তিয়েনশানের ওপারে
পর্ব ৩
জেনারেল বোরিস কোন শত্রু কিংবা সন্দেহজনক কিছু পেছনে রেখে যেতে চায় না। এই নীতির ভিত্তিতেই সে হত্যা করেছে ছোট তারিম নদীর তীরে ঐ পাঁচজন হুই যুবককে। সেই সাথে সে উদ্ধার করেছে সুন্দরী অভিনেত্রী মেইলিগুলিকে। মেইলিগুলিকে ঐ যুবকরা ধরে নিয়া যাচ্ছিল। তারা নিহত হলে মেইলিগুলি সাহায্যের আবেদন জানায় এবং তাকে কাশগড় পৌছে দিতে জেনারেল বোরিসকে অনুরোধ করে। জেনারেল বোরিস বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার পর তাকে কাফেলায় শামিল করে নেয়।
মেইলিগুলির গোটা দেহটা কাল কাপড়ে আবৃত ছিল। হুই যুবকরা তাকে কিডন্যাপ করার পর তার দেহে এই বোরখা পরিয়ে দিয়েছিল। মেইলিগুলি এখন ওটা খুলে ফেলল। কা্লো বোরখার আবরন চলে গেলে বেরিয়ে এল লাল রং এর পশ্চিমা ষ্টাইলের স্কার্ট পরা তার দেহ। অপরূপ তার দেহ সুষমা।
আহমদ মুসা সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তাকে বেঁধে ঘোড়ার পিঠে আগের মত করেই শুইয়ে রাখা হয়েছিল।
পাঁচজন হুই যুবক হত্যার ঐ ঘটনা ঘটার পর জেনারেল বোরিসের কাফেলা কোন প্রকার বিশ্রাম না নিয়ে দ্রুতবেগে এগিয়ে চলল কাশগড়ের দিকে। সে ভয় করেছিল হুইরা এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে চেষ্টা করতে পারে।
মেইলিগুলি এবং জেনারেল বোরিসের ঘোড়া প্রায় পাশাপাশি চলছিল। তাদের সামনে কিছু আগে আহমদ মুসার ঘোড়া। ঘোড়ার জিনের সাথে বেঁধে রাখা তার দেহ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছেনা। পাহাড়ী পথে ঘোড়ার চলা ও উঠা নামায় দেহটা তার অবিরাম ঝাঁকুনি খাচ্ছে।
আহমদ মুসার নিষ্পাপ দীপ্তিমান মুখ প্রথমেই মেইলিগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আহমদ মুসার রক্তাক্ত পোষাকও তার দৃষ্টি এড়ায়নি। সে বুঝতে পেরেছে ঐ বন্দীর উপর অমানুষিক নির্যাতনও করা হয়েছে। কিন্তু সে বিস্মিত হয়েছে আহমদ মুসার চিন্তা শূন্য উদ্বেগহীন উজ্জ্বল প্রশান্ত-পবিত্র মুখ দেখে। মনে হচ্ছে কোন কিছুর প্রতিই যেন তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বন্দীর চেহারা তো এমন হয়না। সুতরাং শুরু থেকেই আহমদ মুসার ব্যাপারে মেইলিগুলির মনে একটা কৌতুহলের সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে সে সাহস পায়নি। জেনারেল বোরিস তাকে আপনা থেকেই বলেছিল, বন্দী একজন ভয়ংকর লোক। মেইলিগুলি জেনারেল বোরিসের একথা বিশ্বাস করেনি। কারণ ভয়ংকর কোন লোকের চেহারা এমন হয় না। তবে সে মনে করেছে, সাধারন কোন মন ও অসাধারন কোন শক্তির অধিকারী না হলে এমন বিপদে কোন মানুষ এমন প্রশান্ত উজ্জ্বল থাকতে পারে না। এমন যে লোকটি সে কে? এই জিজ্ঞাসা মেইলিগুলির মনে তীব্রতর হয়ে উঠল।
আরেকটা জিনিস মেইলিগুলির নজর এড়ায়নি। সেটা হলো, একমাত্র বন্দী ছাড়া সবাই রুশ। বন্দীকে তার মতে তুর্কি বংশোদ্ভূত বলেই মনে হয়েছে। মুখের সুন্দর দাড়ি দেখে তার মনে বার বারই প্রশ্ন জেগেছে বন্দী কি মুসলমান?
জেনারেল বোরিসের কাফেলা অনেক্ষণ আগে অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ তারা কাশগড়ের নিকটবর্তী হয়েছে। সমভূমিতে নেমে আসার পর জেনারেল বোরিসকে খুবই গম্ভীর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে কি যেন হিসেব করছে সে।
এক জায়গায় এসে জেনারেল বোরিস থমকে দাঁড়াল। থামিয়ে দিল কাফেলা। পকেট থেকে একটা কাগজ টেনে বের করল। কাগজটা কাশগড় এলাকার মানচিত্র।
যেখানে এসে কাফেলা দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে একটা বড় রাস্তা সোজা পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। আরেকটা ছোট রাস্তা উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে ছোট তারিমের তীর ধরে এগিয়ে গেছে। বড় রাস্তাটা কাশগড় যাওয়ার সোজা এবং সংক্ষিপ্ত পথ। আর ছোট রাস্তাটা তারিমের সাথে আঁকা বাঁকা পথে এগিয়ে অনেক পথ ঘুরে কাশগড়ের পাশ দিয়ে আরও পূর্বে তাকলামাকান মরুভূমির দিকে চলে গেছে।
জেনারেল বোরিস মানচিত্রটি পকেটে রেখে তার একজন সহকারী কর্ণেল কুনাকভকে বলল, তুমি চারজনকে নিয়ে এই সোজা পথে কাশগড় চলে যাও। যা বলেছি সেইভাবে ব্যবস্থা করে আমাকে খবর দাও। তারপর আমরা আসব।
মেইলিগুলি বলল, আমি কি এদের সাথে কাশগড় চলে যেতে পারি জেনারেল?
জেনারেল বোরিস একটু হেসে বলল, না আপনি আমাদের সাথে যাবেন।
কুনাকভ সহ তার চারজন সাথী চলে যাবার মিনিট পাঁচেক পর জেনারেল বোরিস তার অবশিষ্ট কাফেলাকে উত্তরের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলার নির্দেশ দিল। এই নির্দেশে মেইলিগুলি বিস্মিত হলো, কর্ণেল কুনাকভকে দেয়া কথা মোতাবেক তো তার তরফ থেকে খবর না আসা পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করার কথা। মেইলিগুলি এই বিস্ময় তার মনে চেপে রাখল। দেখল, জেনারেল বোরিসের মুখ অত্যন্ত গম্ভীর।
কাফেলা প্রায় এক ঘন্টা চলার পর এক জায়গায় এসে জেনারেল বোরিস ওয়্যারলেস কানে লাগিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়ল। সে ঘোড়া থেকে নামল এবং কাফেলাকে দাঁড়াতে বলে পাশের পাহাড়ের টিলায় উঠে গেল। চোখে দূরবীন লাগিয়ে চারদিকটা দেখল। প্রায় এক মাইল পূর্ব দিকে তারিম নদীর তীরে এই রাস্তার পাশে পুলিশ ষ্টেশনের একটা সাইনবোর্ড দেখে জেনারেল বোরিসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সে নেমে এল পাহাড় থেকে। তারপর কাফেলায় ফিরে এসে মেইলিগুলিকে একপাশে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি বলল, আমি যে দলকে কাশগড় পাঠিয়েছিলাম, পথে তাদের উপর হুইরা আক্রমন করেছিল। কিন্তু আপনাকে না দেখে তাদের ছেড়ে দিয়ে ওরা এদিকে এগিয়ে আসছে এবং কাশগড় থেকে হুইদের আরেকটা দলও এই পথে এদিকে আসছে।
একটু দম নিল জেনারেল বোরিস, তারপর বলল, এখন আমাদের করণীয় হল, সামনেই একটা পুলিশ ষ্টেশন আছে। আমরা আপনাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি সেখানে গিয়ে বলবেন, হুইরা আপনাকে কিডন্যাপ করে পাহাড়ের ঘাটিতে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা ব্যবসায়ী, আসার পথে আমরা আপনাকে উদ্ধার করেছি। উদ্ধার করতে গিয়ে এই লোক (আহমদ মুসা) আহত হয়েছে। এখন হুইরা আবার আপনাকে ধরতে আসছে। আপনি পুলিশের সাহায্য চান। এরপর যা বলার আমিই বলল।
মেইলিগুলি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, কথাগুলো বলার সময় জেনারেল বোরিসকে খুবই উত্তেজিত ও উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। যে ধরনের ঘটনা এবং যে অবস্থা তাতে এতটা উদ্বেগ বোধ করার কিছু নেই। মেইলিগুলির মনে প্রশ্ন জাগল, তাহলে এর বাইরেও কি কিছু আছে? বন্দী লোকটা কে? এই প্রশ্ন আবার তার মনে জাগল।
জেনারেল বোরিসের কথার জবাবে মেইলিগুলি বলল, ঠিক আছে, আমি বলল। এরপর জেনারেল বোরিস আহমদ মুসার ঘোড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার বাঁধন খুলে দিল। বাঁধন খুলে গেলে আহমদ মুসা উঠে বসল। জেনারেল বোরিসের নির্দেশে একটা বড় সাদা চাদর আনা হলো। সে সাদা চাদরটি জেনারেল বোরিস আহমদ মুসার হাতে তুলে দিয়ে বলল, গায়ে জড়িয়ে নিন।
একটু দম নিল যেন জেনারেল বোরিস । তারপর বলল, শুনুন, এই মেয়েকে কিডন্যাপকারী হুইদের সাথে সংঘর্ষে আপনি আহত হয়েছেন, এখন অসুস্থ আপনি। কেউ জিজ্ঞেস করলে এই কথাই বলবেন।
একটু থেকে হাতের রিভলভারটি নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, মনে রাখবেন, যে মুহূর্তে কথার সামান্য অন্যথা দেখব, ছাতু করে দেব মাথা।
আহমদ মুসার মুখে একটা প্রশান্ত হাসি ফুটে উঠল। কোন উত্তর দিল না।
মেইলিগুলি বোরিসের পাশেই দাঁড়িয়েছিল। তার মনে হল বোরিসের হুমকি যেন পাথরের বুকে আছাড় খেয়ে ফিরে এল।
জেনারেল বোরিসের কাফেলা থানায় গিয়ে হাজির হলো।
থানাটি রাস্তা থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে একেবারে নদীর তীরে দাঁড়ানো। প্রথমেই একটা বড় গেট। গেট পেরুলে একটা লন, তারপর থানার প্রধান অফিস ঘর।
গেটে একজন পুলিশ দাঁড়ানো ছিল। মেইলিগুলি তাকে গিয়ে তার প্রয়োজনের কথা বলল। পুলিশ একবার মেইলিগুলির আগুন ঝরা অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে গেট ছেড়ে দিল। মেইলিগুলি এবং জেনারেল বোরিস ভেতরে ঢুকে গেল। আহমদ মুসাকে নিয়ে অন্যারা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল।
থানার অফিসার ইনচার্জ একজন হীন গোত্রীয় চীনা। ধর্ম পরিচয়ে ওরা বৌদ্ধ। দু’একজন সেপাই ছাড়া থানার অধিকাংশ পুলিশই হীন গোষ্ঠীর। চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় অন্যান্য ক্ষেত্রের মত পুলিশ বিভাগ থেকে মুসলমানদের খেদানো হয়েছিল। বর্মমানে নতুন প্রশাসনের অধীনে তারা চাকুরী আবার কিছু কিছু ফিরে পেতে শুরু করেছে মাত্র।
মেইলিগুলি গিয়ে থানার অফিসার ইনচার্জকে তার কথা বলতে শুরু করল।
মেইলিগুলির নাম শুনেই পুলিশ অফিসার লাফিয়ে উঠল। পাশের ফাইল থেকে একটা ফটো বের করে এসে একবার ফটোর দিকে আর একবার মেইলিগুলির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক মিলেছে, আপনার জন্যে হয়রান আমরা। কাশগড় রেষ্ট হাউজে আপনার মা ভীষণ উদ্বিগ্ন, তাকে আমরা জানিয়ে দিই আপনার কথা? খুশী হয়ে মেইলিগুলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
অফিসার ভেতরে আরেকটা রুমে চলে গেল। অল্পক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, হেড কোয়ার্টারে জানিয়ে দিয়েছি। এখনি ওরা জানিয়ে দেবে আপনার মাকে।
-এখন শুনুন আমার কথা। বলল মেইলিগুলি।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন।
সব কথা শুনে অফিসার ইনচার্জ একগাল হেসে বলল, ও আপনি কোন চিন্তা করবেন না। ওরা থানার আশে-পাশে আসতে সাহস পাবে না।
তারপর জেনারেল বোরিসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ব্রেভম্যান, আপনাদের ধন্যবাদ। আমাদের বিরাট ঝামেলা থেকে বাঁচিয়েছেন।
জেনারেল বোরিসের মাথায় তখন অন্য চিন্তার ঝড়। সে ভাবছে, কাশগড়ে তাদের সংবাদ গেল কি করে? নিশ্চয় ছোট তারিমের ঐ এলাকয় হুই মুসলমানদের যে ঘাটি আছে সেখান থেকেই তাদের ব্যাপারে সব কথা কাশগড়ে তাদের লোকদের জানানো হয়েছে। আর তা অবশ্যই ওয়্যারলেসে। ওয়্যারলেসে তাদের জানানো সব কথার মধ্যে কি কি কথা আছে? সাইমুমের সাথে তাদের কি কোন সম্পর্ক আছে? যখন এসবের কিচুই জানা নেই, তখন সব কিছুই সন্দেহের ব্যাপার। সুতরাং কিছুতেই তার এদের নজরে পড়া চলবে না। আবার থানাতেও বেশীক্ষণ দেরী করা বিপজ্জনক। আহমদ মুসার ব্যাপারটাই শুধু নয়, আগ্নেয়াস্ত্রসহ যে সব লাগেজ আছে তা একবার চীনা পুলিশের নজরে পড়লে কোন দিনই এদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে না। এই সংকট থেকে উদ্ধার পাবার দুটোই পথ। প্রথমত মেইলিগুলিকে তার কাফেলা থেকে পৃথক করা, যাতে করে হুইদের নজরে পড়া থেকে এ কাফেলা বাঁচতে পারে। দ্বিতীয়ত কারো নজরে না পড়ে এইভাবে আহমদ মুসাকে কাশগড় পর্যন্ত পৌঁছানো। কাশগড়ে একবার পৌঁছাতে পারলে উরুমচি যাবার সব ব্যবস্থা এখানকার ‘ফ্র’ ইউনিট ঠিক করে রেখেছে।
জেনারেল বোরিস অফিসার ইনচার্জকে বলল, আমাদের প্রতি আপনার এ শুভেচ্ছার জন্যে ধন্যবাদ।
এক মুহূর্ত থেকে জেনারেল বোরিস বলল, মেইলিগুলির কাছে আপনি সবকিছু শুনেছেন। এখন আমার আবেদন হল, মেইলিগুলির দায়িত্ব আপনারা নিয়ে তাকে কাশগড়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আর আমাদের জন্যে যেমন করে হোক একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন যাতে অসুস্থ লোকটিকে কাশগড় পর্যন্ত ভালোভাবে নিয়ে যেতে পারি। ঘোড়াগুলো আমাদের ক্লান্ত, এরা লাগেজও আর বইতে পারছে না।
থানা অফিসার একটু চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, অসুবিধা হবে না। একটা চার আসনের পিকআপ ভ্যান হলেই তো আপনার চলবে। আর মেইলিগুলিকে নিয়ে তো কাশগড় শুধু নয় উইঘুর ও গোটা সিংকিয়াং-এ মহা হৈ চৈ চলছে। ওঁকে এখনি একটা গাড়িতে কাশগড় পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-আমরা এখনই যাত্রা করতে চাই।
-মেইলিগুলিকে এখনি পাঠাচ্ছি। পুলিশ সাথে থাকবে। এতে আপনাদেরও সুবিধা হবে।
-ধন্যবাদ। বলল জেনারেল বোরিস।
গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে গেল। জেনারেল বোরিস ও তার লোকজন ঘোড়ার পিঠ থেকে লাগেজ খুলে পিকআপ ভ্যানে তোলার ব্যবস্থা করছে।
আহমদ মুসাকে প্রথমেই পিকআপ ভ্যান তোলা হয়েছে এবং দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জানালা দিয়ে আহমদ মুসাকে দেখা যাচ্ছে। জেনারেল বোরিসের একজন লোক সে জানালার পাশে ঘুর ঘুর করছে। বোঝাই যাচ্ছে সে আহমদ মুসার দিকে চোখ রেখেছে। তার একটা হাত পকেটে। অর্থাৎ প্রয়োজন হলে রিভলভার বের করতে এক মূহূর্ত দেরী করবে না।
মেইলিগুলির জীপ রেডি। একসাথে যাবার জন্যে সে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ ঘুরে ঘুরে বারবার আহমদ মুসার দিকেই নিবন্ধ হচ্ছিল। কিন্তু একবারই শুধু তার সাথে চোখাচোখি হয়েছে। সেই যে চোখ নামিয়ে নিয়েছে আর সে মুখ তুলেনি তার দিকে। মেইলিগুলির মনে পড়ল, জেনারেল বোরিস যখন তার বাঁধন খুলে দিচ্ছিল এবং কথা বলছিল তখনও সে মেইলিগুলির দিকে একবারও ফিরে তাকায়নি। সে বিস্ময় মানল, কাছে পেয়েও মেইলিগুলির দিকে চোখ ফেলে না, তার দিকে গোগ্রাসে তাকিয়ে থাকে না, এমন মানুষ কি থাকতে পারে। সেই কৈশোর থেকে এমন একজন মানুষও তো সে পায়নি। হঠাৎ করে মনে পড়ল তাকে কিডন্যাপকারী যুবকদের কথা। তারা তাকে কিডন্যাপ করে দুই রাত লুকিয়ে রেখেছিল নির্জন স্থানে, তারপর একদিন মধ্য রাতে তাকে নিয়ে যাত্রা করেছিল তিয়েনশানে। কিন্তু তারা কেউ তার গা স্পর্শ করেনি, কোন প্রকার অশ্লীল আচরণও করেনি। ঐ যুবকদের আচরণও তার কাছে বিস্ময়কর। তবু তাদের চোরা চোখের দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে সে তার প্রতি প্রশংসার পীড়ন অনুভব করেছে। কিন্তু এর চোখ তো তাকে কোন গণ্যের মধ্যেই আনছে না। কে এই অদ্ভুত বন্দী?
মেইলিগুলি ইতস্তত হাঁটতে হাঁটতে সেই পিকআপের জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মেইলিগুলি সেখানে দাঁড়ালে জেনারেল বোরিসের লোকটি একপাশে সরে গিয়ে পায়চারি করতে লাগল।
মেইলিগুলি আহমদ মুসার প্রায় মুখোমুখি। দু’জনের মধ্যে ব্যবধান এক গজের চেয়ে বেশি হবে না। আহমদ মুসা একবার চোখ তুলেই আবার নামিয়ে নিয়েছে।
মেইলিগুলি জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, কে এই বন্দী, কিন্তু হঠাৎ এ সময় তার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল, কিছু বলার আছে আপনার?
একেবারে ফিসফিসে স্বর ছিল মেইলিগুলির। প্রশ্নটা করেই সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল লাগেজ টানাটানি কাজের দিকে। কিন্তু সে উৎকর্ণ ছিল আহমদ মুসার উত্তর শোনার জন্যে।
আহমদ মুসা তার এই প্রশ্নে কিছুটা বিস্মিত হলো এবং মেয়েটির এই সুন্দর অভিনয়ে মনে মনে হাসল। একটু ভেবে নিয়ে মেয়েটির ঐ প্রশ্নের জবাবে সে উইঘুর এলাকার আঞ্চলিক টানে বলল, শুকরিয়াহ বোন, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন এবং জাতির কাজে লাগার শক্তি আপনাকে দিন।
কথা শেষ করে নিজের কথায় নিজেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বহুদিন-অনেক বছর পর সে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলল। মাতৃভাষার এ ধ্বনি যেন মুহুর্তে তাকে অনেক পেছনের অতীতে টেনে নিয়ে গেল। মনে পড়ল শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের প্রারম্ভ কালের অনেক ঘটনা, অনেক পুরানো চিত্র এবং তিয়েনশানের কোলে মুক্ত বাতাসের মত ছুটে বেড়ানোর মধুর অনেক স্মৃতি। যেভাবেই হোক, সেই তিয়েনশানের কোলে, সেই সিংকিয়াং-এ সে হাজির। একথা মনে হতেই কোত্থেকে যেন নতুন প্রাণের জোয়ার আসছে তার দেহে, প্রতি ধমনীতে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতে না হতেই জেনারেল বোরিস ছুটে এল এদিকে। এসে বলল, সব রেডি, উঠুন এবার গাড়িতে। এখন যাত্রা শুরু করলেও সন্ধ্যার আগে কিছুতেই আমরা কাশগড় পৌছাতে পারবো না।
মেইলিগুলি মনে মনে হাসল। বুঝল, বন্দীর সাথে কথা বলি এটা বোরিস চান না। এটা ঠেকানোর জন্যেই এখন গাড়িতে ওঠার তাড়াহুড়া। মেইলিগুলি মুখে বলল, ধন্যবাদ জেনারেল বোরিস, আমি প্রস্তুত।
মেইলিগুলি গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িতে উঠে বসল সে। পেছনের সিটে বসল চারজন পুলিশ। হাতে তাদের স্টেনগান।
আগে চলল মেইলিগুলির জিপ। তার পেছনে জেনারেল বোরিসের পিকআপ। জেনারেল বোরিসদের ঘোড়াগুলো বাঁধা থাকল থানার গেটের বাইরে। ওগুলোর মালিকানা জেনারেল বোরিস থানা ইনচার্জকে দিয়ে গেল।
ছুটে চলেছে দু’টি গাড়ি কাশগড়ের পথে।
গাড়িতে বসে এখন এগিয়ে চলতে ভালো লাগছে মেইলিগুলির। মনে হচ্ছে, জীবনের এক দুঃস্বপ্নের ইতি ঘটিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সে।
সুখের এই স্মৃতিচারণের সময় আবার তার সামনে এল সেই অদ্ভুত বন্দীর কথা। কি অদ্ভুত মানুষ সে। নিজের কথা সে কিছুই বলল না, যা বলা ছিল ঐ রকম নির্যাতনপিষ্ট বন্দীর জন্যে স্বাভাবিক। উপরি সে আমারই মঙ্গল কামনা করল। নিজের সম্পর্কে এমন নির্বিকার কোন কাউকে তো তার এর আগে নজরে পড়েনি। তার উপদেশের কথাও মনে পড়ল। জাতির কাজে লাগার জন্যে যে শক্তি চাই তা তিনি মেইলিগুলির জন্যে প্রার্থনা করেছেন কিন্তু যা তিনি চেয়েছেন তা তো আমি কোনদিন চাইনি। নিজেকে নিয়ে ভেবেছি, জাতিকে নিয়ে তো কোন দিন ভাবিনি। তার কথা কি এই ভাববারই আহবান! কে এই আহ্বানকারী অদ্ভুত, অসাধারণ এবং অজানা এই বন্দী?
আশ-পাশের ঝোপঝাড় এবং পাহাড়ের ছোটখাট টিলার মিছিল পেছনে ফেলে তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দু’টো গাড়ি। মাঝপথে একদল ঘোড়সওয়ারকে অতিক্রম করল গাড়ি দু’টি। মুখ বাড়িয়ে তাদের দেখে মেইলিগুলি বুঝল, হুইরা বোধ হয় তাদের সন্ধানেই বেরিয়েছিল।
সন্ধ্যার পর গাড়ি দু’টি কাশগড় শহরে প্রবেশ করল। শহরে প্রবেশ করার পর মেইলিগুলির গাড়ি এগিয়ে চলল সরকারী রেষ্ট হাউজের দিকে। আর জেনারেল বোরিসের গাড়ি মোড় নিল শহরের হান রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিকে। মুখ ফিরিয়ে মেইলিগুলি একবার জেনারেল বোরিসের গাড়ির দিকে চাইল, একটা বেদনা বোধ করল সে মনে। জেনারেল বোরিসের হাতে ঐ অদ্ভুত বন্দীর কী যে হবে! বন্দীর মুখ থেকে শোনা তার উইঘুর টোনের কথা মনে পড়ল। সেকি তাহলে সিংকিয়াং-এর লোক? হঠাৎ মেইলিগুলির মনে হল, সে কি তার জন্যে কিছু করতে পারতো না!
কথাটা যখন মনে পড়ল, তখন সে চোখ ফিরিয়ে দেখল জেনারেল বোরিসের গাড়িটির রেয়ার লাইটের ক্ষীণ চিহ্নটিও পেছনের কালো আঁধারে মিশে গেছে।
কাশগড় থেকে অভ্যর্থনার জন্যে আসা হুই ঘোড়সওয়ারদের কাছ থেকে হাসান তারিক জেনারেল বোরিসকে অনুসন্ধানের তাদের চেষ্টার কথা শুনছিল। যেখান থেকে জেনারেল বোরিস উত্তর দিকে মোড় নিয়ে তারিম তীরের পথে কাশগড় যাত্রা করেছিল, সেখানে সে মোড়ে এসে হাসান তারিক দাঁড়াল।
হাসান তারিক কাশগড় থেকে আসা একজনের দিকে তাকিয়ে কাশগড়গামী সোজা পথটার দিকে ইংগিত করে বলল, তোমরা তো এ পথেই চারজন রুশ ঘোড়সওয়ারের দেখা পেয়েছিলে?
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল সেই ঘোড়সওয়ার।
হাসান তারিক আব্দুল্লায়েভের দিকে তাকিয়ে বলল, ধূর্ত জেনারেল বোরিস চারজনকে সোজা পথটায় পাঠিয়ে উত্তরদিকের এ ঘোরা পথটা ধরেই কাশগড় গেছে।
সেই ঘোড়সওয়ারটি বলল, কিন্তু জনাব, আমরা সর্বক্ষন এ পথের ওপর চোখ রেখেছি, রাত তক এক বা একাধিক কোন ঘোড়সওয়ারই এ পথ দিয়ে যায়নি।
‘সেটা ভিন্ন কথা, কিন্তু জেনারেল বোরিস উত্তরের এ পথ ধরেই গেছে।’ বলে একটু থামল, একটু চিন্তা করল হাসান তারিক। তারপর উত্তরের পথ ধরে চলতে শুরু করল সে।
সেই থানার কাছাকাছি হাসান তারিকরা এসে পড়েছে। ওদিকে আলো দেখে হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, ওখানে কি? কোন বাড়ি?
-না ওটা থানা। আহমদ ইয়াং জবাব দিল।
থানার কথা শুনে হাসান তারিক থমকে দাঁড়াল। হঠাৎ তার মনে হল, জেনারেল বোরিসের হাতে মেইলিগুলি ছিল। প্রখ্যাত অভিনেত্রী সে, কিডন্যাপ হয়েছিল। পুলিশের সাহায্য সে পেতে পারে। জেনারেল বোরিস কি এরই সুযোগ গ্রহণ করেছে! কোন ঘোড়সওয়ার কাশগড় যায়নি। তার অর্থ ওরা কি এখনও থানায় থাকতে পারে? থানায় গিয়ে থানার প্যাঁচে আটকে পড়তেও তো পারে? একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা উঁকি দিল তার মনে।
হাসান তারিক একটু চিন্তা করল, তারপর আহমদ ইয়াং– এর দিকে চেয়ে বলল, থানায় একটু খোঁজ নেয়া যেতে পারে, আমার মনে হয় জেনারেল বোরিস এখানে আসতে পারে।
-তাহলে আপনারা দাঁড়ান, আমি খোঁজ নিয়ে আসি।
-ঠিক আছে, আমিও তোমার সাথে যাব। বলল হাসান তারিক
তারপর হাসান তারিক এবং আহমদ ইয়াং দু’জনে থানার পথ ধরে এগিয়ে চলল। আহমদ ইয়াং আগে চলছে, পেছনে হাসান তারিক।
থানা প্রাচীর ঘেরা। সামনে লোহার বড় গেট। লোহার গেট ঘেঁষে ভেতরে একটা পুলিশ বক্স। ওখানে বন্দুকধারী একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। গেটের ডান পাশে জেনারেল বোরিসের রেখে যাওয়া সেই পাঁচটি ঘোড়া বাঁধা আছে তখনও।
আহমদ ইয়াং তখন গেটের কাছাকাছি পৌছেছে। হঠাৎ ঘোড়ারা হ্রেষা ধ্বনি করলে সে বাম দিকে চাইল। দেখল কয়েকটি ঘোড়া সেখানে বাঁধা। তাকে দেখে ঘোড়াগুলো পা ছুড়ছে এবং হ্রেষা ধ্বনি করছে।
আহমদ ইয়াং এর মনোযোগ ছিল গেটের দিকে, গেটের পুলিশের দিকে। সে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত সেদিকে চলল।
গেটের পুলিশকে দেখে আহমদ ইয়াং মনে মনে বেজার হলো। পুলিশটি হান গোষ্ঠীর। ওরা সিংকিয়াং-এর মূল বাসিন্দা মুসলমানদের ভালো চোখে দেখে না। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ে ওদের বিপুল সংখ্যায় এনে সিংকিয়াং-এ বসানো হয়েছে। এ অঞ্চলের মুসলমানদের বিরুদ্ধে তারা পাল্টা শক্তি, এই মন্ত্র তাদের কানে দেয়া হয়েছিল। এটা তারা ভুলে যায়নি। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, তারা শাসন করতেই এসেছে। এ ধারণা প্রকাশের কোন সুযোগই তারা ছাড়ে না।
আহমদ ইয়াং এসে দু’হাত গেটে রেখে গেট ঘেঁষে দাঁড়াল। সে জানে হানদের খুশী করতে হলে ওদের চীনা ভাষায় কথা বলতে হবে। আহমদ ইয়াং চীনা ভাষায় পুলিশটির প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বলল, কোন মেহমান এসেছিল কি থানায়?
-কাদের কথা বলছ, মেইলিগুলি?
-রুশ কেউ?
-কয়েকজন রুশ মেইলিগুলির সাথেই এসেছিল। তাদের সাথে তোমার কি, কেন জিজ্ঞেস করছ?
-কিছু না খোঁজ করছি, ওরা আমাদের সাথী কিনা।
শেষ কথাটা শুনে পুলিশটি একটু খুশী হলো বলে মনে হলো। সাগ্রহে এবার বলল, মেইলিগুলিকে তোমরা কোথায় পেলে বলত? কি যে হয়রানী গেছে কয়দিন।
-পাহাড়ের পথে ওকে আমরা উদ্ধার করেছি।
-বড় ভাল মেয়ে তাই না, গোটা দেশে ও রকম একটি মেয়েও আমার চোখে পড়েনি। একেবারে সাক্ষাত পরী।
পুলিশের মুখে এবার কথার খই ফুটতে শুরু করেছে। আহমদ ইয়াং জানে মেইলিগুলির প্রসংগ নিয়ে কথা বললে ঘন্টাতেও শেষ হবে না। কিন্তু সময় নেই আহমদ ইয়াংদের। কথার মোড় ঘুরিয়ে সে বলল, ওরা এখন কোথায়?
-না ওরা সংগে সংগেই চলে গেছে। আমাদের সাহেব নিজে ওদের থানার গাড়িতে করে কাশগড় পাঠিয়ে দিয়েছে। ঐ দেখ ওদের ঘোড়া ওরা রেখে গেছে।
আহমদ ইয়াং ঘোড়াগুলোর দিকে ফিরে তাকালো। ঘোড়াগুলোর দিকে তাকাতে গিয়ে আহমদ ইয়াং আবার সেই দৃশ্যই দেখল, ঘোড়াগুলো তার দিকে তাকিয়ে মুখ তুলে হ্রেসা রব করছে। ঘোড়াগুলোর এই আচরণে এবার বিস্মিত হলো আহমদ ইয়াং।
পুলিশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আহমদ ইয়াং ঘোড়াগুলোর কাছে এল। পেছনে পেছনে হাসান তারিক।
ঘোড়াগুলোর কাছে এসে চক্ষু স্থির হয়ে গেল আহমদ ইয়াং–এর একরাশ বিস্ময় এসে যেন তার কন্ঠ রুদ্ধ করে দিল। একি এ যে আমাদের ঘোড়া! সামনের দু’পায়ের সন্ধিস্থলে অস্পষ্টভাবে ‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ এর প্রতীক রেড ক্রিসেন্ট আঁকা! ঘোড়াগুলোকে এবার স্পষ্ট চিনতে পারল আহমদ ইয়াং। আর চিনতে পারার সাথে সাথে এক অজানা আশংকায় গোটা দেহ শিউরে উঠল তার।
অভিভূতের মত এগিয়ে আহমদ ইয়াং একটি ঘোড়ার গায়ে হাত বুলাল।
ইতিমধ্যে গেটের পুলিশ ছুটে এল সেখানে। বলল, শুন, ঘোড়াগুলো ওরা কিন্তু আমাদের বড় সাহেবকে দিয়ে গেছে।
আহমদ ইয়াং একবার পুলিশের দিকে ফিরে তাকাল। তারপর ফিরে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। কাফেলার উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল আহমদ ইয়াং। তার পেছনে পেছনে হাসান তারিক।
চলতে চলতে বিস্মিত হাসান তারিক বলল, কি ব্যাপার আহমদ ইয়াং, ঘোড়াগুলোর ব্যাপারটা কি?
-তারিক ভাই, মনে হচ্ছে আমাদের একটা বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে।
-কি?
-‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় আপনাদের বিপ্লবের খবর পেয়ে গ্রুপের ডেপুটি লিডার উরুমচির হাজি সেলিম চ্যাং এর নেতৃত্বে একটা দল তাসখন্দের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিল, এ ঘোড়াগুলো তাদেরই।
‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ চীনের বিশেষ করে সিংকিয়াং অঞ্চলের মুসলমানদের মুক্তিকামী একটা বিপ্লবী সংগঠন সাধারন মুসলমানদের কাছে এ সংগঠন ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ নামে পরিচিত। নয় শ’ চৌত্রিশ খৃস্টাব্দে তিয়েনশানের এপারে পুর্ব তুর্কিস্তান অঞ্চলে ইসলাম প্রথম প্রবেশ করে। উইঘুর নেতা আবদুল করিম সাতুক বোগরা খান ইসলাম গ্রহণের পর পূর্ব তুর্কিস্থানে ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই সাতুক বোগরা খানই চুরানব্বই খৃস্টাব্দে পূর্ব তুর্কিস্থানে ইসলামের প্রথম স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সে রাষ্ট্র ‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার’ নামে অভিহিত ছিল। চীনের মুসলিম ভূখন্ডে কম্যুনিষ্ট নিপীড়ন শুরু হবার পর বিশেষ করে মাও এর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলাকালে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিলুপ্তি হবার মুখে চীনের মুসলমানদের মুক্তির জন্যে লড়াইরত মুসলমানরা মুক্তির সম্মিলিত প্লাটফরম হিসেবে চীনের প্রথম মুসলিম সাম্রাজ্যের নাম অনুসারে ‘মুসলিম টার্কিক এম্পায়ার গ্রুপ’ নামে এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করে। ‘ এম্পায়ার গ্রুপ’ আরো সংক্ষেপে ‘এম্পায়ার’ এখন চীনা মুসলমানদের প্রাণের সংগঠন। কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে আপোষহীন বিপ্লবী নেতা শহীদ ওসিমান এর ছেলে উরুমুচির ইউসুফ চিয়াং এখন ‘এম্পায়ার’ এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন্ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ‘কালো দিন’ থেকে চীনা জনগণকে উদ্ধারকারী চীনের বর্তমান প্রশাসন ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর অনেক দাবী ইতিমধ্যেই মেনে নিয়েছে। সংগঠনটি এখনও আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করছে। ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর প্রধান লড়াই কম্যুনিস্টদের আর্ন্তজাতিক সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ‘ফ্র’ এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধ্বংসাবিশিষ্ট ‘রেড ড্রাগন’ এর সাথে। চীনে ‘ফ্র’ এবং ‘রেড ড্রাগন’ কার্যত এক হয়ে এখন ‘ফ্র’ এর ব্যানারে কাজ করছে। সিংকিয়াং-এ তাদের এক নম্বর শত্রু মুসলমানরা এবং দু’নম্বর শত্রু হল নতুন চীন সরকার।
আহমদ ইয়াং এর কথা শেষ হলে একটু চিন্তা করে হাসান তারিক বলল, তারা যায়নি, এমনকি হতে পারে না?
-অসম্ভব। জেনারেল বোরিসের হাতে তাদের ঘোড়াগুলো পড়েছে এটাই প্রমাণ যে তারা গেছে।
হঠাৎ হাসান তারিকের মনে পড়ল পামিরে দেখা চীনা উইঘুর কাজাখদের দশটি লাশের কথা। সংগে সংগে হাসান তারিক দাঁড়িয়ে পড়ল। আহমদ ইয়াংও। হাসান তারিক বলল, ওরা কি দশজন ছিল?
-হ্যাঁ, দশজন, কেমন করে জানলেন আপনি?
-আমাদের চোখের দূর্ভাগ্য ইয়াং, আমরা তাহলে তাঁদের লাশই দেখে এসেছি পামিরে।
একটু ঢোক গিলে হাসান তারিক আবার বলতে শুরু করল, আমরা তখনই মনে করেছিলাম, ওদের ঘোড়া হাত করার জন্যেই ওদের হত্যা করা হয়েছে।
আহমদ ইয়াং দু’হাতে মুখ ঢেকেছিল। তার আঙুলের ফাঁক গলিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।
ধীরে ধীরে হাসান তারিক কাঁধে হাত রাখল। বলল, চল ভাই, ওরা আমাদের প্রেরণা। শহীদের রক্ত আন্দোলনকে দুর্বল করে না, শক্তিশালী করে।
কান্না চেপে কম্পিত গলায় আহমদ ইয়াং বলল, তারিক ভাই, হাজী সেলিম ভাই যেদিন গেছেন, তার পরদিন তার প্রথম পুত্র সন্তান জন্ম……
কথা শেষ করতে পারলো না আহমদ ইয়াং। কান্নায় জড়িয়ে গেল তার কথা।
হাসান তারিকের চোখটাও ভারী হয়ে উঠল। তবু আহমদ ইয়াংকে সান্তনা দিয়ে বলল, নিজের পুত্র, নিজের ভাই, নিজের স্ত্রী, নিজের আত্নীয় স্বজন সবার চেয়ে সেলিম ভাই যাকে বেশী ভালবাসতেন তার কাছেই তিনি গেছেন। ইয়াং, দু:খ করো না।
বলে হাসান তারিক আহমদ ইয়াং এর একটা হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল।
কাফেলায় ফিরে এল তারা। কাফেলা ছুটে চলল এবার কাশগড়ের দিকে।
কাশগড়ের কাছাকাছি এসে হাসান তারিক আবদুল্লায়েভ ও আহমদ ইয়াং বাদে অন্যদের অন্যপথ ধরে কাশগড় প্রবেশের নির্দেশ দিল, দলবেঁধে প্রবেশ সে ভাল মনে করল না। সে ধূর্ত জেনারেলকে কিছুতেই জানতে দিতে চায় না যে কেউ তাকে অনুসন্ধান করছে।
কাশগড়ে বিখ্যাত ইদগান মসজিদের উত্তর পাশে তিনতলা একটা বিল্ডিং এ ‘এম্পায়ার গ্রুপ’ এর অফিস। কাশগড় এলাকার কাজ এখান থেকেই চলে।
অফিসের রেস্ট রুমে একটু গড়িয়ে নিল হাসান তারিক। অনেকদিন পর এই শয়ন। শোবার পর বুঝা গেল কি ধকল গেছে শরীরের ওপর দিয়ে। শরীরের জোড়াগুলো যেন খুলে যাচ্ছে, বেদনায় শরীরটা ঝাঁঝরা।
নরম বিছানায় একটু আরাম বোধ হতেই মনে পড়ল আহমদ মুসার কথা। সংগে সংগে ভুলে গেল নিজের দেহের কথা। জেনারেল বোরিসের মত অমানুষের হাতে কেমন আছে সে? বিছানা থেকে উঠে বসল হাসান তারিক। ডাকল আবদুল্লায়েভ এবং আহমদ ইয়াংকে। আহমদ ইয়াং এর সাথে আলোচনা করল এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ‘ফ্র’ এর কর্মতৎপরতা নিয়ে, জানা গেল পুর্ব তুর্কিস্থান অর্থাৎ সিংকিয়াং এ ‘ফ্র’ এর হেড় কোয়ার্টার উরুমচি এলাকায়। খোটান, ইয়ারকন্দ, আলতাই, তুরপান থেকে উরুমচি পর্যন্ত শরহগুলোর সাথে যোগাযোগের একমাত্র উপায় বাস। উরুমচির সাথে পনের দিনে একবার বিমান যোগাযোগ আছে।
সব শুনে হাসান তারিক বলল, আমার মনে হয় জেনারেল বোরিস আহমদ মুসাকে কাশগড়ে ইচ্ছা করে একদিনও রাখবেনা। যে শহর থেকে হুইরা মেইলিগুলিকে সরকারী তত্ত্বাবধান থেকে কিডন্যাপ করতে পারে, সে শহরে আহমদ মুসাকে রাখা নিরাপদ নয়।
একটু থেমে হাসান তারিক আহমদ ইয়াংকে বলল, আমি কয়েকটা জিনিস জানতে চাই। উরুমচিতে বিমান ফ্লাইট কবে, উরুমচিতে বাস যাবার সবচেয়ে কাছের তারিখ কবে, উরুমচি যাবার প্রাইভেট গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।
আহমদ ইয়াং বলল, কাশগড়ে কোন প্রাইভেট গাড়ি মেলে না। আজ সকালে উরুমচিতে একটা ফ্লাইট গেছে। আগামী কাল উরুমচির উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ার দিন।
একটু চিন্তা করল হাসান তারিক। তারপর বলল, তোমরা একটু বিশ্রাম নাও। আমরা যোহরের নামায পড়ে প্রথমে বিমান অফিস, তারপর বাস অফিসে যাব।
তারা যোহর নামায পড়ল ইদগান মসজিদে। কাশগড়ের সবেচেয়ে বড় মসজিদ। পনের হাজারেরও বেশি লোক এখানে একসাথে নামায আদায় করতে পারে। পাথরের দেয়াল। লক্ষণীয় মেহরাব এবং দেয়ালের বরাবর নিচের অংশটা খালি, সিমেন্ট বের হয়ে আছে।
হাসান তারিকের পাশে আহমদ ইয়াং নামায পড়ছিল। নামাযের ফাঁকে আহমদ ইয়াং কার্পেটের একটা অংশ উঠিয়ে দেখাল, মসজিদের মেঝেও এবড়ো থেবড়ো। আহমদ ইয়াং বলল, দেয়াল এবং মেঝে শ্বেত পাথরে আবৃত ছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় কম্যুনিষ্টরা সব খুলে নিয়ে গেছে। মসজিদে ঝাড়বাতি ছিল, মূল্যবান কাঠের জানালা কপাট সবই ওরা নিয়ে যায়। বহুদিন মসজিদ জানালা কপাটহীন উন্মুক্ত ছিল। কুকুর বিড়ালের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল মসজিদ।
-কেন নামায হতো না মসজিদে? জিজ্ঞেস করল হাসান তারিক।
-প্রকাশ্যে মসজিদে আসার সাধ্য তখন কারো ছিলনা। মসজিদের ইমাম মুফতি হাজী ইউনুস এবং মুয়াজ্জিন হাজী ওয়াংকে যেদিন ওরা শ্রম-শিবিরে নিয়ে গেল, সেদিন থেকে কার্যত মসজিদে নামায বাদই হয়ে যায়।
-ওরা এখন কোথায়?
-হাজী ইউনুস এবং ওয়াং?
-হ্যাঁ।
-ওরা আর ফিরে আসেননি। শুনেছি অমানুষিক পরিশ্রম এবং রোগে ভূগে শ্রম শিবিরেই মারা গেছেন।
-এখনকার ইমাম ইনি কে?
-হুজুর হাজী ইউনুসের ভাতিজা।
তখন ইনি কাশগড়ের মাদ্রাসাতুল হাদিসের ছাত্র ছিলেন। তাঁকে পাঁচ বছর দাস শিবিরে কাটাতে হয়। বর্তমান সরকারের আমলে তিনি ছাড়া পেয়েছেন।
এ সময় ইকামত শুরু হলো। সবাই ফরজ নামাজ আদাযের জন্য উঠে দাঁড়াল।
নামায শেষে হাসান তারিক, আবদুল্লায়েভ এবং আহমদ ইয়াং বিমান অফিসে এল বিমান অফিস শহরের এক প্রান্তে। বিমান বন্দরের সাথে সংলগ্ন। দু’তলা বিল্ডিং।
বিমান অফিসের বুকিং কাউন্টারে ঢুকতে ঢুকতে হাসান তারিক আহমদ ইয়াংকে বলল, দু’টো খোঁজ নিতে হবে। এক, আজকের সকালের ফ্লাইটে কারা গেছে তাদের নাম। দুই, কি কি লাগেজ বুক হয়েছে তার তালিকা।
বুকিং অফিসে ঢুকে ‘অনুসন্ধান’ ট্যাগ আটা কাউন্টারে গিয়ে আহমদ ইয়াং বলল, আমি আমার একজন আত্নীয়ের সন্ধান করছি, আজকের ফ্লাইটে যারা উরুমচি গেছে তাদের একটা তালিকা এবং লাগেজের একটা বিবরণী চাই।
অফিসারটি হান গোষ্ঠীর। সে চোখ কপালে তুলে বলল, এ এক বিরাট ফিরিস্তির ব্যাপার। আমার এটা কাজও নয়।
কাউন্টার থেকে ফিরেই অফিসের একজন মেসেঞ্জারকে পেল। বয়স বিশ একুশ হবে। জাতিতে উইঘুর-মুসলমান। খুশী হল আহমদ ইযাং। সে তাকে জিজ্ঞেস করল, অফিসের বুকিং ইনচার্জ কে?
-কেন?
-আজকের ফ্লাইটের যাত্রী ও লাগেজের একটা তালিকা চাই।
-এ ধরনের তালিকা বাইরে দেয়ার নিয়ম নেই। একটু চিন্তা করে জবাব দিল যুবকটি।
-কিন্তু আমার যে জরুরী প্রয়োজন। জোর দিয়ে বলল আহমদ ইয়াং।
যুবকটি আহমদ ইয়াং-এর দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর তাদেরকে নিয়ে সে ওয়েটিং কর্ণারে এল। বসার পর যুবকটি চুপি চুপি বলল, একটাই পথ খোলা আছে। বুকিং ইনচার্জ হান জাতের একজন অফিসার। ঘুষখোর। আপনারা একজন তার রুমে যান। প্রথমে একটা মানিব্যাগ তার হাতে তুলে দিয়ে তার কাছে সাহায্য চাইবেন। আমার ধারণা কাজ হবে।
যুবকটির পরামর্শ কাজে লাগল। দশ মিনিট পর আহমদ ইয়াং যাত্রী ও লাগেজ তালিকার কপি নিয়ে বের হয়ে এল।
অফিস থেকে বেরুবার সময় আহমদ ইয়াং সেই মেসেঞ্জার যুবকটির হাতে পঞ্চাশ ইউয়ানের একটা নোট গুজে দিল।
যুবকটি বিনীতভাবে সেটা ফিরিযে দিয়ে বলল, আমি গরীব, কিন্তু এ টাকা নেয়ার আমার জন্য অন্যায় হবে। ঘুষ নেয়াকে আমার হুজুর বড় পাপ বলেছেন।
-তোমার হুজুর কে?
-আরতোশের হুজুরের কাছে আমি মাসে একবার কুরআন শেখার জন্য যাই।
আরতোশ কাশগড়ের কাছেই ছোট একটা শহর। কাশগড়ের চেয়েও প্রাচীন। এখানেই পূর্ব তুর্কিস্তানের প্রথম স্বাধীন মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল করিম সাতুক বোগরা খানের মাজার। মাজার সংলগ্ন প্রাচীন একটা মসজিদ আছে সেখানে। বৃদ্ধ শেখ জামীরুদ্দীন সেখানকার ইমাম। তিনি সেখানে একটি মাদ্রাসাও চালান। কোরআন-হাদীসে গভীর জ্ঞান ও পবিত্র চরিত্রের জন্যে তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ তাঁর কাছে কুরআনের তাফসীর শুনতে যায়। গভীর রাতে তাঁর এ কুরআনের দরস শুরু হয়।
যুবকটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসান তারিকরা বেরিয়ে এল বিমান অফিস থেকে। আসার সময় আহমদ ইয়াং যুবকটির পরিচয় জেনে নিল।
তারা ভাড়া করা একটা বেবী ট্যাক্সী নিয়ে বেরিয়েছিল। গাড়িতে ওঠার সময় হঠাৎ পেছনে নজর যাওয়ায় হাসান তারিক দেখল, অনুসন্ধান কাউণ্টারের সেই হান যুবকটি অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেসেঞ্জার যুবকটির সাথে আলাপ করছে। গাড়িতে ওঠা হলে গাড়ি ছেড়ে দিল।
বেবী ট্যাক্সীতে মুখোমুখি চারটি সিট। হাসান তারিক বসেছিল সামনের সিটে। অর্থাৎ তার নজর ছিল পেছনের দিকে।
গাড়ি একটা টার্ন নেবার সময় হাসান তারিকের নজর আবার পেছনে গেল। সে দেখল, অনুসন্ধান কাউন্টারের সেই যুবকটি একটা বেবী ট্যাক্সীতে উঠছে। বেবী ট্যাক্সীটি নতুন। সামনের নাম্বার প্লেটে লাল অক্ষরে বড় বড় করে ৯৯’লেখা। চীনে এ এলাকায় সামনে পিছনে দু’দিকেই নাম্বার থাকে।
হাসান তারিক আহমদ ইয়াং এর কাছ থেকে বিমানের যাত্রী ও লাগেজ তালিকা নিয়ে ওতে নজর বুলাতে লাগল।
যাত্রী তালিকায় জেনারেল বোরিসের নাম পাবে না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল। একটা সোভিয়েত নাম সে খুঁজছিল তাও পেল না। হতাশ হয়ে হাসান তারিক লাগেজের তালিকাটা তুলে নিল। লাগেজ তালিকায় সর্বশেষ আইটেমটি ছিল একটা কফিন। আশার একটা আবেশ ফুটে উঠল হাসান তারিকের চোখে। সে দ্রুত যাত্রী তালিকা তুলে নিয়ে সর্বশেষ নামটির দিকে চোখ বসাল। নামটি ইংলিশ-আলেকজান্ডার। হঠাৎ হাসান তারিকের মনে হল আলেকজান্ডার নাম ইউরোপে কমন। সোভিয়েতেও এ নাম আছে। খুশী হলো হাসান তারিক। আলেকজান্ডার যদি জেনারেল বোরিস হয় তাহলে তার ঐ কফিনে আহমদ মুসাকে পাচার করা যেতে পারে।
হাসান তারিকদের গাড়ি এসে দাঁড়াল বাস অফিসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে সবাই ঢুকে গেল অফিসের ভেতরে।
অফিসের ওয়েটিং রুমে পায়চারী করছিল হাসান তারিক। হঠাৎ জানালার বাইরে চোখ যেতেই তার নজরে পড়ল, সেই ৯৯নং বেবী ট্যাক্সীটি রাস্তার ওপারে একটা ব্যাংকের পার্ক ষ্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে এবং ‘অনুসন্ধান’ কাউন্টারের সেই যুবকটি গাড়ির ভেতর বসে তাদের বেবী ট্যাক্সীর দিকে তাকিয়ে আছে।
মনটা ছ্যাঁত করে উঠল হাসান তারিকের। ও কি ফলো করছে আমাদের?
এই সময় আহমদ ইয়াংরা অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল। হাসান তারিক ইতিমধ্যেই একটা প্ল্যান দাঁড় করিয়েছে।
হাসান তারিক আবদুল্লায়েভ ও আহমদ ইয়াংকে এক পাশে ডেকে বলল, মনে হচ্ছে একটা ফেউ লেগেছে আমাদের পেছনে। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চাই।
হাসান তারিক একটু থামল। দ্রুত গাড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, আসার পথে রাস্তায় একটা সিনেমা হল দেখলাম। ওখানে ইভিনিং শো শুরু হচ্ছে বেলা তিনটায়। তোমরা এখান থেকে সোজা গিয়ে হলে ঢুকবে। ঘন্টাখানেক পরে বেরিয়ে বাসায় ফিরবে।
-আপনি? আহমদ ইয়াং জিজ্ঞেস করল।
-আমি ঐ ফেউকে পরখ করে দেখতে চাই।
নির্দেশ মোতাবেক আব্দুল্লায়েভ আহমদ ইয়াংকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
হাসান তারিক জানালা দিয়ে দেখল, আবদুল্লায়েভদের চলে যাবার পর সেই ‘ফেউ’ বেবী ট্যাক্সীটিও চলতে শুরু করল।
ওরা চলে গেলে হাসান তারিকও আরেকটি বেবী ট্যাক্সী নিয়ে সেই সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন। তাই হলের সামনে বেশ ভীড়। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে হাসান তারিক দেখল আবদুল্লায়েভরা প্রথম শ্রেণীর টিকিট কাউন্টার থেকে বেরিয়ে হলে ঢুকে গেল! আর সেই ‘ফেউ’ যুবকটি মানিব্যাগ বের করে টাকা গুণল। তারপর কি ভাবল। যে দরজা দিয়ে আবদুল্লায়েভরা হলে ঢুকেছে সেদিকে একবার তাকাল। পরে হল থেকে বেরিয়ে হন হন করে গিয়ে গাড়িতে উঠল। গাড়ি ছেড়ে দিল তার।
হাসান তারিকও এসে গাড়িতে উঠল।
বেশী দূর যেতে হলো না। মাইল খানেক গিয়েই একটা আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করল। দু’পাশে ফ্লাট বাড়ির সারি। অনেক খানি দূরত্ব রেখে হাসান তারিকের গাড়ি এগুচ্ছিল। একটা চারতলা ফ্লাট বাড়ির সামনে গিয়ে আগের বেবী ট্যাক্সীটি দাঁড়াল।
হাসান তারিক দেখল, বাড়িটির চার তলায় ষোলটি ফ্লাট আছে। সবগুলোই এক রুমের ব্যাচেলর কোয়ার্টার।
ফেউ’যুবকটি যখন ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়িতে গিয়ে পা দিয়েছে সেই সময় হাসান তারিকের গাড়ি গিয়ে ফ্লাটের সামনে দাঁড়াল।
হাসান তারিক ড্রাইভারকে দাঁড়াতে বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। হাসান তারিক গাড়িতে উঠার পর তার সব সময়ের সাথী ব্যাগ থেকে গোঁফ বের করে মুখে লাগিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং তাকে কেউ হঠাৎ করে দেখেই চিনতে পারবে না।
সে যুবকটি বেশ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। আর হাসান তারিক বিড়ালের মত নিঃশব্দে তার পিছু নিয়েছে।
চার তলায় গিয়ে ফেউ যুবকটির পায়ের শব্দ থেমে গেল। হাসান তারিক উঁকি দিয়ে দেখল, সিঁড়ির বাম পাশের ফ্ল্যাটের সামনে যুবকটি দাঁড়িয়ে। আরেকটু উঠে উঁকি দিল। দেখল, ঐ ফ্ল্যাটের দরজার কি হোলে চাবি দিয়ে ঘুরাচ্ছে সে। দরজা খুলে গেল। যুবকটি ভেতরে প্রবেশ করলে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতর থেকে কি হোলে চাবি দেয়ার একটা ক্লিক শব্দও পাওয়া গেল।
হাসান তারিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা ও কি হোল ভাল করে দেখল। মনে মনে ভাবল, সে ভেতরে প্রবেশ করবে। ব্যাচেলর ফ্ল্যাট। যুবকটি একাই রয়েছে। ইচ্ছা করলে এখনই প্রবেশ করে প্রয়োজন সিদ্ধ করতে পারে। কিন্তু না, এখানকার ‘ফ্র’ এবং জেনারেল বোরিসকে সে এখনই জানতে দিতে চায় না যে কেউ তার পেছনে লেগেছে। নরপশু জেনারেল বোরিস তাহলে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে আহমদ মুসার উপর কোন জঘন্য প্রতিশোধ নিয়ে বসতে পারে।
হাসান তারিক ধীরে ধীরে চারতলা থেকে নেমে এল।
সে গাড়িতে উঠে বসলে গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িতে বসে হাসান তারিক হিসেব কশল, যুবকটি কাজ অর্ধ সমাপ্ত রেখে সম্ভবত টাকার ঘাটতি থাকায় বাড়িতে ফিরে এসেছে। শো ভাঙ্গার আগে অবশ্যই সে ফিরে আসবে যাতে করে ওদের অনুসরণ করে ঠিকানাটা জেনে নিতে পারে। যুবকটি যখন দ্বিতীয়বার এই কাজে বেরুবে, সেই সুযোগেই তার ঘরে প্রবেশ করতে হবে।
সেই সিনেমা হলে আবার ফিরে এল হাসান তারিক। ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আবদুল্লায়েভদের বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল। সেই ফেউ যুবকটি আসে কখন সেদিকেও তার নজর থাকল।
ঘন্টা খানেক পর আবদুল্লায়েভরা বেরিয়ে এলে হাসান তারিক তাদেরকে বাথরুমের দিকে ডেকে নিয়ে শো শেষ হওয়া পর্যন্ত হলে থাকতে বলল। শো শেষ হলে তবেই তারা যেন বের হয়।
আবদুল্লায়েভরা গোঁফওয়ালা হাসান তারিককে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। চিনতে পেরে নিজেদের বোকামীর জন্যে হেসেছে। আর হাসান তারিক খুশী হয়েছে এই ভেবে যে তার গোঁফ পরা সফল হয়েছে।
আবদুল্লায়েভরা আবার হলে ঢুকে গেল।
হাসান তারিককে আরও আধা ঘন্টা ভীড়ের মধ্যে অপেক্ষা করতে হল। তখন সাড়ে চারটা বাজে। সিনেমা হলের বিপরীত দিকে একটা দোকানের পাশে সে দাঁড়িয়েছিল। শব্দ করে একটা বেবী ট্যাক্সী সিনেমা হলের সামনে দাঁড়াতে দেখে ওদিকে তাকাল হাসান তারিক। দেখল, সেই যুবক বেবী ট্যাক্সী থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে হলে উঠে গেল।
হাসান তারিক আরেকটা বেবী ট্যাক্সী নিয়ে এগিয়ে চলল সেই রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ার দিকে।
খুবই সাধারণ ধরনের লক। সাধারণ মাষ্টার কি’তেই খুলে গেল।
মাষ্টার কি টা পকেটে রেখে এক হাতে ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটর, অন্য হাতে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করল হাসান তারিক।
হাতের ইলেক্ট্রিক ডেটোনেটরটা শান্ত। গোটা ঘরটা একবার ঘুরে এল। নিশ্চিত হল সে, না কোথাও ইলেক্ট্রিক ট্র্যাপ নেই।
ঘরটা একেবারেই সাদামাটা গোছের। একটা শোবার খাট। একটা টেবিল, একটা চেয়ার। একটা ওয়্যারড্রোপ। রান্না ঘরে একটা গ্যাস ষ্টোভ। ট্রাংক, সুটকেস, ব্রিফকেস কিছুই নেই। হতাশ হল হাসান তারিক। যুবকটি নিশ্চয় সাধারণ ইনফরমারের বেশী কিছু নয়!
টেবিলটা শুন্য। টেবিল ক্লথের নিচটাও শুন্য। টেবিলের ড্রয়ারে কয়েকটা ইউয়ান পড়ে আছে মাত্র। ড্রয়ারের ফ্লোরে একটা সাদা কাগজ বিছানো। চীনা এয়ারলাইন্সের প্যাডের একটা পাতা বেশ পুরানো। হাসান তারিক বুঝল, ড্রয়ারের কভার হিসেবে অনেক দিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু দু’টো টেলিফোন নাম্বার লেখা দেখল। লেখা পুরানো, কালি বেশ ফেড হয়ে গেছে চার ডিজিটের নাম্বার। কাশগড়ের নাম্বার তিন ডিজিটের। তাহলে নাম্বারটা কাশগড়ের বাইরের। কাজে লাগতে পারে ভেবে নাম্বার দু’টো টুকে নিল হাসান তারিক।
ওয়্যারড্রোপ খুলল। তাতেও কিছু নেই। কয়েকটা জামা কাপড়। খুব ভালো করে পরীক্ষা করল, না কোন গোপন কেবিনও কোথাও নেই!
বালিশের নিচটা, তোষকের নিচটা সবই পরীক্ষা করল। না কিছুই কোথাও নেই।
হতাশ হলো হাসান তারিক। তাহলে সেকি একটা বাজে চুনোপুটির পিছনে ছুটে সময় নষ্ট করল!
কিচেনটা একবার দেখবে বলে ওদিকে পা বাড়াল, এমন সময় বাইরে থেকে দরজার তালা খোলার শব্দ হল। হাসান তারিক দ্রুত সরে গেল কিচেনে। পকেট থেকে রিভলবারটা হাতে তুলে নিয়েছে সে।
দরজা খুলে ঘরে ঢুকল একটি মেয়ে। বয়স বিশ বাইশ বছর হবে।
চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে মেয়েটির দিকে নজর রেখেছিল হাসান তারিক। মেয়েটির ঘরে ঢুকার ভাব দেখে হাসান তারিক বুঝল, মেয়েটি এ ঘরের পরিচিত।
মেয়েটি ঘরে ঢুকে সোজা বিছানায় এসে বসল। জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট এক টুকরা কাগজ বের করল। তারপর বিছানা থেকে বালিশটি তুলে নিয়ে কভারটি খুলে ফেলল। বালিশের মাঝখানের সেলাইটি ফাঁক করে সেই কাগজের টুকরাটা বালিশের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তারপর বালিশের কভার পরিয়ে যথাস্থানে রেখে যেমনভাবে এসেছিল ঠিক তেমনভাবে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
হাসান তারিক কিচেন থেকে বেরিয়ে দরজা লেগেছে কিনা দেখে এল। তারপর দরজা থেকে ফিরে এসে বালিশ থেকে সেই কাগজ বের করল সে। চীনা ভাষা্র একটা চিরকুট। চীনা ভাষা সে জানে না, মুশকিলে পড়ল সে। এখন এ চিরকুট না নিয়ে উপায় নেই। কিন্তু নিয়ে গেলে তার এখানে আগমন ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এছাড়া উপায় কি!
হাসান যখন রুম থেকে বেরিয়ে এল তখন বাজে সোয়া পাঁচটা। সিনেমা শো ভাঙ্গতে তখন পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকী।
হাসান তারিক ফিরে এল সেই সিনেমা হলের সামনে আবার।
ঠিক ছয়টার সময় বেরিয়ে এল আবদুল্লায়েভরা হল থেকে। হাসান তারিক লক্ষ্য করল তাদের পেছনে পেছনে বেরিয়ে এল সেই ‘ফেউ’ যুবক!
হাঁটতে হাঁটতে হাসান তারিক আহমদ ইয়াংকে বলল, ফেউ আমাদের পেছনে লেগেছে ও আমাদের আস্তানা দেখে তবেই ছাড়বে। আমরা তার উদ্দেশ্য সফল হতে দিতে পারি না।
একটু থেমে হাসান তারিক জিজ্ঞেস করল, আরতোশ এখান থেকে কতদূর।
-পাঁচ মাইল।
-চল আরতোশ যাব, আবদুল করিম বোগরা খানের কবর জেয়ারত করে এশার দিকে ফিরে আসব। ইতিমধ্যে কেউ পিছু না ছাড়লে তার একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
একটা বেবী ট্যাক্সি নিয়ে আরতোশের দিকে ছুটল হাসান তারিকরা। গাড়িতে ওঠার সময় হাসান তারিক লক্ষ্য করল ‘ফেউ’ যুবকটি একটা বেবীতে উঠে বসছে।
আরতোশ শহরটি কাশগড় থেকে উত্তর পশ্চিমে পাহাড় ঘেরা একটা উপত্যকায় একটা বিখ্যাত ঝরণার পাশে।
সোয়া ছয়টার দিকে হাসান তারিকদের বেবী ট্যাক্সি শহর থেকে বেরিয়ে এল। ‘ফেউ’ এর বেবী ট্যাক্সি তখন পর্যন্ত সমান গতিতে তাদের পেছনে ছুটে আসছে। কিন্তু শহর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর আসার পর বেবী ট্যাক্সিটি আর কেউ দেখতে পেল না। সন্ধ্যার অন্ধকার তখন নেমে এসেছে। নিশ্চয় ‘ফেউ’ যুবকটি এই রাতের বেলা শহর থেকে বাইরে অনিশ্চয়তার পথে তাদেরকে অনুসরণ করতে সাহস পায়নি। হাসান তারিক হাফ ছেড়ে বাঁচল। অহেতুক একটা চুনোপুঁটিকে মেরে চারদিকে সাড়া জাগাতে চায় না, জেনারেল বোরিসদের সাবধান করে দিতে চায় না।
চলতে চলতে আব্দুল্লায়েভ জিজ্ঞেস করল, কিছু পেলেন তারিক ভাই?
-পেয়েছি। মুসা ভাইকে ওরা আজ সকালের ফ্লাইটেই উরুমচি নিয়ে গেছে।
-আর যে নতুন মিশনে গিয়েছিলেন সেখানে?
-‘ফেউ’ এর ওখানকার কথা বলছ?
-হ্যাঁ।
-শুরুতেই সন্দেহ হয়েছিল ও বোরিসের লোক, ‘ফ্র’ এর এজেন্ট, ঠিক তাই। ওর প্রত্যেক জামার কলারেই ‘ফ্র’ এর প্রতীক দেখেছি! তবে বিশেষ কিছু পাইনি। একটা চীনা ভাষার চিরকুট পেয়েছি। জানি না ওতে কি আছে।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে হাসান তারিকরা আরতোশে পৌঁছাল। বেবী ট্যাক্সিকে অপেক্ষা করতে বলে তারা তিনজন ওজু খানায় ওজু করে বোগরা খান মসজিদে ঢুকে গেল। মসজিদের পাশেই কবর গাহ।
প্রথমে ওরা কবরগাহে গিয়ে দোয়া করল। অলঙ্কার বিহীন সাদা-সিদা কবর গাহ। বিল্ডিংটা জরাজীর্ণ। চারিদিকে লোহার রেলিং। মাঝে মাঝে ভেঙ্গে গেছে। ভেঙ্গে যাওয়া অংশ কাঠ লাগিয়ে পুরণ করা হয়েছে।
বোগরা খান মসজিদের অবস্থাও কবর গাহের মতই। দেয়ালের পাথরগুলো হা করে আছে। কোথাও কোথাও গর্ত হয়েছে। মসজিদের মেঝে এবড়ো-থেবড়ো। মসজিদের উঁচু মিনার দেখার মত, কিন্তু তার একাংশ ভেঙে গেছে। এখন মিনারে উঠে আর আযান দেওয়া হয় না। ওঠা বিপজ্জনক। ওখানে মাইকের হর্ণ লাগানো আছে। নিচে থেকে আযান হয়। মাইকের হর্ণটি নতুন, মাইকও নতুন। আহমেদ ইয়াং জানাল, মাইকটি অতি সম্প্রতি লেগেছে। এতদিন জোরে আযান নিষিদ্ধ ছিল। আর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তো আযান এবং নামাযও বন্ধ ছিল।
এশার নামায হাসান তারিকরা মসজিদেই পড়ল। বোগরা খান মসজিদের সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের জিনিস গোটা মসজিদ জুড়ে থাকা লাল কার্পেট। ঠিক এ ধরনের কার্পেট হাসান তারিক কাশগড়ের ঈদগান মসজিদেও দেখেছে। হাসান তারিক আহমেদ ইয়াংকে জিজ্ঞেস করল, মসজিদের অবস্থার সাথে কার্পেট তো মিলে না?
আহমেদ ইয়াং বলল, ঠিক বলেছেন, মসজিদ চীনের কিন্তু কার্পেটগুলো চীনের নয়। ওগুলো সম্প্রতি মক্কা থেকে এসেছে। মক্কার রাবেতায়ে আলম আল-ইসলামী সম্প্রতি এ কার্পেটগুলো দান করেছে। সিংকিয়াং এর সব মসজিদেই এ রকম কার্পেট দেখতে পাবেন। ওরা আমাদের ইসলামী সমিতির (সরকার নিয়ন্ত্রিত) কাছে মসজিদ সমূহ সংস্কারের জন্যে অর্থ সরবরাহেরও অফার দিয়েছে। আগে তো মসজিদ সংস্কারের অনুমতি ছিল না। এখন কিছু কিছু মিলছে। এখন যদি সরকার রাবেতার সাহায্য নেয়ার অনুমতি দেয়, তাহলে মসজিদগুলোর দুঃসময় হয়তো কাটতে পারে।
নামায শেষে আহমেদ ইয়াং মসজিদের শেখ জামিরুদ্দিনের সাথে হাসান তারিক এবং আব্দুল্লায়েভকে পরিচয় করিয়ে দিল।
বৃদ্ধ শেখ জামিরুদ্দিন তাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে কেউ নেই দেখে বলল, বাবা, সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার মুক্তির খবর পেয়ে সেদিন কেঁদেছি আর প্রাণ ভরে দোয়া করেছি। এ ভাগ্য যেন আল্লাহ্ আমাদেরকেও দান করেন।
অনেক কথা হল শেখ জামিরুদ্দিনের সাথে। কিছু না খেয়ে আসতেই দিল না।
বিদায়ের সময় মসজিদের দিকে চেয়ে শেখ জামিরুদ্দিন বলল, মসজিদের এই বিধ্বস্ত দশা দেখে অনেক সময় দুঃখ হয়, কিন্তু যখন ভাবি মুসলিম সমাজের চেয়ে মসজিদ ভালো হবে কি করে, তখন অন্তরে বল পাই, কাজ করার শক্তি পাই। মুসলিম সমাজকে ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করতে পারলে তবেই মসজিদকে তার আপন জায়গায় বহাল করা যাবে।
হাসান তারিক বলল, ঠিক বলেছেন। মসজিদ হলো মুসলিম সমাজের স্বাধীনতার প্রতীক। মুসলিম সমাজের স্বাধীনতা না থাকলে মসজিদও অক্ষত থাকে না। আপন অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। দোয়া করুন, মুসলিম সমাজ এবং মসজিদ যেন তাদের হারানো দিন ফিরে পায়, যেদিন আবদুল করিম সাতুক বোগরা খান একদিন এদেশের মুসলমানদের জন্য এনেছিলেন।
হাসান তারিকরা বিদায় নিল শেখ জামিরুদ্দিনের কাছ থেকে।
ছুটে চলল তাদের ট্যাক্সি কাশগড়ের উদ্দেশ্যে। হাসান তারিক নামাযের ফাঁকে সেই চীনা ভাষার চিরকুটটি পড়ে নিয়েছে আহমেদ ইয়াং এর কাছ থেকে। ওতে উরুমচির একটা ঠিকানায় টেলেক্স করতে বলা হয়েছে। টেলেক্সে বলতে বলা হয়েছে যে, তিয়েনশানের ওপার থেকে দু’জন সন্দেহ জনক ব্যক্তি হুইদের সাথে কাশগড়ে আজ বেলা দশটায় প্রবেশ করেছে।
হাসান তারিক খুশী হয়েছে। উরুমচির ঠিকানাটা নিশ্চয় জেনারেল বোরিস কিংবা ‘ফ্র’-এর হবে।
বেবী ট্যাক্সি পাথুরে মরু পথের মধ্য দিয়ে ছুটছে কাশগড়ের দিকে পূর্ণ বেগে।
হাসান তারিক অনেকটা স্বগত কণ্ঠেই বলল, আপাতত কাশগড়ের কাজ শেষ। তারপর আহমেদ ইয়াং এর দিকে ফিরে বলল, যাবার পথেই আমরা বাস অফিস থেকে আগামীকাল সকালের জন্য উরুমচির তিনটা টিকিট করে নিয়ে যাব। প্রস্তুত আছ তো?
আহমেদ ইয়াং মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
পর্ব ৪
কয়দিন কাটল তার কোন হিসেব আহমেদ মুসার কাছে নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। পাথরের মেঝে, পাথরের দেওয়াল। অনেক উঁচুতে একটা ঘুলঘুলি। ওখানে মাঝে মাঝে একটা আবছা আলোর রেখা ফুটে ওঠে। আহমদ মুসা এখন বুঝেছে, ঐ আবছা আলোর রেখাটা দিনের লক্ষণ। যখন আবছা আলোটা থাকে না তখন রাত। এটা বুঝার পর আহমেদ মুসা আনন্দিত হয়েছে এই ভেবে যে, অন্তত রাত দিনের হিসেবটা সে রাখতে পারবে।
রাত দিনের পরিবর্তন বুঝার পর আহমদ মুসা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের একটা সময় ঠিক করে নিয়েছে। হাত মুখ ধোয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। গোসল কবে থেকে নেই তার মনে পড়ে না। অন্ধকার মেঝের এক কোণায় একটা মাটির ছোট কলস আছে। টিনের মগ দিয়ে ঢাকা। অন্ধকারে হাতড়ে ঐ মগ দিয়েই সে পানি খায়। মুখটা ধুয়ে নেয় মাঝে মাঝে। এই ঘরের সাথেই লাগানো একটা খুপরীতে পায়খানার জায়গা। সেখানেও পানির রেশন। প্রতিদিনের জন্যে এক মগ পানি বরাদ্দ।
ঘরের এক পাশে একটা খাটিয়া। কাঠের। কম্বল বিছানো। আরেকটা কম্বল আছে গায়ে দেবার। শীতটা যেন একটু বেড়েছে। সে বুঝতে পারে না, তার শরীর খারাপ না আবহাওয়ার পরিবর্তন। আবহাওয়ার পরিবর্তন কিভাবে এত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাহলে কি স্থান পরিবর্তন? সে কাশগড়ে এসেছে, এতটুকু সে জানে। কিন্তু কাশগড়ে তো এই শীত হবার কথা নয়! কোথায় সে তাহলে? মনে আছে সেদিন রাতে জেনারেল বোরিস তাকে একটা ইনজেকশন দেয়। ইনজেকশনের পর রাজ্যের ঘুম এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর কি ঘটেছে কিছুই তার আর মনে নেই। সেই ঘুমানোর পর এই অন্ধকার ঘরেই সে চোখ মেলেছে।
পূর্ব, পশ্চিম কিংবা কেবলা কোন দিকে কিছুই তার জানা নেই। পাথরের দেয়ালে তায়াম্মুম করে মনে মনে একদিকে কেবলাকে ধরে নিয়ে সে নামায আদায় করে।
যেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার, তেমনি নিঃসীম নিশব্দ চারদিক। এক অন্ধকার ছাড়া চোখ তার কিছু দেখে না। জীবনের একটা স্পন্দন হলো শব্দ, এ শব্দও তার কানে আসে না। ঘরটা কি তাহলে মাটির নীচে? জীবনের স্পন্দনহীন নিরব-নিথর অন্ধকারে মাঝে মাঝে নিজেকে অশরীর মনে হয়। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার ভয় ও রোমাঞ্চের কথা। দাদির কোলে বসে ভূতের গল্প শুনত সে, ভালো লাগত। অন্ধকারকে দারুণ সে ভয় করত। এমনকি অন্ধকার ঘরে ঢুকতেও সে ভয় পেত। তার আম্মা দাদির কাছে এসে অনুযোগ করতেন, আম্মা আপনার নাতি কিন্তু দেখবেন ভীতু হবে।
-কেন, কেন? দাদি বলতেন।
-আপনার কাছে ভূতের গল্প শুনে শুনে এখন তো সব জায়গায় ভূত দেখে।
তার আম্মার কথা শুনে দাদি হাসতেন। তাকে কোলে তুলে নিয়ে মাথা নেড়ে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে বলতেন, তুমি কিছু ভেব না বৌমা, আমার এ ভাইটি আল্লাহ্ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না। বড় হলে বাহাদুর হবে।
দাদির কথা শুনে তার আম্মার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠত। তার আম্মা তাকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আম্মা দোয়া করবেন আমার আহমদের জন্যে। যেন সে আমাদের নাম রাখে, জাতির মান রাখে।
কোথায় গেল সেই দিন। সেই দাদি, সেই আম্মা কোথায়, তাদের বুক ভরা সেই ভালবাসা কোথায়? চোখের কোণ দু’টি ভারি হয়ে ওঠে আহমেদ মুসার। তার দাদি, তার মায়ের কবরও সে আর কোনদিন কি দেখতে পাবে? পাবে না।
কমিউনিষ্ট বাহিনী ওখানে হয়তো প্রস্রাব পায়খানার জায়গা তৈরী করেছে। মুসলমানদের যা কিছু পবিত্র তাকে অপবিত্র করাই ছিল ওদের প্রথম কাজ। মুসলমানদের কবর গাহ ওদের হিংসার আগুন থেকে বাঁচবে কেমন করে?
অবসর ও একাকিত্বের সুযোগ গ্রহণ করে কত কথা, কত ঘটনা রূপ ধরে তার সামনে এসে দাড়ায়। বাইরের দু’চোখ বন্ধ করলে নাকি মনের চোখের গতি বেড়ে যায়। তাই হয়েছে আহমেদ মুসার ক্ষেত্রেও। যে স্মৃতিকে সে দু’হাতে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তাই যেন তার সামনে এসে ভীড় করে বেশী। ফাতিমা ফারহানার অশ্রু ধোয়া মুখটি আবার মূর্তিমান হয়ে যেন তার সামনে এসে দাঁড়াল। বৃদ্ধ আবদুল গফুর যখন ফারহানার হাত তার হাতে তুলে দিল, তখনকার তার হাতের উত্তপ্ত কম্পন তার হাতে যেন এখনও লেগে আছে। ও কেমন আছে? ফাতিমা ফারহানা যেন আরও নিবিড় হয়ে আসে তার কাছে। বৃদ্ধ আবদুল গফুরের বাড়িতে প্রথম দিন সেই ঔষুধ খাবার সময়, তারপর সেদিন ফারহানার হাত যখন হাতে এল সে সময় যে অপরিচিত এক সুবাস সে পেয়েছিল, তাও যেন এসে তাকে আচ্ছন্ন করছে। সচেতন হল আহমদ মুসা। দু’হাতে সে ঠেলে দিতে চাইল স্মৃতির ভাবকে। না, এমন নিবিড়তায় সে ওকে ভাবতে পারে না। আল্লাহ এ অধিকার এখনও তাকে দান করেননি। একজন মুমিনকে একজন মুমিনের চিন্তার কলুষতা থেকেও নিরাপদ রাখা দরকার।
এ সময় ঘরের ওপ্রান্তে দরজার ওপার থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল।
এ পায়ের শব্দের সাথে আহমদ মুসা পরিচিত। নির্দিষ্ট একটা সময় পর পর ওরা আসে। দরজার ওপারে আলো জ্বলে ওঠে। দরজা খুলে যায়। দরজায় দাঁড়ায় উদ্যত ষ্টেনগান হাতে চারজন রুশ প্রহরী। একজন চীনা মেয়ে খাবার নিয়ে ভেতরে ঢোকে। খাবার ট্রে বিছানার ওপর রেখে পাশের দেয়াল সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকে।
মেয়েটির বয়স বিশ/বাইশের বেশী হবে না। সুন্দরী। চোখে মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ।
যতক্ষণ আহমদ মুসা খায়, ততক্ষণ সে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খাওয়া হলে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যায়। তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আলো নিভে যায়। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায় দূরে।
এই অন্ধকার কুঠরীতে আসার পর জেনারেল বোরিস একবারই এসেছে। আনুমানিক সেটা গতকাল হবে। জেনারেল বোরিসের এত পরে আসায় আহমদ মুসা প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল। পরে বুঝেছে, আহমদ মুসাকে মানসিক ভাবে দূর্বল করার জন্যে সে সময় নিতে চায়।
গতকাল জেনারেল বোরিস একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। প্রস্তাব ছিল, আহমদ মুসা কর্ণেল কুতাইবার কাছে চিঠি লিখবে ‘ফ্র’ কে দশ বিলিয়ন ডলার দেবার জন্যে। মধ্য এশিয়ার পাঁচটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন ব্যাংক ও ট্রেজারিতে এ টাকা রয়েছে। এ টাকা হেলিকপ্টারে করে নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে চলে যাবার পর ‘ফ্র’ আহমদ মুসাকে ছেড়ে দেবে। আর টাকা দিতে রাজী না হলে নির্দিষ্ট সময়ের পর ‘ফ্র’ আহমদ মুসাকে হত্যা করবে।
আহমদ মুসা কোন জবাব দেয়নি এ প্রস্তাবের। দেবার প্রবৃত্তি হয়নি তার। প্রস্তাব রাখার পর জেনারেল বোরিস দেরী করেনি। যাবার সময় বলে গেছে পরদিন আবার আসবে।
দরজার ওপাশের পায়ের শব্দ নিকটতর হলো। দরজার সামনে এসে তা থেমে গেল। ওপারে জ্বলে উঠল আলো। দরজার ফাঁক গলে ছুটে এলো জমাটবদ্ধ একগুচ্ছ আলোর কণা। চৌকাঠের প্রান্তকেই তা আলোকিত করল মাত্র।
দরজা খুলে গেল।
দরজায় এসে দাঁড়াল সেই চারজন প্রহরী।
তারপর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল জেনারেল বোরিস। হাতে তার রিভলভার।
আহমদ মুসা মনে মনে হাসল। জেনারেল বোরিস লোকটা আসলে ভীতু। চারজন প্রহরী দাঁড় করিয়েও ভরসা নেই, নিজ হাতেও রিভলভার নাচাতে হচ্ছে।
জেনারেল বোরিস ঘরে প্রবেশ করে ঘরের এদিক-ওদিক একবার পায়চারী করল। তারপর আহমদ মুসার মুখোমুখি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কি চিন্তা করলেন?
-কোন ব্যাপারে?
-কালকে একটা চিঠি লেখার কথা বলেছিলাম!
-জেনারেল বোরিস, আপনারা একটা আদর্শের জন্যে লড়াই করেন জানতাম, কিন্তু আপনারা এমন নিরেট অর্থলোলুপ তাতো জানতাম না?
-আমার প্রশ্নের জবাব চাই আহমদ মুসা।
গর্জে উঠল জেনারেল বোরিসের কন্ঠ। গোটা মুখ লাল হয়ে উঠেছে তার।
-আমার একটা প্রশ্ন আছে জেনারেল বোরিস।
-কি প্রশ্ন?
-এই চিঠি আমাকে লিখতে বলছেন কেন?
-কে লিখবে তাহলে?
-জেনারেল বোরিস লিখবে, টাকা তো তারই দরকার।
-এ টাকা তোমারও দরকার। এ টাকার ওপর তোমার মুক্তি নির্ভর করছে। মনে করো না জেনারেল বাগাড়ম্বর করে। নির্দিষ্ট তারিখের নির্দিষ্ট দিন পার হয়ে গেলে তুমি আর এক মুহূর্ত পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখবে না। তোমাকে গুলি করে মারবো না। গায়ের চামড়া খুলে পশুর মত তোমাকে মরাব।
-আমাকে ভয় দেখাচ্ছো জেনারেল বোরিস?
-হ্যাঁ, ভয় দেখাবার মত শক্তি আমার আছে?
-মৃত্যুকে যে ভয় করে না, তাকে আর কোন ভয় দেখাবে জেনারেল বোরিস?
জেনারেল বোরিস পাগলের মত হো হো করে হেসে উঠল। হাসি থামলে আবার সে তার আগের প্রশ্নেরই পুনরাবৃত্তি করল, আমার প্রশ্নের জবাব জানতে চাই আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা মৃদু হেসে বলল, জেনারেল বোরিস, তুমি কেমন করে ধারণা করলে যে আমি তোমার ব্ল্যাক মেইলিং এর সহায়ক হব?
-ইচ্ছায় না হলে অনিচ্ছায় তোমাকে সহায়ক হতেই হবে।
একটু থামল জেনারেল বোরিস। বাষ্পের মত ফুঁসছে সে। মুখ তার টকটকে লাল। যেন আগুন বেরুচ্ছে মুখ দিয়ে। বার কয়েক পায়চারি করে সে বলল, হ্যাঁ দরকার হলে জেনারেল বোরিসই চিঠি লিখবে। কিন্তু মনে রেখ, তোমার যে হাত চিঠি লিখবে না, সে হাতও ঐ চিঠির সাথে যাবে। তোমাদের ইসলাম ধর্মের তো হাত কাটার অভ্যাস আছে। আমরা এবার ওটার প্রয়োগ করব। তোমার ডান হাতটা যখন চিঠির সাথে ওদের কাছে যাবে, তখন তুমি চিঠি লেখার চেয়ে সেটা বেশী ফায়দা দেবে বলে আমি মনে করি।
বলে জেনারেল বোরিস আবার সেই হো হো করে হেসে উঠল।
যাবার জন্যে ফিরে দাঁড়াল সে। যেতে যেতে বলল, এখন আহমদ মুসা তুমিই সিদ্ধান্ত নাও তুমি চিঠি দেবে, না হাত দেবে।
জেনারেল বোরিস বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ওপারের আলো নিভে গেল। আবার সেই আঁধারে ডুবে গেল ঘর।
আহমদ মুসা তার দু’পা নিচে ঝুলিয়ে খাটিয়ায় বসে ছিল। ঐভাবেই বসে রইল। তার মনে ছুটে গেল হঠাৎ মধ্য এশিয়ায়। যুগ-যুগান্তের অপরিসীম ত্যাগ-তীতিক্ষার পর ওখানকার দুর্ভাগ্য মুসলমানরা স্বাধীন হয়েছে। ওদের হাজারো সমস্যা। এ সমস্যা মুকাবিলার জন্যে ওদের প্রচুর অর্থ চাই, যা ওদের নেই। এই অবস্থায় দশ বিলিয়ন কেন দশ ডলার ওদের অপচয় করা যাবে না। আহমদ মুসার জীবন মৃত্যুর মালিক আল্লাহ! দশ বিলিয়ন ডলার তাকে বাঁচাতে পারবে না। জেনারেল বোরিসের শেষ কথায় হাসি পেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসার কাটা হাত ওখানকার সাথীদের দুঃখ দেবে, কিন্তু দশ বিলিয়ন ডলার দিলে আহমদ মুসা মুক্তি পাবে, এ বিশ্বাস তারা অবশ্যই করবে না করতে পারে না। মৃত আহমদ মুসার হাত কেটেও ওভাবে পাঠানো যায়!
এই চিন্তা আহমদ মুসার মনকে অনেক হালকা করে দিল। সে দু’টি পা বিছানায় তুলে গা এলিয়ে দিল বিছানায়।
শুয়েই নজর পড়ল সেই ঘুলঘুলির দিকে। ওখানে সাদা আলোর যে রেখাটা ছিল, তা এখন নেই। অন্ধকার সেখানে এসে স্থান করে নিয়েছে। আহমদ মুসা বুঝল, মাগরিবের সময় হয়েছে, বা যাচ্ছে।
সে উঠে বসল বিছানা থেকে। দেয়ালে তায়াম্মুম করে নামাযে দাঁড়াল।
হোটেল সিংকিয়াং এ বিরাট এক ভোজ সভা। উরুমচির সবচেয়ে অভিজাত হোটেল এটা। ভোজের আয়োজন করেছে আলেকজান্ডার বোরিসভ। জেনারেল বোরিস এখন এই নামে উরুমচিতে বাস করছে। তার পরিচয় বড় একজন ব্যবসায়ী সে। রুশ অঞ্চল থেকে বহুদিন আগে হিজরত করে আসা একজন চীনা নাগরিক বহুদিন সাংহাই এ বসবাস করছে, এখন এসেছে উরুমচিতে।
ভোজে আমন্ত্রিত হয়েছে উরুমচির নামি-দামি অনেক লোক। এ ধরনের ভোজ সরকারী ব্যবস্থাপনা ছাড়া বড় একটা হয় না। তাই দুর্লভ এমন আমন্ত্রণ পেয়ে কেউ তা ছাড়েনি।
আজকের আমন্ত্রিতদের মধ্যমণি দেখা যাচ্ছে মেইলিগুলিকে। সবারই চোখ তার দিকে। সিংকিয়াং এর অপরূপ সুন্দরী এই নায়িকা ‘তিয়েনশান পাহাড়ের ফুল’ নামে অভিহিত। অপরিচিত এক ব্যবসায়ীর দাওয়াতে তাকে এ ভোজ সভায় দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছে।
এই বিস্ময়টা অমূলক নয়। মেইলিগুলি সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে এক কল্পনার বস্তু। কিন্তু মেইলিগুলি জেনারেল বোরিসের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে পারেনি। প্রথম কারণ, এ লোকটি তাকে বড় এক বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। দ্বিতীয়ত জেনারেল বোরিস তাকে টেলিফোন করার সংগে সংগে তার ঐ অদ্ভুত বন্দীর কথা মনে পড়েছিল। ঐ অদ্ভুত বন্দীটি কেমন আছে, কোথায় আছে, এটা জানার একটা অদম্য কৌতুহল তার জেগেছিল। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে এই আমন্ত্রণ সে গ্রহন করেছিল।
ভোজ সভায় জেনারেল বোরিস সারাক্ষণ মেইলিগুলির কাছে ঘুরঘুর করেছে। খেতেও বসেছে পাশা-পাশি। খেতে খেতে জেনারেল বোরিস বলেছিলেন, কয়েকটা কথা আপনাকে বলতে চাই, যদি খাবার পর সময় দেন দয়া করে।
ঘড়ি দেখে মেইলিগুলি তাকে বলল, আমি এখান থেকে বাড়ি হয়ে তবে অফিসে যাব, পাঁচ/সাত মিনিট সময় আপনি নিতে পারেন।
খাবার পর মেইলিগুলি জেনারেল বোরিসের সাথে তার হোটেল স্যুটে এল।
সোফায় মেইলিগুলির পাশেই বসল জেনারেল বোরিস। মেইলিগুলির ভ্রুটা একটু কুঞ্চিত হলো। যেন ভালভাবে নিল না সে এই আচরণকে। কথা শুরু করল বোরিস। বলল আপনার মত এক অপরূপ নায়িকা আমি খুজছিলাম মিস মেইলিগুলি?
-কেন?
-আমি একটা বই করতে চাই।
-বই মানে চলচ্চিত্র? আপনি?
-হ্যাঁ সব ঠিক, আপনি রাজী …।
মেইলিগুলির ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বুঝতে পারল, জেনারেল বোরিসের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এদেশে যে বেসরকারী কোন চলচ্চিত্র হয় না তাও ভুলে গেছে। কিন্তু সে কথা আর না বাড়াবার জন্য বলল, সব ঠিক? তাহলে ঠিক আছে। পরে কথা বলব।
বলে মেইলিগুলি ঘড়ির দিকে চাইল। অর্থাৎ মেইলিগুলি এখন উঠতে চায়। হঠাৎ জেনারেল বোরিস মেইলগুলির আরেকটু কাছে সরে এল। তার বাম হাত চেপে ধরে বলল, প্লিজ মেইলিগুলি …
মেইলিগুলি এক ঝটকায় তার হাত কেড়ে নিল। তারপর কাপড়ের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা রিভলভার বের করে তার কপাল বরাবর ধরে বলল, ভদ্রবেশী শয়তান, আর এক পা এগুলে মাথাগুড়ো করে দেব। আমি চলচ্চিত্রে অভিনয় করি বটে, কিন্তু আমি উইঘুর মেয়ে।
জেনারেল বোরিসের যে চোখে এতক্ষণ ছিল কামনার আগুন সে চোখে এখন বিস্ময় ও ভয়ের চিহ্ন।
মেইলিগুলি বেরিয়ে এল জেনারেল বোরিসের হোটেল স্যুট থেকে। বেরিয়ে রিভলভারটা কাপড়ের তলায় আবার গোপন করে তর তর করে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে।
মেইলিগুলির এই আচরণ কোনো অস্বাভাবিক নয়। রিভলবার দিয়েই সে এর জবাব দিয়েছে। তাই এ রিভলবার তার অতি প্রিয়। বাইরে সে একপাও নড়ে না এ রিভলবার ছাড়া। তার স্টুডিও এবং শুটিং এর সময়ও সে অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার মুকাবিলা করেছে। একবার একজন বেয়াদব চিনা পরিচালক তার রিভলবার এর গুলিতে আহত পর্যন্ত হয়। পড়ে সে পরিচালকের চাকুরী যায়। এখন সবাই তাকে সমীহ করে চলে। অনেকেই প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা এতই যে, তার বিরুদ্ধে কোন কথাই কোথাও কাজে লাগেনি। বাইরের কোন শুটিং-এ সে তার পরিবারের সাথে ছাড়া যায় না।
হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে পার্কিং থেকে নিজের গাড়ি বের করে মেইলিগুলি ছুটল নিজের বাসার উদ্দেশে।
উরুমচির অভিজাত এলাকায় বিশাল বাড়ি মেইলিগুলির। বাড়িটা মেইলিগুলির পৈত্রিক। মেইলিগুলির পরিবার সিংকিয়াং এর সবচেয়ে পুরাতন সবচেয়ে সম্মানিত পরিবারের একটি। মেইলিগুলির পূর্ব পুরুষ ইবনে সাদ মক্কা থেকে সপরিবারে সিংকিয়াং এ আসেন। বলা হয় ইনি মহানবী (সঃ) এর একত্রিশতম বংশধরের পৌত্র। গোঁটা চীনে তিনি ইসলাম প্রচারের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দেন। ইবনে সা’দ স্থানীয় জনগনের সাইয়েদে পরিনত হন এবং তাদের অতুল ভালবাসা লাভ করেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে শানসি, সিচুয়ান ও ইউনান প্রদেশের শাসন কর্তার পদ ও লাভ করেন। পড়ো জমি আবাদ করা, স্কুল প্রতিষ্ঠা, সেচ ব্যাবস্থার বিস্তার, ডাক চলাচল ও উন্নত কৃষি ব্যাবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি তার জনহিতকর কাজগুলির কথা প্রবাদের মত এখনও মানুষের মুখে মুখে। সিংকিয়াং এ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা উইঘুরদের আব্দুল করিম সাতুক বোগড়া খানের পরিবারের সাথে সাইয়েদ ইবনে সাদের পরিবার ঘনিষ্ঠ হয়। এই উইঘুর পরিবারের এক রাজকুমারীকে বিয়ে করার মাধ্যমে সাইয়েদ পরিবার উইঘুরদের সাথে মিশে যায়। মেইলিগুলি এই সাইয়েদ উইঘুর পরিবারেরই সন্তান। শুধু উইঘুরই নয়, সিংকিয়াং এর হুই, কাজাখ, প্রভৃতি সব মুসলিম সম্প্রদায়ই এই সাইয়েদ পরিবারকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখে। মাও এর সংস্কৃতিক বিপ্লব এর সময় মেইলিগুলিদের বাড়িটাও বিপ্লবীরা দখল করেছিল। কিন্তু উইঘুরদের অসন্তোষ হ্রাসের জন্যে পরে তারা এই বাড়িটা মেইলিগুলিদের ফিরিয়ে দেয়।
মেইলিগুলি একুশ বছরে পা দিয়েছে। গত বছরে সে উরুমচির সমাজ বিজ্ঞান কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়েছে ইতিহাস বিষয়ে। তার শিক্ষার সাথে তার পেশা মেলে না। সিংকিয়াং এর সরকারি চলচ্চিত্র সংস্থা তিয়েনশান স্টুডিওতে যারা ঢোকে, তারা সকলেই কলেজ অফ আর্টস থেকে ডিগ্রি নেয়া। মেইলিগুলিই একমাত্র ব্যতিক্রম। প্রকৃত পক্ষে অনুকরন ও উপস্থাপনার অপূর্ব ক্ষমতা দেখেই যুব কম্যুনিস্ট পার্টি তাকে অভিনয়ে ঢুকিয়েছে। মেইলিগুলি উরুমচির যুব কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। মেইলিগুলি আজ তিন বছর হল অভিনয়ে ঢুকেছে।
মেইলেগুলি বাড়িতে পৌঁছে তাড়াতাড়ি পোশাক পাল্টিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল অফিসে, তার কর্মস্থল তিয়েনশান স্টুডিওতে।
দাদির ঘরের সামনে দিয়ে নিচের তলায় নামার সিঁড়ি।
দাদির ঘরের সামনে দিয়ে মেইলিগুলি সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল।
দাদি ডাকল, আমিনা।
মেইলিগুলির দাদির ডাক শুনেই থমকে দাঁড়াল।
দাদির ঘরের দরজা খোলাই ছিল, মেইলিগুলি ছুটে ঘরে ঢুকে বলল, কি দাদি?
তার দাদির বয়স শত বর্ষ পূর্ণ হয়েছে গত বছর। একশ’ এক বছর চলছে এবার। শুভ্র কেশ, গা-মুখের চামড়া কুচকে গেছে, নড়া-চড়ায় তার কষ্ট হয়, অবয়ব ঘিরে এক শুভ্র পবিত্রতা। মনে হয় তার চোখ মুখ দিয়ে কি এক উজ্জ্বল্য যেন ঠিকরে পড়ছে।
দাদি বালিশে ঠেশ দিয়ে বসেছিল। মেইলিগুলি ঘরে ঢুকলে সে সোজা হয়ে বসল। ঠোটে স্নেহের হাসি জড়িয়ে বলল, আয় আমার পাশে বস।
মেইলিগুলি এসে তার পাশে বসতে বসতে বলল, অফিস এর সময় হয়েছে তো তাই একটু তাড়া, তিনটায় একটা কাজ আছে।
-কথা বলার জন্য তোকে আজ কাল দু’দণ্ডও পাই না।
-সত্যি ব্যস্ত দাদি, মাঝখানে আবার কাশগড় গিয়েছিলাম।
-কাশগড়ে তোর কি ঘটেছিল, সেটা পুরাপরি কেউ আমাকে বলল না।
-ও কিছু না দাদি। একটা এক্সিডেন্ট।
-এক্সিডেন্ট কি ঘটনা নয়?
দাদি একটু থামল। কণ্ঠটা তার ভারি শোনাল। একটা ঢোক গিলল দাদি। তারপর আবার শুরু করল, জানি, তোদের এ সব কাজ আমি পছন্দ করিনা, তাই তোরা আমাকে এড়িয়ে চলতে চাস।
-না দাদি তুমি আমাকে ভুল বুঝ না। আমি সত্যিই ব্যস্ত, প্রায়ই উরুমচির বাইরে যেতে হয়।
-কেন ব্যস্ত, কিসের কাজে তুই ব্যস্ত।
বলে দাদি মেইলিগুলির মুখ এক হাতে উঁচু করে তুলে ধরল। তার চোখে চোখ রেখে বলল, তোকে ওরা মেইলিগুলি বলে- ‘তুই তিয়েনশান পাহাড়ের ফুল’ ওদের কাছে। কিন্তু আমরা তো তোর নাম রেখেছিলাম, ‘আমিনাগুলি’ আমরা চেয়েছিলাম তুই ‘বিশ্বাসী ফুল’ হবি। তুই আজ ঐ পথে কেন?
মেইলিগুলি ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, দোষ কি এতে দাদি?
-দোষ তুই দেখতে পাবি না। বলত তুই কে?
-উয়ঘুর মেয়ে।
-শুধু কি তাই? তোর কি অতীত নেই, কোন ঐতিহ্য নেই?
মেইলিগুলি নরম কণ্ঠে বলল, দাদি আমি যুব কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য। আমার তো কোন অতীত নেই।
-তুই এ কথা বলতে পারলি? তোর রক্ত তুই অস্বীকার করিস? সিংকিয়াং-এ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা সকলের পরম শ্রদ্ধেয় ইবনে সাদ তোর পূর্ব পুরুষ । সিংকিয়াং-এ ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল করীম সাতুক বোগড়া খানের রক্ত তোর দেহে। তুই এসব অস্বীকার করিস?
বলতে বলতে দাদির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। চোখ দুটি তার নিচে নেমে গেল।
মেইলিগুলি দাদির একটা হাত তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, দাদি তুমি আমাকে ভুল বুঝ না, আমি তোমাকে আঘাত দিতে চাইনি। বাস্তবতাকেই শুধু আমি তুলে ধরতে চেয়েছি।
-গায়ের জোরে একটা জিনিস চালু হয়ে গেলেই তা বাস্তব হয়ে যায় নারে! বাস্তবতার সাথে মানুষের বিশ্বাসের যোগ থাকতে হয়। সেটা এখন কোথাও নেই। মানুষের বিশ্বাসের সাথে তোর ঐ বাস্তবতার সংঘর্ষে মানুষ আজ ক্ষত -বিক্ষত হচ্ছে। তুই বুকে হাত দিয়ে বলত, তোর বিশ্বাসের সাথে তোর বাস্তবতার কোনও সম্পর্ক আছে?
মেইলিগুলি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না। একটু ভাবল, তারপর বলল, তোমার প্রশ্নের জবাব আজ দিতে পারলাম্ না। ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।
বলে উঠে দাঁড়াল মেইলিগুলি। দাদির দু’টো হাত নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, দাদি, তোমার ‘আমিনাগুলি’ আমিনাগুলিই আছে, তোমার ‘বিশ্বাসী ফুল’- এতে কোনও অশুভ হাতের ছোঁয়া লাগেনি। অন্যান্য কম্যুনিস্টদের ব্যাপার যাই হোক, আত্ম সম্ভ্রম ও আত্ম মর্যাদা রক্ষার ঐতিহ্য আমার কাছে কোনও অতীত বিষয় নয়।
বলে মেইলিগুলি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তর তর করে নামল সিঁড়ি দিয়ে। হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, তিনটা বেজে পাঁচ মিনিট। আশ্বস্ত হল খুব একটা দেরী হবে না।
তখন বিকেল সাড়ে চারটা। তিয়েনশান স্টুডিওতে তার অফিস কক্ষে বসে মেইলিগুলি একটা স্ক্রিপ্ট এর ওপর চোখ বুলাচ্ছিল। এমন সময় এ্যাটেনডেন্ট মিস লি ওয়ান দরজায় এসে ভিতরে আসার অনুমতি চাইল।
মাথা নেড়ে অনুমতি দিল মেইলিগুলি।
লি ওয়ান ভিতরে ঢুকে একটা স্লিপ এগিয়ে দিল মেইলিগুলির সামনে। স্লিপটির উপর নজর বুলাল মেইলিগুলি। স্লিপে সাক্ষাতদানের একটা অনুরোধ। নিচে নাম স্বাক্ষর ‘হাসান তারিক’।
পড়ে ভ্রু কুঞ্চিত করল মেইলিগুলি। না এই নামের কাউকে সে চিনে না। এই নামের কোনও লোকের সাথে তার পরিবারের বা পেশাগত কোন সম্পর্কের কথাও সে স্মরণ করতে পারল না। নিশ্চয় কেউ বিরক্ত করতে এসেছে। এখন সাক্ষাত প্রার্থীর সংখ্যা প্রতিদিন প্রচুর। সবাইকেই ফিরে যেতে হয়। ফিল্ম সংক্রান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে সে দেখা করে না। তবু ওয়েটিং রুমে ভীড় লেগেই থাকে। বেরুবার সময় এক মুহূর্ত দেখার জন্যে।
মিস ওয়ান এর দিকে মুখ তুলে মেইলিগুলি বলল, তুমি বলনি ফিল্ম সংক্রান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে আমি দেখা করি না?
-বলেছি, কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। বলছে, অভিনেত্রী বলে তার সাথে দেখা করতে আসিনি। তবু আমি রাজি না হলে সে বলেছে’ বিদেশ থেকে সে এসেছে, একটা উপকার আপনি, তার করতে পারেন’ এই অনুরধ আপনাকে জানাবার জন্যে।
ভ্রু কুঞ্চিত হল মেইলিগুলির। আবার চোখ বুলাল নামটার উপর। ঠিক নামটা এদেশে স্বাভাবিক নয়।
-জিজ্ঞেস করেছো কোন দেশী? বলল মেইলিগুলি।
-না জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস করে আসি।
বলে দরজার দিকে পা বাড়াল লি ওয়ান। মেইলিগুলি তকে থামিয়ে দিয়ে বলল, দরকার নেই জিজ্ঞাসার। তুমি তাকে নিয়ে এস।
লি ওয়ান বেরিয়ে গেল। অল্পক্ষণ পর হাসান তারিককে নিয়ে ফিরে এল।
হাসান তারিক ঘরে প্রবেশ করে মেইলিগুলির সাথে চোখাচোখি হতেই পরিষ্কার কণ্ঠে সালাম দিল।
মেইলিগুলি ছোট্ট করে সালামের জবাব দিয়ে বলল, বসুন।
মেইলিগুলিও উঠে দাঁড়িয়েছিল। হাসান তারিক বসার সাথে সাথে মেইলিগুলিও বসে পড়ল।
মেইলিগুলিও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিল হাসান তারিককে। পঁচিশ/ছাব্বিশ বছর বয়স। বলিষ্ঠ গড়ন। ছোট করে ছাঁটা চুল। মুখে সারল্য, দৃষ্টির মধ্যে একটা পরিছন্নতা। বিরক্তির ভাবটা কেটে গেল মেইলিগুলির। এমন চেহারার লোক চারশো বিশ গোছের হয় না।
মেইলিগুলি কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল। কিন্তু তার আগেই কথা বলে উঠল হাসান তারিক। বলল, মিস মেইলিগুলি, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য মাফ চাইছি। একটা ব্যাপারে আমি আপানার সাহায্য চাই।
-আপনি কে, কি পরিচয় আপনার আগে বলুন।
-পরিচয় দেবার মত কোন পরিচয় আমার নেই। একজন সাধারন মানুষ আমি। এসেছি তাসখন্দ থেকে।
-তাসখন্দ থেকে? আচ্ছা ওখানে যে বিপ্লব হয়েছে, সে সম্বন্ধে কিছু জানেন আপনি?
-হ্যাঁ, সেখানকার মুসলমানরা কম্যুনিস্টদের হটিয়ে দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে।
-ব্যাপারটা আমার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য। মনে হয় যা শুনেছি সবই রুপকথা। যাক, আপনার প্রয়োজন বলুন।
-জেনারেল বোরিসকে আপনি চেনেন?
জেনারেল বোরিসের নাম শুনে চমকে উঠল মেইলিগুলি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার তাকাল হাসান তারিকের দিকে। ধীর কন্ঠে বলল, তার সাথে পরিচয় হয়েছিল, কিন্তু কে তিনি তার বিস্তারিত কিছু জানি না।
-জেনারেল বোরিস কাশগড় থেকে উরুমচি এসেছেন, আপনি জানেন?
-জানি, এসেছেন।
একটু থামল হাসান তারিক। বোধহয় একটু ঢোক গিলল। মেইলিগুলির কথায় যেন তার চোখ দু’টি চকচক করে উঠেছে। ধীরে ধীরে সে বলল, মিস মেইলিগুলি, আপনি কি তার ঠিকানা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারেন?
-দুঃখিত, মিঃ হাসান তারিক, তার ঠিকানা আমার জানা নেই। উনি উরুমচিতে আসার পর হোটেল সিংকিয়াং-এ একটা ভোজ সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমাকেও দাওয়াত করেছিলেন। সেখানেই তার সাথে দেখা। আর কিছুই জানি না আমি তার সম্বন্ধে।
বিরাট আশা হোঁচট খেল হাসান তারিকের। একটা বিষণ্ণ অন্ধকার নেমে এল তার চোখে মুখে। ব্যাপারটা মেইলিগুলির দৃষ্টি এড়ালনা। মনে মনে দুঃখই হলো তার। বেচারার কতইনা জরুরী কাজ ছিল।
‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত মিস মেইলিগুলি’ বলে উঠে দাঁড়াল হাসান তারিক। কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে আবার ফিরে দাঁড়াল সে।
মেইলিগুলি হাসান তারিককে বিদায় দেবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার ফিরে দাঁড়ানো দেখে বলল, কিছু বলবেন?
-আপনি তিয়েনশান ভ্যালি থেকে কাশগড় আসার পথে জেনারেল বোরিসের সাথে তো একজন বন্দী দেখেছিলেন।
-হ্যাঁ, কেন?
-কেমন দেখেছেন তাকে, কেমন ছিলেন তিনি? হাসান তারিকের স্বরটা ভারি।
মেইলিগুলিও কৌতুহল ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। একটু পর বলল, মিঃ হাসান তারিক, আপনি কাকে খুজছেন, বন্দীকে না জেনারেল বোরিসকে?
-বন্দীকে। আর বন্দীকে পাবার জন্যেই খুঁজছি জেনারেল বোরিসকে।
মেইলিগুলি দাঁড়িয়েই কথা বলছিল। বসে পড়ল। হাসান তারিককেও বসতে বলল।
-বন্দীটি কে মিঃ হাসান তারিক?
-আহমদ মুসা। ফিলিস্তিন বিপ্লব, মিন্দানাও বিপ্লব এবং মধ্য এশিয়া বিপ্লবের অধিনায়ক।
বিস্ময়ের ঘোর নিয়ে কিছুক্ষণ সে তাকিয়ে রইল হাসান তারিকের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে। পরে সে চোখ দু’টি বন্ধ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
কিছুক্ষন পর চোখ খুলে সে সোজা হয়ে বসল। অনেকটা স্বগত কন্ঠেই বলল, আমি দেখেই তখন তাকে অসাধারন কেউ ভেবেছিলাম। ঠিক হলো আমার ভাবনা। অসাধারন না হলে ঐ অবস্থায় অত নিশ্চিন্ত কোন মানুষ হতে পারে না।
তারপর হাসান তারিকের দিকে চেয়ে বলল, একটা কথাই আমি ওর সাথে বলার সু্যোগ পেয়েছি। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাঁর কিছু বলার আছে কিনা কাউকে? কি জবাব দিয়েছিলেন জানেন? চিরদিন মনে থাকবে আমার সেই জবাবটা। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন, জাতির কাজে লাগার শক্তি আপনাকে আল্লাহ দিন।
-মিস মেইলিগুলি, ওঁর গোটা জীবন, ওঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, ওঁর ধ্যান, জ্ঞান সব দুনিয়ার মুসলমানদের জন্যে নিবেদিত। স্বাধীন ইসলামী বিশ্ব ওর সর্বক্ষনের স্বপ্ন।
-সেদিন যা দেখেছি, এত বড় একজন বিপ্লবী এত শান্ত, এত সৌম্যও হতে পারে।
-অবসরকালীন আহমদ মুসার ঐ রুপ ওটা। কিন্তু এ্যাকশনের সময় সে সিংহের মত সাহসি, নেকড়ের মত ক্ষিপ্র। যাক, মিস মেইলিগুলি, আমি জানতে চেয়াছিলাম, কেমন ছিলেন তিনি?
একটু দ্বিধা করে মেইলিগুলি বলল, ওঁর গোটা পোশাক আমি রক্তে ভেজা দেখেছি। ওঁর মুখ দেখে আমি কিছু বুঝতে পারিনি, মাঝে মাঝে ওঁকে ওঁর মাথা চেপে ধরতে দেখেছি।
হাসান তারিক মুখ নিচু করেছিল। অশ্রু গোপন করতে চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারলনা। দু’চোখ বেঁয়ে নেমে এলো অশ্রু।
মেইলিগুলি হাসান তারিকের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু বিব্রত বোধ করল সে। জিজ্ঞেস করল, মিঃ হাসান তারিক, ওঁর সাথে আপনার কি সম্পর্ক?
হাসান তারিক চোখটা ভাল করে মুছে নিয়ে বলল, ওঁর সংগ্রামের একজন সাথী আমি।
-আচ্ছা জেনারেল বোরিস কে?
-জেনারেল বোরিস ‘ফ্র’ এর নেতা এবং মধ্য এশিয়ার কম্যুনিস্ট গভর্ণর জেনারেল ছিলেন।
-এবার সব বুঝেছি মিঃ হাসান তারিক।
হাসান তারিক একটু ভাবল। তারপর বলল, জেনারেল বোরিসকে ট্রেস করার আর কোন পথ আছে মিস মেইলিগুলি? আমরা একটা ঠিকানা উদ্ধার করেছিলাম কাশগড় থেকে। কিন্তু কাশগড় থেকে সে সম্ভবত ঐ খবর পেয়ে যায়। আমরা উরুমচিতে পৌছার আগেই সে তার ঐ ঠিকানা বদলে ফেলেছে।
চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে মেইলিগুলি। সে চিন্তা করছিল। এক সময় খুশি হয়ে সে বলল, আপনি হোটেল সিংকিয়াং-এ খোঁজ নিন, একটা স্যুট ওর নামে ছিল, সেটা আছে কি না? আরেকটা জিনিস জেনারেল বোরিস আলেকজান্ডার বোরিসভ নামে এখানকার চেম্বার অব কমার্সের সদস্য হয়েছে। আপনি সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে পারেন। তার সাথে যোগাযোগের ঠিকানা সেখানে কি দেয়া আছে। তাছাড়া এই শহরে সে নতুন এসেছে। নিশ্চয় সিটিজেন রেজিষ্টারে তার নাম উঠেছে। সেখানেও ঠিকানা থাকার কথা। এ খোঁজগুলো আপনি নিন। আমিও এ ব্যাপারে দেখব।
‘শুকরিয়াহ’ বলে হাসান তারিক উঠে দাঁড়াল।
মেইলিগুলি তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বলল, প্রয়োজন হলেই আমার সাথে যোগাযোগ করবেন, দ্বিধা করবেন না।
হাসান তারিক চলে গেলে মেইলিগুলি ফিরে এল তার চেয়ারে। কিন্তু আর কাজে মন বসাতে পারল না। বার বার তার ঐ অদ্ভুত বন্দীর কথাই মনে আসছে। আজকের মুসলিম জাতির মধ্যে এমন মানুষও আছে। মনে মনে হাসি পেল তার। থাকবে না কেন, না থাকলে ফিলিস্তিন, মিন্দানাও এবং মধ্য এশিয়ায় বিপ্লব হলো কেমন করে?
সামনের স্ক্রিপটা বন্ধ করে ফাইলে রেখে দিল ।
এ সময় একটা টেলিফন এল!
রিসিভার তুলে নিতেই ওপার থেকে কথা ভেসে এলো, গতকালের প্রস্তাব সম্পর্কে তুমি তো কিছু বললে না।
-সরি স্যার, একটু ব্যস্ত ছিলাম। ঐ বইয়ে আমি অংশ নিতে পারছি না।
-কেন, কেন?
-তিনটি এমন দৃশ্য আছে, যে দৃশ্যে আমি অভিনয় করি না, করব না।
-যেমন?
-আলিঙ্গন, পানির নিচে জলকেলি, গোসল করে উঠে ভিজা কাপড়ে নাচা।
-ঠিক আছে ও দৃশ্যগুলি বাদ যাবে।
-ধন্যবাদ স্যার।
ওপারে টেলিফোন রেখে দিল। মেইলিগুলিও টেলিফোন রেখে উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এলো অফিস থেকে।