমদ মুসা বললেন, ঠিক আছে নেইজেন। বোনের কাছে ভাইয়া হার স্বীকার করল। তোমাদের ‘এজেন’টা ঠিক সময়ে হয়ে যাক। তারপর তোমার ভাইয়েরটা।
‘ভাইয়া’ বলে একটা চিৎকার করে ছুটে গেল নেইজেন। গিয়ে জড়িয়ে ধরল মেইলিগুলিকে।
আহমদ মুসা তার পাশে দাঁড়ানো লি ইউয়ানকে বললেন, আপনি আমিনার মতটা নিন এবং তার পিতামাতাকে বলুন।
লি ইউয়ান নতমুখে দন্ডায়মান আহমদ মুসাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, বাবা তোমাদের দুভাইবোনের কথা শুনলাম। আমার কোন ছেলে নেই এ দৃশ্য আমার কাছে অভূতপূর্ব। আমার আজ গর্বে বুক ফুলে উঠছে এক ছেলে পেয়ে। বাবা আমার বেঁচে থাক।
আহমদ মুসাকে আলিঙ্গন থেকে ছেড়ে দিয়ে বলল, বাবা তুমি আহমদ ইয়াং-এর কাছে যাও। আমি এদিকে সব ব্যবস্থা করছি। আর নেইজেনের ‘এজেন’ নেবার জন্যে ওদেরকেও পাঠাও।
আহমদ মুসার চোখের দুকোণায় দুফোঁটা পানি এসে জমা হয়েছিল। চোখ মুছে তিনি চলে গেলেন বিয়ের আসরে।
আহমদ ইয়াং ও নেইজেনের বিয়ের পর আহমদ মুসা ও মেইলিগুলির বিয়ে সম্পন্ন করতে এগারটা পনের মিনিট বেজে গেল। মেইলিগুলির সম্মতি আদায়ে বেশ সময় নিয়েছে। তার বক্তব্য ছিল আহমদ মুসাকে চাপের মুখে ফেলে এই সম্মতি আদায় ঠিক হয়নি, কিছুতেই এ বিয়ে এভাবে হতে পারে না এ নিয়ে বহু কাঁদাকাটি সে করেছে। অবশেষে আহমদ মুসাকে মেইলিগুলির সাথে কথা বলতে হয়েছে। আহমদ মুসা তাকে বলেছেন, নেইজেনের উপর রাগ করো না আমিনা। সে যেটা করেছে , আল্লাহর ইচ্ছা হয়তো সেটাই।
বিয়ে অনুষ্ঠান শেষে প্রীতিভোজের পাঠ চুকাতে আরো পঁচিশ মিনিট চলে গেল। এয়ারপোর্টে কমপক্ষে এগারটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে যাত্রা করতেই হবে।
খাওয়া শেষ করে আহমদ মুসা ভেতরে আসতেই নেইজেনের মা প্রায় কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল, বাবা মেইলিগুলির সাথে যে তোমাকে দেখা করাতেই পারলাম না। কালকে গেলে হয় না বাবা?
না আম্মা, দেরী করা যাবে না। একদিন দেরী করে গেলে গোটা পরিকল্পনা গরমিল করে দেবে। এয়ারপোর্টে যাবার পথে আমার গাড়িতে মেইলিগুলিকে তুলে নেব। গাড়িতেই ওর সাথে কথা বলব।
তা হয়না বাবা।
কিছু চিন্তা করবেন না আম্মা। চলুন, আমিনার আম্মা-আব্বা কোথায়।
মেইলিগুলির পিতামাতা, মেইলিগুলি ও নেইজেন সবাই এক ঘরে বসে ছিল। আহমদ মুসা তাদের সালাম দিলেন।
মেইলিগুলি আহমদ মুসাকে দেখে মাথার চাদরটা টেনে দিয়েছিল। মুখের অর্ধেকটাই ঢেকে গেছে চাদরে। নেইজেন উঠে চাদরটা টেনে মাথা পর্যন্ত সরিয়ে এনে বলল, এখন আর ভাইয়ার কাছে মুখ ঢাকার পর্দা তো দরকার নেই। মেইলিগুলির মা নেইজেনের মায়ের মতই চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠল, বাবা অন্তত একটা দিন কি থাকা যায় না?
না আম্মা, একটা দিন দেরী করলে গোটা পরিকল্পনাই ঢেলে সাজাতে হবে।
ককেশাসে তুমি কবে যাচ্ছ?
তাসখন্দে পৌছার পরই আমি বিস্তারিত জানতে পারব আম্মা।
ককেশাসের সাথে আমাদের যোগাযোগ কিভাবে হবে?
সেখানে যাওয়ার আগে সবকিছুই আমার কাছে অন্ধকার।
ভাইয়া, আমার ভয় করছে, আপনার ভয় করছে না সেই ভয়ংকর অন্ধকারে পা বাড়াতে? বলল নেইজেন।
কিসের ভয় করব. জীবনের ভয়?
জীবনের মায়া করলে তো হাসি মুখে এবং দ্বিধাহীন চিত্তে মৃত্যুমুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব না। আর তা না পারলে শত্রুর সাথে আমরা লড়ব কি করে?
মৃত্যুকে জ্বলজ্যান্ত দেখে ভয় করে না? আমি সেই কথাই বলছি। বলল নেইজেন।
ভয় করবে কেন? মৃত্যু তো একবারই আসবে এবং আসবে আল্লাহ যখন নির্ধারিত করেছেন তার এক মিনিট আগেও নয় পরেও নয়।
আহমদ মুসা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, আম্মা-আব্বা আপনারা আমাকে দোয়া করুন। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমাকে বেরুতে হবে। প্রস্তুতির কিছু বাকিও আছে আমার। এই সময় চোখ তুলে মেইলিগুলি আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তার দুচোখ জলে ভরা। বিয়ের পর এটাই প্রথম দৃষ্টি বিনিময়। আহমদ মুসা এই প্রথম দেখল মেইলিগুলিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে। দুজনের কেউই চোখ সরাতে পারছিল না। অবশেষে আহমদ মুসাই তার চোখ টেনে নিয়ে বললেন, তুমি তৈরী হও আমিনা। আমার সাথে তুমি এয়ারপোর্টে যাবে।

গাড়ির এক মিছিল চলছে এয়ারপোর্টের দিকে। সামনে পেছনে এম্পায়ার গ্রুপের কর্মীদের গাড়ী। মাঝখানে পর পর চারটি করে। সামনেরটিতে হাসান তারিক, যুবায়েরভ, আবুল ওয়াফা, ও আব্দুল্লায়েভ। তারপর আহমদ মুসার গাড়ী। আহমদ মুসা নিজেই ড্রাইভ করছেন। তার পাশে মেইলিগুলি। আহমদ মুসার পেছনে আহমদ ইয়াং এবং নেইজেনের গাড়ী। তার পরের গাড়িতে আছেন নেইজেনের মা ইউজিনা এবং মেইলিগুলির আব্বা-আম্মা।
ধীর গতিতে চলছে গাড়ী। স্টিয়ারিং হুইল ধরা আহমদ মুসার হাত। তার দৃষ্টি সামনে। মেইলিগুলি মুখ নিচু করে বসে আছে। তার চোখ দুটি ভারী।
আহমদ মুসা মেইলিগুলির দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, কথা বলছ না যে?
মেইলিগুলির মুখটা লাল হয়ে উঠল। একটু চুপ করে থেকে সে বলল, এমনটা হয়ে গেল কিছু মনে করনি তো?
আল্লাহ হয়তো আমার জন্য ভালটাই করেছেন। এখন কি মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে, আমার একটা শিকড় আছে। আগে আমার সামনেটাই ছিল সব, পেছন বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু এখন পেছনে এক প্রবল আকর্ষন।
এ আকর্ষণ তোমার কাজের গতির ক্ষতি করবে না তো?
এ আকর্ষণ পেছনে টানার আকর্ষণ নয়। জীবনটাকে আরো ভালবাসার আকর্ষণ। সত্যি আমিনা শূণ্যতা যে একটা ছিল এখন পূর্ণতার পরই তা বুঝতে পারছি।
আহমদ মুসা কথাটা শেষ করেই একবার মেইলিগুলির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, সবাই অন্তত একটা দিন থাকতে বলল, তুমি তো কিছু বললে না।
বললে তুমি যেতে পারবে না এ ভয়ে।
ভয় কেন?
ককেশাস সম্পর্কিত তোমার পরিকল্পনার ক্ষতির ভয়। আমি চাইনি আমাদের এই মিলন আন্দোলনের ক্ষতির কারণ হোক। তোমাকে তো সেখানে কত কষ্ট করতে হবে। তার সাথে আমার এ ভাগ্যটুকু জুড়ে দিতে পেরে খুবই গর্ব বোধ করছি।
আহমদ মুসা মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেইলিগুলির দিকে তাকালেন। তারপর ডান হাত স্টিয়ারিং হুইলে রেখে বাঁ হাত বাড়িয়ে দিলেন মেইলিগুলির দিকে। মেইলিগুলি একটু সরে এল । আহমদ মুসা তার ডান হাতটা তুলে নিয়ে তাতে চুমু খেলেন। বললেন আমিনা, তুমি হবে আমার সামনে এগুবার শক্তি, আমার সংগ্রামের প্রেরণা।
মেইলিগুলি আহমদ মুসার হাতটি আর ছাড়ল না। হাতটি দুহাতে জড়িয়ে ধরে তাতে মুখ গুঁজল।
আহমদ মুসা হাত টেনে নিলেন না।
মেইলিগুলির চোখের পানিতে আহমদ মুসার হাত ভিজে গেল।
কাঁদছ তুমি আমিনা? নরম কন্ঠে বললেন আহমদ মুসা।
মেইলিগুলি আহমদ মুসার হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে বলল, তুমি কিছু মনে করো না, এ আমার কান্না নয়, আনন্দ। বিদায়ের আগে এতটুকু স্পর্শ তোমার পাই, আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছিলাম। আল্লাহ তা পূরণ করেছেন।
গাড়ি বিমান বন্দরে এসে পৌঁছল। বিমান উড়ার আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি।
আহমদ ইয়াংসহ এম্পায়ার গ্রুপের কর্মীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। আহমদ ইয়াং কাঁদছে। সকলের চোখেই পানি।
গাড়ির পাশেই মায়েদের সাথে সারা গা চাদরে ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে মেইলিগুলি এবং নেইজেন। তাদেরও চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মেইলিগুলি কাঁদবে না ভেবেছিল। কিন্তু পারল না নিজেকে ধরে রাখতে। এম্পায়ার গ্রুপের নেতা ও কর্মীদের কাছে বিদায় নিয়ে আহমদ ইয়াং এর কাছে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল আহমদ মুসা। আহমদ ইয়াং হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কিন্তু আহমদ মুসার চোখ একেবারে শুকনো, মুখে হাসি। আহমদ ইয়াং এর পিঠ চাপড়ে আহমদ মুসা চলে এলেন নেইজেন ও মেইলিগুলির কাছে। নেইজেনকে বললেন, বোকা বোনটি, ভাইয়ের বিদায়ের সময় হাসি দিতে হয়, কান্না নয়। ক্রন্দনরতা মেইলিগুলির কাছে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসা বললেন, আমিনা, তাকাও আমার দিকে, দেখ আমার চোখে কোন অশ্রু নেই, আছে আল্লাহ। একজন সৈনিক হিসেবে আল্লাহর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ।
মেইলিগুলি চোখ তুলে তাকাল আহমদ মুসার দিকে। দেখল আহমদ মুসার চোখে নিশ্চিত প্রত্যয়ের এক প্রদীপ্ত শিখা। সে শিখা যেন সব শংকা, সব দুর্ভাবনা নিমেষে দূর করে দেয়।
মেইলিগুলি চোখ মুছল। বলল, তুমি আমাকে মাফ কর।
আহমদ মুসা বললেন, মেইলিগুলি মনে রেখ তুমি সেই মুসলিম মহিলাদের উত্তরসূরি, যারা স্বামী এবং সন্তানদের শাহাদতের খবর শুনে হাত তুলে প্রার্থনা করেছে- হে আল্লাহ; আমার আরও সন্তান থাকলে তাদেরকেও তোমার রাস্তায় শহীদ হবার জন্যে পাঠাতাম!
মেইলিগুলি বলল, আমার জন্যে তুমি দোয়া কর।
‘ফি আমানিল্লাহ’ বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে সবাইকে সালাম দিয়ে টারমাকের দিকে পা বাড়ালেন আহমদ মুসা। বিমানের সিঁড়িতে একজন তাকে রিসিভ করার জন্যে দাঁড়িয়ে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.