০৭. তিয়েনশানের ওপারে (পর্ব ১-২)

০৭. তিয়েনশানের ওপারে 


পর্ব ১

আব্দুল গফুরের বাড়ি থেকে তারা মাত্র কয়েক’শ গজ এগিয়েছে। হেলিকপ্টারের কাছে পৌঁছতে এখনও অনেকটা পথ বাকী। হাসান তারিক আগে আগে চলছিল, পেছনে আব্দুল্লায়েভ। রাস্তার দু’ধারে আব্দুল্লায়েভদের গমের ক্ষেত। বলিষ্ঠ সবুজ গমের গাছগুলো দু’ফুটের মত লম্বা হয়ে উঠেছে। সামনে রাস্তার ডানপাশে একটা ঝোপ।
উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিটা সামনে ছড়িয়ে পথ চলছিল হাসান তারিক। মনে মনে গুন গুন করে আল-কোরআনের একটা আয়াত পাঠ করছিলঃ ‘রাব্বানাগ ফিরলানা যুনুবানা ওয়া ইসরাফানা ফি আমরিনা ওয়া সাব্বিত আকদামানা ওয়ানসুরনা আলাল কাউমিল কাফিরীন।’
হঠাৎ হাসান তারিকের চোখে পড়ল কারো একটা মাথা যেন ঝোপের বাইরে এসেই আবার ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে গেল। হাসান তারিকের সতর্ক স্নায়ুতন্ত্রী জুড়ে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। হঠাৎই মনটা তার তোলপাড় করে উঠল। চিন্তা দ্রুত হলো। কে লুকাল ওমন করে ঝোপের মধ্যে কেন লুকালো?
পেছন দিকে না ফিরেই হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, ‘আব্দুল্লায়েভ’ পাড়ায় তোমাদের কি কোন শত্রু আছে?’
‘না’-আবাদুল্লায়েভ জবাব দিল। তারপর উল্টো প্রশ্ন করল, ‘কেন এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন?’ আব্দুল্লায়েভের কন্ঠে বিস্ময়। হাসান তারিক কোন জবাব দিল না আব্দুল্লায়েভের প্রশ্নের। নানা চিন্তা তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগল, জেনারেল বরিসরা কি চলে গেছে? বড় একটা শিকার তারা ধরেছে বটে, কিন্তু আর কি শিকার নেই? মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্রের প্রধান কর্ণেল কুতায়বাও কি লোভনীয় শিকার নয়? এই কথা চিন্তা করার সাথে সাথে হাসান তারিকের মনটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সেই সাথে পীড়া অনুভব করল মনে, এই সহজ সম্ভাবনার কথাটা কেন তাদের আগে মনে হয়নি।
তখনও ঝোপটা ১শ গজের মত দূরে। নিশ্চিত না হয়ে আর এগুনো ঠিক মনে করল না হাসান তারিক।
দাঁড়িয়ে পড়ল সে। বিস্মিত আব্দুল্রায়েভ পাশে এসে দাঁড়াল। হাসান তারিকের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কিছু ঘটেছে তারিক ভাই?’ তার কন্ঠে উদ্বেগ।
আব্দুল্রায়েভের প্রশ্নের প্রতি কোন মনোযোগ না দিয়ে হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, ‘কেউ বা কারা যেন এ ঝোপে লুকিয়ে আছে। তারা এ পাড়ার কেউ হতে পারে বলে কি তুমি মনে কর?’
একটু চিন্তা করল আব্দুল্লায়েভ। তারপর বলল, আমাকে দেখার পর কোন উদ্দেশ্যে কেউ এই ঝোপে লুকাবে এমন কেউ এই পাড়ায় নেই।’ একটু দম নিয়ে সে বলল, ‘এমন কিছু কি ঘটেছে তারিক ভাই?’
‘হ্যাঁ।’ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল হাসান তারিক।
‘তাহলে আমি দেখি’ বলে সামনের দিকে পা বাড়াতে চাইল আব্দুল্লায়েভ। হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দিল হাসান তারিক। বলল, ‘কোন ব্যাপারকেই ছোট করে দেখা ঠিক নয় আব্দুল্লাহ, রিভলবারটা বের করে নাও। দেখ ওটা গুলি ভর্তি আছে কিনা।’ বলে হাসান তারিক নিজেও জ্যাকেটের পকেট থেকে নিজের রিভলভারটা বের করে নিল।
এই সময় পেছনে আব্দুল্লায়েভের বাড়ির দিক থেকে সাব মেশিনগানের একটানা ব্রাশফায়ারের আওয়াজ ভেসে এল।
চমকে উঠে পেছন ফিরল দু’জনেই। মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। ঝোপের দিক থেকে গর্জে উঠল কয়েকটা সাবমেশিনগান।
বিদ্যুত বেগে দু’জনেই বসে পড়ল। বসে পড়েই এক হাতে রিভলভার অন্য হাতে আব্দুল্লায়েভের হাত ধরে টেনে নিয়ে দৌড় দিল হাসান তারিক রাস্তার ডান পাশে একটা গাছের আড়ালে।
সেই ঝোপ থেকে ওরা জনা পাঁচেক লোক গুলি করতে করতে ছুটে আসছিল রাস্তা দিয়ে। প্রায় ৫০ গজ দূরে ওরা এসে পড়েছে। ওদের চোখে সন্ধানী দৃষ্টি, কিছুটা বিমূঢ় ভাবও। দু’জন মানুষ হঠাৎ কোথায় গেল এটাই বোধ হয় চিন্তা। কিন্তু তাদেরকে খুব সতর্ক মনে হলো না। লক্ষ্যহীনভাবে গুলির দেয়াল সৃষ্টি করে সৈনিকরা যেমন আত্মরক্ষামূলকভাবে সামনে এগোয়, তাদের আচরণটা সে রকমই। তাদের লক্ষ্য রাস্তা বরাবর সামনের দিকে, পাশের দিকে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
আরো কাছে চলে এসেছে তারা। গাছের গুড়ির সাথে মিশে রিভলভার বাগিয়ে অপেক্ষা করছিল হাসান তারিক। গাছের বাম পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল ওদের গুলি। কিছু গুলি এসে গাছে বিদ্ধ হচ্ছিল। কচিৎ দু’একটা গাছের ডান পাশ দিয়ে আসছিল। ওরা যখন আরও কাছে এসে পড়ল; তখন ডান পাশ দিয়ে গুলি আসা বন্ধই হয়ে গেল। হাসান তারিক এবার তার রিভলভারের ট্রিগারে আঙ্গুল চেপে মাথাটা একটু বাড়াল।
হঠাৎ ওদের একজনের দৃষ্টিতে পড়ে গেল হাসান তারিক। চোখাচোখি হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ওর ষ্টেনগানের মাথাটা এদিকে মোড় নিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তারিক তাকে আর সুযোগ দিল না। দু’হাতে রিভলভার ধরে ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলি দিয়ে প্রচন্ডভাবে চেপে ধরল ট্রিগার। সাইমুমের এম-১০ অটোমেটিক রিভলভার ঝাঁকি দিয়ে জেগে জেগে উঠল। ছুটে চলল গুলির বৃষ্টি। স্পট টার্গেট, লক্ষ্যভ্রষ্ট হবার কোনই কারণ নেই। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। পাঁচটি লাশ মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে।
আরও কয়েক সেকেন্ড পার হলো। না; আর কেউ এল না। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ।
‘ফ্র’ -এর ইউনিফরম পরা লাশগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে ছুট দিল হাসান তারিক আব্দুল্লায়েভের বাড়ীর দিকে। পেছনে তার আব্দুল্লায়েভ । গুলি বৃষ্টির শব্দ তখনও আসছে সেদিক থেকে। হাসান তারিকরা যখন বৈঠকখানার চত্বরে পৌছঁল, তখন গুলি থেমে গেছে এবং বাড়ির গেট ও বৈঠকখানার দরজা দিয়ে সাইমুম কর্মীরা সাবমেশিনগান বাগিয়ে বেরিয়ে আসছিল।
হাসান তারিক ওদের বলল, ‘এদিক থেকে আর কোন ভয় নেই, পাঁচ জনকে শুইয়ে রেখে এসেছি। এখানে খবর কি? কিছু হয়নি তো? হাসান তারিকের কন্ঠে উদ্বেগ।
একজন সাইমুম কর্মী বলল, ‘জনাব কুতায়বা ভাল আছেন কিন্তু. ……..’
‘কিন্তু কি?’ প্রশ্ন করল হাসান তারিক। প্রশ্ন করেই কোন জবাবের অপেক্ষা না করে হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ ছুটে গেল বাড়ির ভেতর। দেখল তারা, বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে খামার বাড়ির সাথে যে প্যাসেজ সেই প্যাসেজে পড়ে আছে দু’টি দেহ। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে কুতাইবা এবং ইকরামভ। আর ডান দিকে বড় ঘরের দরজার সামনে শিরীন শবনম ব্যান্ডেজ বাঁধছে আয়েশা আলিয়েভার বাম বাহুতে, কনুয়ের নিচে। আয়েশা আলিয়েভার ডান হাতে তখনও এম-১০ রিভলভার।
আয়েশা আলিয়েভা এবং শিরীন শবনমকে ওখানে দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠল হাসান তারিকের বুকটা। তাহলে প্যাসেজে ঐ মেয়ে দু’টির লাশ কাদের?
ছুটে গেল হাসান তারিক সেখানে। দেখল বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দু’টি দেহ। একটি ফাতিমা ফারহানার, আরেকটা তার ভাবী আব্দুল্লায়েভের স্ত্রী আতিয়ার।
হাসান তারিকের চোখ ফেটে অশ্রু নেমে এল। অশ্রু নামছিল কুতাইবা এবং ইকরামভের চোখ দিয়েও। কারও মুখে কোন কথা নেই। অনেক্ষণ পর মুখ খুলল কুতাইবা। বলল, ‘ওরা দু’দিক থেকেই হামলা করেছিল। আপনারা সামনের দিকটা না ঠেকালে হয়তো আরও বিপদ হতো। কিন্তু সর্বনাশ তো হয়েই গেল, কি জবাব দেব আমরা মুসা ভাইকে ……….’
রুমালে চোখ মুছল কুতাইবা।
হাসান তারিক বলল, আমাদের ভূল হয়েছে। কেউ আমরা এ চিন্তা করিনি যে, ‘ফ্র’ শুধু একটা শিকার নিয়েই সন্তুষ্ট হবে না, তাদের জাল আরও থাকতে পারে।
-মুসা ভাইয়ের ব্যাপারটা আমাদের এতটাই অভিভূত করছিল যে আমরা কিছু ভাবতে পারিনি। তবু আল্লাহর শুকরিয়া যে, তারা তাদের লক্ষ্য হাসিল করতে পারেনি।
-কেন, ফারহানা ………..
-এ যাত্রা তাদের টার্গেট ছিল মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট কর্ণেল কুতাইবা। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে বলতে পারি, হেলিকপ্টার থেকে আপনাকে নামতে দেখেই তারা এ অপারেশনের পরিকল্পনা করেছে। লক্ষ্যহীন লোক হত্যার অপারেশন হলে তারা ভোর রাতেই আরেক অপারেশনে আসত।
-আপনি কি মনে করেন, ওরা আশেপাশেই আছে? মুসা ভাইকে কি তাহলে আশেপাশেই পাওয়া যাবে?
-‘না’ আমি তা মনে করি না। মুসা ভাইকে মধ্য এশিয়ার কোথাও রাখার মত জায়গা তাদের নেই। মনে হয়, আশেপাশে তাদের কোন সংঘবদ্ধ লোকও আর নেই। থাকলে এত বড় অপারেশনে তারা মাত্র এ’কজন আসতো না।
হাসান তারিকের হাতে মারা পড়েছিল পাঁচজন ‘ফ্র’ কর্মী, আর এদিকে মারা পড়েছে ওরা সাতজন। ওদের লাশ খামার বাড়ির গোলা ঘরের পাশে এবং প্যাসেজের মুখে দু’পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওরা এ পথেই বাড়িতে প্রবেশ করতে চেয়েছিল।
কুতাইবা চুপ করে কি যেন ভাবছিল। এসময় আব্দুল্লায়েভ বলল, ‘তারিক ভাই, আয়েশা আপা আহত! ওদিকে। ……….
হাসান তারিক আব্দুল্লায়েভের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তার কাঁধে হাত দিয়ে ধীর কন্ঠে উচ্চারণ করল, ‘কিন্তু আব্দুল্লাহ তোমার স্ত্রী, তোমার বোন আহত নয়, নিহত।’
-না তারিক ভাই, ওরা নিহত নয়, ওরা শহীদ।
বলতে বলতে আব্দুল্লায়েভের চোখ দিয়ে অশ্রুর দু’টি ধারা নেমে এল। সে তাড়াতাড়ি চোখ দু’টি মুছে বলল, ‘শহীদদের দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। তার আগে আব্বার কাছে একবার ……………’
-যাব চল, তার আগে আয়েশাকে একটু দেখে আসি।
আয়েশা ফারহানার ঘরে চলে গিয়েছিল। হাসান তারিক সে ঘরের দরজায় গিয়ে ছোট্ট একটা কাশি দিল। সঙ্গে সঙ্গে সে ঘর থেকে শিরীন শবনম বেরিয়ে গেল।
হাসান তারিক ঘরে ঢুকল। আয়েশা আলিয়েভা মাথা নিচু করে খাটের উপর বসে ছিল। হাসান তারিক সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, আঘাতটা কেমন, কেমন বোধ করছ এখন?’
আয়েশা কোন জবাব দিল না। ‘ফারহানা আপা চলে গেলেন’ বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
হাসান তারিক পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমাদের ধৈর্য্য ধরতে হবে আয়েশা, আল্লাহর পরিকল্পনা আমরা জানি না। খবর পেয়ে আমরা এলাম বিয়ে দিতে। কিন্তু দু জনই এখন আমাদের নাগালের বাইরে।
ওড়নার কোণা দিয়ে চোখ মুছে আয়েশা বলল, ‘তোমাদের বিদায় দিয়ে আমরা এ ঘরেই এসে বসেছিলাম। ফারহানা কাঁদছিল। আমি সান্তনা দিলে ডুকরে কেঁদে উঠল। বলল ‘আমি সহ্য করতে পারছি না আয়েশা। ও কেমন আছে কোথায় আছে –এ প্রশ্নের ছুরি যে আমার হৃদয়কে টুকরো টুকরো করে কাটছে অবিরাম।’
ফারহানার মনকে অন্যদিকে সরিয়ে নেবার জন্যই বোধহয় ওর ভাবী এই সময় বলল, ‘চল খামার বাডি থেকে ঘুরে আসি। আব্বার নাস্তার সময় হয়েছে ছাগলের দুধ দুইয়ে আনতে হবে।’
বলে ওর ভাবী ফারহানাকে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা বেরিয়ে গেলে আমি একটু গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়।
মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। হঠাৎ ওদিকে থেকে ‘আয়েশা’ বলে একটা চিৎকার আমার কানে এল। ফারহানার গলা। আমি সংগে সংগে উঠে বসলাম। ঠিক এ সময় একটা ব্রাশ ফায়ারের শব্দ কানে এল। আমি আমার রিভলবারটা নিয়ে ছুটলাম ওদিকে। প্যাসেজটির মুখে যেতেই দেখলাম কয়েকজন গুলি করতে করতে বাডির ভেতরে ছুটে আসছে, আমি এখানে দেয়ালের কোণায় শুয়ে পডে রিভলভার থেকে ওদের দিকে গুলি করতে লাগলাম। হঠাৎ গুলি বৃষ্টির মুখোমুখি হয়ে ওরা থমকে দাডাল। কিন্তু বৃষ্টির মত গুলি আসতেই থাকল। একটা গুলি এসে আমার কনুই এর নীচে লাগল। গুলিটা বিদ্ধ হয়নি। বাহুর একটা অংশ ছিডে নিয়ে পিছলে গেছে। এ সময় বৈঠকখানার দিক থেকে ছুটে এল ভাই কুতাইবা এবং সাইমুম কর্মীরা।
হাসান তারিক বলল, কর্নেল কুতাইবা ওদের টার্গেট ছিল। আল্লাহ্‌ এক অপূরণীয় ক্ষতি থেকে মুসলিম মধ্য এশিয়াকে রক্ষা করেছেন। এ সময় আব্দুল্লায়েভ ঘরের সামনে এসে একটা কাশি দিল।
-‘আসছি আবদুল্লাহ’ বলে হাসান তারিক তাড়াতাড়ি উঠে দাড়াল এবং ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কুতাইবা, হাসান তারিক, আবদুল্লাহ সকলে অসুস্থ বৃদ্ধ আব্দুল গফুরের ঘরে প্রবেশ করল। ইকরামভ আগে থেকেই পিতার পাশে বসে ছিল। পাশে দাঁড়িয়েছিল আব্দুল্লায়েভের মা। এরা ঘরে ঢুকলে আব্দুল্লায়েভের মা ঘরের এক পাশে সরে গেল।
সবাই গিয়ে বৃদ্ধের কাছে তার বিছানার চার পাশে ঘিরে বসল। বৃদ্ধের চোখ দু’টি বোজা। সবারই মুখ নীচু কারো মুখে কোন কথা নেই। আবদুল্লাহ ডাকল আব্বা…..
ধীরে ধীরে বৃদ্ধ চোখ খুলল। চারদিকে একবার চাইল। তারপর চোখ দু’টি স্থির করল কুতাইবার দিকে। কুতাইবার চোখ ছলছল করছে। বিমুঢ় একটা ভাব কিভাবে কথা তুলবে যেন ভেবে পাচ্ছে না।
বৃদ্ধ তার দুর্বল হাত দিয়ে কুতাইবার একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, ‘আমি সব জানি তোমরা যা বলবে। আহমদ মুসাকে ওরা নিয়ে গেছে। আমার বৌমা, আমার ফাতিমা চিরতরে হারিয়ে গেছে।’
বৃদ্ধের দু’চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু নেমে এল। কিন্তু গলা তার একটুও কাঁপল না। সে বলল, ‘আমার আহমদ মুসা ফিরে আসবেই। আল্লাহ্‌ তার সহায়। আমার মা আর ফিরবে না, না ফিরুক। আয়েশা, শবনম এবং আরও অনেক মা আমি পেয়েছি।’
একটু থামল বৃদ্ধ তারপর আবার শুরু করল, ‘তোমরা বুঝবে না আমার বুকে আজ কত গর্ব। যে দেশের মুক্তি কামনায় আমরা দেশ ছেড়েছি। সে মুক্ত দেশের অধিনায়ক তুমি আমার সামনে। এর চেয়ে বড় আনন্দের আমার আর কিছুই নেই। এখন আমার দুই সন্তান ইকরাম ও আবদুল্লাহ আছে, তাদেরকেও তোমার হাতে তুলে দিলাম।’
বৃদ্ধ আবার চোখ বুজল। হাঁপাচ্ছে সে। অনেক কষ্টে এক নাগাড়ে এতগুলো কথা সে বলেছে। হঠাৎ চোখ খুলল বৃদ্ধ, তার চোখ দু’টি চঞ্চল। কিছু যেন তার মনে পড়েছে। সে আব্দুল্লায়েভের দিকে চেয়ে বলল, ‘বেটা, কাঠের বাক্সের তলায় দেখ রেশমের খাপে একটা তলোয়ার আছে। ওটা বের করে আন।’
আব্দল্লাহ পাশের ঘরে চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পর রেশমের খাপে রাখা একটা দীর্ঘ তলোয়ার বের করে আনল।
বৃদ্ধ তলোয়ারটি হাতে নিয়ে খাপ খুলে ফেলল। কুতাইবার দিকে চেয়ে বলল, ‘আজ বহু বছর ধরে এই তলোয়ার আমরা সযত্নে সংরক্ষণ করছি। এ তলোয়ার সাথে জড়িয়ে আছে এক কাহিনী।
যেদিন সন্ধ্যায় কম্যুনিস্ট লাল ফৌজের হাতে বোখারার পতন ঘটে, তার পরদিন সকালে আমাদের মহল্লার রাস্তার পাশে একজন আহত সংজ্ঞাহীন সৈনিককে কুড়িয়ে পাওয়া যায়। তার কোমরে রেশমের খাপে ছিল অসাধারন দীর্ঘ এক তলোয়ার। রাস্তায় দাড়িয়ে ছিল একটি ঘোডা। আমরা বুঝেছিলাম ঐ ঘোড়াই সেই আহত ও সংজ্ঞাহীন সৈনিককে বহন করে আনে। সম্ভবত এখানে এসে সৈনিকটি ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায়। ঘোড়াও আর প্রভুকে ছেড়ে সামনে এগোয়নি।
শুশ্রুষা করার পর সৈনিকটির জ্ঞান ফিরে আসে। জানতে পারা যায় তার নাম আমীর আব্দুল্লাহ। তিনি বোখারার সেনাধ্যক্ষ আমীর আব্দল্লাহ এ পরিচয় পেয়ে সবাই বিস্মিত হয়ে যায়। সকালে আরও বিস্মিত হয়ে যায় একশ মাইল দুরে এই উজবেক পল্লীতে তার পৌছার কাহিনী শুনে। সেনাধ্যক্ষ আমীর আব্দুল্লাহ বলেছিল, আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত বিশাল লাল ফৌজের আক্রমন এবং বিশ্বাসঘাতকদের অন্তর্ঘাত তৎপরতায় নগরীর প্রতিরক্ষা দেয়াল যখন ধ্বসে পড়ে, যখন নগরীর অধিকাংশ এলাকা ওদের হাতে চলে যায়, যখন আমরা বোখারার প্রাণকেন্দ্র মীরই আরব মাদ্রাসা ঘিরে শেষ রক্ষার জন্য লড়াই করছি তখন একটা গুলি এসে আমার বুকের ডান অংশে বিদ্ধ হয়। তারপর কিছু মনে মনে নেই আমার।
আমরা তার জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিলাম, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারিনি। সেদিনই তিনি শাহাদাত বরণ করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর সেই দীর্ঘ তরবারী আমার দাদার হাতে তুলে দেন এবং বলেন, এই তরবারী ইসলামের স্বর্ণযুগের মধ্য এশিয়াকে জাহেলিয়াতের কবল থেকে মুক্তকারী মুসলিম বিজেতা দরবেশ সেনাপতি কুতাইবার। এই তরবারীটি সমরকন্দে মহানবী(সঃ)এর খুলুতাত কুসুম বিন আব্বাসের সৃতি সৌধ শাহ-ই-যিন্দ এ সংরক্ষিত ছিল। লাল ফৌজের হাতে সমরকন্দের পতন হলে এ তরবারী এক সৈনিক নিয়ে এসে আমাকে দেয়। আমার সময় এখন শেষ। এ তরবারী আমি আপনার হাতে দিয়ে গেলাম উপযুক্ত হাতে পৌছে দেবার জন্যে।’
বৃদ্ধ একটু দম নিল। এক নাগাড়ে এত কথা বলায় সে হাপাচ্ছে। তার কপালে দেখা দিয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আব্দুল্লায়েভ তার পিতার মাথায় ধীরে ধীরে পাখার বাতাস করছিল।
বৃদ্ধ আবার শুরু করল। বলল, ‘আল্লাহু আকবর, আলৌকিকভাবে তরবারীটি আমাদের হাতে পৌছেছে। তা না হলে একজন সংজ্ঞাহীন সৈনিককে একটা ঘোড়া একশ মাইল পথ কিভাবে নিয়ে এল! আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি, হাজার হাজার বছর পর আর এক বিজেতা কুতাইবার হাতে তরবারীটি তুলে দিতে পারলাম। আমি মনে করছি বাবা, নতুন স্বর্ণযুগের যাত্রা শুরুর ইংগিত এটা। আবেগে বৃদ্ধের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল।
কুতাইবা তলোয়ার হাতে নিয়ে ধারের হীরার মত ঔজ্জল্য দেখে মুগ্ধ হোল। চুম্বন করল তরবারিটিকে। তারপর বলল, ‘চাচাজান এ তরবারী গ্রহন করার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি মুসা ভাই। আমি তার পক্ষে এ তরবারী গ্রহন করলাম।’
বলে কুতাইবা তরবারী হাসান তারিকের হাতে তুলে দিল।
হাসান তারিকও তরবারীটাকে চুম্বন করল। তারপর বলল, ‘চাচাজান আমার মনে হয় সেনাপতি কুতাইবার পর এ তরবারী আর ব্যবহার হয়নি। তা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল শাহ-ই- যিন্দের শো-কেসে। ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও মুক্তির এ তরবারী কোষবদ্ধ হবার পরই মুসলমানদের পতন সুচিত হয় এবং কম্যুনিস্ট লাল ফৌজ সে পতন চুড়ান্ত করে। কম্যুনিস্ট লাল ফৌজের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলামের তরবারী আজ আবার কোষমুক্ত হলো, ইনশাআল্লাহ কোষবদ্ধ হবে না এ তরবারী আর।’
-কিন্তু তারেক ভাই, সেনাপতি কুতাইবার পর কি মধ্য এশিয়ায় কোষমুক্ততরবারী ছিল না?’ জিজ্ঞেস করল আব্দল্লায়েভ।
-হ্যা কোষমূক্ত তরবারী ছিল কিন্তু সে তরবারী ছিল কোন শাসকের কিংবা কোন রাজা বাদশার স্বার্থে। বলল হাসান তারিক ।
-ইসলামের তরবারী এবং একজন মুসলিম শাসকের তরবারীর মধ্য কি কোন পার্থক্য আছে তারিক ভাই?
-পার্থক্য অনেক। একজন মুসলিম শাসকের তরবারী তার রাজ্যের স্বার্থে আরেকজন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে, যেমন অনেক হয়েছে। কিন্তু ইসলামের তরবারী শুধু আল্লাহর জন্যই ব্যবহৃত হয়। অন্যায়ের প্রতিরোধ, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, ‘মানুষ খোদাদের’ কবল থেকে মানুষের মুক্তি এবং ‘মানুষ প্রভুদের’ রাজত্ব খতম করে আল্লাহর রাজ্যত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই ইসলামের তরবারী ব্যবহার হয়। এজন্যই ইসলামের তরবারী শান্তির প্রতীক। অন্যদিকে কোন মুসলিম শাসকের তরবারী আল্লাহর বান্দাদের উপর জুলুমের প্রতীক হতে পারে। যার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে ইতিহাসে।
আব্দুলায়েভের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। আর বৃদ্ধা আব্দুল গফুর যেন কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত গিলছে। ইকরামভ ইতিমধ্যে বাইরে গিয়েছিল। সে ঘরে ঢুকে বলল ‘শহীদদের দাফন….’
ইকরামভকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বৃদ্ধা আব্দুল গফুর বলল, ‘আমার শহীদ মা’দের দাফন আমার গোলাপ বাগানে হবে। ফাতিমা গোলাপ বড় ভালবাসত।’
এ নির্দেশ নিয়ে সকলেই বের হয়ে এল ঘর থেকে।
দাফন শেষ হয়েছে এমন সময় আকাশে হেলিকপ্টারের শব্দ পাওয়া গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই অনেকগুলো হেলিকপ্টার শব্দ আকাশে তোলপাড় করে তুলল। কয়েকটি হেলিকপ্টার মাথার উপর চক্কর দিতে লাগল। অধিকাংশই খুব নিচু দিয়ে উড়ে পূর্ব ও উত্তর দিকে চলে গেল। একটা হেলিকপ্টার নেমে এল।
কুতাইবা এবং হাসান তারিকরা আব্দুল গফুরের বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করছিল। নতুন মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগের সেক্রেটারি অয়ারলেসে আগেই জানিয়েছিল, উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে সাইমুমের ইষ্টার্ন ফ্রন্টিয়ারের অধিনায়ক আনোয়ার ইব্রাহিমকে পাঠানো হচ্ছে। আব্দুল গফুরের বাড়িতে ‘ফ্র’-এর নতুন হামলার পর কুতাইবা অন্যদের সাথে পরামর্শ করে হাসান তারিকদের তিয়েনশান যাত্রা স্থগিত করে দিয়েছিল। জেনারেল বোরিস দেশের ভেতরে এই পূর্বাঞ্চলে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারে। সুতরাং একটা সার্চ অভিযান না চালিয়ে কিছুটা নিশ্চিত না হয়ে তাদের পাঠানো ঠিক হবে না।
হেলিকপ্টার থেকে নেমে আনোয়ার ইব্রাহিম বৈঠকখানায় এল। সালাম বিনিময়ের পর অশ্রুরুদ্ধ আবেগকে চাপা দিতে গিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম শুরুতে কোন কথাই বলতে পারলনা। কুতাইবা তাকে সান্তনা দিল। হাসান তারিক তার কাঁধে এক ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘ইয়ংম্যান, আমাদের শোককে শক্তিতে পরিনত করতে হবে। এখন প্রতিটা মুহূর্ত আমাদের মূল্যবান।’
আনোয়ার ইব্রাহিম রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বলল, ঠিক বলেছেন। তারপর সে কুতাইবার দিকে ফিরে বলল, জনাব, আপনার নির্দেশক্রমে গোটা মাউন্টেন হেলিকপ্টার বহরকে পামির সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। সকল রাস্তার সকল পয়েন্টে গাড়ি ও সকল প্রকার যানবাহন সার্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সকাল ৭টা থেকে এ আদেশ কার্যকরী হয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের সীমান্ত পর্যন্ত পামির সড়কে বিশেষ পাহারা ও সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। স্থল বাহিনীর কতকগুলো ইউনিট পামির সড়কে টহল দিচ্ছে। পাহাড় জংগলের সম্ভাব্য সকল স্থান চেক করার জন্য গোয়েন্দা বিভাগের বিমান ও স্থল ইউনিটকে কাজে লাগানো হয়েছে। সন্দেহজনক স্থানে প্যারাট্রুপারস নামানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা প্রাথমিক রিপোর্ট পাব আশা করছি।
আনোয়ার ইব্রাহিমের কথা শেষ না হতেই তার ওয়ারলেস কথা বলে উঠল। সে কান লাগিয়ে কল রিসিভ করল। শুনতে শুনতে তার মুখটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে উঠল।
গোটা বৈঠকখানায় নিরবতা নেমে এসেছে। সবারই চোখেমুখে একটা উম্মুখ প্রশ্ন। সেই সাথে দুশ্চিন্তার একটা কাল ছায়াও।
আনোয়ার ইব্রাহিম কল রিসিভ শেষ করল। একটু থামল, দম নিল সে। তারপর বলল, আমাদের পামির বায়োলজিক্যাল ইনষ্টিটিউটস্থ ঘাঁটি আজ রাত থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত ঘটনার যে সময়ওয়ারী তথ্য সংগ্রহ করেছে, তা থেকে জানাল, মধ্য এশিয়া মুসলিম সাধারণন্ত্রের পতাকাবাহী তিনটি মাউন্টেন ফুড ক্যারিয়ার আজ ভোর রাতে পামির অতিক্রম করেছে। অত্যন্ত দ্রুতগামী ক্যারিয়ারগুলো আজ ভোর ছয়টায় পামির বায়োলজিক্যাল ইনষ্টিটিউট পয়েন্ট পার হয়ে গেছে। কোন কোন পয়েন্ট থেকে কেউ কেউ এ তিনটি ক্যারিয়ারে রুশ সাধারণতন্ত্রের পতাকাও দেখেছে।
থামল আনোয়ার ইব্রাহিম। সবাই চুপচাপ। সবাই যেন ভাবনার এক অতল গভীরে হারিয়ে গেছে।
কথা বলল, প্রথমে হাসান তারিক। বলল, এ ক্যারিয়ার বহর যে জেনারেল বোরিসের আমার মনে হয় এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
-তাই মনে করো? বলল, কুতাইবা।
-হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবে আমি এটা মনে করি। একবার মুসলিম, একবার রুশ পতাকা ব্যবহার থেকেই বুঝা যায়, প্রয়োজনমত সবার চোখকে ধুলা দেবার জন্যই এটা করা হয়েছে এবং বর্তমান অবস্থায় এটা জেনারেল বোরিস হওয়াই স্বাভাবিক।
একটু থেমে হাসান তারিক আবার বলল, ‘এটা আমরা সকলেই জানি জেনারেল বোরিস ছাড়া ‘ফ্র’ পক্ষের আর কেউ এ পথে গাড়ি ঘোড়া নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে পালায়নি।
একটু ভেবে কুতাইবা বলল, ‘ঠিকই বলেছেন আপনি। জেনারেরল বোরিস প্রথমে হেলিকপ্টার নিয়ে পালায়। কিন্তু পরে সে বক্স শহরে হেলিকপ্টার ছেড়ে দিয়ে গোটা পাঁচেক মাউন্টেন ফুড ক্যারিয়ার নিয়ে নেয়। তারই তিনটি হয়তো সে নিয়ে গেছে। কিন্তু একটা জিনিস, সকালের আক্রমন পরিকল্পনায় সে ছিল কিনা?’
-আমার মনে হয়, না। আমি যেটা মনে করছি সেটা হলো, ধরিবাজ ক্রুর বোরিস ধরেই নিয়েছিল এখানে বড় ধরনের আরও শিকার পাওয়া যেতে পারে। এই শিকার পাওয়ার আশায় কিংবা একটা পশ্চাৎবাহিনী হিসেবেই এই গ্রুপকে সে পেছনে রেখে গিয়েছিল।
-তাহলে আমার মনে হয়, আশেপাশে কোথাও জেনারেল বোরিসের অবশিষ্ট দু’টো মাউন্টেন ক্যারিয়ার আমরা পাব। আনোয়ার ইব্রাহিম এ সময় তার ওয়ারলেসে একটা কল রিসিভ করছিল। কুতাইবার কথা শেষ হতেই সে বলল, অবশিষ্ট দু’টো মাউন্টেন ক্যারিয়ারের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের একটা সার্চ পার্টি এখানে পামির সড়কের পাশে ও দু’টো খুঁজে পেয়েছে।
-তাহলে আমরা কি এখন নিশ্চিত হতে পারি, জেনারেল বোরিস আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করেছে? বলল কুতাইবা।
-ভোর ছ’টায় যদি তাদের পামির বায়োলজিক্যাল ইনষ্টিটিউট পয়েন্টে দেখা গিয়ে থাকে, তাহলে তারা এখন সীমান্ত অতিক্রম না করলেও নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে গেছে।
হাসান তারিক কথা শেষ করল। কেউ কোন কথা বলল না। সবাই চুপ চাপ। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল আব্দুল্লায়েভ। বলল, এবার আমাদের স্থগিত যাত্রা শুরু হতে পারে।
কুতাইবা প্রশ্নবোধকভাবে মুখ তুলল হাসান তারিকের দিকে। হাসান তারিক বলল, আমাদের সময় নষ্ট করা উচিত নয়।
-তাহলে হেলিকপ্টার আপনাদেরকে আমাদের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিক।
-এতে আমরা শত্রুর চোখে পড়া এবং শত্রুর সাবধান হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পাবনা। বলল হাসান তারিক।
-তাহলে?
-হেলিকপ্টার আমাদেরকে পামির বায়োলজিক্যাল ইনষ্টিটিউট পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, তারপর আইস ক্যারিয়ারে করে যতটুকু যাওয়া যায় গিয়ে আমরা ঘোড়া নিয়ে সামনে এগুব।
-তাই হোক। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। বলল, কুতাইবা। তার শেষের কথাগুলো খুব ভারি শোনাল।



পর্ব ২


প্রবল ঝাকুনির মধ্য দিয়ে জ্ঞান ফিরে পেল আহমদ মুসা। জ্ঞান ফিরে পেয়েই সে তড়িঘড়ি উঠে বসল। চোখে তার একরাশ বিস্ময়। কোথায় সে? ফারহানাদের বৈঠকখানাতো এটা নয়। তাহলে কোথায় সে? স্পষ্টই বুঝতে পারছে, একটা উঁচু-নিচু পাথুরে পথের উপর দিয়ে একটা গাড়ীতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
চারদিকে অন্ধকারটা একটু ফিকে হয়ে এলে সে বুঝল, খাদ্য দ্রব্য পরিবহনের ইয়ারকন্ডিশন ক্যারিয়ারে চড়ে সে চলছে। চারদিকে বন্ধ। কিছুই বোঝার উপায় নেই যে, কোন পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে সে। চারদিকে হাতড়িয়ে সে দেখল, গাড়ীর মেঝেতে অনেকগুলো বড় বড় ট্রাংক স্যুটকেশ।
এটা এখন তার কাছে পরিষ্কার, শত্রুর হাতে সে বন্দী। কিন্তু কিভাবে? রাত দশটায় সে ফারহানাদের বৈঠকখানায় ঘুমিয়েছে। তারপর সেখানে কি ঘটেছে?
কি ঘটেছে চিন্তা করতে গিয়েই তার বুকটা কেঁপে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবল বড় কিছু ঘটলে তার ঘুম ভাঙবে না কেন? ঘুমানো অবস্থাতেই শত্রুরা তাকে বন্দী করেছে। অর্থাৎ শত্রুরা এ কাজ করেছে নিরবে, কোন শব্দ বা হৈ চৈ না করে।
এ শত্রু কে? কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে?
এ সময় ক্লিক করে একটা শব্দ হলো, সংগে সংগে কেবিনের সামনের দিকে খুলে গেল একটা জানালা। দিনের একরাশ আলো এসে প্রবেশ করল কেবিনে। জানালায় একটা মুখ দেখা গেল। মুখ দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। একি! জেনারেল বরিস!
জেনারেল বোরিসের ঠোঁটে ক্রুর হাসি। বলল, আমাকে দেখে অবাক হয়েছ আহমদ মুসা? ভাবছ, যে শত্রুর সব শেষ করলে সে আবার তোমাকে এভাবে খাঁচায় পুরল কিভাবে। বলে সে হো হো করে এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।
আহমদ মুসার মনে তখন অন্য চিন্তা। রক্তপায়ী, নিষ্ঠুর বোরিসরা আব্দুল গফুর, ফারহানাদের কোন ক্ষতি করেনি তো। এদের আকাশ-স্পর্শী প্রতিহিংসা থেকে তারা তো রক্ষা পাবার কথা নয়। চিন্তাটা তাকে মারাত্মকভাবে পীড়া দিতে লাগল।
জেনারেল বোরিসের মুখ থেকে বের করার জন্যেই বোধহয় আহমদ মুসা প্রশ্ন করল, কাউকে জানতে না দিয়ে কাপুরুষের মত একজন ঘুমন্ত মানুষকে চুরি করেছ, তাতে কৃতিত্বের কি আছে জেনারেল বোরিস?
-তোমাকে মুঠোয় পাওয়ার জন্য কাপুরুষ হতে দোষ নেই।
একটু থামল জেনারিল বোরিস। তারপর বলল, ভেব না, ফাঁদ পেতে রেখে এসেছি, আমি বড় শিকার আরও চাই, ছোট শিকার মেরে আমার এখনকার কোন মূল্যবান বুলেট আমি নষ্ট করতে চাই না।
থামল আবার জেনারেল বোরিস। তারপর হাতের পিস্তলটা তুলে আহমদ মুসাকে তাক করে অত্যন্ত কঠোর কন্ঠে বলল, তুমি আমাকে কাপুরুষ বলেছ, শুনে রাখ ‘ফ্র’ এর কেউ কাপুরুষ নয়। আবার যদি এমন বেয়াদবী কর জিহবা কেটে নেব।
-কাউকে গালি দেওয়া আমার অভ্যেস নয়। তুমি আমাকে কাপুরুষের মত বন্দী করেছ সেই কথা আমি বলেছি।
জেনারেল বোরিস আহমদ মুসার কথা শেষ না হতেই তার রিভালবারের ট্রিগারে চাপ দিল। একটা গুলি আহমদ মুসার কানের পাশ দিয়ে গিয়ে পেছনের দেওয়ালে বিদ্ধ হলো। বোরিসের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছিল। বলল, আহমদ মুসা, জেনারেল বরিস যা বলে তাই করে, মনে রেখ।
জানালা থেকে সরে গেল জেনারেল বোরিস। আহমদ মুসা কেবিনের চারদিকটা দেখে নিল। ঠিক যা অনুমান করছিল তাই, কেবিনটা ষ্টিলের বড় বড় ট্রাংকে ভর্তি। সামনে একপাশে দেখতে পেল কাঠের একটা বাস্কেট। তাতে কয়েক বোতল পানি এবং কতগুলো প্যাকেট। একটা প্যাকেট ছিড়ে দেখল রুটি। খুব ক্ষুধা পেয়েছিল আহমদ মুসার। রুটি খেতে শুরু করল।
আবার ক্লিক শব্দ করে জানালা বন্ধ হয়ে গেল। ঘুট ঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল চারদিকটা। অন্ধকারের মধ্যেই রুটি খাওয়া শেষ করল আহমদ মুসা। অন্ধকারে হাতড়িয়ে বোতল থেকে পানিও খেয়ে নিল।
খাবার পরে একটু আরাম বোধ করল আহমদ মুসা। একটা বড় ট্রাংকে হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু প্রবল ঝাকুনি এবং এবং ট্রাংকের ধারালো প্রান্ত তাকে কোন আরাম দিল না।
কোথায় যাচ্ছে সে, কোনদিকে যাচ্ছে? এ অন্ধকারে দিক নির্ণয় সম্ভব নয়। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল, জানালা খুললে সূর্যের আলো জানালার বাম প্রান্তকে বেশী আলোকিত করেছিল। অর্থাৎ সূর্য ডান দিকে রয়েছে। এর অর্থ ডান দিকটা পূর্ব। তাহলে গাড়ি এখন উত্তর দিকে যাচ্ছে।
কোন এলাকা, কোন পথের ওপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে এখন? আহমদ মুসা নিশ্চিত দেশের অভ্যন্তরের পথ দিয়ে জেনারেল বোরিস এভাবে চলতে পারে না, সে সুযোগ তার নেই। নিশ্চয় এতক্ষণে সব রাস্তা ব্লক করা হয়েছে, চেক করা হচ্ছে। তাহলে এ পাহাড়ী রাস্তা কোনটি? পামির সড়ক কি! হ্যাঁ পামির সড়কই হতে পারে, আহমদ মুসার মনে হল। রাতারাতি সে যদি পামির সড়কের নিম্নাঞ্চল পার হয়ে এসে থাকে, তাহলে পাহাড়ের উপরের পথটা তার জন্যে নিরাপদই হবে। গাড়ীর উত্তর গতি দেখে এটাই মনে হয় গাড়ি আপার পামিরে উঠে এসেছে।
ভাবতে ভাবতে আহমদ মুসা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে। গাড়ীর সেই জার্কিং নেই। অর্থাৎ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মনটা আহমদ মুসার চঞ্চল হয়ে উঠল। গোলাগুলি হচ্ছে কার সাথে? সাইমুম কি জেনারেল বোরিসের সন্ধান পেয়েছে? তারাই কি এসেছে?
বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলল। তারপর সব নিরব। গাড়িও স্থির দাঁড়িয়ে আছে, চলছে না। ব্যাপার কি? জেনারেল বোরিসরা কি পালাল? প্রতিটা মুহূর্ত এক এক ঘন্টার মত দীর্ঘ মনে হতে লাগল তাঁর।
আরো কিছুক্ষণ গত হলো। আহমদ মুসার অসহনীয় অপেক্ষার একটা মুহূর্তে হঠাৎ কেবিনের দরজা খুলে গেল। বিকেলের হলুদ রোদ চোখটা তাঁর বাঁধিয়ে দিল, কিন্তু এক পশলা ঠান্ডা ও মুক্ত বাতাসের স্পর্শ খুবই ভাল লাগাল আহমদ মুসার।
কেবিনের দরজার সামনে উদ্যত ষ্টেনগান হাতে দু’জন দাঁড়িয়েছিল। একপাশে পিস্তল হাতে জেনারেল বোরিস দাঁড়িয়ে। গোলাগুলির শব্দ শুনে যে আশাটুকু আহমদ মুসার মনে জেগেছিল, তা দপ করে নিভে গেল।
রিভালবার নাচাতে নাচাতে জেনারেল বোরিস বলল, তাড়াতাড়ি নেমে এস আহমদ মুসা। আহমদ মুসা নামল।
নেমে চারদিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে শিউরে উঠল আহমদ মুসা। গাড়ি থেকে আট-দশ গজ দুরে বুলেটে ঝাঝরা অনেকগুলো লাশ পড়ে আছে। একজন মুমূর্ষ মানুষ তখনও কাতরাচ্ছে আর আল্লাহ পানি, আল্লাহ পানি বলে চিৎকার করছে।
ঐ মুমূর্ষ মানুষের কাতরানি শুনে আহমদ মুসার গোটা দেহে অসহনীয় এক জ্বালা ছড়িয়ে পড়ল। দেহের মাংসপেশীগুলো যেন রোষে ফুলে উঠল।
আহমদ মুসা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে একবার বোরিসের দিকে তাকাল। তারপর স্থির কন্ঠে বলল, জেনারেল বোরিস, ঐ মুমূর্ষ মানুষকে পানি দাও।
-কেন, ওর আল্লাহ ওকে পানি খাওয়াবে না? ক্রুর হাসিতে ফেটে পড়ল জেনারেল বোরিস।
-ঠিক আছে আমাকেই খাওয়াতে দাও।
জেনারেল বোরিস যেন একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, স্বজাতির জন্যে খুব মায়া না?
-স্বজাতি নয়, মানুষের জন্যে।
জেনারেল বোরিস কিছু বলল না। একজনকে ইশারা করে বলল, আহমদ মুসাকে পানির বোতল এনে দাও, পানি খাইয়ে কিছু পূণ্য কামাবে।
আহমদ মুসা পানির বোতল নিয়ে এগিয়ে গেল সেই মুমূর্ষ লোকটির কাছে। পানির বোতলের দিকে চোখ পড়তেই রাজ্যের তৃষ্ণা নিয়ে লোকটি মাথা তুলল।
আহমদ মুসা এক হাতে লোকটির মাথা তুলে ধরে, অন্য হাতে পানির বোতল তার মুখে ধরল।
এমন সময় পাশে দাঁড়ানো জেনারেল বোরিস এক লাথি মারল পানির বোতলে। আহমদ মুসার হাত থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল পানির বোতল।
আহমদ মুসা স্প্রিং এর মত বিদ্যুৎ গতিতে উঠে দাঁড়াল। জেনারেল বোরিস কিছু বুঝার আগেই এক ঝটকায় তার হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিল। কিন্তু পরক্ষণেই পেছন দিক থেকে স্টেনগানের বাটের প্রচন্ড এক আঘাত এসে পড়ল আহমদ মুসার রিভলভার ধরা হাতে। ছিটকে পড়ে গেল রিভলভার।
জেনারেল বোরিস তাড়াতাড়ি রিভলভারটি কুড়িয়ে আহমদ মুসার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। আগুন ঝরা কন্ঠে বলল, এর শাস্তি যে কি তুমি কল্পনা করতে পার না আহমদ মুসা। কিন্তু আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। তুমি ‘ফ্র’ এর এক বিরাট পুঁজি। ‘ফ্র’ এক বড় ব্যবসায় করবে তোমাকে দিয়ে।
তবে বেয়াদবির শাস্তির তোমাকে পেতে হবে।
বলে সে পাশের লোককে বলল চাবুক লাগাও। মন থেকে মানুষের জন্যে ওর মায়া দূর হোক।
লোকটা দ্রুত পাশের গাড়ি থেকে চাবুক এনে তিনটি চাবুক লাগাল আহমদ মুসার পিঠে।
চামড়ার চাবুক পিঠে কিভাবে কতটুকু বসে গেল জামা গায়ে থাকায় তা বুঝা গেল না। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে জামা রক্তে ভিজে গেল। আহমদ মুসা পাথরের মত স্থির দাঁড়িয়ে চাবুকের তিনটি আঘাত গ্রহন করল। মুখে সামান্য পরিবর্তনও তার এল না।
জেনারেল বোরিস হেসে বলল, ধন্যবাদ তোমাকে আহমদ মুসা, এ আঘাতে হাতিও চিৎকার করত।
আহমদ মুসা বলল, জেনারেল বোরিস, এই যে নিরীহ মানুষকে তুমি পশুর মত হত্যা করলে, এর শাস্তি থেকে তুমি রেহাই পাবে না মনে রেখো।
-পারলে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না আমি জানি, কিন্তু বিশ্বাস কর, ওদের না মেরে উপায় ছিল না। মুখে শয়তানের মতো ক্রুর হাসি টেনে বলল জেনারেল বোরিস।
একটু দম নিয়ে আগের কথার রেশ টেনে সে বলল, আমাদের গাড়ি তো আর চলবে না, তাই তাদের ঘোড়াগুলো আমাদের খুব দরকার। জীবিত থাকতে তো ওদের ঘোড়া নেয়া যাবে না, তাই ওদের মারা। তুমিই বল, হেঁটে গেলে কাশগড়ে যেতে আমাদের কতদিন লাগত।
কথা শেষ করে জেনারেল বোরিস একটু সরে গিয়ে তার লোকজনদের কি যেন র্নিদেশ দিল। এদিকে গাড়ি থেকে মাল সামান নামিয়ে ঘোড়ার পিঠে বোঝাই করা হচ্ছিল।
র্নিদেশ দিয়ে জেনারেল বোরিস গাড়িতে চলে যাবার পর চারজন লোক এসে আহমদ মুসাকে বাঁধল। তার দু’হাতকে শরীরের সাথে রেখে পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত প্লাষ্টিক কর্ড দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে বাঁধা হলো। তারপর মাল-সামানের সাথে ঘোড়ার পিঠে বেঁধে রাখা হলো তাকে।
চারটি ঘোড়ার পিঠে মাল-সামান সাজিয়ে অন্য চারটি ঘোড়ায় দু’জন করে উঠল। অবশিষ্ট একটি ঘোড়ায় উঠল জেনারেল বোরিস। মাল-সামান বোঝাই ঘোড়া মাঝখানে রেখে ৯ ঘোড়ার কাফেলা ছোট তারিম নদী উপত্যকা ধরে কাশগড়গামী ঐতিহ্যবাহী পথে যাত্রা করল।
ছোট তারিম নদী আসলে একটা পাহাড়ী ঝর্ণা। ঝর্ণা হলেও বেশ প্রশস্ত এবং স্থানে স্থানে বেশ গভীর। এ পাহাড়ী নদীটি পামির থেকে উৎপন্ন হয়ে দীর্ঘ পাহাড়ী পথ অতিক্রম করে সিংকিয়াং-এর তাকলামাকান মরুভুমির পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত চীনের দীর্ঘতম নদী তারিমে গিয়ে মিশেছে। লোকে একে তারিমের নামেই ছোট তারিম বলে ডাকে।

হাসান তারিকরা ঘোড়ায় চড়ে এগুচ্ছিল। আগের পরিকল্পনায় যে পথটা আইস ক্যারিয়ারে চড়ে আসার কথা, সে পথটাও তারা ঘোড়ায় চড়েই আসছে। হেলিকপ্টারে পামির বায়োলজিক্যাল ইন্সটিটিউটে আসার পর তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। তারা চিন্তা করে মাঝখানের পথটুকুর জন্যে আর আইস ক্যারিয়ারের ঝামেলা করে লাভ নেই, ঘোড়াই উত্তম। পামিরের পথের শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু হাসান তারিক রাজী হয়নি তাতে। শত্রুর চোখে তারা কিছুতেই ধরা পড়তে চায় না। শত্রু তাতে সাবধান হয়ে যাবে, এমনকি কোন ক্ষতিও করে বসতে পারে আহমদ মুসার। ক্ষতির কথা তার মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে ওঠে। কিন্তু পর মুহূর্তেই ভাবে। আহমদ মুসা ওদের জন্যে এখন বিরাট এ্যাসেট। একে তারা নানা রকম দর কশাকশিতে কাজে লাগাতে পারে। সুতরাং তাদের কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আহমদ মুসাকে তারা হত্যা করবে না। এই চিন্তায় কিছুটা স্বস্তি বোধ করল হাসান তারিক।
হাসান তারিক আগে আগে চলছিল। পেছনে আবদুল্লায়েভ। দু’জনেই দু’টি উৎকৃষ্ট আরবী ঘোড়ায় সওয়ার। চলতে চলতে আবদুল্লায়েভ জিজ্ঞেস করল, ওরা কোথায় যেতে পারে আপনি মনে করছেন?
-আমি মনে করছি, ওরা আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করে আপাতত চীনে প্রবেশ করবে। এটাই তাদের জন্য নিরাপদ।
-আমাদের সামনে চীনে প্রবেশের দু’টো পথ আছে। একটা হল তারিম হয়ে, আরেকটা কিরঘিজিয়ার রাজধানী ফ্রেঞ্জ থেকে যে পথটি কাশগড় গেছে সেই পথে। অন্য একটা পথ কাজাকিস্তানের রাজধানী আলমা আতা সড়ক থেকে বের হয়ে উরুমচি গেছে। কিন্তু সে পথটা অনেক দুরে এবং দুর্গম। অবশিষ্ট দু’টি পথের কোনটি জেনারেল বোরিস ব্যবহার করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
-আমি মনে করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে আমাদের এলাকা ত্যাগ করে চীনে প্রবেশ করতে চায়। কারণ সে পরিষ্কারই জানে, পামিরের পথে বেশী সময় নিলে ধরা পড়ে যাবে।
কথা বলতে বলতে একটা টিলার ওপাশে গিয়েই ঘোড়ার লাগাম টেনে থমকে দাঁড়াল হাসান তারিক। সে দেখতে পেল, কিছু দুরে পামির সড়কের উপর তিনটি মাউন্টেন ফুড ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য তখনও ডুবেনি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তিনটি ক্যারিয়ারকে। তিনটিই চলার ভংগিতে উত্তর মুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে যাচ্ছে ওরা যেন কোন কাজে দাঁড়িয়ে আছে।
হাসান তারিক ঘোড়া পেছনে হাটিয়ে টিলার আড়ালে চলে এল। তারপর পকেট থেকে দুরবীন বের করে চোখে লাগাল। দুরবীনের চোখটা ওদিকে পড়তেই চমকে উঠল হাসান তারিক। ওকি! গাড়িগুলোর পাশে অত লাশ কার? তিনটি গাড়িরই দরজা খোলা, কোন জীবিত মানুষ চোখে পড়ল না। তারপাশে আতিপাতি করে খুঁজল। না, কোথাও জীবিত মানুষের কোন চিহ্ন নেই।
একটা আশংকা হাসান তারিকের মনে উঁকি দিল, তাহলে কি সব শেষ? অন্য কোন দল কি সম্পদের লোভে সবাইকে হত্যা করে গেছে? না আহমদ মুসা ওদের হত্যা করে নিজেকে মুক্ত করেছে? শেষ কথাটি হাসান তারিকের মনে আশার সঞ্চার করল। হাসান তারিক আবদুল্লায়েভের দিকে তাকিয়ে বলল, সামনে দেখেছ তো?
-হ্যাঁ, দেখেছি তিনটি মাউন্টেন ফুড ক্যারিয়ার, সম্ভবত জেনারেল বোরিস যেগুলো নিয়ে পালিয়েছিল সেগুলো।
-শুধু ঐ তিনটি গাড়ি নয়, গাড়ির পাশে অনেকগুলো লাশ দেখা যাচ্ছে।
-অনেকগুলো।
বিস্ময় উদ্বেগে আবদুল্লায়েভের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল। হাসান তারিক আর কোন কথা না বলে আবদুল্লায়েভকে ইশারা করে গাড়ির দিকে চলল। দু’জনের হাতে উদ্যত স্টেনগান। সেখানে গিয়ে তারা লাশ আর শূণ্য গাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।
লাশ দেখেই আবদুল্লায়েভ বলল, এতো দেখি চীনের উইঘুর কাজাখদের লাশ। হাসান তারিক হতাশ হল। সে দেখতে চেয়েছিল জেনারেল বোরিসদের লাশ। তার জায়গায় পাওয়া গেল স্বজনদেরই। একটা বুলেটের খোল তুলে নিয়ে একটু পরীক্ষা করে বুঝল ‘ফ্র’ দের ব্যবহৃত বিশেষ ধরনের স্টেনগানেরই বুলেট। হাসান তারিক বলল, আবদুল্লায়েভ, জেনারেল বোরিসরাই এদের মেরেছে।
একটু থামল, তারপর আবার শুরু করল হাসান তারিক, কিন্তু এদের মারল কেন? দু’পক্ষে সংঘর্ষ হয়নি বোঝাই যাচ্ছে। এদের কারও কাঁধ থেকেই রাইফেল নামেনি। মনে হচ্ছে গুলি খাবার আগে এরা বুঝতেই পারেনি কি হচ্ছে। নিশ্চয়ই জেনারেল বোরিসকে এরা বিশ্বাস করে, সম্ভবত সরকারী গাড়ি দেখে।
আবদুল্লা্য়েভ চারিদিক একবার পর্যবেক্ষণ করে বলল, দেখুন এদের ঘোড়া কোথাও দেখা যাচ্ছে না, উইঘুর কাজাখদের ঘোড়া তার মনিবদের ছেড়ে এভাবে দল বেধে সরে যায় না। নিশ্চয় জেনারেল বোরিসরা এদের ঘোড়া নিয়েই পালিয়েছে। আর এদের তারা হত্যাও করেছে ঐ ঘোড়া হাত করার জন্য।
হাসান তারিক আবদুল্লায়েভের পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ, এটাই সবচেয়ে সংগত ব্যাখ্যা। গাড়ি যখন আর চলবে না, তখন ঘোড়ার চেয়ে বড় মূল্যবান তাদের কাছে আর কিছু ছিল না।
একটু থেমে হাসান তারিক আবার বলল, এর দ্বারা আরেকটা জিনিস প্রমাণ হয়, তারা এ ছোট তারিমের পথই অনুসরণ করেছে।
আবদুল্লায়েভ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। সেই সাথে বলল, তবু সামনের পথটা আর একটু পরীক্ষা করে আসি। ঘোড়া যদি পামিরের পথে যেয়ে থাকে তাহলে চিহ্ন চোখে ধরা পড়বেই।
বলে আবদুল্লায়েভ সামনের দিকে এগুলো। পামিরে যদিও তখন গ্রীষ্মকাল। কিন্তু পামিরের মাথা বরফে ঢাকা। সাদা বরফের উপর শ্যেন দৃষ্টি আবদুল্লায়েভের।
হাসান তারিক শূন্য গাড়িগুলোতে একটু নজর বুলাতে গেল। তিনটি গাড়িই আনকোরা নতুন। তিনটি গাড়িই শূন্য, কোন চিহ্নই পেল না কোন গাড়িতে। হতাশ হলো হাসান তারিক। বোধহয় মন চাইছিল আহমদ মুসার কোন চিহ্ন খুঁজে পাক।
হাসান তারিক নেমে এল গাড়ি থেকে। আবদুল্লায়েভও এ সময় ফিরে এল।
-না তারিক ভাই, ওরা পামিরের পথে যায়নি। বলল আবদুল্লায়েভ।
-বলেছিই তো ওরা ছোট তারিমের পথ ধরবে।
-আমরা কি এখনই যাত্রা শুরু করব?
-আমরা সময় নষ্ট করতে পারি না। রাতেও আমাদের পথ চলতে হবে। ওদের আমরা পথেই ধরতে চাই।
-তারিক ভাই, রক্তের রং দেখে আমি বুঝতে পারছি, ঘটনা পাঁচ ঘন্টা আগে ঘটেছে। অর্থাৎ বলা যায়, প্রায় পাঁচ ঘন্টা আগে ওরা এই ছোট তারিমের পথে যাত্রা শুরু করেছে।
হাসান তারিক তাকিয়েছিল নিচে তিয়েনশানের পূর্ব্ ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়া তারিম উপত্যকারই দিকে। তার চোখে ভেসে উঠছে, এ উপত্যকারই পথ ধরে আহমদ মুসাকে বন্দী করে জেনারেল বোরিসরা এগিয়ে যাচ্ছে। কি অবস্থায় আছে আহমদ মুসা! এ কথা ভাবতেই মনটা তার আনচান করে উঠল।
হাসান তারিক যেন অনেকটা স্বগত কন্ঠেই বলল, ওরা কমপক্ষে আট মাইল সামনে। সুতরাং ওদের নাগাল পাওয়া সহজ নয়। কিন্তু কাশগড়ে পৌছার আগে যদি ওদের সন্ধান করতে না পারি, তাহলে ওদের বের করা মুশকিল হবে আমাদের জন্য।
পামির থেকে তিয়েনশানের ঢাল বেয়ে তারিম উপত্যকার পথে যাত্রা শুরু করল হাসান তারিক ও আবদুল্লায়েভ। দু’জনেরই পরনে তাজিক ব্যবসায়ীর পোশাক।
আগে আগে চলছিল হাসান তারিক। আবদুল্লায়েভকে লক্ষ্য করে সে বলল, তুমি রাস্তার ডানদিকে সন্ধানী চোখ রাখবে, আমি বাম দিকটা দেখব।
আবদুল্লায়েভ মাথা নেড়ে সায় দিল।
নিরবে এগিয়ে চলল দু’জনের কাফেলা। সফেদ বরফের উপর দিয়ে ইতিহাসের এক অতি পুরানো পথ ধরে তারা চলছে। কত ঘটনার সাক্ষী এই পথ! কত আনন্দ, কত বেদনার পদচিহ্ন ঘুমিয়ে আছে এই পথে! বাগদাদে আব্বাসীয় খলিফাদের শাসন কাল। মুসলিম বিজয়ের তখন স্বর্ণযুগ। ইসলামের সেনাপতি কুতাইবা সমরখন্দ, বোখারা মুক্ত করার পর এ তারিমের পথ ধরেই কাশগড় পৌছে ছিলেন। বিজেতা কুতাইবা এ পথেই আবার ফিরেছিলেন বাগদাদ। সে বিজয়ী ঘোড়সওয়ারের পদচিহ্ন এ পথের বুকে এখন হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, কিন্তু পথের স্মৃতিকথা এবং দু’পাশের পাহাড়ের মৌন শৃংগগুলোর নির্বাক জীবনকাব্যে তা অক্ষয় হয়ে আছে।
তিয়েনশানের পূর্ব ঢালটি তার পশ্চিম ঢালের মতই। পামির থেকে নেমে বরফ মোড়া পথে অনেকটা এগুতে হবে। এক সময় অথৈ এ বরফের রাজ্য শেষ হয়ে যাবে। পাওয়া যাবে সবুজ ঘাসে মোড়া উপত্যকা-পাহাড় শ্রেণীর এক জগত। সেটা পেরুলে সামনে আসবে সবুজ বনানী। তখন বুঝতে হবে আমরা তিয়েনশানের গোড়ায় পৌছে গেছি। তবু কিন্তু অনেক সময় লাগবে পাহাড় থেকে নামতে। পামির থেকে কাশগড় পর্যন্ত গোটা পথটা ছোট তারিম নদীকে অনুসরণ করে এগিয়ে এসেছে। এ পথের যাত্রীকে বারবারই তারিমের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে হবে এবং একে পার হয়েই সামনে এগিয়ে চলতে হবে। তারিমের পথ ধরে চলতে চলতেই এক সময় আঙুর ও নানা ফলের বাগান আচ্ছাদিত একটি নগরীর বহির্দেয়াল এসে পথিকের পথ আগলে দাঁড়াবে। এ নগরীই কাশগড়।
বিরামহীনভাবে চলছিল হাসান তারিকরা। খাওয়াও খাচ্ছে ঘোড়ার পিঠে। একমাত্র নামাজ পড়ার জন্যেই তারা ঘোড়া থেকে নামছে।
ছোট তারিমকে যেখানে প্রথম অতিক্রম করতে হয়, সেই জায়গাটা অতি সুন্দর। প্রায় পঞ্চাশ ফিট ওপর থেকে তারিম এখানে একটা সবুজ উপত্যকায় আছড়ে পড়ছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট তারিমের রূপালী রূপ পথিকের মন কেড়ে নেবার মত।
এখানে ছোট তারিম পার হয়ে ওপারে উঠতেই একটা বড় পাথরের উপর কিছু ফলের খোসা পাথরের পাশে পড়ে থাকা সিগারেটের একটা কার্টুন দেখে হাসান তারিক খুশী হলো। ঘোড়া থেকে নামল হাসান তারিক। আবদুল্লায়েভও।
আবদুল্লায়েভ একটা কমলার খোসা ভালোভাবে পরীক্ষা করে বলল, তারিক ভাই, প্রায় পাঁচ ছয় ঘন্টা আগে এই কমলা ফাড়া হয়েছে।
-তোমার কথা ঠিক হলে বুঝা যাচ্ছে কোন বিশ্রাম না নিয়ে ওরা দ্রুত পথ চলছে।
-ঠিক তাই, রক্তের রং দেখে যে সময়ের কথা আমি বলেছিলাম, তার চেয়ে তারা পিছিয়ে পড়েনি। ওদের চলার গতিটা আমাদের চেয়ে কম নয়।
-তাহলে জেনারেল বোরিস তাকে অনুসরণের ভয় করছে কি?
-তাই মনে হয়।
হাসান তারিকেরা যে বড় পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল সে পাথরের পাশেই আরেকটা ছোট পাথর। সেদিকে চোখ পড়তেই হাসান তারিকের চোখ দুটি উজ্জল হয়ে উঠল। ওখানে কমলার ছোট ছোট খোসা এমনভাবে পাশাপাশি রাখা হয়েছে যা আরবী আলিফ-এর রূপ নিয়েছে। “আলিফ” আহমদ মুসার সাংকেতিক নাম। অর্থাৎ মুসা ভাই এ সংকেত এখানে রেখে গেছেন।
হাসান তারিক আনন্দে আবদুল্লায়েভকে জড়িয়ে ধরল। দু’জনে তাঁদের নেতা আহমদ মুসার বেঁচে থাকার সুস্পষ্ট ও নিশ্চিত সংকেত পেয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
তারপর আবার তাদের যাত্রা শুরু হলো। তারা চলার গতি আরও দ্রুততর করলো। তাদের মনে হল, শরীর এবং মনে যেন আগের চেয়ে বেশী শক্তি তারা পাচ্ছে।
তিয়েনশানের গোড়ায় তখন তারা পৌছে গেছে। শুরু হয়েছে জংগল পথ। তারিমকে বামে রেখে সংকীর্ণ উপত্যকা পথে তারা এগিয়ে চলেছে। তাদের দু’ধারে বিক্ষিপ্ত বনরাজী।
এই জংগল পথে প্রবেশের পর আবদুল্লায়েভ আগের চেয়ে অনেক সতর্ক। হাসান তারিককেও সে সতর্ক করে দিয়েছে। এক সময় দস্যুদের দৌরাত্মের কারণে তিয়েনশানের ঐ পথটি খুবই ঝুকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পরে সিংকিয়াং এ মুসলিম প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই বিপদ দূর হয়। কিন্তু চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পর আবার এই পথে কিছু উচ্ছৃংখলতা নেমে আসে, চীনা হানরা এখানে এসে আসন গাড়ার পর তাদের দৌরাত্ম কিছু কমে গেছে, কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। আবদুল্লায়েভ ও হাসান তারিক স্টেনগান হাতে নিয়ে সাবধানে সামনে এগুচ্ছিল।
তারিমের তীরে একটা প্রশস্ত উপত্যকায় এসে যোহরের সময় হলো। তারা সিদ্ধান্ত নিল, এখানেই তারা যোহরের নামাজটা সেরে নেবে। কিন্তু উপত্যকায় পা দেবার পর থেকেই তারা বারুদের গন্ধ পাচ্ছিল। দু’জনেই উৎকন্ঠিত হয়ে উঠল। উপত্যকায় অল্প কিছুটা পথ এগিয়ে তারা দাড়িয়ে পড়ল। চোখে দূরবীন লাগিয়ে সতর্কতার সাথে চারদিকটা একবার পরীক্ষা করতে শুরু করল।
এক জায়গায় গিয়ে হাসান তারিকের দূরবীনের চোখ আটকে গেল। দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠল হাসান তারিক। ৫ জন যুবকের রক্তাক্ত লাশ ইত:স্তত বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে।
আবদুল্লায়েভের দূরবীনটাও এখানে এসে থেমে গিয়েছিল।
দু’জনেই তাদের চোখ থেকে দূরবীন নামাল। চাইল পরস্পরের দিকে। কথা বলল প্রথম আবদুল্লায়েভ। বলল, কোন স্বার্থ বা গোত্র দ্বন্দ্বের ফল এটা হতে পারে। অথবা হতে পারে জেনারেল বোরিসের কীর্তি।
-আমরা কি একটু এগিয়ে দেখব? বলল হাসান তারিক।
-কোন বিপদে জড়িয়ে তো কাজ নেই, আমাদের লক্ষ্য তো ভিন্ন। বলে আবদুল্লায়েভ আবার দূরবীন তুলে নিয়ে ঐ দৃশ্যটা নিরীক্ষণ করল। দূরবীনটা চোখে রেখেই বলল, তারিক ভাই, আমার দেখাটা মিথ্যা না হলে আমার মনে হচ্ছে এরা হুই জাতির মুসলমান। হুই যুবকরা যে ধরনের টুপী পরে, এদের মাথায় সেই টুপী দেখছি। চেহারাও তাদের……;
কথা শেষ হবার আগেই পেছন থেকে একটা শব্দ পেয়ে বিদ্যুত গতিতে হাসান তারিক পেছনে ফিরল। দেখল মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে তিনটি উদ্যত রাইফেল। তাদের দিকে হা করে আছে। হাসান তারিকের ডান হাতে ধরা স্টেনগান নিমিষে উঠে এল। ট্রিগারে চাপ পড়ল তার শাহাদত আঙুলের। বেরিয়ে গেল গুলি।
হাসান তারিকের সাথে সাথেই ঘুরে দাড়িয়েছিল আবদুল্লায়েভ। দেখল, রাইফেল বাগিয়ে দাড়িয়ে সেই হুই চেহারার তিন যুবক। আর সেই সাথে সে দেখল, হাসান তারিকের স্টেনগানের মাথা উপরে উঠছে। সংগে সংগে সে নিজের স্টেনগান দিয়ে আঘাত করল হাসান তারিকের স্টেনগানের নলে। মুখে চীৎকার করে উঠল, গুলি করবেন না তারিক ভাই।
কিন্তু তার আগেই কয়েকটা গুলি বেরিয়ে গেছে। ঢলে পড়েছে সামনের একজন যুবকের দেহ। দেহটা সবুজ ঘাসের উপর পড়ে কয়েক মুহূর্ত ছটফট করে নিশ্চল হয়ে গেছে। আবদুল্লায়েভের স্টেনগানের আঘাতে হাসান তারিকের স্টেনগানের নল নিচু হয়ে গিয়েছিল এবং শাহাদত আঙুলিও আলগা হয়ে গিয়েছিল ট্রিগার থেকে। গুলি আর হয় নি।
সামনে দাড়ানো অবশিষ্ট দুজন যুবকের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সুঠামদেহী যুবকটি উদ্যত রাইফেলের নল উপরে তুলে আকাশের দিকে একটা ফাকা আওয়াজ করল। গুলির শব্দে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে উপত্যকার চারদিক থেকে এক ঝাক মানুষ বেরিয়ে এল উপত্যকায়। তাদের প্রত্যেকের হাতে উদ্যত রাইফেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কয়েক ডজন রাইফেল এসে তাদের ঘিরে ধরল। দীর্ঘ ও সুঠামদেহী সেই যুবকটি এগিয়ে এসে বলল, তোমাদের স্টেনগান দিয়ে দাও।
যুবকটি হুই ভাষায় এ নির্দেশ দিল। আবদুল্লায়েভ হুই ভাষা কিছু কিছু জানে। হাসান তারিক ও আবদুল্লায়েভ তাদের স্টেনগান যুবকটির হাতে দিয়ে দিল। যুবকটি হাত পেতে গ্রহন করল। তার এবং অন্যদের চোখে তখন রাজ্যের ক্রোধ ও ঘৃণা।
আবদুল্লায়েভ ভাংগা ভাংগা হুই ভাষায় সেই যুবকটিকে লক্ষ্য করে বলল, তোমার নাম কি, তুমি কি মুসলমান?
-আমি আহমদ ইয়াং। মুসলমান। অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ক্রোধের সাথে জবাব দিল যুবকটি।
-আমি আবদুল্লায়েভ এ হাসান তারিক। আমরা মুসলমান। বলল আবদুল্লায়েভ।
যুবকটির ক্রোধ ও ঘৃণাভরা চোখটি যেন হঠাৎ কেঁপে উঠল। তাক করে ধরে থাকা বন্দুকটির মাথাও যেন হঠাৎ নড়ে উঠল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। চোখ পাকিয়ে কঠোর স্বরে যুবকটি বলল, তোমাদের লোকেরা আমাদের ৬জন লোককে খুন করেছে।
আবদুল্লায়েভ প্রতিবাদ করে বলল, না একজন লোক মরেছে। তাও ভুল বুঝাবুঝির ফলে।
-অন্য পাঁচজন?
-আমরা জানি না। আমরা এই মাত্র উপত্যকায় পৌছলাম।
-কে তাহলে ওদের মারল? তোমাদের মত ওই স্টেনগানের গুলিতে ওরা মরেছে।
-আমরা জানি না, তবে আমরা অনুমান করতে পারি।
-কি?
-এখন থেকে প্রায় পাঁচ ঘন্টা আগে এখান দিয়ে আরেকটা দল চলে গেছে। এটা ওদের কাজ হতে পারে।
যুবকটি একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, যাই হোক তোমাদের আমরা ছাড়তে পারি না। আমাদের শেখের কাছে তোমাদের যেতে হবে।
এরপর যুবকটি ছয়জনকে হাসান তারিকদের পাহারায় দাঁড় করিয়ে অবশিষ্টদের নিয়ে ছয়টি লাশ একত্রিত করল। তারপর সকলকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল।

ছোট তারিমের সেই উপত্যকা থেকে সোজা দেড় মাইল উত্তরে পাহাড় ঘেরা একটা সবুজ উপত্যকা। এর একপাশ দিয়ে ছোট্ট একটা ঝরণা প্রবাহিত। উপত্যকার উত্তর পাশে পাহাড়ের একটা বড় গুহা ঘিরে বড় একটা পাথরের বাড়ি। পাহাড়ের পাদদেশে ছড়ানো আরো কয়েকটি তাবু। পাহাড়ের ঐ বড় গুহা বাড়িতে বাস করেন হুই নেতা শেখ ওয়াং চিং চাই।
শেখ ওয়াং চিং চাই চীনের বিখ্যাত হুই নেতা মা পেন চাই এর বংশধর। মা পেন চাই জাপান বিরোধী সংগ্রামের জন্যে চীনের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। জাপান বাহিনী যখন চীন আক্রমণ করে, যখন তাদের আগ্রাসী থাবা কানশু-শামসি পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। হুই মুসলমানরা রুখে দাঁড়াল তাদের বিরুদ্ধে। মা পেন চাই এর নেতৃত্বে হুই বাহিনী এতটাই সাহসী ও সফল ভুমিকা পালন করে যে এই বাহিনী কে ইস্পাত বাহিনী নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
আজকের চীনের কানশু প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে চীং নদীর উপকুলবর্তী পিং লিয়াং ছিল হুই মুসলমানদের সবচেয়ে ঘন বসতি অঞ্চলের একটি। এখানে বাস ছিল মা পেন চাইদের। মা পেন চাই এর বড় ছেলে শেখ চি হো এন তখন হুই মুসলমানদের নেতা এবং তাদের ইমাম। এই সময় মাও এর নেতৃত্বে কম্যুনিষ্ট বাহিনীর কালো থাবা এ অঞ্চলের উপর এসে পড়ে। সংগ্রামী হুই মুসলমানরা তাদেরকে বুঝতে ভুল করে। প্রথমে তাদেরকে বন্ধু এবং নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের সহায়ক হিসেবে গ্রহণ করে। মাও এর প্রচারকরা প্রথমে এ কথাই বলেছিল, চীনের রাজতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী আগ্রাসন থেকে তারা চিরতরে মুক্তি পাবে। কিন্তু চারিদিকে থাবা পাকাপোক্ত করার পর মাওবাদিরা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করল। সংগ্রামী হুইরা তাদের আধিপত্য মেনে নিল না। ইমাম চি হো এন এর নেতৃত্বে তারা কম্যুনিষ্টদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কম্যুনিষ্টদের হাত তখন অনেক মজবুত। তবু সংগ্রাম চালাল অনেক দিন ধরে। হুইরা উৎখাত হলো ভিটেমাটি থেকে। পাহাড়ে আত্মগোপন করে তারা চি হো এন এর নেতৃত্বে সংগ্রাম চালিয়ে গেল। অবশেষে সোভিয়েতের মদদপুষ্ট মাও বাহিনীর দ্বারা কানশুর পাহাড় এলাকা থেকেও তারা বিতাড়িত হলো। অনেকে নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পন করল। কিন্তু চি হো এন এর নেতৃত্বে সংগ্রামরত হুই মুসলমানদের একটি দল সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন রেখে কানশু থেকে পালিয়ে এল। প্রথমে তারা আশ্রয় নিল উরুমচিতে। সেখান থেকে কাশগড়ে। এখনও তারা কাশগড়ে আত্মগোপন করে আছে। ছোট তারিম নদীর উত্তরে এ ঘাটিটি তারা তৈরী করেছে ট্রেনিং কেন্দ্র হিসেবে। আজকের হুই নেতা শেখ ওয়াং চিং চাই ঐ শেখ চি হো এন এর বড় ছেলে।
পাহাড়ের সেই পাথুরে বাড়িটির সম্মুখ ভাগে একটি বড় কক্ষ। দরবার কক্ষ এটা। একই সাথে মসজিদও। মেহরাবের সামনে একটা জায়নামাজে বসে আছেন শেখ ওয়াং চিং চাই। তার সামনে বসে হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভ। শেখ ওয়াং চিং চাই এর ডানে-বামে এবং ঘরের চারদিক ঘিরে বসে আছে সেই যুবক আহমদ ইয়াং সহ হুইদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। হাসান তারিক কথা বলছিল। ঘরের সবাই গোগ্রাসে তা যেন গিলছিল । যুবক আহমদ ইয়াং এর চোখ আনন্দোজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, কখনও হয়ে পড়ছিল বেদনায় নিষ্প্রভ।
কথা শেষ করল হাসান তারিক।
সবাই নিরব। অশ্রু ঝরছিল বৃদ্ধ শেখ ওয়াং চিং চাই এর চোখ থেকে। অনেকক্ষণ পর সে মুখ তুলল। মাথা থেকে নেমে আসা রুমালের প্রান্ত দিয়ে দু’চোখ একটু মুছে প্রথমে হাসান তারিক তারপর আব্দুল্লায়েভ এর হাতে চুমো দিয়ে বৃদ্ধ বলল, বাবা আল্লাহর শোকর যে তোমাদের এমনভাবে কাছে পাবার সৌভাগ্য আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন ।
তারপর সে মুখ তুলে ঘরের সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ভাইসব আমাদের যে ক’জন ভাই মারা গেছেন তাদের জন্যে আমরা বেদনা বোধ করছি, কিন্তু তার চেয়েও হাজার গুন বেশী বেদনাদায়ক হলো, ফিলিস্তিনের যে বিপ্লবের জন্যে আমরা গৌরব করি, মিন্দানওয়ে যে বিপ্লব আমাদের অহংকার, কয়েকদিন আগে সংঘঠিত মধ্য এশিয়ার যে বিপ্লব আমাদের কাছে প্রাণের চেয়ে প্রিয়, সেই বিপ্লবের নেতা আহমদ মুসাকে আমাদের পাশ দিয়ে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। আমরা যদি জানতে পারতাম এবং আরও অনেক প্রাণের বিনিময়ে হলেও যদি ওঁকে উদ্ধার করতে পারতাম।
বৃদ্ধ একটু থামল। তারপর আহমদ ইয়াংকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি কাশগড়ে এখনি ওয়ারলেস করে দাও। বলে দাও কাশগড় পৌছার আগেই যেন ওরা জেনারেল বোরিসকে পাকড়াও এবং আহমদ মুসাকে উদ্ধারের চেষ্টা করে।
আহমদ ইয়াং শেখ ওয়াং চিং চাই এর বড় ছেলে এবং এখানকার অপারেশন কমান্ডার।
নির্দেশ পাওয়ার পর আহমদ ইয়াং বেরিয়ে গেল।
বৃদ্ধ শেখ ওয়াং চিং চাই আবার আত্মস্থ হয়েছে। কোন ভাবনার গভীরে যেন ডুবে গেছে সে। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলল। হাসান তারিকের দিকে চেয়ে বলল, তোমাদের কাছে পেয়ে বুক ভরা বেদনা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
একটু থামল, একটু ঢোক গিলল শেখ ওয়াং চিং চাই। তারপর শুরু করল আবার, তোমরা ফিলিস্তিন, ফিলিপাইন এবং সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় মুসলমানদের যে দূর্দশা দেখেছ, যা জেনেছ, চীনের দুখী মুসললমানরা তার চেয়ে ভাল ব্যবহার পায়নি। আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে কানশুর পিয়াংলিয়াংএ। আমি দেখেছি কম্যুনিস্টরা কেমন করে বন্ধু হিসেবে প্রবেশ করে আমাদের সর্বনাশ করেছে। একে একে ওরা আমাদের সব কিছু ছিনিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু ওরা যেদিন আল্লাহর ঘর মসজিদে হাত দিল সেদিন আমরা বরদাশত করতে পারিনি। কিন্তু বাবা, আমরা জীবন দিয়েছি, সব হারিয়েছি, তারপরও আমরা মসজিদ বাঁচাতে পারিনি। শুনেছি, চিং নদীর তীরে আমাদের সুন্দর মসজিদটিকে ওরা নৃত্যশালা বানিয়েছে। এক ইঞ্চি পুরু ইমামের সুন্দর জায়নামাজটিকে নৃত্যশালার দরজায় রেখে ওতে ওরা পা মুছছে। এখন শুনছি আজকের চীনের নতুন সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এ মসজিদের বদলে আরেকটা মসজিদ করে দিতে চাইছে। কিন্তু গরু মেরে জুতা দান ক্ষতিপূরণ নয়।
এই সময় আহমদ ইয়াং ঘরে প্রবেশ করল। শেখ ওয়াং কে উদ্দেশ্য করে বলল, জনাব আমি কাশগড়ে কথা বলেছি ওরা এখনি বেরুচ্ছে।
-জনাব আমরাও এখনি কাশগড় যাত্রা করতে চাই, আপনি অনুমতি দিন। আহমদ ইয়াং কথা শেষ করার সাথে সাথেই বলে উঠল হাসান তারিক।
-নিশ্চয় যাবে, সময় এখন অত্যন্ত মুল্যবান। বলল বৃদ্ধ শেখ ওয়াং। একটু থামল, কি যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, আমাদের ছেলে একটু ভুল করে ছিল, যার কারণে ঐ পাঁচজনকে জীবন দিতে হয়েছে প্রায়শ্চিত্য করার জন্যে। উইঘুরের মুসলিম চিত্রাভিনেত্রী ‘মেইলিগুলি’কে ওরা কিডন্যাপ করে এখানে নিয়ে আসছিল। ‘মেইলিগুলি’ শুটিং এর জন্যে এসেছিল কাশগড়। ছেলেদের যুক্তি ছিল, একটি ভালো ঘরের ভা্লো মুসলিম মেয়ে নিয়ে সর্বব্যাপী নির্লজ্জ চর্চা অসহ্য, তাকে এবং মুসলিম সমাজকে এ থেকে রক্ষা করা দরকার।
একটা ঢোক গিলে বৃদ্ধ শেখ আবার বলল, এ বিষয়টা তোমাদের এ জন্যেই জানালাম যে, জিনিসটা শুরু থেকেই আমাকে পীড়া দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ভাল কাজ হয়নি, এ জন্যেই আল্লাহ বোধ হয় শাস্তি দিলেন আমাদের।
থামল বৃদ্ধ শেখ ওয়াং। তারপর আহমদ ইয়াং এর দিকে চেয়ে বলল, মেহমানদের খাবার ব্যবস্থা কর।
আহমদ ইয়াং বেরিয়ে গেলে শেখ ওয়াং চিং চাই হাসান তারিককে বলল, খেয়ে আধা ঘন্টার মধ্যেই তোমরা যাত্রা করতে পারবে। তোমাদের সাথে যাবে আহমদ ইয়াং।
বলে বৃদ্ধ তার বিশ্রাম কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, তোমরা খেয়ে নাও, আমি আসছি।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.