০৮. সিংকিয়াং থেকে ককেশাস
পর্ব ৫
আর্মেনিয়ার রাজধানী ইয়েরেভেনের নতুন অংশে সেন্ট জন পল রোড যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে নীরব- মনোরম পরিবেশ এক সবুজ টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছে ককেশাস অঞ্চলের সবচেয়ে মর্যাদাশালী শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’।
ইনস্টিটিউট বিল্ডিং -এর সামনে কৃত্রিম একটা লেক। তার চারপাশে বাগান। বাগানের ছায়ায় অনেক আসন পাতা। ক্লাস বিরতির সময়টুকু ছাত্ররা লাইব্রেরীতে অথবা এখানেই কাটায়।
বেলা দেড়টা। শেষ বর্ষের ক্লাস থেকে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল সোফিয়া এঞ্জেলা। সাদা স্কার্ট, সাদা শার্ট পরা। গলায় একটা সোনার চেন। চেনের সাথে বুকের ওপর ঝুলে আছে মূল্যবান লাল পাথরের তৈরি ক্রুশের উপর ক্রুশবিদ্ধ খ্রিস্টের ছবি। খুব সাধারণ পোশাকেও মেয়েটিকে ‘এঞ্জেলা’ অর্থাৎ দেবী বলেই মনে হচ্ছে। সোফিয়া আর্মেনিয়ার কিরকেশিয়ান গোত্রের মেয়ে। সৌন্দর্যের জন্য এরা বিখ্যাত। তুর্কী খলিফাদের অনেকেই এখান থেকে তাদের বেগম বাছাই করেছেন।
সোফিয়া এঞ্জেলা আর্মেনিয়ার নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতা সেন্ট জর্জ সাইমনের মেয়ে।
সোফিয়ার চোখ দুটি চঞ্চল। সে তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। সে খুঁজছে সালমান শামিলকে। সালমান শামিল ক্লাসের সেরা ছাত্র। বরাবর সে ক্লাসে প্রথম হয়ে আসছে। খৃস্টান আর্মেনিয়দের পরিচালিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুসলমানদের উৎকট বৈষম্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। সে যদি আবার আজারবাইজানী হয় তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু সালমান শামিল আজারবাইজানী হবার পরেও তাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। তার মত ছাত্র এ ইন্সটিটিউটে আর আসেনি। শিক্ষকরাও তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করেন।
সালমান শামিল তো প্রথম সারিতেই বসেছিল, হুট করে বেরিয়ে গেল কোথায়? সোফিয়া তাকে খুঁজতে লাইব্রেরীতে এল। না লাইব্রেরীতে নেই। লাইব্রেরীতে যে চেয়ারে সে বসে সেটা খালি। এল এবার সে লেক গার্ডেনে। না, কোথাও নেই। হতাশ হয়ে ইনস্টিটিউট বিল্ডিং-এ ফেরার পথে পেল ডেভিডকে। তাদেরই সহপাঠী। সে সালমানকে দেখেছে কিনা সোফিয়া জিজ্ঞেস করল।
ডেভিড থমকে দাঁড়িয়ে সোফিয়ার দিকে মুহূর্তকাল এক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, বয়ে গেছে আমার ঐ খুনেদের খোঁজ রাখতে।
সোভিয়েতরা ককেশাস দখলের পর এর নাম পরিচয় অনেক কিছুই পাল্টে দিয়েছিল জাতীয় ঐক্য যাতে আসতে না পারে এজন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জাতিসত্তাকে উজ্জীবিত করে ককেশাসকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। সৃষ্টি করা হয়েছে জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ইত্যাদি। সবচেয়ে অবিচার করা হয়েছে ইতিহাস নিয়ে। রাজনৈতিক লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য ইতিহাস নতুন করে লেখা হয়েছে। এ ইতিহাসে মুসলমানদের খুনি জাতি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। নতুন আর্মেনিয়রা মুসলমানদের প্রতি একটা জাতি বিদ্বেষ নিয়ে তাদের বুদ্ধির চোখ মেলে।
একজনকে এভাবে বলা ঠিক নয়। বলল সোফিয়া।
সে তো একজন ব্যক্তি মাত্র নয়, একটা জাতির অংশ।
তা হোক, ওর দোষটা কি?
দোষটা টের পাবে। দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষছে ইনস্টিটিউট। তার প্রতিভা দিয়ে আমাদের কি?
তাদের প্রতিভা কি আমাদের কাজে লাগছে না?
তুমি সেন্ট সাইমনের মেয়ে বটে। কিন্তু অন্ধ। বই ছাড়া কিছুই বুঝ না। সামনে দিনটা কি আসছে জান?
কি?
দুই প্রদীপ তো একসাথে থাকতে পারে না, এই ককেশাসে হয় তারা থাকবে, না হয় আমারা থাকব।
দেখ এসব রাজনীতির কথা। নতুন কথাও নয়। এসব আমি বুঝি না। বল দেখেছ কিনা সালমানকে, ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল কোথায়?
কি দরকার তাকে, ঐ মুসলমানের বাচ্চাটাকে?
সামনে পরীক্ষা মনে নেই, ওর একটা নোট আজ আমাকে দেবার কথা।
তাহলে পালিয়েছে। ও হিংসুক, কোন উপকার করবে আমাদের?
এ সময় আরেক সহপাঠী রাফেলো সেখানে এসে দাঁড়ালো। বলল, কার কথা বলছিসরে ডেভিড?
খুনি কুকুরদের কথা, সালমানদের কথা।
কি উপকার করবে সে?
সোফিয়া একটা নোট চেয়েছে তার কাছে। দেবার কথা আজ। পালিয়েছে।
রাফেলো সোফিয়ার দিকে কটাক্ষ করে বলল, যতই সুন্দরী হও, স্বর্গের অপ্সরী হও, ও ব্যাটারা কিন্তু কাজে ঠিক আছে। কলা দেখাবে তোমাকে। তুমি চেন না ওদের।
বলে ডেভিডের পিঠে একটা থাপ্পড় দিয়ে বলল, চল লাঞ্চ সেরে আসি। ক্লাসের দেরি হবে আমাদের।
ডেভিড যাবার জন্যে পা বাড়িয়ে পকেট থেকে একটা হ্যান্ডবিল বের করে সোফিয়ার হাতে দিয়ে বলল, রাজনীতি তো বুঝ না, পড়ে একবার বুঝতে চেষ্টা করো।
তারা চলে গেল।
সোফিয়া হ্যান্ডবিলটির দিকে নজর বুলাতে বুলাতে ইন্সটিটিউটের দিকে পা বাড়াল।
হ্যান্ডবিলটি প্রচার করেছে ‘জাগ্রত আর্মেনিয় জনগণ’ -এর পক্ষে ‘হোয়াইট উলফ’। হ্যান্ডবিলে এ অঞ্চলের খৃস্টান জনগণের ওপর মুসলমানদের নির্যাতন ও গণহত্যার বিবরণ দেয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, তাদের হাত থেকে ককেশাস অঞ্চল মুক্ত করতে না পারলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবার ঘটবে। সুতরাং ‘হোয়াইট উলফ’ -এর সাথে সকলে একাত্ম হওয়া এবং দেশকে খুনিদের হাত থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। হ্যান্ডবিলটির শেষে ফুটনোটে লেখা হয়েছে, হ্যান্ডবিলটি বার বার পড়ুন, সংরক্ষণ করুন এবং অন্যকে পড়ান, খ্রিস্ট খুশি হবেন।
সোফিয়া পড়ে হ্যান্ডবিলটি ব্যাগে রেখে দিল। একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক থেকে। কি হচ্ছে এসব দেশে? এমন অসহনশীল ছিল না মানুষ। এই ডেভিড, রাফেলোকে তো সে আজ থেকে থেকে চিনে না। তারা এমন মানুষ ছিল না। এই তো এক বছর আগে সালমান যখন অনার্সে ফার্স্ট হলো, ডেভিডই তো তাঁকে কাঁধে তুলে নিয়েছিল, যদিও মুসলমান বলে একটা ঘৃণা, একটা বিদ্বেষ তার প্রতি ছিল। কিন্তু এই এক বছরের মধ্যে কি ঘটে গেল, তারা এমন হয়ে গেল কেন? শুধু তারা কেন, সর্বত্রই তো ধূমায়িত বিক্ষোভ দেখছি।
সোফিয়া আবার ফিরে এল লাইব্রেরীতে। কিন্তু দেখল সালমানের সিটটা শূন্যই। সোফিয়া তার নিজের ব্যাগটা টেবিলে রেখে বাথরুমে গেল।
বাথরুমের সামনের করিডোরটি পশ্চিম দিকে এগিয়ে বাথরুম ঘুরে উত্তর দিকে গেছে। করিডোরটি পশ্চিম দিকে এগিয়ে বাথরুম ঘুরে উত্তর দিকে গেছে। করিডোরের উত্তর প্রান্তে বাথরুম। সুইপারদের স্টোর রুম।
সোফিয়া করিডোরের পশ্চিম প্রান্তে দুটো জুতার গোড়ালী দেখতে পেল। ওভাবে ওখানে জুতা পড়ে কেন?
বাথরুম থেকে বেরুবার পর সোফিয়ার সে কেৌতূহলটা আবার জাগল, জুতা কেন, কার জুতা!
করিডোরের পশ্চিম প্রান্তের কাছাকাছি হতেই পুরো জুতাটা তার নজরে পড়ল। একি, এ যে সালমান শামিলের জুতা!
করিডোরের মাথায় গিয়ে উত্তর দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সোফিয়া। দেখল, সালমান নামাযে দাঁড়িয়ে। তার হাত দুটি বুকে বাঁধা, চোখ দুটি মাটির দিকে। ধ্যানমগ্ন চেহারা। ঠোঁট দুটি শুধু তার নড়ছে।
সোফিয়া সেদিক থেকে চোখ সরাতে পারল না। সালমান শামিল শুধু ভাল ছাত্র নয়, তার ব্যায়াম পুষ্ট সুন্দর সুগঠিত দেহও সকলের ঈর্ষার বস্তু। সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার চোখ ও মুখের পবিত্র লাবণ্য। সেদিকে চাইলে মনে হয় না সে কারো শত্রু হতে পারে। তার নিষ্পাপ চেহারা শুধু কাছেই টানে কাউকে দূরে সরিয়ে দেয় না।
সোফিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সালমানের রুকু, সিজদা গোটা নামাযই দেখল। সে যে একজন সামনে দাঁড়িয়ে, কোন খেয়ালই তার নেই। যেন গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন সে, যেন মন তার অন্য কোন জগতে। নামায এই রকম, এত সুন্দর। কই গীর্জায় তো সে যায়, ফাদার কিংবা কারো মধ্যেই তো এই ধ্যানমগ্নতা, এই একাগ্রতা কোন দিন সে দেখেনি।
সালাম ফিরিয়েই সালমান শামিল সোফিয়াকে দেখতে পেল। হেসে উঠে দাঁড়ালো। কি ব্যাপার সোফিয়া, তুমি এখানে?
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।
কি করে জানলে আমি এখানে?
তোমার জুতা বলে দিয়েছে। এসেছিলাম বাথরুমে। জুতার গোড়ালি দেখে সন্ধান নিতে এসে দেখি তুমি এখানে নামায পড়ছ। বলতো, সুইপারের করিডোরে এভাবে নামায পড়ছ কেন? সব জায়গায় কি নামায হয়?
আল্লাহর জমিনের সব জায়গাই পবিত্র, সব জায়গা থেকেই তাকে ডাকা যাবে।
তবু লাইব্রেরীতে তো অনেক নিরিবিলি জায়গা আছে, সেখানে তো নামায পড়তে পার।
আপত্তি উঠেছে।
আপত্তি উঠেছে? কে আপত্তি করেছে?
এসব কথা থাক সোফিয়া। তুমি অনেক কিছুই জান না, জেনে কি লাভ!
এসব নিকৃষ্ট সংকীর্ণতা।
সংকীর্ণতাকে দোষ দিচ্ছ? এ সংকীর্ণতাই তো যুগ যুগ ধরে ক্রুসেড চালিয়েছে।
কিন্তু ক্রুসেডের জন্য তো তোমরা দায়ী।
বল সোফিয়া, মুসলমানরা কি যুদ্ধ করার জন্য ইউরোপে গিয়েছিল, না ইউরোপীয়রা যুদ্ধ করতে মুসলিম ভূখন্ডে এসেছিল?
কিন্তু তোমরা তো আমাদের খ্রীষ্ট ভূমি জেরুজালেম দখল করে রেখেছিলে।
না, জেরুজালেম আমরা মুক্ত করেছিলাম, অনাচারের হাত থেকে মুক্ত করে খ্রীষ্ট এবং বহু নবীর জম্ম ও কর্মস্থানকে আমরা মর্যাদা দিয়েছিলাম। আমরা জেরুজালেম মুক্ত করেছিলাম তার প্রমাণ জেরুজালেম যখন আমাদের হাতে আসে তখন একফোটা রক্তপাত ও হয়নি, কোন মানুষের একটি টাকা ও লুন্ঠিত হয়নি। মুসলমানদের আগমনে জেরুজালেমবাসীরা হেসেছিল। কিন্তু তোমরা যখন জেরুজালেমে প্রবেশ করেছ তখন সত্তর হাজার লোক নিহত হয়েছে, কোন বাড়িই লুন্ঠনের হাত থেকে বাঁচেনি, কোন একটি বাড়িও আগুন ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
শোন তোমার সাথে আমি ঝগড়া করতে পারব না। ভাল লাগছে না। আজ সারাদিনই এসব শুনছি।
কি শুনছ?
এখন আমি আবার আরেকটা কাহিনী শুরু করি। আমি পারব না। এসব কথা উচ্চারণ করতে ও আমার ঘৃণা বোধ হয়।
কোন সব কথা?
নোংরা রাজনীতির কথা।
বলে সোফিয়া তার ব্যাগ থেকে সেই হ্যান্ডবিলটা বের করে সালমানের হাতে দিতে দিতে বলল, এই কিছুক্ষণ আগে একজন এটা আমার হাতে দিল এবং দুজনে একটা বক্তৃতাও দিয়েছে।
সালমান শামিল হ্যান্ডবিলে নজর বুলিয়ে সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এ হ্যান্ডবিলটা এ ইনস্টিটিউটেও বিলি হচ্ছে?
তা বোধ হয় নয়। একজন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছে।
পড়ে কি মনে করছ?
বলেছিই তো, ভাল লাগছে না। আমি এসব আলোচনা করতে রাজী নই। আমি এসেছি তোমাকে একটা কথা বলতে।
বল। সোফিয়ার দিকে চকিতে একবার চোখ তুলে বলল সালমান শামিল।
হ্যাঁ, এই সুইপার করিডোরে দাঁড়িয়ে কথা বলি! চল লাইব্রেরীতে। লাইব্রেরীতে গিয়ে দুজন বসল পাশাপাশি চেয়ারে। চেয়ারটা একটু লাগালাগি হয়ে গিয়েছিল। সালমান শামিল চেয়ারটা টেনে সরিয়ে নিল। সোফিয়া ভ্রুকুটি করে বলল, দেখ আমি বাঘ নই যে তোমাকে নিরাপদ দূরত্বে সরে থাকতে হবে।
তা নয়………
লজ্জিত সালমান শামিল তার কথা শেষ না করেই থেমে গেল।
তা নয় তো কি? পুরুষ মানুষের এত লজ্জা সাজে না। বলতো কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তুমি কথা বলতে পার? বিয়ের অনুষ্ঠানে বরের মত চোখটা সব সময় নিচের দিকে। এটা কি?
সোফিয়ার কথা শুনে সালমান শামিল হাসল। বলল, সোফিয়া, পারি না বলে নয়, পারা উচিত নয় বলে তাকাই না।
উচিত নয় কেন?
ইসলামে নিষেধ আছে। নর ও নারীর বৃহত্তর স্বার্থেই এই নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতাকে নিষেধ করা হয়েছে।
সোফিয়া একটু ভাবল। বলল, সালমান বিষয়টাকে নিয়ে আমি এভাবে কখনও ভাবিনি। আমাকে ভাবতে হবে আরও।
তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে তুমি একটু দুরেই থাক, এবার শোন আমার কথা।
থামল সোফিয়া। ধীরে ধীরে শুরু করল আবার, তোমার কি শত্রু আছে সালমান?
কেন এ কথা বলছ?
এমনি, বল না?
না, আমি আমার শত্রু দেখছি না।
আচ্ছা, তুমি কারো কোন স্বার্থের ক্ষতি করেছ?
না।
কিন্তু তোমার শত্রু আছে। তারা তোমার ক্ষতি করতে চেষ্টা করবে। তোমাকে সাবধান থাকতে হবে।
এসব কথা তুমি বলছ কোথ্থেকে?
আমাকে তুমি এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করো না। আমাকে তুমি বিশ্বাস কর, আমি ঠিক বলছি। অনুরোধ ঝরে পড়ল তার কন্ঠে।
সোফিয়ার কাছে থেকে এ ধরনের খবর শুনে কিছুটা চমকে উঠেছিল সালমান শামিল। কিন্তু চমকে ওঠাটা সে প্রকাশ হতে দেয়নি সোফিয়ার কাছে এবং সোফিয়ার কথা সে এক বিন্দুও অবিশ্বাস করেনি। কিন্তু বিষ্ময়ের ব্যাপার হলো সোফিয়ার কাছে এ খবর এল কি করে? এ বিষয়টা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই সে প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে বলল, বিপদের পরিচয় জানলে সাবধান হওয়া সহজ হতো সোফিয়া।
তোমার কাছে মিথ্যা বলব না সালমান। আমি কিছুই জানি না। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি, তুমি কারো ভয়ানক শত্রুতার টার্গেট। এই বুঝতে পারা সূত্রটা কি তা জিজ্ঞেস করতে তোমাকে নিষেধ করছি।
শুকরিয়া সোফিয়া।
শুকরিয়া জানাতে হবে না, তুমি বল আমার কথা তুমি গুরুত্বের সাথে নিয়েছ? সাবধান থাকবে?
জীবনের ভয় কি আমার নেই সোফিয়া?
না, নেই। একদিন তুমি বলেছিলে না যে, জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে? এ নিয়ে মানুষের চিন্তার কিছু নেই।
এ কথা আমি এখনো বলি।
এখানেই আমার আপত্তি। সাবধান তুমি তাহলে কেমন করে হবে?
পাগল, যুদ্ধে জয়-পরাজয় তো আল্লাহর হাতে, তার মানে কি অস্ত্র না ধরলেও, যুদ্ধ না করলেও আল্লাহ জয় এনে দেবে?
‘ঠিক আছে, বুঝেছি’ বলে একটু হেসে উঠে দাঁড়ালো সোফিয়া। বলল, এখন আসি। বলে হাত বাড়িয়ে দিল। কিন্তু ‘স্যরি’ বলে হাত টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল সালমান শামিলের। ঘড়ির রেড়িয়াম ডায়ালের দিকে চেয়ে দেখল রাত দুটা। এ সময়ে ঘুম ভাঙল কেন?
এই সাথে খেয়াল হল, সে তো বিছানায় শুয়ে নেই, সোফায়। মনে পড়ল, সোফায় হেলান দিয়ে চিন্তা করতে করতেই সে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
সোফিয়ার দেয়া তথ্য নিয়েই চিন্তা করছিল সালমান শামিল। ককেশাসের মুসলিম কম্যুনিটির এ পর্যন্ত পঁচিশজন নেতা হারিয়েছে।
সালমান শামিল জানে। এই হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় সেও থাকতে পারে। প্রতিভাবান ও সম্বাবনাময় ছাত্র বলে শুধু নয় । তার সবচেয় বড় অপরাধ হল সে ইমাম শামিল এর বংশধর।
ঈমাম শামিল ককেশীয় মুসলমাদের কিংবদন্তীর নায়ক অকুতভয় স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং ককেশীয় মুসালমানদের অবিসংবাদিত আধ্যাত্তিক নেতা। ইমাম শামিল উনিশ শতকের মধ্য ভাগের প্রায় চার দশক ধরে ককেশীয় মুসলমানদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনগণকে সংঘবদ্ধ করে রাশিয়ার জারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। বহু বছর তিনি জারের সংগ্রাম ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। রুশ বিপ্লবের পর লিখিত সোভিয়েত এনসাইক্লোপেডিয়ার প্রথম সংস্করণেও তার জার বিরোধী সংগ্রামের প্রশংসা আছে । তাতে পরিস্কার বলা হয়ছিল ককেসীয় পাহাড়ী জনগণের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নায়ক ছিলেন শামিল। জার শাসিত রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই ছিল তার সংগ্রাম।
কিন্তু পরবর্তীকালে সোভিয়েত কম্যুনিস্টরা যখন দেখল শামিলকে স্বীকৃতি দিলে শামিলের ইসলামী আন্দোলনের প্রতিও স্বীকৃতি দেয়া হয়ে যা, তখন তারা ইতিহাস পাল্টায়। ককেশাসের মীরজাফর বাগীরভ ও দানিয়ালভদের দ্বারা ঘোষণা করা হলো শামিলকে জাতীয় নেতা বলে স্বীকার করা যেতে পারে না। বলা হলো শামিলের ইসলামী আন্দোলন প্রগতিশীল ও স্বাধীনতাকামী হতে পারে না।
সেই ইমাম শামিল এর বংশধর সালমান শামিলের ভর্তি নিয়েও অনেক টাল বাহানা হয়েছে। কিন্তু তার ব্যতিক্রমধমী রেজাল্টই ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের দরজা তার সামনে খুলে দিয়েছে।
সোফিয়ার ওটুকু ইংগিতই সালমান শামিলের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। সালমান শামিল ইমাম শামিলের প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আন্দোলন ককেশাস ক্রিসেন্ট এর যুব শাখার প্রধান। তার চিন্তার বিষয় ছিল, এখন তার কি করনীয়। অদৃশ শত্রুর বিরুদ্ধে কি করে সে লড়াই করবে? এ অদৃশ শত্রুদের তারা চেনে। কিন্তু কারা কোত্থেকে কিভাবে কাজ করে চলেছে এটাই জানা নেই তাদের। এরা অত্যন্ত কুশলী এবং দক্ষ। তারা কাজ করে কিন্তু পেছনে কোন চিহ্ন রেখে যায় না।
সালমান শামিল দুচোখ ভালো করে রগডে সোফা থেকে উঠতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা ধাতব গন্ধ তার নাকে প্রবেশ করল। বিজ্ঞানের ছাত্র সালমান শামিল সংগে সংগে বুজতে পারল এটা গলিত ইস্পাতের গন্ধ। বুঝার সাথে সাথেই আঁৎকে ঊঠল সালমান শামিল। তাহলে কি ঘরের ইস্পাতের লক গলিয়ে ফেলা হচ্ছে!
সালমান শামিল দ্রুত সন্তর্পণে ছুটে গেল প্রথমে বাইরের ব্যালকনির দিকের দরজার কাছে। দরজার লকের দিকে তাকাতেই কীহোল দিয়ে ক্ষুদ্র একবিন্দু চোখ ধাঁধানো নীল আলো দেখতে পেল। বুঝলো ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার লক গলিয়ে ফেলা হচ্ছে।
সালমান শামিলের কাছে সব পরিস্কার হয় গেল। মনে পড়ল সোফিয়ার সাবধান বানীর কথা।
সালমান শামিল তাড়াতাড়ি দরজার পাশে রাখা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করার বাড়তি ব্যবস্থা লোহার মোটা বার তুলে সন্তর্পণে চৌকাঠের দুই হুকে ঢুকিয়ে দিল। সালমান শামিল জানে ল্যাসার বিম দিয়ে গোটা দরজাই উড়িয়ে দেয়া যাবে। তবু এই ব্যবস্থা এ জন্যই যে, কিছুটা সময় হাতে পাওয়া যাবে।
সালমান শামিল দ্রত ভেতরের দরজা খুলে বাড়ির ছাদে উঠে এল। সিড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করল না। সেখানে পাহারা থাকবে নিশ্চিত।
সালমান শামিলের এ বাড়িটি সেন্ট জন পল রোডের পাশেই। এ রোডের মাঝামাঝি গোল্ডেন প্লাজা এলাকায় একটা ছোট রাস্তা সেন্ট জন পল রোড থেকে পূর্বদিকে বেরিয়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে শ’দুয়েক গজ গেলেই এই বাড়ি। বাড়িটির উত্তর পাশ দিয়েই ঐ রাস্তাটির পূর্ব ও দক্ষিন পাশ খোলা। পশ্চিম পাশে একটা বাড়ি। দুই বাড়ির মাঝখানে অন্ধকার। সুইপার প্যাসেজ। প্যাসেজটির মাথায় একটি ভাঙা দরজা।
আটটি ফ্ল্যাট বিশিষ্ট চারতলা বিল্ডিং এর টপ ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছে সালমান শামিল। তার চার রুমের দুরুম সে থাকতে দিয়েছে একটি মুসলিম পরিবারকে অবশিষ্ট দুরুম নিয়ে সে থাকে।
সালমান শামিল ছাদে উঠে দ্রুত পানির পাইপ বেয়ে বাড়ির মধ্যকার সেই অন্ধকার প্যাসেজে নেমে গেল। তারপর গুটি গুটি করে এগুলো রাস্তার দিকে।
ভাঙ্গা দরজার কাছে এসে ফুটোয় চোখ লাগিয়ে দেখল দরজার মুখেই একটা জীপ দাড়িয়ে। রাস্তার বাতিটা বেশ খানিকটা তফাতে। তবুও জীপের ভেতরে বেশ ফর্শা। দেখল কেউ জীপে নেই। ওরা কি সবাই ভেতর ঢুকে গেছে? না ও হতে পারে, হয়তো দু একজনকে সালমান শামিলের বাসার সামনের লনটায় পাহারায় রেখে গেছে।
সালমান শামিল হামাগুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে জীপের দিকে এগোল। তার লক্ষ জীপে এমন কিছু পাওয়া যায় কিনা যা থেকে নাম পরিচয় ঠিকানার কিছু জানা যাবে।
জীপের দরজা তারা খোলাই রেখে গিয়েছিল। জীপে প্রবেশ করে চারদিক চোখ বুলাতে গিয়ে প্যানেল বোর্ডের উপর নজর পড়তেই তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। দেখল, একটা নোট বুক। নোট বুকটা পকেটে ফেলে জীপ থেকে নামতে গিয়ে সে দেখল জীপের লকে চাবি ঝুলছে। একটা চিন্তা ঝিলিক দিয়ে উঠল তার মনে। এই জীপ নিয়েই তো সরে যেতে পারি।
যা ভাবা সেই কাজ। কী হোলে চাবি ঘুরিয়ে একসেলটারে চাপ দিল সে। গাডি গো গো করে উঠে চলতে শুরু করল সালমান শামিল গিয়ার চেঞ্জ করে স্পীড বাড়িয়ে দিল জীপের। লাফিয়ে উঠে ছুটে চলল গাড়ি। সালমান শামিল মুখ বাড়িয়ে পেছনে দিকে তাকিয়ে দেখল সালমান শামিলের গেট দিয়ে বেরিয়ে কে একজন ছুটে আসছে। মুখ ঘুরিয়ে নিল সালমান শামিল। পেছনে থেকে পর পর গুলীর আওয়াজ শুনতে পেল।
সালমান সেন্ট জন পল রোডে উঠে এসে সোজা দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলল। তারপর অনেক রাস্তা ঘুরে সে ব্ল্যাক টেম্পল এর পাশে এসে থামল। গাড়ির নাম্বারটা দেখে নিয়ে সালমান শামিল সেখানে থেকে পায়ে হেঁটে অপেক্ষাকৃত ছোট কিংস রোড ধরে পূর্বদিকে এগিয়ে চলল। কয়েকটা অলি গলি পেরিয়ে সে একটা ফ্লাটের দরজায় এসে দাড়াল। রাস্থার লাইটটা নষ্ট থাকায় জায়গাটা অন্ধকার। এই অবস্থায় পুলিশ তাকে এখানে দাড়ানো দেখলে নির্ঘাত চোর ডাকাত ঠাওরাবে। সে খুশি হলো যে তার জামার পকেটে আইডেন্টিটি কার্ডটা আছে। যে জামা পরে সে ইনস্টিটিউটে গিয়েছিল সে জামা আর খুলেনি। জামার পকেটে কিছু টাকাও আছে।
সালমান শামিল প্রথমে দরজার টোকা দিল। প্রথমে এক … দুই … তিন। তারপর এক ……দুই …। সব শেষে এক ……। কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করল সে এই সিরিজের। এই সিরিজ ‘ককেসাস ক্রিসেন্ট’ এর একটা কোড।
মিনিট তিনেক পরে দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। সালাম দিয়ে সালমান শামিল ভেতর প্রবেশ করল।
দরজা বন্ধ করে বিস্মিত উসমান এফেন্দী লাইট জ্বেলে দিয়ে বলল কি ব্যাপার সালমান শামিল ভাই কিছু ঘটেছে?
সালমান শামিল সোফায় বসে গাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে বলল ওরা আজ আমার ওখানে গিয়েছিল।
তারপর? মুখটা কালো করে বলল উসমান।
হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। টের পেয়ে যাই। ওরা যখন ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার তালা গলাচ্ছিল তখন আমি সরে আসি আল্লাহর ইচ্ছায়।
উসমান এফেন্দী কিছুক্ষন কথা বলতে পারল না। হা করে তাকিয়ে থাকল সালমান শামিলের দিকে। আনেকক্ষণ পর বলল আল্লাহর অশেষ দয়া এবং আমাদের ভাগ্য, ওদের হাত থেকে এইভাবে তো আর কেউ বাঁচেনি।
জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে উসমান।
বলে একটু থেমে আবার বলল এসব আলোচনা পরে হবে এখন তুমি আমাকে শোবার ব্যবস্তা করে দাও।
উসমান এফেন্দী ভেতর চলে গেল।
উসমান এফেন্দী ককেশাস ক্রিসেন্ট এর যুব শাখার একজন কর্মী। কিংস রোডে তার একটা ফলের দোকান আছে।
ড্রইং রুমের পাশেই ছিল মেহমান খানা। বিছানা করে উসমান সালমান শামিল কে ডাকল।
শুতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল পকেটের সেই নোট বুকের কথা। সোজা হয়ে বসল। বলল উসমান তুমি শুয়ে পড়। আমি একটু পরে শোব।
‘আজ রাতে আমার ঘুম ধরেছে সালমান ভাই’ বলতে বলতে ভেতর চলে গেল উসমান।
সালমান শামিল পকেট থেকে নোট বুকটি বের করল। নোট বুকটি একদম সাদা। মনে হল সদ্য কেনা। হতাশ হল সালমান শামিল।
হতাশভাবে নোট বুকটির পাতা উল্টাচ্ছিল। হঠাৎ নোট বইয়ের মধ্যে থেকে একখণ্ড কাগজ বেরিয়ে এল। কাগজটি সাদা নয় লেখা।
আগ্রহের সাথে সালমান শামিল কাগজটি চোখের সামনে তুলে ধরল। একটি নামের তালিকা। প্রথমেই কর্নেল আবদুল্লা এফেন্দীর নাম। চমকে উঠল সালমান শামিল। ইনি পঁচিশজন হারানো নেতার প্রথম জন। বাকুর ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ ইউনিটের প্রধান ছিলেন ইনি।
নামের তালিকা রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেল সালমান শামিল। পঁচিশজন হারানো নেতার নামই সেখানে। ছাব্বিশ নম্বর নামটি সালমান শামিলের। সাতাশ নম্বরে ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ –এর প্রধান আল্লামা ইব্রাহীম এদতিনার নাম। পঁচিশটি নামের বামে লালা কালি দিয়ে ক্রস দেয়া। খালি আছে মাত্র তিনটা নাম।
চমকে উঠল সালমান শামিল। অর্থাৎ ‘আমি ছিলাম ছাব্বিশ নম্বর টার্গেট।’ আর …..
পরবর্তী সাতাশ নম্বর নামের কথা মনে হতেই সমস্ত শরীরটা ঝিম ঝিম করে উঠল সালমান শামিলের। আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয়, ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’-এর সংগ্রামী নেতা আল্লামা ইব্রাহীম এদতিনা তাদের সাতাশ নম্বর টার্গেট।
সালমান শামিল তার ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল রাত সাড়ে তিনটা বাজে। ইয়েরেভেন থেকে কুমুখী তিনশ মাইল পথ।
আজারবাইজানের কুরা উপত্যকায় ‘কুরা’ নদী ও ‘আরাকস’ নদীর সংগমস্থলে প্রাচীন নগরী ‘কুমুখী’তে বাস করেন আল্লামা ইব্রাহীম এদতিনা। ইয়েরেভেন সড়ক পথে ওখানে যেতে লাগবে কমপক্ষে ছয়ঘন্টা। ককেশাস পর্বতের অলিগলি দিয়ে ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইলের বেশি গাড়ি চালানো মুশকিল। আর ট্রেনে যেতে লাগবে আরো বেশি সময়।
সালমান শামিল উঠে গিয়ে আবার উসমান এফেন্দীর শোবার ঘরের দরজায় নক করল।
বেরিয়ে এল উসমান এফেন্দী। বলল কি ব্যাপার সালমান শামিল ভাই। তার কন্ঠে উদ্বেগ।
তোমার জীপ কোথায়?
সামনেই কার টার্মিনালে।
টার্মিনালের গেট কখন খুলবে?
সাড়ে চারটায়।
এখন তিনটা। আর দেড় ঘন্টা।
কেন কি হয়েছে সালমান শামিল ভাই?
কুমুখী যেতে হবে, এখনি। কিন্তু এখন তো যাবার উপায় নেই। দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করতেই হবে।
কি ঘটেছে ব্যাপার কি জানতে পারি কিছু?
উসমান এফেন্দীর কণ্ঠে উদ্বেগ।
সালমান শামিল উসমান এফেন্দীকে নামের তালিকার সব কথা জানিয়ে বলল, নাও তৈরি হয়ে নাও। ঠিক সাড়ে চারটাতেই আমরা গাড়িতে উঠব।
বলে সালমান শামিল তার বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিল। শুয়ে হঠাৎ মনে পড়ল সোফিয়া এঞ্জেলার কথা। ও এতটা সঠিক সংবাদ পেল কোত্থেকে? বলতে চায় না। হাজার হোক তার কম্যুনিটির ব্যাপার। কিন্তু এই সাবধান করে দেবার কাজটা সে করল কেন?
ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুম এসে তাকে দখল করে নিয়েছিল, টেরই পায়নি। উসমান এফেন্দীর ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ভোর চারটা দশ মিনিট।
টেবিলের উপর কিছু সাজানো।
উসমান এফেন্দী বলল, সালমান শামিল ভাই, আসুন কিছু খেয়ে নেই। রাস্তায় কখন কোথায় কি পাওয়া যাবে।
সালমান শামিল বাথরুমে যেতে যেতে বলল, খাবারগুলো প্যাকেট করে গাড়িতে নিয়ে নাও। গাড়িতে বসে খাওয়া যাবে।
ঠিক চারটা পঁচিশ মিনিটে ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
সালমান শামিল বলল, এক্সট্রা রিভলবার নিয়েছ তো? আমি কিন্তু খালি হাতে এসেছি।
জি এনেছি বলে উসমান এফেন্দী পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করে সালমান শামিলের দিকে এগিয়ে দিল।
সালমান শামিলদের গাড়ি ঠিক চারটা চল্লিশ মিনিটে টার্মিনাল ভবন থেকে রাস্তায় নামল।
ব্লাক টেম্পেলের পাশ দিয়ে যাবার সময় সালমান শামিল দেখল, হানাদারদের সেই জীপটি এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভিং সিটে বসেছিল সালমান শামিল। তার পাশে ওসমান এফেন্দী। সালমান শামিলের দৃষ্টি সামনে। বলল, আমরা কি ঠিক সময়ে পৌছতে পারব? ওদের ছাব্বিশ-সাতাশের মধ্যে গ্যাপটা কতখানি?
উসমান এফেন্দী শুধু শুনল। কোন জবাব তার কাছেও নেই।
কাস্পিয়ান সাগর তীর থেকে পঞ্চাশ মাইল ভেতরে কুরা ও আরাকস নদীর সংগমস্থলে কুমুখী একটি সবুজ নগরী। ছোট ছোট পাহাড় উপত্যকাগুলো সবই সবুজ। প্রায় চারশ বছর আগের এই শহরটি তুর্কি সুলতানরা প্রতিষ্ঠিত করে।
শহরের পশ্চিম অংশটা পুরনো। এই অংশেই একেবারে পশ্চিম প্রান্তে একটা পাহাড়ের পাদদেশে আল্লামা ইব্রাহিম এদতিনার বাড়ি। বাড়িটি বিরাট এবং পুরনো। বাড়ির সামনে মসজিদ এবং মাদ্রাসা। এসবের গায়ে কিছু কিছু নতুন প্রলেপ লাগলেও কাঠামোটা অতীতকে বুকে নিয়ে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে।
এই বাড়িটি ককেশীয় মুসলমানদের কাছে অনেকটা তীর্থের মত। গোটা ককেশাসে এই এদতিনা মাদ্রাসা বিখ্যাত। ককেশীয় মুসলমানদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক নেতা ইমাম শামিল এই মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। আল্লামা ইব্রাহিম এদতিনার পূর্বপুরুষ আরচি জামাল এদতিনা এই বাড়ি, এই মাদ্রাসা, এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই ইমাম শামিলের উস্তাদ ছিলন।
একটি সুন্দর স্বচ্ছ-জল দিঘির উত্তর পাড়ে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত দক্ষিণমুখী বাড়ি আল্লামা ইব্রাহিম এদতিনার। দিঘিটির পশ্চিম পাড়ে মসজিদ এবং দক্ষিন পাড়ে মাদ্রাসা। বিশাল মাদ্রাসাটি দিঘির একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। ককেশাস, তাতারিয়া এবং ক্রিমিয়ার প্রায় পাঁচশত ছাত্র লেখাপড়া করে এই মাদ্রাসায়। ইমাম শামিল প্রতিষ্ঠিত ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ – এর জন্যে লোক তৈরির একটা কেন্দ্র এই মাদ্রাসা। এখানে যুদ্ধ বিদ্যাকে দ্বীনি শিক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ বলে ধরা হয়। দিঘির পূর্ব পাড়ে চারদিকে বাগান ঘেরা এক বিশাল মাঠ। আল্লামা ইব্রাহিম এদতিনা মাগরিবের নামায থেকে এশার আযান পর্যন্ত ছাত্রদের একটা ক্লাশ নেন। তারপর এশার নামায শেষে মসজিদ সংলগ্ন দরবার কক্ষে আধা ঘন্টার জন্যে বসেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকজনকে সাক্ষাৎ দেন। এটাই তাঁর দিনের শেষ রুটিন। তারপর তিনি ঘরে ফেরেন। খাওয়া-দাওয়ার পর রাত দশটার দিকে ঘুমাতে যান।
সেদিনও তিনি এশার নামায শেষে দরবার কক্ষে ঢুকলেন। আজ সাক্ষাতের জন্য বেশি লোক ছিল না। দুজন লোক এল। উস্কো-খুস্কো চুল। সফরের ক্লান্তি তখন তাদের চোখে-মুখে।
ওরা এখান থেকে ষাট মাইল দূরে ‘কুরা’ তীরের পার্বত্য গ্রাম ‘মুগীর’ এর বাসিন্দা। প্রায় পাঁচশ মুসলিম পরিবার নিয়ে সমৃদ্ধ গ্রামটি।
দরবার কক্ষে ঢুকেই ওরা কেঁদে উঠল। বলল, হুজুর, আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। গোটা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। সবগুলো ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে পেট্রল ছিটিয়ে ওরা আগুন ধরিয়ে দেয়। দুচারজন ছাড়া আর কেউ বেরুতে পারেনি, সবাই পুড়ে মারা গেছে। আমাদের বাগান, শস্য ক্ষেতও ওরা পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে গেছে।
ওরা থামল।
আল্লামা ইব্রাহিম এদতিনা ওদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদের সব কথা মনোযোগের সাথে শুনলেন। ওরা থামলে তার দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে নিবদ্ধ হলো। তার দৃষ্টিটা শূন্য। সেখানে যেন বাইরের অন্ধকারের মতই একটা অনিশ্চয়তা। কোন কথা বললেন না তিনি।
অনেকক্ষণ পর তাঁর দৃষ্টি বাইরে থেকে ফিরিয়ে এনে আবার নিবদ্ধ করলেন লোক দুজনের মুখের উপর।
আল্লামা এদতিনার চুল-দাড়ি সফেদ। চোখের ভ্রুও সাদা হয়ে গেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যটা অটুট আছে। প্রশস্ত ললাট। মুখে একটা পবিত্র দীপ্তি। কঠিন দুঃসংবাদেও ম্লান হয়নি। একটু গম্ভীর মনে হচ্ছে মুখ, আর তাঁর চোখে একটা বেদনার রেখা।
গম্ভীর মুখের ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল আল্লামা এদতিনার, ‘যারা বেঁচে আছে তারা কোথায়?’
পাহাড়ের ওপরে এক গুহায় আশ্রয় নিয়েছে।
খাওয়ার ব্যবস্থা?
জঙ্গলে ফল আছে।
কতজন?
তিরিশ জন। তার মধ্যে শিশু মাত্র এক, নারী দুই।
অর্থাৎ গ্রামের প্রায় তিন হাজার লোককে ওরা পুড়িয়ে মেরেছে। আল্লামা এদতিনা মুহূর্তের জন্যে তাঁর চোখটা একবার বুজেছিলেন। বোধ হয় ধাক্কাটা শামলে নিলেন তিনি।
চেখ খুলে শান্ত কন্ঠে বললেন, লোক এখনি পাঠাচ্ছি ওখানে। তোমরা খেয়ে বিশ্রাম নাও। আল্লামা এদতিনা তাঁর আসন থেকে উঠতে উঠতে বললেন, ওরা মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করতে চায় ককেশাসের মাটি থেকে। যে কোন ক্ষতির জন্যে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। আল্লাহর সাহায্য আমরা পাবই। বলে আল্লামা এদতিনা দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে চললেন।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই নাতি আবু জামাল এদতিনা এসে আল্লামা এদতিনাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, দাদু- আম্মা বলেছে, বড় হলে আমাকে যুদ্ধ করতে হবে? নাতিকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, তা তো করবেই।
যুদ্ধ করলে কি করতে হয় দাদু?
গুলী করতে হয়।
তাহলে যে মানুষ মরে যাবে, গুলী করব কেন?
তোমাকে যখন কেউ গুলী করতে আসবে?
আমাকে গুলী করতে আসবে কেন?
আল্লাহর শত্রু অনেক দুষ্ট লোক আছে দুনিয়ায়।
রাসুল (স:) যুদ্ধ করেছেন দাদু?
হ্যাঁ।
গুলী করেছেন?
আল্লামা এদতিনা মুশকিলে পড়ে গেলেন। বললেন, দাদু তখন তো বন্দুক ছিল না। তলোয়ার ছিল।
কথা শেষ করেই আল্লামা এদতিনা নাতিকে মেয়ে সালমার কোলে তুলে দিয়ে বলল, নাও তোমার সর্ব-সন্ধানী ছেলেকে।
আল্লামা এদতিনা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
আল্লামা এদতিনার বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে। মাদ্রাসার ছাত্ররাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
বাকু-নাগারনো কারাবাখ সড়কের একটা শাখা যেখানে দিঘির পূর্ব পাড়ের বাগানে এসে প্রবেশ করেছে, সেখানে দুজন প্রহরী স্টেনগান হাতে বসে । আরেক জন প্রহরী বাগানের উত্তর-পশ্চিম কোণ যেখানে শেষ হয়েছে তার কয়েক গজ সামনে দিঘির বাঁধানো পাড়ে বসে। তার হাতেও স্টেনগান। তার সন্ধানী দৃষ্টি আল্লামা এদিতনার বাড়ির দিকে। অন্য একজন প্রহরী দক্ষিণ দিক থেকে পায়ে চলা যে রাস্তাটি মাদ্রাসার পূর্ব পাশ দিয়ে উঠে এসেছে, তার মুখে দাঁড়িয়ে। আল্লামা এদতিনার বাড়ির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকটায় পাহাড়। পাহাড়গুলো আবার পানি ও জঙ্গলে পূর্ণ গভীর উপত্যকা দিয়ে ঘেরা।
রাত তখন দুটা।
আকাশে চাঁদ নেই। রাস্তার বিজলী বাতিগুলো অন্ধকারের সাথে লড়াই করে অবরুদ্ধ অবস্থায় আত্মরক্ষা করে চলেছে। রাস্তার বাতি ছাড়াও আল্লামা এদতিনার বাড়ির সামনে একটা, মসজিদের সামনে একটা, মাদ্রাসার সামনে একটা এবং পূর্ব পাড়ের দিঘির ঘাটে একটা আলো জ্বলছে। সব মিলে একটা আলো-আঁধারীর এই লুকোচুরি খেলায় আঁধারকেই বিজয়ী দেখা যাচ্ছে। কালো পোশাক পরা এক ঝাঁক লোককে অন্ধকার সাপের মত গড়িয়ে গড়িয়ে আল্লামা এদতিনার বাড়ির দিকে আসতে দেখা গেল। তারা আসছে সড়ক পথ-বাদ দিয়ে পাথর ও আগাছা ভরা নিম্নভূমি দিয়ে। পিঠে তাদের একটি করে কালো ব্যাগ আছে, একটি করে খাটো নলওয়ালা রাইফেল। কোমরে ঝুলানো পিস্তল। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে।
নিঃশব্দে তারা উঠে এল বাগানে। বাগানে উঠে ওরা ব্যাগ থেকে গ্যাস মাস্ক বের করে নিল। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে তারা তিন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল গেল উত্তর দিকে সড়কটি যেখানে এসে মিশেছে সেই দিকে। মনে হল তাদের লক্ষ্য সড়কের মুখে বসে থাকা স্টেনগানধারী দুজন প্রহরী। দ্বিতীয় দল এগলো বাগানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে। আর তৃতীয় দলটি বাগানের পূর্ব ও দক্ষিণ দিক ঘুরে সেই পায়ে হাঁটা রাস্তার মুখের দিকে এগুলো। মনে হল, তারা পরিস্কার জানে প্রহরীরা কে কোথায়।
বাগানে নানা রকম ফুল ও ফলের গাছ সারিবদ্ধভাবে লাগানো। বাগানের গাছের তলায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারকে আশ্রয় করে দুই সারির মাঝখানের সরল প্যাসেজ দিয়ে ধীরে নিঃশব্দে ওরা এগিয়ে চলল। উত্তরের দলটি সড়ক মুখে বসে থাকা সেই দুজন প্রহরীর পাঁচ গজের মধ্যে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু গাছের আড়ালে দেখা যাচ্ছে না ওদের। দুজনকে থামতে বলে দলের একজন আরো বাঁয়ে ঘুরে সামনে এগুলো। পেছনটা বাগানের মধ্যে বলে দলের একজন আরো বাঁয়ে ঘুরে সামনে এগুলো। পোছনটা বাগানের মধ্যে রেখে মাথা বাড়িয়ে পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখল, প্রহরী দুজন পূর্বদিকে তাকিয়ে বসে আছে।
হাসি ফুটে উঠল লোকটির মুখে। খাটো নল রাইফেলটি পিঠ থেকে হাতে নিয়ে পাশাপাশি দুজনের একজনকে তাক করে ট্রিগারে চাপ দিল। ক্লিক করে সাড়া দিয়ে উঠল ট্রিগারটি। সাইলেন্সার লাগানো রাইফেল থেকে দুপ করে একটি ক্ষুদ্র নিউট্রন বুলেট বেরিয়ে গেল। নিউট্রন বুলেট নিউট্রন বোমার ক্ষুদ্রতম একটি সংস্করণ। বুলেটটি নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব পার হওয়া কিংবা কারো গায়ে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে যায়। তারপর সেকেন্ডের মধ্যেই পাঁচ বর্গগজের মধ্যেকার সব প্রাণী নীরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাতাসে নিউট্রন বুলেটের কার্যকারিতা ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় না।
প্রহরী দুজন ‘দুপ’ শব্দ শুনে চমকে পেছনে তাকয়েছিল এবং ঐ ভাবেই তারা নিঃশব্দে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। তাদের শিথিল হাত থেকে খসে পড়ল স্টেনগান।
এ দলটি বাগানের পাশে অন্ধকারে বসে একটু জিরিয়ে নিল। তারপর একজন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আর্মেনিয় ভাষায় বলল, চল।
তারা তিনজন রাস্তা ধরে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলল দিঘির পাড়ের দিকে।
বাগানের কোণায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখল, দিঘির পাড়ে বসা প্রহরীটি ঢলে পড়ে আছে মাটিতে এবং মাঝখানের দলটি এগিয়ে যাচ্ছে মাদ্রাসার হোস্টেল ভবনের দিকে। পরিকল্পনা অনুসারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দলটি প্রহরীদের সরিয়ে ফেলার পর সম্মিলিতভাবে মাদ্রাসা হোস্টেলে আপারেশন চালায়। হোস্টেলের পাঁচশ নিবেদিত ছাত্রই এখানকার শক্তির উৎস। ওদেরকে আগে সরাতে হবে।
দশ সদস্যের সম্মিলিত দল উঠে গেল পাঁচ তলা হোস্টেলে। প্রতি তলায় দুজন করে। তাদের এক হাতে নিউট্রন রাইফেল, অন্য হাতে নিউট্রন স্প্রেয়ার। তারা প্রতিটি রুমে দরজার নিচ দিয়ে নল ঢুকিয়ে নিউট্রন গ্যাস স্প্রে করতে শুরু করল।
মাদ্রাসা হোস্টেলে আপারেশন শেষ করে আধা ঘন্টা পরে সম্মিলিত দলটি ফিরেএল আল্লামা এদতিনার বাড়ির সামনে পুকুরের কোণায় বসা প্রথম দলটির কাছে। অপারেশনের দ্বিতীয় পর্যায় নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হওয়ার আনন্দে ওরা হেঁটেই এল দিঘির পাড় দিয়ে।
তিনটি গ্রুপ একত্রিত হয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল এদতিনার বাড়ির দিকে।
এদতিনার বাড়ির সামনে, যেখানে পাথর বিছানো পায়ে হাঁটার রাস্তাটা শেষ হয়েছে, সেখানে একটা ছাদওয়ালা খোলা উঁচু বারান্দা। মাঝে মাঝে আল্লামা এদতিনা অবসর সময়ে চেয়ার নিয়ে এখানে বসে কারো সাথে আলাপ করেন কিংবা তাকিয়ে থাকেন দিঘির স্বচ্ছ পানির দিকে, অথবা চোখ মেলে ধরেন তিনি নীল আকাশের দিকে।
পাথর বিছানো পায়ে হাঁটা রাস্তা থেকে তিন ধাপ উঠলেই বারান্দা। বারান্দা পেরিয়ে গেলে একটা বড় দরজা। ওটা একটা হলঘর … পারিবারিক বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার হয়। বৈঠকখানা পেরুলে খাবার ঘর। খাবার ঘর থেকে বাম দিকের প্যাসেজ ধরে এগুলো আল্লামা এদতিনার শোবার ঘর।
আল্লামা এদতিনার বিরাট পরিবার।
কালো কাপড়ে সর্বাঙ্গ ঢাকা গ্যাস মাস্ক পরা ছায়ামূর্তিরা সেই বারান্দায় উঠে এল। সবাই নয়, বুকে কালা কাপড়ের ওপর সাদা নেকড়ে আঁকা দলপতিসহ চারজন। অন্যরা বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে থাকল রাইফেল বাগিয়ে প্রস্তুত হয়ে।
দলপতি লোকটা সম্ভবত লক পরীক্ষার জন্যে দরজার দিকে এগুলো। এ সময় ঝট করে দরজা খুলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই দরজা দিয়ে ছুটে এল এক ঝাঁক গুলী।
বারান্দায় দাঁড়ানো চারজন কিছু বুঝার আগেই ঢলে পড়ল ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া দেহ নিয়ে।
কিন্তু যারা বারান্দার নিচে দাঁড়িয়েছিল, তাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল গুলী। ফলে তারা বসে পড়ার এবং পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পেয়ে গেল। তাদের কয়েকজনের নিউট্রন রাইফেল থেকে সেই ‘দুপ’ আওয়াজ উত্থিত হলো। নিউটন বুলেটগুলো ছুটে গেল ভেতরে।
স্টেনগান হাতে আল্লামা এদতিনা এবং তার ছেলে আবদুল্লাহ এদতিনা গুলী করতে করতে তখন দরজা পর্যন্ত ছুটে এসেছিলেন। কিন্তু নিউট্রন বুলেট তাদের এগুতে দিলনা। পাকা ফলের মতো তাদের দেহ ঝরে পড়ল দরজার ওপরেই।
বারান্দার নিচের ছায়ামূর্তিগুলো উঠে এল বারান্দায়। কালো মুখোশের নিচে তাদের চোখগুলোতে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। তাদের কয়েকজন ছুটল বাড়ির ভেতরে। একজন চিৎকার করে নির্দেশ দিল, নিউট্রন বুলেট নষ্ট করবেনা। ওদের স্টেনগান দিয়েই ওদের সৎকার করে এস।
ভেতর থেকে ভেসে এল স্টেনগানের একটানা গুলীর শব্দ এবং শিশু ও নারীর বুকভাঙা আর্তনাদ।
কুমুখী শহরের পথে চলতে গিয়ে মনটা আনচান করে উঠল সালমান শামিলের। যে কয়টা মসিজদ সে এ পর্যন্ত পথের পাশে পেল, সবগুলো মসজিদে সবাই গোল হয়ে বসে কুরআন শরীফ পড়ছে। কোন দুঃসময়ে কিংবা বড় কেউ মারা গেলে এইভাবে সম্মিলিত ভাবে কুরআন শরীফ পড়া ককেশাসের একটা নিয়ম। শংকা বোধ করল সালমান শামিল, বড় কিছু কি ঘটেছে? আল্লামা এদতিনার কথা মনে হতেই বুকটা আবার ধড়ফড় করে উঠল সালমান শামিলের।
সালমান শামিল তার জীপের স্পীড বাড়িয়ে দিল। মুখ ফিরিয়ে উসমান এফেন্দীকে সালমান শামিল জিজ্ঞেস করল, কি বুঝছ তুমি উসমান?
নগরীর কোন লোকের মুখে হাসি দেখছি না। সবাই মাথা নত করে হাঁটছে।
কোন দোকান-পাটও খুলেনি লক্ষ্য করেছ?
ঠিক তাই তো।
এর অর্থ কি উসমান? সালমান শামিলর গলাটা কাঁপল।
উসমান কোন জবাব দিতে পারল না।
সালমান শামিলের গাড়ি যতই নাগারনো কারাবাখ – বাকু রোড হয়ে আল্লামা এদতিনার বাড়ির কাছাকাছি পৌছতে লাগল মানুষের ভীড় ততই বাড়তে লাগল।
নাগারনো কারাবাখ সড়ক থেকে যে সড়কটি বেরিয়ে আল্লামা এদতিনার বাড়ির দিকে গেছে সে সড়ক একদম লোকে ভর্তি।
ইমাম শামিলের ছেলে যুবনেতা সালমান শামিল সবার কাছে পরিচিত। তাকে দেখে সবাই পথ করে দিতে লাগল। কিছু যুবক ত্বরিৎ এগিয়ে এসে এ কাজে সহযোগিতা করতে লাগল।
কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস হলো না সালমান শামিলের। সালমান শামিলকে দেখে অনেকেই কেঁদে ফেলেছে, বিশেষ করে যুবকরা। সালমান শামিলের কিছু বুঝার বাকি রইল না। তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল বেদনায়।
কিন্তু আল্লামা এদতিনার বাড়িতে পৌঁছার পর যে দৃশ্য দেখল, তাতে সালমান শামিল একদম যেন বোবা হয়ে গেল। এত নিষ্ঠুরতা, এত বর্বরতাও কোন মানুষ করতে পারে। মাদ্রাসার পাঁচশ’ ছাত্রের কেউ বেঁচে নেই। প্রত্যেকে যে যার সিটে বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু কারও প্রাণ নেই। ওদের চেহারা দেখেই বিজ্ঞানের ছাত্র সালমান শামিল বুঝল, ভয়াবহ নিউট্রন গ্যাসের ফল।
আল্লামা এদতিনার বৈঠকখানার দরজায় চৌকাঠের ওপর তখন আবদুল্লাহ এতদিনা পড়ে আছে। বাড়ির সব নারী-শিশু একটি ঘরে রক্তে ভাসছে। আল্লামা এদতিনার অতি আদরের নাতি আবু জামাল এদতিনা মায়ের কোলের ভেতরই বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। মা হয়তো কোলে লুকিয়ে নিজের জীবন দিয়ে তাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মা এবং ছেলে কেউই বাঁচেনি।
কিন্তু আল্লামা এদতিনাকে কোথাও পাওয়া গেল না। হঠাৎ সালমান শামিলের খেয়াল হলো, আগের পচিঁশজনকে জীবিত কিংবা মৃত কোন ভাবেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই তালিকায় আল্লামা এদতিনাকে পাওয়া যাবে কেমন করে?
সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে সালমান শামিল ‘কুমুখী’র ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’- এর প্রধান লতিফ কিরিমভকে বলল, আল্লামা হুজুর যে শেষ মুহূর্তে জানতে পেরেছিলেন এবং প্রতিরোধ করেছিলেন বারান্দার রক্তগুলোই তার প্রামাণ। নিশ্চয় তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন আহত-নিহত হয়েছে। আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করল, আবদুল্লাহ এদতিনার দেহে কোন গুলীর দাগ বা আঘাতের চিহৃ নেই। সেও নিউট্রন গ্যাসের শিকার। নিউট্রন বুলেটই তাদের প্রতিরোধকে সফল হতে দেয়নি।
সালমান শামিল বারান্দার মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখতে পেল সিঁড়ির নিচে ভাঁজ করা একটা কাল কাগজ। কাগজটি তুলে নিয়ে ভাঁজ খুলে দেখল, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, আজারবাইজান, পারস্য ও তুরস্কের একটা অংশ নিয়ে বৃহত্তর আর্মেনিয়ার একটা মানচিত্র। তার ভেতরে সাদা একটা নেকড়ে আঁকা। কাগজটি লতিফ কিরিমভের হাতে তুলে দিতে দিতে সালমান শামিল বলল, ‘হোয়াইট উলফ’ তার চিহ্ন রেখে গেছে।
বারান্দার নিচে এবং দিঘির চারধার ঘিরে তখন হাজারো মানুষের ভীড়। লতিফ কিরিমভ বলল, সালমান শামিল ভাই, ভয়, আশংকা এবং শোকে মানুষ মুষড়ে পড়েছে। আপনিই এখন উপযুক্ত ব্যক্তি তাদের সান্ত্বনা দেবার জন্যে। আপনি কিছু বলুন। লোকজনকে এদিকে ডাকার জন্য আমি বলে দিয়েছি।
একজন ঘোষক ঘোষণা করে দিয়ে এল।
মানুষ এগিয়ে এল আল্লামা এদতিনার বাড়ির দিকে।
সালমান শামিল একটা টেবিলের ওপর দাঁড়ালেন। তারপর জনতার উদ্দেশ্যে বললেনঃ
ভাই সব, খৃষ্টানদের সংগঠন, ‘হোয়াইট উলফ’ অন্যান্য ঘটনার মত এ ঘটনার জন্যেও দায়ী। তারা চায় আমাদেরকে আমাদের মাতৃভূমি থেকে উৎখাত করে তাদের স্বপ্নের বৃহত্তর আর্মেনিয়া গঠন করতে। তাদের সাহায্য করছে কম্যুনিষ্ট দেশ রাশিয়া রিপাবলিক এবং পশ্চিমের কিছু খৃষ্টান দেশ। আমাদের সহায় আল্লাহ। ইতিহাস সাক্ষী, তাদের সব যড়যন্ত্রই অতীতে আমরা ব্যর্থ করে দিয়েছি। এ নতুন যড়যন্ত্রও আমরা ব্যর্থ করে দেব। আপনাদের সংগঠন ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ তাদের জঘন্য ও কাপুরুষোচিত কাজের উপযুক্ত জবাব দেবে। আমি আনন্দের সাথে ঘোষণা করছি, বিশ্বের মজলুম মুসলমানদের নেতা অনেক বিপ্লবের মহানায়ক আহমদ মুসা দুএকদিনের মধ্যেই আমাদের মধ্যে আসছেন। তিনি আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। ইমাম শামিল যে কাজ শেষ করে যেতে পারেননি, তা ইনশাআল্লাহ তিনি শেষ করবেন।
উপস্থিত শোক-সন্তপ্ত জনতা সমবেত কণ্ঠে ‘আল্লাহ আকবার’ ধ্বনি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল।
সালমান শামিল নেমে এল টেবিলের মঞ্চ থেকে। লতিফ কিরিমভকে বলল, শহীদদের দাফনের কি ব্যবস্থা হয়েছে?
জেলা গভর্নর শহিদভ সকালেই এসেছিলেন। তিনি সব ব্যবস্থা করছেন।
বলল লতিফ কিরিমভ।
এখানকার সব ব্যাপার গুছিয়ে নেয়ার দায়িত্ব কে পালন করবে? এ চিন্তার দায়িত্ব এখন আপনার।
ঠিক আছে, কুমুখীর ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’- এর প্রধান হিসেবে এখানকার দায়িত্ব তোমাকেই পালন করতে হবে।
আহমদ মুসা কবে আসছেন?
দুএকদিনের মধ্যেই আশা করছি।
তাকে বাধা দেবার জন্য ‘হোয়াইট উলফ’ রাশিয়া ও পশ্চিমের সহযোগিতায় সব ব্যবস্থাই করেছে শোনা যাচ্ছে।
আমি ইয়েরেভেনে থাকার জন্য বিস্তারিত ব্যাপারটা জানি না। জানতো আল্লামা হুজুর। আর জানে বাকুতে যে সাইমুম ইউনিট এসেছে তারা। তবে আমি এটুকু জানি, আহমদ মুসাকে বাধা দেয়ার সাধ্য ‘হোয়াইট উলফ’ এবং তার মুরুব্বীদের নেই।
এ সময় একটি গাড়িতে করে আজারবাইজান সরকারের ‘কুমুখী’ জেলার গভর্নর আহমদ শহিদভ এবং আরও কয়েকজন আল্লামা এদতিনার বাড়ির সামনে এসে নামল।
গাড়ি থেকে নেমে ওরা এসে জড়িয়ে ধরল সালমান শামিলকে। শহিদভের চোখে অশ্রু।
লতিফ কিরিমভের কাছে শুনেছি দাফন সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আপনারা নিয়েছেন। এটা আপনাদের সরকারের অনুমতিক্রমে? জিজ্ঞাসা করল সালমান শামিল।
সরকার এ ব্যাপারে বিরোধিতা করবে না, অনুমতিও দিতে পারবে না। কিছু জানে না এই ভূমিকা পালন করবে।
সালমান শামিলের মুখে একটা বেদনার হাসি ফুটে উঠর। বলল, এই নতজানু ভূমিকা কি সরকারকে রক্ষা করতে পারবে?
সালমান শামিল ভাই, আমি গত পরশু দিন বাকুতে ছিলাম। ঐ দিন রুশ, বৃটিশ ও মার্কিন এমবাস্যাডর আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। তারা বলে দিয়েছেন, ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’-এর মত সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে আজারবাইজন সরকার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে তারা আজারবাইজানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আপনাদের প্রধানমন্ত্রী ‘হোয়াইট উলফ’-এর হত্যা, সন্ত্রাস ও পোড়ামাটি নীতি সম্পর্কে কিছু বলেননি? বলেনি যে, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া এবং তারাও কিভাবে ‘হোয়াইট উলফ’ কে সাহায্য করছে?
বলেছে। কিন্তু তাদের বক্তব্য হলো, এসব হত্যা, সন্ত্রাস মুসলমানদের আভ্যান্তরীন গ্রুপ দ্বন্দ্বের ফল এবং ‘ককেশাস ক্রিসেন্টে’র কারণেই এসব ঘটেছে। ‘হোয়াইট উলফ’ নামে কোন সংগঠনকে তারা চেনে না।
সালমান শামিল হাসল। একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে। আমরা জানি, মুসলমানদের আল্লাহ ছাড়া কোন বন্ধু নেই, আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারী নেই। আমরা তাঁরই ওপর নির্ভর করছি।
বলে সালমান শামিল, লতিফ কিরিমভের দিকে ফিরে বলল, লতিফ তুমি এঁদের সাথে শহীদদের দাফনের আয়োজন কর। আমি আল্লামা হুজুরের অফিসটা একটু চেক করি।
মসজিদের পাশে দরবার কক্ষের সাথে সংলগ্ন ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’-এর নাম সাইনবোর্ডহীন সদর দফতর। আল্লামা এদতিনা এখানেই বসতেন।
সালমান শামিল বারান্দা থেকে নেমে ঐ অফিসের দিকে চলে গেল।
পর্ব ৬
বাকুর ‘ককেশাস সিক্রেট’ প্রধান মুহাম্মদ বিন মুসার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করে এবং বাকুতে অবস্থানরত সাইমুম প্রতিনিধি দলের নেতা আলী আজিমভের সাথে প্রয়োজনীয় আলোচনা সেরে সালমান শামিল সেদিন রাতেই ইয়েরেভেনে ফিরে এসেছে। ‘কুমুখী’ ও ‘মুগী’ গ্রামের ভয়াবহ হত্যাকান্ড এবং আল্লামা ইব্রাহীম এদতিনার হারিয়ে যাওয়া সালমান শামিলকে অস্থির করে তুলেছে। ‘হোয়াইট উলফ’ দেখা যাচ্ছে ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’-এর সব কিছুই জানে এবং তাদের পরিকল্পনা মুতাবিক একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে, কিন্তু ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ তাদের কোন নাগালই পাচ্ছেনা। তাদের একজন লোকেরও পরিচয় জানা যায়নি। তাদের বিরুদ্ধে ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ কার্যত এক ইঞ্চিও এগুতে পারেনি। এই ব্যর্থতার বেদনা সালমান শামিলের অন্তরকে স্থির থাকতে দিচ্ছেনা। আল্লামা ইব্রাহিম এদতিনার হারিয়ে যাওয়ার পর আন্দোলন পরিচালনার বিরাট দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করা হয়েছে। সাংগঠনিক অনেক কাজ তার পড়ে রয়েছে। এরপরও কিছুমাত্র দেরি না করে ছুটে এসেছে ইয়েরেভেনে। তার আশা এখান থেকেই সে সামনে এগুবার একটা ‘ক্লু’ পাবে।
সালমান শামিলের লক্ষ্য সোফিয়া এঞ্জেলা। তার ধারণা সোফিয়া এঞ্জেলার কাছ থেকে একটু সূত্র পাওয়া যাবে। সালমান শামিলকে সাবধান করার মত ‘এ্যকুরেট’ খবর সোফিয়া যে সূত্র থেকে পেয়েছে, সে সূত্র ধরে এগুলেই, সালমান শামিলের বিশ্বাস, ‘হোয়াইট উলফ’ এর একটা ঠিকানায় পৌঁছা যাবে।
সালমান শামিল ও উসমান এফেন্দী ভোরে এসে পৌঁছেছে ইয়েরেভেনে। এসে ফজরের নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ঘুম থেকে উঠল সকাল আটটায়। হাতমুখ ধুয়ে এসে দেখল টেবিলে সেদিনের কাগজ। সালমান শামিল কাগজটি হাতে নিয়ে আরেকবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কাগজের এক জায়গায় গিয়ে চোখ আটকে গেল সালমান শামিলের।
আগের দিন রাতে সালমান শামিলের ঘরে যে অভিযান পরিচালিত হয়েছিল, তার ওপর রিপোর্ট করেছে পত্রিকাটি। শিরোনাম দিয়েছে, ‘নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের দেশ বরেণ্য কৃতি ছাত্র এবং ইনস্টিটিউট অব এডভানস্ড নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’- এর চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র সালমানকে বাসভবন থেকে কে বা কারা অপহরণ করেছে। অকুস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে এই রিপোর্ট দেখেছে, অত্যাধুনিক ল্যাসার বীম দিয়ে দরজার তালা গলিয়ে ফেলে তার ঘরে প্রবেশ করা হয়। ওয়াকিফহাল মহলের ধারণা একটি শক্তিশালী মহল সুপরিকল্পিতভাবে এই কাজ করেছে। এ ব্যাপারে তার প্রতিবেশী জনাব খলিলভ থানায় একটা মামলা দায়ের করেছে। পুলিশী তদন্ত চলছে। পুলিশ এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করেনি।’
খবর পড়ে মাথায় হাত দিল সালমান শামিল। কি ঝামেলা। এখন আবার থানায় যেতে হবে, বলতে হবে আমি অপহৃত হইনি। তা বললেই ঘটনার শেষ হয়ে যাবেনা। অপহরণকারীরা কারা এসেছিল, তাদের ব্যাপারে কতটুকু জানি, ইত্যাদি নানা রকম সাক্ষ্য দেয়ার ঝামেলায় তাকে পড়তে হবে। তাছাড়া তার ইনস্টিটিউটেতো এ নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেছে। এতো সব ঝামেলায় সে জড়িয়ে পড়তে চায়না।
অনেক চিন্তা ভাবনা করে সালমান শামিল থানার জন্যে জবানবন্দী তৈরী করে উসমান এফেন্দীর হাতে দিয়ে বলল, এটা তুমি খলিলভকে দিয়ে এস। সে থানায় পৌছেঁ দেবে এটা। থানায় খলিলভ যেন বলে, নিরাপত্তার কারণেই আমি কয়েকদিন বেরুতে পারবেোনা।
উসমান এফেন্দীকে পাঠিয়ে দিয়ে সালমান শামিলও বেরিয়ে পড়ল ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্যে। তখন বেলা সড়ে আটটা। দশটায় ইনস্টিটিউটের ক্লাস শুরু হয়। ছেলেদের কাছে অন্তহীন জবাবদিহির ঝামেলা এড়াবার জন্যে সে আগেই ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টরের সাথে দেখা করে সব কথা বলে সোফিয়ার সাথে কথা বলা যায় কিনা চেষ্টা করে আজকের মত সরে পড়তে চায়।
ইনস্টিটিউটের পাশেই ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর পল জনসনের বাড়ি। ভদ্রলোকের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। দীর্ঘ দেহ। ব্যায়াম পুষ্ট সুগঠিত দেহ। মনেই হয়না যে, বয়স তার চল্লিশের বেশি হবে। মুখে হাসি সব সময় লেগেই থাকে যেন। অথচ সে হাসে অত্যন্ত কম। তাঁর মুখে হাসি হাসি ভাবটা আসলে তার শিশুসুলভ সারল্যের দীপ্তি। একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, জ্ঞানের একজন নিবেদিত সাধক সে। ভাল ছাত্ররা তার কাছে সন্তানের চেয়েও প্রিয়।
সালমান শামিল এসে ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক ভবনের কাছে গাড়ি থেকে নামল।
প্রশাসনিক ভবনের নিচের তলাতেই ড. পল জনসনের অফিস। ঢুকতেই বাম পাশের প্রথম ঘরটি।
সালমান শামিল অফিসের বারান্দায় উঠতেই একজন বেয়ারা মুখোমুখি হলো। সালমান শামিলকে দেখে ভুত দেখার মতই সে দাড়িয়ে গেছে। বলল, শুনলাম স্যার, আপনি না …
সালমান শামিল তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল, হ্যাঁ আমি ফিরে এসেছি।
বলে সে দ্রুত ডিরেক্টরের অফিসের দিকে চলে গেল।
কিন্তু বেয়ারাটি চলে গেলনা, সালমান শামিল ড. পল জনসনের অফিসে ঢোকা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল অফিসের সিড়িঁর ওপর।
সালমান শামিল দরজার লক ঘুরিয়ে একটু ফাঁক করে দেখল ড. পল জনসন এক মনে টেবিলে কাজ করছেন।
স্যারকে এই সময় বিরক্ত করার ব্যাপারে সালমান শামিল একটু দ্বিধা করল। কিন্তু পর মুহূর্তেই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলল, আসতে পারি স্যার?
ড. পল জনসন চমকে উঠে মাথা তুলল। সালমান শামিলের উপর চোখ পড়তেই তাঁর শিশু সুলভ চোখে একটা আনন্দের দীপ্তি চিকচিক করে উঠল। ছোট্ট করে সে বলল, এস বৎস।
সালমান শামিল গিয়ে তাঁর টেবিলের কাছে দাঁড়াল। ড. জনসন তাঁর চোখ দুটি সালমান শামিলের ওপর থেকে সরায়নি। তাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, বস।
ড. জনসনের হাসি মাখা মুখ। বলল, বোধ হয় বলতে এসেছ যে, তুমি অপহৃত হওনি?
জি স্যার।
জান, আমি ঘটনার কথা খুটিয়ে খুটিয়ে শুনেছি। যখন শুনলাম, তোমার ঘুমানোর পোশাকটা বিছানার উপর পড়ে আছে, তখনই আমি বুঝেছি তুমি অপহৃত হওনি, সরে পড়তে পেরেছ।
আমি সেদিন বিছানায় ঘুমোতেই যাইনি স্যার প্যান্ট-শার্ট পরা অবস্থায় সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
কিছুক্ষণ কথা বলল না ড. পল জনসন. তার চোখটা বুজে গেছে। কিছু একটা চিন্তা করছে সে। ঐ অবস্থাতেই সে প্রশ্ন করল, কিছু চিন্তা করেছ, কারা তোমার সে শক্র?
কারা তা জানতে পারিনি স্যার।
সালমান শামিল ইচ্ছা করেই ‘হোয়াইট উলফ’-এর নাম গোপন করল
আমি চিন্তা করেছি বৎস। প্রথমে ভেবেছিলাম, তোমার অসাধারণ প্রতিভার প্রতি হিংসা পরায়ন কেউ এটা করতে পারে। কিন্তু পরে মনে হয়েছে তা নয়। তোমার শক্রু আরও বড় কেউ।
বলতে বলতে ড. পল জনসনের হাসি মাখা মুখটা ম্লান হয়ে গেল।
কে হবে স্যার?
আমি জানি না, তবে আমার মনে হয়েছে গোটা ককেশাসে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসটা চলছে তার সাথে তোমার ব্যাপারটা নিঃসম্পর্ক নয়।
মুহূর্ত কয়েক থেমেই আবার শুরু করল, তোমাকে নিয়ে সত্যিই আমি উদ্বিগ্ন বৎস।
কেন স্যার?
তোমার বিপদ কাটেনি। আমি তোমাকে ইনস্টিটিউটে আসা এ্যালাও করবোনা। এতে তোমার ক্ষতি হবে। কিন্তু তোমার প্রতিভার মূল্য তার চেয়ে অনেক বড়। আমি আগে জানতে পারলে তোমার এই আসাও আমি এ্যালাও করতামনা। তুমি এখান থেকে ফিরে যাও এখনি।
ড. পল জনসনের মুখটা গম্ভীর।
তাহলে ইনস্টিটিউটে যাব না?
না।
স্যার সোফিয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।
হ্যাঁ তার সাথে তুমি দেখা করতে পার। বড় ভাল মেয়ে। তোমার খবর শুনে কেঁদে কেঁদে একাকার। আমাকে এসে বলেছে, আমি পুলিশকে বলে দেই পুলিশ যেন তোমার অনুসন্ধানের ব্যাপারে কোন গাফলতি না করে।
তাহলে উঠি স্যার।
কোথায় যাবে?
সোফিয়া তো এখন লাইব্রেরীতে এসেছে।
না তুমি যাবে না।
একটু উচ্চ কণ্ঠে বলল ড. পল জনসন। রাগ ফুটে উঠল তাঁর কণ্ঠে। একটু থেমেই আবার সে বলতে শুরু করল, আমি চাই তুমি কারো চোখে না পড়। শোন সালমান, পরাজয়ের প্রতিহিংসা আরও ভয়ংকর। যাদের সেদিন পরাজিত করেছ, তারা কি পরাজয় মেনে নিয়েছে ভেবেছ?
ড. পল জনসনের এই কথা সালমান শামিলের মনকেও কাঁপিয়ে দিল। সালমান শামিল সত্যিই ব্যাপারটাকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেনি। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে, চারিদিকেই শত্রুর চোখ। খোলামেলা চলতে সে পারে না।
সালমান শামিল মাথা নিচু করে বলল, এখন আমি বুঝতে পেরেছি স্যার।
ড. পল জনসন টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বলল, সালমান, পাশে আমার রেস্ট রুমে গিয়ে বস। আমি সোফিয়াকে ডেকে পাঠাচ্ছি।
সালমান শামিল ড. জনসনের অফিস থেকে বেরিয়ে এসে প্রবেশ করল রেস্ট রুমে।
দুমিনিট পরেই সোফিয়া এসে উঁকি দিল ড. জনসনের রুমে।
কালো স্কার্টের ওপর কালো শার্ট পরেছে সোফিয়া।
ড. জনসন মাথা নিচু করে টেবিলে কাজ করছিল। সোফিয়া বলল, আসব সার?
আমার রেস্ট রুমে যাও। মাথা না তুলেই বলল ড. জনসন।
সোফিয়া এঞ্জেলা দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস পেল না, কিন্তু বুঝলনা কেন সেখানে যাবে। ডেকেছিলেন তো তিনি। ঐ রুমে তো কাউকে তিনি প্রবেশ করতে দেন না।
আস্তে আস্তে গিয়ে লক ঘুরিয়ে দরজা খুলল রেস্ট রুমের। উকি দিল ভেতরে। সালমান শামিলের ওপর নজর পড়তেই চমকে উঠল সোফিয়া। মুহূর্ত কয়েক তার নড়ার শক্তি থাকলনা।
সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজে বসেছিল সালমান শামিল। সে টের পেলনা দরজার দাঁড়ানো সোফিয়াকে।
দরজায় কয়েক মুহূর্ত দাড়িয়েঁ সোফিয়া ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল সোফার ওপর। সালমান শামিলের একটা হাত ছড়ানো ছিল সোফায়। সোফিয়া উপুড় হয়ে আঁকড়ে ধরেছে সে হাত। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলছে, তুমি বেঁচে আছ সালমান, আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, তুমি পেরেছ ওদের হাত থেকে ছুটে আসতে।
সালমান শামিলও মুহূর্তের জন্যে বিমুঢ় হয়ে পড়ল সোফিয়ার এমন ভেঙ্গে পড়ায়। সালমান শামিল এতটা আশা করেনি।
সালমান শামিল হাত টেনে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারলনা, বলল, শান্ত হও সোফিয়া। বলেছি না যে জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।
একটু থেমে সালমান শামিল আবার বলল, তুমি সেদিন সাবধান না করলে আমি হয়তো কিছু বুঝতে পারতাম না, পালাতেও পারতমাম না।
মুখ তুলল সোফিয়া। অশ্রু ধোয়া তার মুখ। বলল, ওরা তোমার ধরতে পারেনি?
না।
তাহলে তুমি কোথায় ছিলে? কাগজে নিউজ বেরুল। আমরা এদিকে অস্থির।
‘আমরা’ কে, শুধু তো তুমি?
না, তুমি ডিরেক্টর স্যারকে জান না। তিনি তোমাকে ছেলের চেয়েও বেশি ভালবাসেন।
সোফিয়া এঞ্জেলা শান্ত হয়ে সোফায় সালমান শামিলের পাশে বসল।
তুমি নাকি খুব কেঁদেছিলে? বলল সালমান শামিল।
কে বলল?
ডিরেক্টর স্যার।
তুমি কি চেয়েছিলে ? আমি হাসি?
হাসলে কি হতো?
কিছুই হতো না। কিন্তু তোমার মত কি সব মানুষ পুস্তকের পাতায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে বসে আছে। তাদের একটা মন আছে।
মন তো অনেকেরই আছে, কিন্তু কেউ তো কাঁদেনি?
যার ইচ্ছা কেঁদেছে। সে কথায় তোমার কাজ নেই। এখন বল, স্যারের এ নিষিদ্ধ রুমে কেন?
স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। স্যার লাইব্রেরীতে যেতে দেয়নি।
কেন?
স্যার আমার নতুন বিপদের ভয় করছেন। স্যার বলেছেন, তিনি আগে জানতে পারলে ইনস্টিটিউটে আসতেই তিনি আমাকে নিষেধ করতেন।
তিনি এতটা আশংকা করছেন? মুখ কালো করে বলল সোফিয়া।
তিনি বলেছেন পরাজিত শত্রুরা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
উদ্বেগ ফুটে উঠল সোফিয়ার চোখে-মুখে। কি চিন্তায় যেন সে ডুবে গেল। ধীরে ধীরে তার চোখে-মুখে উদ্বেগের স্থলে ভয় ও আতংক ফুঠে উঠল। বলল, স্যার ঠিকই বলেছেন সালমান। তোমার ইনস্টিটিউটে আসার তাহলে কি হবে, পরীক্ষা সামনে, কেমন করে পরীক্ষা দেবে?
সালমান শামিল মুখে হাসি টেনে বলল, ইনস্টিটিউটে আসতে পারবনা, পরীক্ষা দিতে পরবনা। তুমি খুশি হবে।
খুশি হব? বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলেল বলল সোফিয়া।
হ্যাঁ। ইনস্টিটিউটে শেষ পরীক্ষাটায় তুমি প্রথম স্থান অধিকার করবে।
মুহূর্তে বেদনায় নীল হয়ে গেল সোফিয়ার মুখ। বোবা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল সালমান শামিলের দিকে। তার চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু খসে পড়ল তার গন্ডে। বলল, সালমান তুমি এত নিষ্ঠুর! তুমি এত কম মূল্যে মানুষকে বিচার কর! তুমি কি জান না, তোমার রেজাল্ট নিয়ে আমার চেয়ে বেশি গর্ব আর কেউ করেনা? বলে দুহাতে মুখ ঢাকল সোফিয়া।
সালমান শামিল গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আমি ওটা কথার কথা বলেছি সোফিয়া। তুমি এতটা সিরিয়াসলি……
সালমান শামিলকে বাধা দিয়ে সোফিয়া বলল, না এ সময় তুমি এমনভাবে কথা বলতে পারনা।
স্বীকার করছি, এভাবে বলা আমার ভুল হয়েছে।
কোন বিষয়ই, বিশেষ করে নিজের ব্যাপার, তুমি সিরিয়াসলি নাও না। এটা তোমার দোষ।
স্বীকার করছি সোফিয়া। সোফিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, এখন কি করবে ভাবছ?
স্যার বলেছেন, সরে থাকতে হবে কিছু দিন।
কত দিন?
আমি জানি না।
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, সোফিয়া। সে নত মুখে শার্টের বোতাম খুটছিল। এক সময় সে মুখ তুলল। বলল, আমার সাথে দেখা হবে না?
যদি সম্ভব না হয়?
তোমার কোন খবর জানাবে না?
চেষ্টা করব।
দুজনেই নীরব। মাথা নিচু করে বসে আছে সোফিয়া। সালমান শামিল একবার সে নত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব সোফিয়া?
সোফিয়া মুখ তুলে বলল, কর।
সালমান শামিল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলল, আমার বিপদ আসছে, এ খবর তুমি কার কাছ থেকে পেয়েছিলে?
সোফিয়া এঞ্জেলা মাথা তুলে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সালমান শামিলের দিকে তাকাল। বলল, এ তথ্যের কি তোমার খুব বেশি প্রয়োজন?
শত্রুকে না চিনলে আমি তার কাছ থেকে কিভাবে আত্মরক্ষা করব?
সোফিয়া আবার কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তার মুখ নিচু, গম্ভীর। কালো বেদনার একটা ছায়া তার গোটা মুখে। একটা যন্ত্রণা যেন তার চোখ-মুখ থেকে ঠিকরে পড়েছে।
সালমান শামিলসেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বলল, আমি চাপ দেব না সোফিয়া।
সোফিয়া চোখ তুলল। তার চোখ জলে ভরা। বলল, সালমান তোমাকে অদেয় আমার কিছু নেই।
তার চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি খসে পড়ল।
সোফিয়া চোখ মুছে বলল, আমার বাবা, আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি।
তোমার বাবা?
বিস্ময় ঝরে পড়ল সালমান শামিলের কণ্ঠে।
সোফিয়া মুখ তুলে স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, আমি জানতে পেরেছি আমার বাবা ‘হোয়াইট উলফ’-এর একজন নেতা।
সালমান শামিল কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে বসে রইল। কোন কথা বলতে পারছিলনা; অনেকক্ষণ নীরবতার পর বলল, তোমাকে বললেন কেন?
না, আমাকে বলেনি। বলে একটু থামল সোফিয়া। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল:
একদিন রাত দশটা। আবার শোবার ঘরের পাশ দিয়ে আসছিলাম। হঠাত আবার একটা কথা আমার কানে গেল। আব্বা আম্মাকে বলছেন, ‘একটা বিরল প্রতিভার মৃত্যু হল এলিজা।‘ আব্বার এই কথা শুনে কৌতুহলবশত আমি থমকে দাঁড়ালাম।
কে, কোন প্রতিভা? মা, প্রশ্ন করলেন আব্বাকে।
সালমান শামিল। বললেন আব্বা।
সালমান মারা গেছে? কবে? সোফিয়া তো বলেনি কিছু? মা বিস্ময় প্রকাশ করলেন।
মরেনি, মরার পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে।
কি বলছ তুমি ?
হ্যাঁ এলিজা–‘হোয়াইট উলফ’ এর ‘প্রতিরোধ নির্মূল’-এর পরিকল্পনায় সালমান শামিলের নামও এসেছে। অতএব তাকে মরতে হবে।
এর কোন নড়চড় হতে পারে না? উৎকণ্ঠার সাথে মা বললেন।
না । বরং তার নাম অনেক পরে ছিল, তাকে সামনে আনা হয়েছে।
যতই বল এটা অন্যায় অযৌক্তিক নিষ্ঠুরতা।
এলিজা, মুখ সংযত কর। দরকার হলে ‘হোয়াইট উলফ’ কিন্তু হাসতে হাসতে তোমার বুকেও ছুরি বসাতে পারে। এর কাছে কোন ব্যক্তি নয় , জাতি বড়।
আম্মাকে ধমক দিয়ে আব্বা এই কথাগুলো কঠোর ভাষায় বললেন।
তাদের মধ্যে আর কি কথা হয়েছিল জানি না আমি। আমার সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার মত অবস্থা ছিল না। আমি কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে ফিরে এসেছিলাম। তার পরদিনই আমি তোমাকে সাবধান করেছি।
থামল সোফিয়া এঞ্জেলা। দু’জনেই চুপচাপ। কারো মুখেই কোন কথা নেই। দেয়াল ঘড়িতে দশটা বাজার শব্দ হলো।
সালমান শামিল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোমার ক্লাসের সময় হলো, তুমি যাও সোফিয়া। সোফিয়াও উঠে দাঁড়াল। বলল কিছু বললে না?
কি বলব? আল্লাহই আমার ভরসা। স্লান হেসে বলল সালমান শামিল। দু’জনে চলতে শুরু করল। দরজার কাছাকাছি এসে সোফিয়া সালমান শামিলের হাত চেপে ধরে বলল,সালমান, ডিরেক্টর স্যার ঠিকই বলেছেন। তুমি খুব সাবধানে থেকো। তুমি তোমার ওপর অবহেলা করো না।
সালমান মুখটা ঘুরিয়ে সোফিয়ার দিকে ফিরে বলল, তুমি দেখেছ আমি অসাবধান নই সোফিয়া। বাকি আল্লাহর হাতে। বলে সালমান শামিল বেরিয়ে এল ঘর থেকে। তার সাথে সোফিয়াও।
করিডোরে বেরিয়ে সালমান শামিল সালমান একবার ডক্টর পল জনসনের দরজার দিকে তাকাল। কিন্তু তাকে আর বিরক্ত করা ঠিক মনে করল না। সে বারান্দার সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে এল নিচের নলে।
ওখানেই তার গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সালমান শামিল গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে সালমান শামিল একবার ফিরে চাইল বারান্দার দিকে। দেখল সেখানে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে সোফিয়া এঞ্জেলা।
সালমান শামিল হাত তুলল। সোফিয়াও হাত তুলে বিদায় জানাল।
স্টার্ট দিয়ে সালমান শামিলের গাড়ি তীরের মত বেরিয়ে গেল ইন্সটিটিউটের গেট দিয়ে রাস্তায়। সেই পথের দিকে তাকিয়ে অচল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল সোফিয়া এঞ্জেলা। গাড়ি তার দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে অনেক্ষন। কিন্তু পথের ওপর তার শূন্য দৃষ্টিটা আটকে আছে।
এই সময় প্রচণ্ড একটা ধাতব সংঘর্ষের তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে এল বাগানের ওপার থেকে। বাগানের ওপারেই জন পল রোড।
শব্দটি সোফিয়া এঞ্জেলার মনকেও কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু তার তন্ময়তা ভাঙতে পারল না।
শব্দটি বাতাসে মিলিয়ে যাবার অল্পক্ষণ পরেই গেটের দারোয়ান ছুটে এল। হন্ত-দন্ত হয়ে সে গিয়ে ঢুকল ডক্টর জনসনের ঘরে।
বিস্মিত সোফিয়া এঞ্জেলাও এক পা, দু’পা করে এগুচ্ছিল ডক্টর জনসনের ঘরের দিকে।
এই সময় ডক্টর জনসন দারোয়ানের সাথে দ্রুত বেরিয়ে এল তার ঘর থেকে। উদ্বিগ্ন তার চখ-মুখ। সোফিয়া এঞ্জেলাকে সামনে পেয়ে বলল, শুনেছ?
কি স্যার?
সোফিয়া এঞ্জেলার চখে-মুখে উদ্বেগ।
দারোয়ান বলছে, আমাদের গেটে একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। এ্যাকসিডেন্টে সালমান শামিলের জীপ উল্টে যায়।
একটু দম নিল ডক্টর জনসন। তারপর কথা শুরুর আগেই অধৈর্য সোফিয়া এঞ্জেলা বলল, সালমান শামিল কোথায়?
তার কথা আর্ত চিৎকারের মত শোনাল।
ও জীপ থেকে ছিটকে পড়ে। একটা মাইক্রোবাস তাকে তুলে নিয়ে গেছে। কথা শেষ করেই ডক্টর পল জনসন বারান্দার সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। বলল, এস তোমরা।
সবাই এসে গেটে দাঁড়াল।
গেটের পর প্রায় সাত ফুটের মত ফুটপাত। তারপর শুরু হয়েছে রাস্তা। সালমান শামিলের জীপটি গেটের ডান দিকে প্রায় গজ দশেক দূরে রাস্তার ওপর উল্টে পড়ে আছে।
দারোয়ান জানাল, সালমান শামিলের জীপটি রাস্তায় উঠে যখন ডান দিকে মোড় নিতে যাচ্ছিল, তখন উত্তর দিক থেকে একটা ট্রাক আসে। তার সাথে ধাক্কা খেয়ে জীপটি উল্টে যায়। সালমান শামিল রাস্তার ওপর ছিটকে পড়েই উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। এই সময় একটা মাইক্রোবাস এসে তার পাশে দাঁড়ায়। মাইক্রোবাস থেকে দু’জন লোক নেমে তাকে মাইক্রোবাসে টেনে তোলে।
সেন্ট জন পল রোড বাম দিকে ইন্সটিটিউটের একাডেমী ভবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়েছে। ওদিক থেকে ট্রাক এল কেন? আর যেখানে ট্রাকটা এসে জীপের সাথে ধাক্কা খেয়েছে, এত বড় রাস্তা ফেলে সেখানে ট্রাকটা এল কেন? এক্সিডেন্টের পর যে উঠে দাঁড়াতে পারে, তাকে তুলে নিয়ে মাইক্রোবাসটি ঐভাবে চলে গেল কেন?
এ প্রশ্ন সামনে আসার পর ডক্টর জনসন অজান্তেই যেন দু’হাতে তার মাথা চেপে ধরল। একটা যন্ত্রনা যেন অনুভব করছে সে। অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘মাই ইলফেটেড বয়’।
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সোফিয়া এঞ্জেলা। উদ্বেগে সে যেন কাঁপছে। বলল, স্যার হাসপাতালে দয়া করে খোঁজ নিন। না হয় চলুন হাসপাতালে।
ডক্টর জনসন ধীরে ধীরে ফিরল সোফিয়া এঞ্জেলার দিকে। তাঁর মুখ বেদনার্ত, গম্ভীর। বলল, মাই ডটার, হাসপাতালে ওকে পাওয়া যাবে না।
কেন স্যার? আর্তস্বরে বলল সোফিয়া এঞ্জেলা।
যাকে এ্যাক্সিডেন্ট মনে করেছ, সেটা এ্যাক্সিডেন্ট নয়। তাকে আবার কিডন্যাপ করা হয়েছে।
‘ও গড’ বলে চিৎকার করে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে রাস্তার ওপরেই বসে পড়ল সোফিয়া এঞ্জেলা।
অন্ধকার ঘরে চোখ খুলল সালমান শামিল। চিন্তা করতে চেষ্টা করল কোথায় সে? বুঝল কংক্রিটের একটা নগ্ন মেঝেতে সে শুয়ে আছে। তার মনে পড়ল, সে জীপ নিয়ে ইনস্টিটিউটের গেট দিয়ে বের হয়ে এসেছিল। সে বাম দিক মোড় নেবার জন্য স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নিচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখে পড়ে বাম দিক থেকে একটা ট্রাক তার জীপ লক্ষ্যে ছুটে আসছে। কিছু করার আগেই ট্রাকটির প্রচণ্ড একটা আঘাতে জীপ সমেত সে ছিটকে পড়ে। মনে পড়ছে মাথাটা প্রচণ্ড বাড়ি খেয়েছিল পিচ ঢাকা রাস্তার সাথে। চোখ তার অন্ধকার হয়ে আসে। এই সময়েই কারা যেন তাকে গাড়িতে টেনে তলে। একটা মিষ্টি গন্ধ তার নাকে প্রবেশ করে। আর কিছুই মনে নেই তার।
সালমান শামিল হাত-পা নেড়ে দেখল, হাত-পা বাঁধা নেই। কপালের বাম পাশে একটা জায়গা খুব ব্যথা করছে। মাথার ঐ জায়গাটাই রাস্তার সাথে বাড়ি খেয়েছিল।
উঠে বসল সালমান শামিল। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাত না দিন কিছুই বোঝা যাচ্ছে ন।
কোথায় সে? সন্দেহ নেই, সে শত্রুর হাতে। এবং তার অনুমান মিথ্যা না হলে ‘হোয়াইট উলফ’-এর হাতে সে বন্দী। ডক্টর স্যারের কথাই সত্য হল, ‘হোয়াইট উলফ’ তার পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে কোন সুযোগই নষ্ট করেনি।
সালমান শামিল উঠে দাড়াল। শরীরটাকে খুব হালকা ও দুর্বল মনে হল। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে।
অন্ধকারে হাতড়িয়ে ঘরের দেয়াল স্পর্শ করল সালমান শামিল। দেয়াল ধরে সে দরজার সন্ধানে এগুল। কিছু খোঁজার পরই দরজা পেয়ে গেল। হাত দিয়েই বুঝল ইস্পাতের দরজা। আরেকটু খুঁজে হাতল পেয়ে গেল দরজার। হাতল ধরে টান দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে আলো জ্বলে উঠল, কিন্তু দরজা খুলল না।
সালমান শামিল দেখল, বিরাট হল ঘর। হল ঘরের এক পাশে শোবার সুন্দর একটি ডিভান। আর অন্য পাশে সিংহাসনের মত বড় এবং সুন্দর একটা চেয়ার। ঘরের লম্বালম্বি দু’পাশ দিয়ে শোফা সেট সাজানো। শ্বেত পাথরের মেঝ। দেখলে মনে হয় এক দরবার কক্ষ এটা। একমাত্র ঐ দরজা ছাড়া কোন দরজা-জানালা ঘরে নেই। কিন্তু কোন অস্বস্তি বোধ হচ্ছে না। এতক্ষণ সালমান শামিল উপলব্ধি করল, ঘরটা এয়ারকন্ডিশন করা। সালমান শামিল দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। দেখল সে তার সামনেই দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। বুঝল স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল সালমান শামিল।
বেরিয়ে সে দীর্ঘ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দু’পাশে তাকিয়ে দেখল, বারান্দাটি সামনে গোল হয়ে বেঁকে গেছে।
বারান্দার পরেই উন্মুক্ত উঠান। ওটাও বারান্দার মতই। গোল হয়ে বেঁকে যাওয়া। উঠান এক বিরাট মাঠের মত। মাঝখানটা উঁচু। চারদিকটা ঢালু হয়ে চারদিকের বিল্ডিং এর বারান্দায় গিয়ে ঠেকেছে।
উঠানের মাঝখানে উঁচু শীর্ষবিন্দুটিতে শ্বেত পাথরের একটা বেদী। বেদীর উপর শ্বেত মর্মরের একটা সুদৃশ্য মূর্তি।
সালমান শামীল উঠান পেরিয়ে সেই বেদীর উপর গিয়ে দাঁড়াল।
মূর্তিটির মুখোমুখি হতেই সালমান শামিল চিনল ওটা শামিউনের মূর্তি। শামিউন খৃষ্টান আর্মেনিয়ার জাতীয় বীর। বৃহত্তর খৃস্টান আর্মেনিয়া গড়ার স্বপ্ন নতুন করে সে চাঙ্গা করে এবং সর্বশেষ সংগ্রাম তার দ্বারাই পরিচালিত হয়। রাশিয়ান জারের পতন ঘটলে ১৯১৮ সালের আটাশে মে ককেশাসের মুসলমানরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কম্যুনিস্ট বিপ্লবের আগে লেনিন ককেশাসের মুসলমানদের এই স্বাধীনতারই আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে লেনিন মুসলমানদের স্বাধীনতার কণ্ঠ রোধ করার জন্য ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পরই বিশাল কম্যুনিস্ট বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে শামিউনকে ককেশাসে পাঠায়। আর্মেনীয় শামিউন ছিল বৃহত্তর খৃষ্টান আর্মেনিয়া গড়ার স্বপ্নে বিভোর মুসলিম বিদ্বেষী একজন মানুষ। শামিউন কম্যুনিস্ট বাহিনী নিয়ে ককেশাসে প্রবেশ করে প্রথমে ট্রেড ইউনিয়ন ও আঞ্চলিক নির্বাচনের প্রহসন করে ককেশাসের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু ককেশীয় সচেতন জনগণ তাদের সে ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। সবখানেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। এরপরই শুরু হয় গণহত্যা। শামিউন বিশাল কম্যুনিস্ট বাহিনীর সহায়তায় ১৯১৮ সালের মার্চ থেকে পরবর্তী চার-পাঁচ মাসে উল্লেখযোগ্য মুসলিম নেতৃবৃন্দসহ পচাত্তর হাজার মুসলিম নর-নারীকে হত্যা করে। কিন্তু চির স্বাধীনতাকামী ককেশীয় মুসলমানরা এত সহজে দমবার পাত্র ছিল না। তারা নতুন করে সংঘবদ্ধ হয় এবং চার মাসের চেষ্টায় শামিউনসহ কম্যুনিস্ট বাহিনীকে তারা ককেশাস থেকে বিতাড়িত করে। কিন্তু ককেশীয় মুসলমানদের দূর্ভাগ্য, ক্রিমিয়া, তাতারিয়া ও মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের অব্যাহত পরাজয়ে ককেশাসের উপর কম্যুনিস্ট চাপ বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ সালের ২৭ এপ্রিল শামিউন রুশ সৈন্যের সাহায্যে ককেশাস দখল করে নেয়। তার অত্যাচার ও গণহত্যার ফলে মুসলিম জনপদগুলো শ্মশানে পরিণত হয়। পুড়িয়ে দেয়া মসজিদ, স্কুল, পাঠাগার ইত্যাদিতে বহু বছর কেউ পা দেয়নি। এই জালিম শামিউনই আর্মেনিয়ার এক মহান নায়ক। কম্যুনিস্টদের জন্য এত কিছু করেও শামিউন কিন্তু কম্যুনিস্টদের কাছ থেকে কিছুই পায়নি। ককেশাস কম্যুনিস্টদের করতলগত হবার পর বৃহত্তর আর্মেনিয়া গঠিত হয়নি, বরং ককেশাসকে জর্জিয়া, আজারবাইজান, তাতারিয়া ও আর্মেনিয়ার মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। আর্মেনিয়ার ভাগে সবচেয়ে কম অঞ্চলই পড়ে। আজ মুসলমানদের উদ্যোগে কম্যুনিস্ট সাম্রাজ্য যখন ধ্বসে পড়েছে, তখন আর্মেনিয়রা তাদের বৃহত্তর খৃস্টান আর্মেনিয়ার স্বপ্ন নিয়ে আবার মাথা তুলেছে ককেশাসের মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আর তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে মুসলমান বিদ্বেষী কম্যুনিস্ট ও খৃষ্টান রাষ্ট্রগুলো। সালমান শামিলের মনে হল, শ্বেত মর্মরে গড়া শামিউনের উই উদ্ধত মূর্তি তাদের সে সম্মিলিত চেষ্টারই প্রতীক। পুজোর বেদীতে শামিউনকে প্রতিষ্ঠা করে তারা শামিউনের সেই গণহত্যা ও সন্ত্রাসেরই পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চাচ্ছে ককেশাসে।
সালমান শামিল দেখল, শামিউনের বাম হাতে একটা মানচিত্র। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বৃহত্তর আর্মেনিয়ার মানচিত্র ওটা। পারস্যের একটা অংশ এবং গোটা পূর্ব আনাতোলিয়াসহ কৃষ্ণ সাগর ও কাম্পিয়ান সাগরের সমগ্র অঞ্চলকে বৃহত্তর আর্মেনিয়ার অংশ দেখানো হয়েছে। ডান হাত তার মুষ্টিবদ্ধভাবে উপরে তোলা যা শক্তির প্রতীক। অর্থাৎ শক্তির জোরেই তারা বৃহত্তর আর্মেনিয়া গঠন করবে। সালমান শামিলের চোখ নেমে এল নিচে। তার চোখ শামিউনের পায়ের তলার বেদীতে নিবদ্ধ হতেই ভীষণভাবে চমকে উঠলো সালমান শামিল। দেখল, শামিউনের মূর্তি যে প্রস্তরখণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার চারদিক ঘিরে নরমুণ্ডু সারিবদ্ধভাবে সাজানো। নরমুণ্ডুগুলো পিতলের প্লেটে রাখা। যেন অর্ঘ দেয়া হয়েছে শামিউনের পায়ে।
নরমুণ্ডুগুলো শামিউনের পদ-তলের সোপান ঘিরে একটি বৃত্ত রচনা করেছে। শামিউনের বাম পাশ থেকে আরেকটি বৃত্তের কাজ শুরু হয়েছে। এ অসমাপ্ত বৃত্তের শেষ নরমুণ্ডুটি সালমান শামিলের একেবারে সামনেই।
সালমান শামিল বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল এই শেষ নরমুণ্ডটির আগের পিতলের প্লেটটি খালি। একটা প্লেট খালি রেখেই পরের প্লেটে শেষ নরমুণ্ডটি রাখা হয়েছে। একটা কৌতুহলই হলো। সালমান শামিল কয়েক পা সামনে এগুলো। সামনের নরমুণ্ডটি তার কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। শামিউনের মূর্তি-মুখো করে দাঁড় করিয়ে রাখা নরমুণ্ডটির মাথার খুলিতে কাল কালিতে লেখা তিনটি শব্দ তার নজরে পড়ল। পড়ার জন্যে সামনে একটু ঝুঁকে পড়লো সালমান শামিল। কালো কালির “আল্লামা ইব্রাহিম এদতিনা” নামটি জ্বল জ্বল করে উঠল তার সামনে।
হদয়ের কোথায় যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেল সালমান শামিল। মুহূর্তের জন্যে নিঃশ্বাস নিতেও সে ভুলে গেছে যেন। অব্যক্ত যন্ত্রণার একটা ঢেউ খেলে গেল তার গোটা দেহে -সমগ্র স্নায়ূতন্ত্রীতে।
আরেকটু ঝুঁকে পড়লো সালমান শামিল নরমুণ্ডটির ওপর। ঔষধ দিয়ে মাথাটি পরিষ্কার করা হয়েছে। সালমান শামিল দেখল হাড়গুলো একদম কাঁচা। মনে হচ্ছে, আজই বা এই মাত্র একে এখানে রাখা হয়েছে। লেখার কালিগুলো যেন এখনও ভাল করে শুকায়নি। অর্থাৎ তাকে কিডন্যাপ করে আজ কালের মধ্যেই খুন করা হয়েছে।
সালমান শামিল মাথা তুলে পাশের নরমুণ্ডটির দিকে এগিয়ে গেল। মাথার খুলিতে সেই কালো কালিতে লেখা নাম পড়ল, ‘আবুল বরকত আহমদভ’।
আবুল বরকত আহমদভ ছিল ককেশাসের নাগারনো কারাবাখ অঞ্চলের ‘ককেশাস ক্রিসেন্ট’ এর প্রধান। দিন আটেক আগে সে হারিয়ে যায়।
সালমান শামিল মাথা তুলল। বেদনা বিস্ফোরিত তার চোখ। তার মনে জেগে উঠল জিজ্ঞাসা, তাহলে কি আমাদের হারানো সব নেতৃবৃন্দকে এনে শামিউনের পায়ে অর্ঘ দেয়া হয়েছে?
সালমান শামিল গুণে দেখল, প্রথম বৃত্তটিতে বিশটি মাথা এবং অসমাপ্ত দ্বিতীয় বৃত্তটিতে ছটি মাথা। হিসেব মিলে যায়, বিগত কয়েক সপ্তাহে ছাব্বিশজন মুসলিম নেতার অন্তর্ধান ঘটেছে, আর ছাব্বিশটি মাথাই এখানে আছে। তবুও একবার ঘুরে ঘুরে নামগুলো দেখল। নজর বুলাল তাদের কংকালে পরিণত হওয়া মুখের দিকে। চোখ ফেটে অশ্রু নেমে এল তার। সবশেষে সে এসে দাঁড়াল ছাব্বিশ নম্বরে রাখা পিতলের খালি প্লেটের কাছে, মনে পড়লো, হ্যাঁ-তালিকায় তার নাম ছাব্বিশ নম্বরে ছিল। অর্থাৎ এ প্লেটটি তার মাথার জন্যেই নির্ধারিত। যেহেতু তার মাথা পাওয়া যায়নি এ পর্যন্ত, তাই ওটা খালি রাখা হয়েছে।
এই সময় বেদীর বুক থেকে একটা কণ্ঠ ধ্বনিত হল। বলল, সালমান ঠিকই ভাবছ, এ প্লেটটি তোমার জন্যেই নির্ধারিত। শিঘ্রই তুমি ওর গৌরব বৃদ্ধি করবে।
সালমান শামিল, বুঝল, বেদীর সাথে মাইক্রোফোন সংযোগ রয়েছে।
সালমান শামিল চারদিকে একবার নজর বুলালো। চারদিকে ঘোরানো বিশাল বিল্ডিং এর সবগুলো দরজাই বন্ধ, একমাত্র তার ঘরের দরজাটা ছাড়া।
সালমান শামিল ধীরে ধীরে বেদী থেকে নেমে এল। সে গোটা বিল্ডিংটা একবার দেখতে চায়। কি আছে, কে আছে ঐ বন্ধ ঘরগুলোতে। কেন কেউ তার সামনে আসছে না।
সালমান শামিল যে ঘরে ছিল সেটা বেদীর পূর্ব দিকে। সালমান শামিল পশ্চিম প্রান্তের বিল্ডিং এর দিকে নেমে গেল। ঘোরানো বিল্ডিংটা গোটাটাই তিনতলা। দূর্গের মত দেখতে। ধরণ-ধারণ ও অবস্থা দেখলেই বোঝা যায়, শত বছরেরও বেশি পুরানো বিল্ডিং। কিন্তু খুবই মজবুত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
সালমান শামিল চিন্তা করে পেল না, এমন বিল্ডিং ইয়েরেভেনের কোথায় আছে। ইয়েরেভেনের প্রতি ইঞ্চি জায়গা সে চেনে। আড়াই হাজার বছর আগের ধ্বংসাবশেষ, এক হাজার, দেড় হাজার বছর আগের ভগ্ন প্রাসাদসহ সব কিছুই সে দেখেছে। কিন্তু এ ধরণের একটা জায়গা, এ ধরণের একটা ভবন তো কোথাও দেখেনি! তাহলে কি এটা ইয়েরেভেন নয়? আর্মেনিয়ার দূর্গম স্থানের কোন কি গোপন নগরী?
সালমান শামিল এসে বারান্দায় উঠে একটা কক্ষের দরজার দিকে চলল। এ সময় একটা কণ্ঠ বিকট শব্দে হেসে উঠল। বলল, সালমান শামিল ঘরগুলো তুমি সার্চ করতে চাও? পারবে না। দরজা তুমি কোনভাবেই ভাঙতে পারবে না। আর ভাঙলেও কোন লাভ হবে না। এই গোটা বিল্ডিং এ তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি বেঁচে থাকা পর্যন্ত ওখানে কারো যাবারও দরকার নেই।
কণ্ঠটি একটু থামল। একটু পরেই আবার বলে উঠল, ‘হোয়াইট উলফ’ একটা শিকারের ওপর দু’বার ঝাপিয়ে পড়ে না। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে একটা অসম্ভব ব্যতিক্রম ঘটেছে। তাই তোমার ব্যাপারে তারা একটা মজার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমার গায়ে তারা হাত লাগাবে না। একজন মানুষ ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কিভাবে তিল তিল করে মৃত্যুবরণ করে সে দৃশ্যটা তারা ধীরে সুস্থে দেখবে। কথা শেষ করে কণ্ঠটি আবার সেই বিকট শব্দে হেসে উঠল।
এক সময় তার হাসিটিও থেমে গেল।
সালমান শামিল কয়েক মূহুর্ত বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে থাকল। সে ঐ কন্ঠের কোন কথাকেই অবিশ্বাস করলো না। ‘হোয়াইট উলফ’-এর পেছনে খৃষ্টানদের যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংস্থা ক্লু-ক্ল্যাক্স-ক্ল্যান এবং যে কম্যুনিষ্ট সন্ত্রাসবাদী সংস্থা, ‘ফ্র’ রয়েছে, তাদের চেয়ে জঘন্য, বর্বর, পশু কোন কিছু আর দুনিয়াতে নেই। এদের উম্মত্ত ও বিকৃত মানসিকতা সব পারে।
সালমান শামিল ফিরে দাঁড়াল ।
সে হাঁটতে শুরু করল তার ঘরের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে সে ভাবল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ ওরা টেলিভিশন ক্যামেরায় দেখছে। বিল্ডিংসহ গোটা এলাকার সবকিছুই নিশ্চয়ই টেলিভিশন ক্যামেরার আওতায়।
সালমান শামিল তার ঘরের দরজায় এসেও আবার বারান্দায় ফিরে গেল।
বসে পড়ল সে বারান্দার পাথরের মেঝেতে।
অনেক হেঁটেছে। খুব ক্লান্তি লাগছে তার। আর খাদ্য ও পানি পাওয়া যাবে না শুনে ক্ষুধা-তৃষ্ঞাও যেন হঠাৎ বেড়ে গেল।
Saimum Series is best book collection ever I see.
ReplyDelete