০৫. রক্তাক্ত পামির
পামির সড়ক ধরে হিসার দূর্গের দিকে তীর বেগে ছুটে আসছিল ‘ফ্র’ এর একটি জীপ।
ইয়াকুবের কাছ থেকে ওয়্যারলেসে খবর পেয়ে ‘ফ্র’ আহমদ মুসাকে ধরার জন্য আরেকজন কর্ণেলের নেতৃত্বে একটি টীম পাঠিয়েছিল হিসার দূর্গে। ‘ফ্র’ জানত, হিসার দূর্গ থেকে প্রকাশ্য প্রতিরোধের কোন সম্ভাবনা নেই এবং ও টিমটাই যথেষ্ট। তবু ‘ফ্র’ কর্মকর্তারা আশ্বস্ত হতে পারেনি, তাই বাড়তি ব্যবস্থা হিসাবে আরেকজন কর্ণেলের নেতৃত্বে তারা এই টিমটি পাঠিয়েছে। এ টিমেও আগের মতই একজন কর্ণেল, একজন ক্যাপ্টেন এবং চারজন লেফটেন্যান্ট।
ফাঁকা পামির সড়কে জীপটি তীর বেগে এগুচ্ছে। রীতিমত কমব্যাট ধরনের জীপ। ড্রাইভ করছিল ক্যাপ্টেন। পাশে বসা কর্ণেল, তার হাতে খোলা ওয়্যারলেস। কর্ণেলের মুখ প্রসন্ন, স্বস্তির একটা তৃপ্তি চোখে-মুখে। ওরা আহমদ মুসা ও আমির সুলাইমানকে বন্দী করে ফিরে আসছে। একশ কিলোমিটার বেগে ওরা আসছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হিসার রোড ছাড়িয়ে পামির রোডে এসে পড়বে।
ওয়্যারলেসে ফিল্মী সংগীত ভেসে আসছে। কর্ণেলের মুখে একটা চিকন হাসি ফুটে উঠল। মনে মনে বলল, কমরেডরা বিজয়টা তো বেশ উপভোগ করছে। কর্ণেল কিছু বলতে যাচ্ছিল ক্যাপ্টেনকে। কিন্তু মুখ ফাঁক করেও আর বলা হলোনা। এক পশলা গুলির একটা জমাট শব্দ ভেসে এল ওয়্যারলেসে। মুহূর্ত কয়েক পরে আবার। চমকে উঠল কর্ণেল। গোটা শরীরটা উদ্বেগে শীর শীর করে উঠল। এলার্মের বোতামটা তর্জনি দিয়ে চেপে ধরলো বার বার। হ্যাঁ, ওপার থেকে আওয়াজ আসছে, রিং হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোন সাড়া নেই। তাহলে কি … … … … …।
কেঁপে উঠল গোটা দেহটা কর্ণেলের।
কর্ণেল উদ্বিগ্ন। ক্যাপ্টেনকে সব ব্যাপার বুঝিয়ে বলল। সেই সাথে বলল, কত তাড়াতাড়ি আমরা পৌঁছতে পারি দেখ।
জীপটা যেন নতুন প্রাণ পেল। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে লাগল স্পিডোমিটারের কাঁটা। বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে চলছে গাড়ী। একশ’ আশিতে দাঁড়িয়ে স্পিডোমিটারের কাঁটা থর থর করে কাঁপছে।
কর্নেল কারবোর্ডের মিনি টিভি স্ক্রীনে অস্থির চোখে তাকিয়ে আছে। হিসার রোডের মোড়টা আর বেশী দূরে নয়। ঐ তো দেখা যাচ্ছে। মোড়ের কাছে এসে জীপের স্পীড কমে এল। মোড় ঘুরল জীপটি। স্পিডোমিটারের কাঁটা আবার লাফিয়ে উঠলো। মিনি টিাভ স্ক্রীনের দিকে চেয়ে থাকা কর্ণেল চমকে উঠল। টিভি স্ক্রীনের কোণায় পরিস্কার একটা গাড়ীর ছবি ভেসে উঠেছে। হিসার রোড ধরে এদিকে এগিয়ে আসছে। কর্ণেল ক্যাপ্টেনকে গাড়ী দাঁড় করাবার জন্য নির্দেশ দিল।
আহমদ মুসার চোখে ছিল দূরবীন। উৎসুক চোখে সে চারিদিকে নজর বুলাচ্ছিল। সামনে আর একটা চড়াই। ওটা পার হলে নজরে পড়বে পামির রোড। একদিন মাত্র এ রাস্তা দিয়ে গেছে আহমদ মুসা। কিন্তু তাতেই মুখস্ত হয়ে গেছে গোটা পথ। আল্লা বকশ গ্রামের কথা তার মনের কোণে একবার ঝিলিক দিয়ে উঠল। এখান থেকে বেশী দূরে তো নয় গ্রামটা। একটু পশ্চিমে গিয়ে তারপর দক্ষিণে। চড়াই এর মাথায় উঠে এসছে জীপটি। হঠাৎ দূরবীনের লেন্সে একটা সজীব জিনিস নড়ে উঠল। হাঁ একটা গাড়ী। পামির রোড ধরে এগিয়ে এসে হিসার রোডে প্রবেশ করল।
গাড়ী চড়াই থেকে সমভূমিতে নেমে এল। দূরবীনের পর্দায় চোখ আহমদ মুসার। ওকি! গাড়ীটা দাঁড়িয়ে পড়েছে কেন? কপালটা কুঞ্চিত হয়ে উঠল আহমদ মুসার। দাঁড়ানো গাড়ীটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবার দূরবীনের পর্দায়। গাড়ীটার উপর ভাল করে নজর বুলিয়ে আহমদ মুসা দূরবীনটা দিয়ে দিল কুতাইবার হাতে। কুতাইবা আহমদ মুসার ভাবান্তর লক্ষ্য করছিল। দূরবীন চোখে লাগিয়েই সে চমকে উঠল। বলল, ওটা ‘ফ্র’ –এর গাড়ী।
আহমদ মুসা সম্মতি সূচক মাথা নাড়লো। কর্ণেল কুতাইবা বলল, গাড়ী কি দাঁড় করাব?
-না। আহমদ মুসা বলল।
-আমাদের কি কিছু চিন্তা করাও উচিৎ নয়?
-চিন্তা করতে হবে, কিন্তু গাড়ী দাঁড় করিয়ে নয়।
-কিন্তু আর একটু এগুলেই তো আমরা ওদের নজরে পড়ে যাব।
-আমরা নজরে পড়ে গেছি কুতাইবা।
-কেমন করে?
-জীপের ছাদে দেখুন রাডার বসানো আছে। আমরা ঐ রাডারে অনেক আগেই ধরা পড়ে গেছি। এখন দাঁড়ানোর অর্থ, আমরা তাদের সন্দেহ করেছি। এতে আমাদের প্রতি তাদের তাদের সন্দেহ পাকাপোক্ত হয়ে যাবে।
-তাহলে………
-আমরা একেবারেই স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে যাব, যাতে ওরা বুঝে আমরা ওদের মোটেই সন্দেহ করিনি। আমাদের ব্যাপারে ওদের সন্দেহ হ্রাস করার এটাই সহজ পথ।
হাসল কর্ণেল কুতাইবা। ধন্যবাদ, মুসা ভাই। আমি এদিকটা চিন্তা করিনি। আপনি ঠিকই বলেছেন।
ঠিক আগের স্পিডেই এগিয়ে চলল কুতাইবার গাড়ী।
‘ফ্র’ -এর গাড়ী আর ৫ শ’ গজ দূরেও নয়। গাড়ীটা রাস্তার ডান পাশটা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। বাম পাশ দিয়ে সহজেই গাড়ী চালিয়ে চলে যাওয়া যায়। আহমদ মুসা কুতাইবাকে নির্দেশ দিল হর্ণ বাজাবারও কোন প্রয়োজন নেই, এগিয়ে যাও বাম পাশ দিয়ে। ওরা চ্যালেঞ্জ না করলে আমরা দাঁড়াবো না। আর ওরা গাড়ী থেকে নামলেই শুধু আমরা ফায়ার করব।
আর মাত্র গজ পঞ্চাশেক। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ‘ফ্র’ এর গাড়ীর পাশাপাশি পৌছা যাবে। আহমদ মুসার নির্দেশ মোতাবেক রাস্তার বাম ঘেঁষে তীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ী।
হঠাৎ মাইক্রোফোনে পরিস্কার রুশ ভাষায় একটা নির্দেশ ভেসে এল। বলা হলো গাড়ী দাঁড় করাবার জন্য। আহমদ মুসা কুতাইবাকে বলল, ওদের গাড়ীর মুখের সমান্তরালে আমাদের গাড়ীর মুখ নিয়ে যাও, যাতে আমরা ওদের নজরে পড়ার আগে ওরা গাড়ী থেকে নামলেই আমাদের সরাসরি নজরে এসে যায়।
কুতাইবা গাড়ীকে ঠিক সেইভাবে দাঁড় করাল। দুই গাড়ীর মাঝখানে রইল কয়েকগজ ফাঁকা জায়গা।
আহমদ মুসা চকিতে একবার চারিদিকটা দেখে নিল। ষ্টিয়ারিং হুইলে রাখা কুতাইবার হাতের বাম পাশেই গাড়ীর তাকে রাখা এম-১০ রিভলবার। চকিতে পিছন ফিরে দেখল সালামভের হাতেও আরেকটি এম-১০ রিভলবার তৈরী হয়ে আছে। আহমদ মুসা বলল, আমি বাম পাশ ও সামনেটা দেখব, তোমরা ডানদিক। বলেই আহমদ মুসা ‘ফ্র’–এর কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সাব-মেশিনগানটা নিয়ে মাথা নিচু করে টুপ করে বাম পাশে নেমে পড়ল।
কুতাইবার গাড়ী দাঁড়াবার সাথে সাথেই ‘ফ্র’ –এর ছ’জন লোক তাদের গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ল। সবার হাতেই উদ্যত সাব মেশিনগান। দু’জন সামনেটা ঘুরে বাম পাশে ছুটে এল এবং চারজন ডান পাশের দরজার দিকে।
বোধহয় ওদের টার্গেট ছিল গাড়ীটা ঘিরে ফেলা এবং তার পর যা করবার তাই করা। এ জন্যই সাব-মেশিনগানের ট্রিগারে ওদের আঙ্গুল আছে ঠিকই, কিন্তু মনোযোগটা দেখা গেল অনুসন্ধানের দিকে। তাই কুতাইবার এম-১০ রিভলবার বিদ্যুৎ গতিতে বেরিয়ে এসে যখন অগ্নি বৃষ্টি করল, তখন তাদের সাব-মেশিনগান মাথা তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু আর সময় হলোনা। আহমদ মুসার সাব-মেশিনগান এবং সালামভ এর এম-১০ রিভলবারও একই সাথে গর্জন করে উঠেছিল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর সব নিরব। ‘ফ্র’ -এর ছ’জন লোক মুখ থুবড়ে পড়েছে রাস্তায়। আহমদ মুসা উঠে এল গাড়ীতে। কুতাইবা তার দিকে চেয়ে বলল, এবার নির্দেশ?
-আপাতত কোন ঘাঁটিতে চল।
-এখান থেকে দু’শ মাইল আপার পামিরে আমাদের একটা বড় ঘাঁটি আছে, মাইল পঞ্চাশেক সামনে গেলে এই পামির রোডের ধারেই আমাদের আরেকটা ঘাঁটি।
-আপার পামিরে পেছনের দিকে আর নয়, সামনের দিকে চল।
আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি। কুতাইবার গাড়ী পামির রোডে উঠে আবার যাত্রা শুরু করল পশ্চিম দিকে। আধঘন্টা পর কুতাইবার গাড়ী যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা পাহাড়ের দেয়াল ঘেরা সংকীর্ণ একটা গলি। কুতাইবা আহমদ মুসাকে বলল, জনাব এখানে নামতে হবে। সালামভ আপনাদের ঘাঁটিতে নিয়ে যাবে।
-তুমি যাবে না?
বলল আহমদ মুসা।
-এখান থেকে আরও কয়েক মাইল পশ্চিমে গাড়ীর ৩১নং রোড ষ্টেশন। ওখানে গাড়ী রেখে আসব।
-কেন, এখানে কোথাও গাড়ী লুকানো যায় না?
-যায়, কিন্তু গাড়ী ষ্টেশনে না রেখে উপায় নেই। প্রতিদিন রাত ১২ টায় ষ্টেশনে গাড়ী চেক করা হয়। পামির রোডের জন্য গাড়ী এবং গাড়ীর সংখ্যা নির্দিষ্ট। রাত ১২টা চেকিং ষ্টেশনের সব গাড়ীর সংখ্যা যোগ করে হিসাব মেলানো হয়। হিসাবে গরমিল হলে আর রক্ষা নেই। যে বহরের গাড়ীর সংখ্যা কম হবে তাকেই পাকড়াও করা হবে। সুতরাং সারাদিন যাই হোক রাত ১২ টায় গাড়ী ষ্টেশনে নিতেই হবে।
আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ওরা হিসেবে কোন ফাঁক রাখতে চায়নি।
আহমদ মুসা, সালামভ এবং আমির সুলাইমান গাড়ী থেকে নেমে পড়ল। কুতাইবা গাড়ী থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, আমি আমার গাড়ী বহরের টুকিটাকি কাজ সেরে বিকেল নাগাদ ঘাটিতেঁ পৌছব। একটা সংকীর্ণ গিরিপথ ধরে ওরা সামনের পাহাড়ের দেয়ালটা পেরিয়ে একটা প্রশস্ত উপত্যকায় গিয়ে পড়ল। উপত্যকাটা উত্তর দক্ষিণে লম্বা। পাথুরে বুক। পাথরের মাঝেও সবুজের সমারোহ। থোকা থোকা কাঁটাগাছ উপত্যকার ধূসর বুকে নীল তিলকের মত। কাঁটাগাছগুলো কোথাও কোথাও মাথা ছুঁই ছুঁই করছে। এর মধ্যে দিয়েই সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে ওরা তিনজন। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সালামভ। সামনেই আরেকটা পাহাড়ের দেয়াল। ও দেয়ালটা পেরিয়ে গেল ওরা। পথ ক্রমেই দূর্গম হয়ে উঠল। দু’ঘন্টা চলার পর একটা পাহাড়ের দক্ষিণ ঢালে জংগল ঘেরা এক উপত্যকায় গিয়ে পৌছল ওরা। পাহাড়ের শেষ দেয়ালটার মাথায় উঠেই সালামভ একটা শীষ দিয়ে উঠল। পর পর দু’বার, দু’নিয়মে। কয়েক মুহূর্ত পরেই লম্বা একটা শীষ ভেসে এল, সালামভ আহমদ মুসার দিকে চেয়ে বলল, আমরা এসে গেছি। সব ঠিক আছে।
একটু থেমে বলল, এই দূর্গম পথে তেমন পাহারার ব্যবস্থা আমরা রাখিনি। ঘাঁটি এলাকার মুখে এটিই আমাদেরঁএকমাত্র চেক পোষ্ট। এখানে পাহাড়ের মাথায় উঠে যদি শীষ না দিতাম তাহলে সাইলেন্সার লাগানো রাইফেল থেকে কয়েকটি গুলি এসে নিঃশব্দে আমাদের বক্ষভেদ করতো।
পাহাড়ের ঢালুতে গাছের ফাঁকে ফাঁকে মসজিদের গম্বুজের মত নীল তাবু। তারা কার্পেপ মোড়া পরিপাটি করে সাজানো একটা পাহাড়ের গুহায় গিয়ে উঠল। গুহামুখে তাদের স্বাগত জানাল আলী ইব্রাহীম। সালামভ আহমদ মুসাকে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয়ের পর আরেক দফা আলিংগন; কুশল বিনিময়।
খুব সম্মানের সাথে আলী ইব্রাহীম আহমদ মুসাকে নিয়ে ফরাশের এক প্রান্তে জায়নামাজ পাতা জায়গায় বসাল। বলল, মুসা ভাই, এটা আমাদের দরবারগৃহ, মেহমান খানা, মসজিদ সবই।
-আমার খুবই ভাল লাগছে। বলল আহমদ মুসা।
-কিন্তু এখানে মেহমানদারীর কিছুই নেই। সলজ্জকণ্ঠে বলল ইব্রাহিম।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ইব্রাহিম তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি একজন দায়িত্বশীল মেজবান; বিপ্লবী নও।
এবার কথা বলল সালামভ। বলল ঠিকই বলেছেন মুসা ভাই। ইব্রাহিম এখনো মনে প্রাণে একজন তাজিক কবিলার সর্দারই রয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, আলী ইব্রাহিম এই ঘাঁটির কমান্ডের দায়িত্বে আছে। কিন্তু আসলেই সে এক তাজিক কবিলার সর্দার। এই উপত্যকা বরাবর মাইল পাঁচেক পশ্চিম দিকে গেলে প্রশস্ত এক উপত্যকায় সবুজ এক গ্রাম। নাম গুলমহল। কয়েক পুরুষ ধরে তারা এই গ্রাম, এই উপত্যকার মালিক। এক সময় তারা বোখারায় বাস কনত, লালবাহিনী বোখারায় ঢোকার পর সেখান থেকে তারা পালিয়ে এসে এই গ্রামে বসতি স্থাপন করে। আলী ইব্রাহিমের বয়স ২৫। দু’বছর আগে তার পিতা নিহত হন। হত্যাকান্ডের কোন কিনারা এখনও হয়নি। তবে সন্দেহ করা হয় ‘ফ্র’-এর এজেন্টের হাতেই তিনি নিহত হয়েছেন। তার পিতা আলী আফজাল খামার দেখাশুনা ছাড়াও গালিচার ব্যবসা করত। তার এই ব্যবসায় আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ও ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সূত্রেই আফগান মুজাহিদের সাথে তার একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এটাই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। একদিন ‘ফ্র’ এর আঞ্চলিক কম্যুনিস্ট পার্টি অফিসে তাঁর ডাক পড়ে। সেখান থেকে ফেরার পথেই তিনি নিহত হন।
পিতার মৃত্যুর পর আলী ইব্রাহিম কবিলার দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে নিয়েছে। সাইমুমের সাথে গোপন যোগাযোগ আলী ইব্রাহিমের আগে থেকেই ছিল। পিতার মৃত্যু তাকে আরো দ্রুত ঠেলে দেয় এই পথে। এই ঘাঁটির সৃষ্টি হয়েছে তারই উদ্যোগে। প্রয়োজন হলে এই ঘাঁটিকে তার কবিলার এক্সটেনশন বরে চালিয়ে দেবার সুযোগ তার আছে। অন্যদিকে যৌথ খামার কাঠামো এবং সরকারী রাজনৈতিক কমিশনের সাথে তার রীতিমাফিক যোগাযোগ রয়েছে।
সালামভের কথায় ঈষৎ হেসে ইব্রাহিম বলল, সেই বিপ্লবী হবার যোগ্যতা আমাদের কোথায়। তবে মধ্য এশিয়ায় ধ্বংসাবশিষ্ট কবিলা সর্দারদের মধ্যে যদি সেই বিপ্লবী চরিত্রের একটা অংশও ঢোকানো যায়, তাহলে সাইমুমের বিপ্লব প্রয়াসের বড় অংশই সফল হয়ে গেল বলতে হবে। এদের ক্ষেত্রটা এতই উর্বর যে, বীজ ফেললেই গাছ উঠে যায়। আর এরা বিপ্লবের সবচেয়ে নিরাপদ সেন্টারও হতে পারে।
-আলহামদুলিল্লাহ, সাইমুম এই বিষয়টার দিকে শুরুতেই জোর দিয়েছিল। ফলও পেয়েছে। বলল আহমদ মুসা। গুহাটির মুখ দক্ষিণ দিকে। সুন্দর ঠান্ডা হাওয়া আসছে। বাতাসে যেন তাজা পানির ছোঁয়া। আহমদ মুসা বলল, কাছেই কি পানি আছে কোথাও?
-সামনেই নদী। বলল, আলী ইব্রাহিম।
একটু যেন চিন্তা করল আহমদ মুসা। তারপর বলল,
-আল্লাবখশ গ্রাম এখান থেকে কতদূর?
-চেনেন আল্লাবখশ গ্রাম?
-হাঁ।
-কেমন করে? বিস্মিত কণ্ঠ আলী ইব্রাহিমের।
সংক্ষেপে আল্লাবখশ গ্রামের কথা বলল আহমদ মুসা। চোখ দু’টি চকচক করে উঠল আলী ইব্রাহিমের। বলল আব্দুল গফুরের ছেলে আব্দুল্লায়েভ আমার পরিচিত। প্রায়ই দেখা হয় আঞ্চলিক কনফারেন্সে। এ অঞ্চলের খুব গুরুত্বপূর্ণ কবিলা ওটা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই কবিলাই শুধু আমাদের আওতার বাইরে। আল্লাবখশ গ্রামের মসজিদটির ইমাম মোল্লা নুরুদ্দিনই শুধু আমাদের লোক।
আহমদ মুসা বলল, আব্দুল্লায়েভের সাথে আমার পরিচয় হয়নি। আব্দুল গফুর তার ছেলে ইকরামভ ও এক মেয়ে ফাতিমা ফারহানার সহযোগিতা আমরা পাব।
আলী ইব্রাহিম কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় নাস্তা এল। আলী ইব্রাহিম সেদিকে তাকিয়ে বলল, আসুন মুসা ভাই, আপনারা নিশ্চয় ক্ষুধার্ত।
কেউ আর কোন কথা বলল না। সবাই যেন এমন কিছুরই অপেক্ষা করছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার তখন নেমে এসেছে। আহমদ মুসা, সালামভ ও আলী ইব্রাহিম দ্রুত নামাজ পড়ার জন্য ঘাঁটিতে ফিরছিল। মাগরিবের সময় তখনও কিছুটা বাকি। কিন্তু পশ্চিম দিগন্তটা পাহাড়ের আড়ালে থাকায় সময়ের তুলনায় অন্ধকারটা বেশীই মনে হলো।
সেই গুহাই নামাজের জায়গা। যখন আহমদ মুসারা গুহামুখে পৌছল, আজান হচ্ছিল তখন।
এমন সময় একজন লোককে এদিকে আসতে দেখে আলী ইব্রাহিম দ্রুত সেদিকে এগিয়ে গেল। কিছু কথা বলল তারা। তারপর তারা দু’জনেই একসাথে এগিয়ে এল। ওদের মুখের দিকে চেয়েই ভ্রু দু’টি কুঁচকে গেল আহমদ মুসার। আহমদ মুসার মনে হল, ওদের গোটা অবয়ব, এমনকি হাঁটা পর্যন্ত কি এক দুঃসংবাদ বহন করছে।
কাছে এসে দাঁড়াতেই আহমদ মুসা একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে আলী ইব্রাহিমের উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকাল। আলী ইব্রাহিম বলল, ভাই কুতাইবা গ্রেফতার হয়েছেন। আর..
আহমদ মুসা আলী ইব্রাহিমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, চল আগে নামাজ সেরে নেই।
সবাই গিয়ে নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষে সবাই বেরিয়ে গেলে আহমদ মুসা আলী ইব্রাহিম এবং সেই লোককে নিয়ে বসল।
লোকটি সাইমুমের একজন তথ্য কর্মী। তার কাছ থেকে জানা গেল, কুতাইবা গাড়ী নিয়ে ষ্টেশনে ফেরার দু’ঘন্টা পরেই গ্রেফতার হয়। আকস্মিক ভাবে গোটা ষ্টেশন ঘেরাও হয়ে যায় এবং গাড়ীগুলো চেক করা হয়। উজবেক তাজিক কোন মুসলিমকেই ষ্টেশন থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। কুতাইবার গাড়ীতে বারুদের গন্ধ পাওয়া যায় এবং রেজিষ্টার থেকে প্রমান হয় যে ঘন্টা দুই আগে গাড়ীটি হিসার দুর্গের ওদিক থেকেই ষ্টেশনে এসেছে। এর পরেই তাকে গ্রেফতার করা হয়।
গাড়ীর অবশিষ্টদের তারা হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেছে। গোটা পামির রাস্তায় এখন টহল চলছে হেলিকপ্টারও টহল দিয়ে ফিরছে। খবরটি শোনার পর সবাই নীরব। আলী ইব্রাহিম এবং আহমদ মুসা দু’জনেই ভাবনার গভীরে। নিরবতা ভেঙ্গে আহমদ মুসাই প্রথমে বলল, আর কোন খবর?
বলল লোকটি, আর একটি দুঃসংবাদ আছে হিসার দুর্গের ওদের কাছ থেকেই শুনলাম, হিসার দুর্গের গোটা জনপদ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে মারা হয়েছে সব লোককেই। যারা বের হতে চেষ্টা করেছে মেশিনগানের গুলিতে নিহত হয়েছে। আর……
থামল লোকটি। যেন কথা বলতে পারছেনা। আহমদ মুসা তার উদ্বিগ্ন চোখ দু’টি তুলে ধরল লোকটির দিকে। বলল, বল।
এই সময় মোল্লা আমির সুলাইমান এখানে এল। লোকটি একবার চোখ তুলে তার দিকে চেয়ে বলল, ‘ফ্র’-এর লোকেরা গর্বের সাথে বলছে, হুজুরের পরিবারের সবাইকে মেরে তারা বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধ নিয়েছে এবং তার ১৮ বছরের নাতনিকে তারা ধরে নিয়ে গেছে।
তীব্র এক খোঁচা লাগল বুকে। সেই খোঁচায় চমকে উঠল আহমদ মুসা। আল্লাবখশ গ্রাম থেকে আহমদ মুসা আশ্রয় নিয়েছিল সম্মানিত এই বৃদ্ধ মোল্লা আমির সুলাইমানের ঘরে। পিতৃস্নেহে তাকে আশ্রয় দিয়েছিল এই বৃদ্ধ। তারই ফলে তার আজ এই পরিণতি। ব্যথায় টন টন করে উঠল আহমাদ মুছার হৃদয়। যারা মারা গেছে তারা শহীদ, কিন্তু আমির সুলাইমানের নাতনিকে ধরে নিয়ে যাবার খবর আহমদ মুসার গোটা সত্তায় আগুন ধরিয়ে দিল।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাল মোল্লা আমির সুলাইমানের দিকে। দেখল তার সফেদ দাড়ির মতই তার মুখটা যেন প্রশান্তিতে হাসছে। সে আহমদ মুসার দিকেই তাকিয়েছিল। আহমাদ মুসার অবস্থা মনে হয় সে বুঝতে পারল। অত্যন্ত শান্ত স্বরে সে বলল। সবই আল্লাহ্র ইচ্ছা। মুমিনের বাড়ি-ঘর , সহায়-সম্পদ এবং স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সবই তো আল্লাহ্র জন্যই। সুতরাং দুঃখ- দুশ্চিন্তার কিছুই নেই। আর আমার শিরীন শবনমের কথা? আল্লাহ্ই তার নেগাহবান।
থামল বৃদ্ধ। বৃদ্ধার এই কথা গুলো প্রশান্তির এক পরশ ছড়াল চারিদিকে। সকল অবস্থায় আল্লাহর ওপর নির্ভর করার, আল্লাহর দিকে রুজু হবার নিখাদ এক আহ্বান ছড়িয়ে দিল তার কথাগুলো।
আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করল আহমদ মুসা। তারপর বৃদ্ধাকে লক্ষ্য করে বলল, আল্লাহর সব প্রশংসা, আপনি আমাদের প্রেরনার উৎস। দোয়া করুন আমাদের জন্য। অতঃপর সেই লোকটির দিকে ফিরে বলল ওদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
-ওদের নিয়ে হেলিকপ্টার বখশ শহর গেছে বলে শুনেছি।
বখশ শহর বখশ নদীর হাইড্র ইলেকট্রিক কেন্দ্র ঘিরে গড়ে ওঠা একটা নতুন নগরী। আপার তাজিকিস্তানের এটাই প্রধান নগর।
আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে মুহূর্ত কয়েক ভাবল। তারপর আলী ইব্রাহিমের দিকে ফিরে বলল এখানকার সাইমুম সম্পর্কে তোমার পরামর্শ কি?
-আমার মতে প্রথমেই এই খবর লেনিন স্মৃতি পার্ক এবং তাসখন্দের হেডকোয়ার্টার সহ আমাদের সকল কেন্দ্রে জানিয়ে দেয়া দরকার। দ্বিতীয় কাজ ওদের উদ্ধারের উদ্যেগ। বলল আলী ইব্রাহিম। একটু থেমে আবার সে বলল কি করতে হবে আমাকে নির্দেশ করুন।
একটু চিন্তা করে আহমদ মুসা বলল, আমাদের অবিলম্বে চারটি কাজ করতে হবে। এক এই খবর হেডকোয়ার্টারসহ সকল কেন্দ্রে প্রেরণ করা। দুই উদ্ধার অভিযান। তিন হিসার দুর্গে লোক প্রেরণ, সেখানকার অবস্থা দেখা এবং কিছু করনীয় থাকলে তা করা। চার সূফী আব্দুর রহমানের মাজারসহ হিসার দুর্গের মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেখানকার জনপদের উপর বর্বর আচরনের কাহিনী মধ্য এশিয়ার প্রত্যেক মুসলমানের কানে পেীছে দেয়া। চতুর্থ কাজটি সময় সাপেক্ষ। কিন্তু অন্য তিনটি কাজ এখনি করতে হবে।
-নির্দেশ করুন। বলল আলী ইব্রাহিম।
-প্রথম ও তৃতীয় কাজের দায়িত্ব তুমি নাও। আর দ্বিতীয় কাজের দায়িত্ব আমার এবং সালামভের। আমারা এখনই যাত্রা করতে চাই।
-মুসা ভাই কিছু মনে না করলে আমি একটা সংশোধনী আনতে চাই। বিনীত কণ্ঠে বলল আলী ইব্রাহিম।
-বল।
-প্রথম ও তৃতীয় কাজের দায়িত্ব সালামভ এবং আমার সহকারীর উপর ছেড়ে দেয়া যায় আর বখশ শহরের উদ্ধার অভিযানে আমি আপনার সাথে থাকলে আমার সরকারী পরিচয় উপকারে আসতে পারে।
-ঠিক আছে। বলল আহমদ মুসা।
এ সময় রাতের খানা এসে পড়লো। সবাই নীরবে সেদিকে মনোযোগ দিল। বাইরে তখন দুর্গম পাহাড়ের জমাট আন্ধকার। নিরব নিথর চারিদিক।
২
তাসখন্দের বেলা ৩টা। সুঁচ ফুটানো রোদ। পা দু’টি উঠতে চাইছিল না রোকাইয়েভার। ক্ষুধা এবং ক্লান্তি দুই-ই তাকে গ্রাস করতে চাইছে। ঘরের দরজা আর বেশী দুরে নয়। কিন্তু ঘরে গিয়ে দাদীকে কি খবর দেবে রোকাইয়েভা। আজও কোন কাজ তার যোগাড় হয়নি। পরিচিত সবাই যেন আজ অপরিচিত হয়ে গেছে। রোকাইয়েভা উপলব্দি করছে তার উপস্থিতিতে সবাই অস্বস্তি বোধ করেছে। এর কারন রোকাইয়েভা বুঝে। ‘বিশ্বাসঘাতক জামিলভের বোন রোকাইয়েভাও আজ সন্দেহের তালিকায়। তাকে চাকুরী দেয়ার অর্থ আহেতুক এক সন্দেহের শিকার হওয়া। কেউই এ সন্দেহের শিকার হতে চায় না। তাই পরিচিত জনদের সকল দরজা তার জন্য বন্ধ। গোটা পৃথিবী তার কাছে আজ ছোট হয়ে গেছে। সরকারের সহযোগী ‘ফ্র’- এর কথায় এমনটি হতোনা। ওরা বলেছিল, ভাইয়ার বিশ্বাসঘাতকতাকে কনডেম করে সরকারের কাছে একটা স্টেটমেন্ট রেকর্ড করলেই পড়াশুনার সুযোগ এবং সরকারী বাড়ী দুই-ই পাওয়া যাবে। কিন্তু রোকাইয়েভা এটা প্রত্যাখ্যান করেছে। এর পরিণতি কি সে জানত। কিন্তু যে পরিণতি হোক ভাইয়ের জীবন দেয়ার চেয়ে বড় কি? না তা নয়। সুতরাং হাসিমুখেই সে এ জীবন বরন করে নিয়েছে। তার নিজের জন্য কোন দুঃখ নেই। দুঃখ হচ্ছে দাদীর জন্য। কষ্ট সহ্যের বয়স তো আর নেই। ঘরের দরজায় এসে পড়েছে। দরজায় নক করল রোকাইয়েভা। হাত দু’টিকেও ভারী মনে হচ্ছে রোকাইয়েভার।
দরজা খুলে গেল। হাসিমুখে দাদী দাঁড়িয়ে। বিছানায় সেই জায়নামাজ এবং কোরআন শরীফ। রোকাইয়েভা বুঝল দাদী কোরআন শরীফ পড়ছিল।
দাদীর মুখে হাসি, কিন্তু দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে হাসির উপর আন্ধকার একটা ছায়া। দাদীর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে এবং তার আধময়লা কাপড় দেখে ভেতর থেকে বেদনাটা উথলে উঠল রোকাইয়েভার। সে দাদীকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে দাদী? শেষের কথাগুলো রোকাইয়েভার ভেঙ্গে পড়তে চাইলো। দাদী রোকাইয়েভার পিঠ চাপড়ে অত্যন্ত পরিষ্কার কণ্ঠে বলল, আমার কোন কষ্ট নেই বোন। গোডাউনের মত এই গরাদ ঘরে থেকে আমি যে তৃপ্তি পাচ্ছি তা এতদিন এয়ারকন্ডিশন ঘরে থেকে পাইনি।
-সত্যই বলছ, সত্যই তোমার কোন কষ্ট হচ্ছেনা দাদী?
-হ্যাঁরে হ্যাঁ। সুখত মনের জিনিস, বাইরের দুঃখ দারিদ্রের সাথে তার কোনই সম্পর্ক নেই। দাদীকে থামিয়ে দিয়ে তার মুখের উপর চোখ রেখে রোকাইয়েভা বলল এত শক্তি তুমি কোথা থেকে পাও দাদী?
-কোথা থেকে পাই? জাতির প্রতি ভালোবাসা থেকে।
আজ যুগ যুগ ধরে কম্যুনিষ্ট সরকার পশু শক্তি আমার মুসলিম ভাই বোনদেরকে যে কষ্ট দিচ্ছে তার কোন পরিমাপ নেই। সে দিকে তুমি যদি একবার চোখ মেলে তাকাও তাহলে নিজের যে কষ্ট তাকে কষ্টই মনে হবে না।
ঘরে একটি মাত্র খাটিয়া। একটা টেবিল একটা চেয়ার। সাথে একটা বাথরুম। তাদের বাড়িটি কেড়ে নিয়ে সরকার এখানে এনে তাদের তুলেছে। সরকারের ইচ্ছামত বিবৃতি না দেয়ায় হুমকি দেয়া হয়েছে। এ ঘরটিও কেড়ে নেয়া হবে এবং বিদ্রোহী হিসেবে শ্রম শিবিরে পাঠান হবে। কিন্তু এর পরও রোকাইয়েভা পারেনি তার ভাইয়াকে বিশ্বাসঘাতক বলে আভিহিত করতে।
রোকাইয়েভা খাটিয়ায় গিয়ে বসল। পাশেই টেবিল। টেবিলে প্লেট দিয়ে একটা বাটি ঢেকে রাখা। রোকাইয়েভাই এটা সকালে রেখে গিয়েছিল। মনে হচ্ছে কেউ তাতে হাত দেয়নি। মনটা আনচান করে উঠল রোকাইয়েভার। সে দ্রুত প্লেট তুলে নিল। দেখল বাটিতে একখণ্ড রুটি। এ রুটি দাদীর জন্য রেখে দিয়েছিল। দাদী রুটিতে হাত দেননি। রোকাইয়েভা দাদীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল দাদী তুমি রুটি খাওনি, না খেয়ে আছ এখন পর্যন্ত?
রুদ্ধ আবেগে গলা কেঁপে উঠল রকাইয়েভার . দাদী ধীরে ধীরে তার কাছে এসে মাথায় হাত রাখল। তারপর সস্নেহে বলল, তুই খেয়ে না গেলে কি আমি খেতে পারি?
সেদিন সকালে একখণ্ড রুটি তাদের ছিল। তারা প্রায় খালি হাতে এখানে এসে উঠেছে। পরার কাপড় ছাড়া আর উল্লেখযোগ্য কিছুই তারা নিয়ে আসতে পারেনি। কিছু রুবল ছিল, সেটা দিয়েই কয়েকদিন তারা রুটি কিনেছে। আজ সকালে রোকাইয়েভা না খেয়েই কাজের খোঁজে গিয়েছিল। দাদীকে বলে গিয়েছিল রুটিটি খাবার জন্য।
দাদীর কথা শুনে রোকাইয়েভা তাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কেঁদে ফেলল। দাদীর শুকনো চোখ দিয়েও এবার নেমে এল অশ্রুর দুটি ধারা। চোখ দু’টি মুছে নিয়ে দাদী বলল, চল বোন রুটি ভাগ করে নেই। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করছি। আমি জানতাম তুই খালি হাতে ফিরে আসবি। কোন দরজাই তোর সামনে খুলবেনা।
দাদীই রুটি ভাগ করল। একভাগ রোকাইয়েভার হাতে দিল। রোকাইয়েভা তার খণ্ডটি দাদীর দিকে তুলে ধরে বলল। এটা তুমি নাও তোমারটা আমাকে দাও।
দাদী স্লান হেসে বলল ঠিক আছে।
দু জনে শুকনো রুটি চিবিয়ে দু গ্লাস পানি খেয়ে নিল। এ সময় দরজায় নক হল। রোকাইয়েভা দাদীর দিকে একবার তাকিয়ে উঠে দাড়াল। দরজা খুলল। দেখল একজন ফুলওয়ালা। তাসখন্দের রাজ পথে এমন কাগজের ফুলওয়ালা অনেক পাওয়া যায়। ঘর সাজানো টেবিল সাজানোর জন্য এদের চাহিদা প্রচুর।
রোকাইয়েভা দরজা খুলে দাড়াতেই ফুলওয়ালা একটা সুন্দর ফুলের ঝাড় তার হাতে গুঁজে দিল। যেন ফরমায়েশি ফুলই সে নিয়ে এসেছে। রোকাইয়েভা মুখ খোলার আগেই ফুলওয়ালা বলল একটা নমুনা দিয়ে গেলাম, পছন্দ কিনা দেখুন বলেই সে পথ চলা শুরু করল। রোকাইয়েভা অবাক হবার চেয়ে বিরক্তই হল। দরজা বন্ধ করে দাদীর দিকে ঘুরে দাডীয়ে বলল। দেখ দাদী কি জ্বালাতন। পয়সা নিল না। কে একজন ফুলওয়ালা দিয়ে গেল।
-এমন তো হয়না কখনও। কি ব্যাপার? -বলল দাদী।
-কি জানি.. বলতে বলতে রোকাইয়েভা ফুলের গুচ্ছটি টেবিলের উপর রাখল। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলো না, পড়ে গেল। মাটির তৈরি রঙ্গিন ফুলদানির তলাটা কেমন উঁছু। তলাটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখল, টেপ দিয়ে ফুলদানীর রংগের একটি কাগজ আটকে রাখা। রোকাইয়েভা তাড়াতাড়ি ওটা খুলে ফেলল। বের হয়ে একটি ভাঁজ করা কাগজ। একটি চিঠি, তার সাথে একটি পাঁচশ রুবলের নোট।
রোকাইয়েভা এবং দাদী দুজনেই বিস্মিত। রোকাইয়েভা চিঠি পড়লঃ
রোকাইয়েভা আমার সালাম নিও। আগামী কাল প্রাভদার তাসখন্দ সন্সকরনে পি ৯১ ক্রমিক নাম্বারে একটি ‘মিস্ট্রেস আবশ্যক’ বিজ্ঞাপন বেরুবে। বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ঠিকানায় তুমি ১০ টায় পৌছাবে। বাসাটা আমির ওসমানের। দ্বিধা করবেনা। তোমার দ্বীনি ভাইদের তরফ থেকেই এই কাজের ব্যবস্থা।
ঐ ভাইদের তরফ থেকেই ৫০০ রুবল পাঠান হলো তাৎক্ষনিক খরচ মিটানোর জন্য।
ওয়াসসালাম-
‘যুবায়েরভ’
রোকাইয়েভা চিঠি পড়ে দাদীর হাতে দিল। দাদীও চিঠিটি পড়ল। পড়ে বলল কে যুবায়েরভ ?
-মনে আছে দাদী ভাইয়ার মৃত্যুর খবর এই যুবায়েরভের চিঠিতেই পেয়েছিলাম।
-মনে আছে, তাইত ভাবছি কে এই যুবায়েরভ!
-আশ্চর্যের কথা। আমরা কোথায় আছি আমাদের কি প্রয়োজন সবই তার জানা আছে!
দাদী কোন উত্তর দিল না। চোখ বন্ধ করে ভাবছিলো। অনেক্ষন পরে চোখ খুলে রোকাইয়েভার দিকে চেয়ে বলল, রোকাইয়েভা, আমরা বোধহয় একা নই। কম্যুনিস্ট সরকার ও ‘ফ্র’ এর সমান্তরালে দেশে আরেকটা শক্তি অদৃশ্যভাবে কাজ করছে। যুবায়েরভ সে শক্তিরই প্রতিক।
দাদী থামল, আবার চোখ দুটি বন্ধ। চোখ দুটি খুলল তার অনেকক্ষন পর। দু’টি চোখ তার উজ্জ্বল। বলল, বুঝতে পেরেছি, প্রাভদার বিজ্ঞাপন তোকে একটা কাজ দেবার অধিকার সৃষ্টিরই কৌশল।
একটু থেমে আবার দাদী বলল, ওরা কি করছে, বলতে পারিস রোকাইয়েভা?
-না দাদী এদের জানিনা। কিন্তু গোপন পত্রিকা সামিজদাদ থেকে জানি, কারা একদল মানুষ এদেশের মুসলমানদের জাগরন ও মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে।
-সামিজদাদ কি? -বলল দাদী।
-সাইক্লোস্টাইল করা গোপন নিয়মিত পত্রিকা। ওতে থাকে এদেশের বিপ্লবী কর্ম তৎপরতার খবর, কম্যুনিস্ট সরকারের অপকীর্তি ও সন্ত্রাসের বিবরন এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী আন্দোলনের নানা তথ্য। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে এর কয়েকটা কপি দেখেছি।
দাদীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বলল। তুই যাই বলিস, আমার খুব আনন্দ লাগছে। আমার জাতি জাগছে জেগে উঠেছে আমার জাতি। বলতে বলতে আবেগে উঠে দাঁড়াল দাদী। রোকাইয়েভা কাছে আসে, তার ঘাড়ে একটা হাত রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল আমার জামি কি এদের জানত নাকি?
-জানবেনা কেন দাদী? ভাইইয়াদের কাছেই সব তথ্য আসে।
-তাহলে বলছি, আমার জামিল এদের সাথে ছিল। তাইত সে জীবন দিল।
তারপর দু’টি হাত উপরে তুলে দাদী বলল, হে আল্লাহ কম্যুনিস্ট সরকারের সহযোগিতা করে এ পরবারে যে পাপ হয়েছিল, জামিলের রক্ত দিয়ে তুমি তার করে দাও।
দাদীর দু’গন্ড দিয়ে দ’তী অশ্রুর ধারা নেমে এল। রোকাইয়েভা অপলক ভাবে তাকিয়েছিল দাদীর দিকে। হঠাৎ যেন তার মনে হোল এ কান্না তার দাদীর নয়, গোটা মধ্য এশিয়ার। আমুদরিয়া ও শিরদরিয়ায় যে অশ্রু বইছে যুগ যুগ ধরে এ যেন সেই অশ্রু। সেও দাদীর সাথে হাত তলল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল ‘আমিন’।
গভীর রাত। রোকাইয়েভা এবং দাদী গাঢ় ঘুমে অচেতন। তাদের দরজায় নক হলো ঠক ঠক ঠক। শক্তিশালী নক। ঘুম তাদের ভাঙ্গলোনা। আবার নক হলো ঠক, ঠক, ঠক।
এবার আগের চেয়ে জোরে। কিন্তু ঘুম তাদের ভাংলোনা। দাদি একটু নড়ে উঠলেন মাত্র। এবার দরজায় কারাঘাত, একবার, দুইবার, তিন………।
চমকে উঠে বসলো দাদী। প্রথমে কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। তারপর যখন বুঝেত পারলো চমকে উঠলো। এত রাতে দরজায় নক করে কে?
আবার কারাঘাত হলো। দাদী রোকাইয়েভাকে জাগিয়ে দিল। সব শুনে রোকাইয়েভা আঁতকে উঠলো। এত রাতে কে আসতে পারে। না ভুল করে কেউ নক করছে এখানে। খোলা উচিৎ কিনা? একটু দরজার কাছাকাছি গিয়ে জিজ্ঞেস করল কে ?
-দরজা খুলুন। বাহির থেকে ভারি কন্ঠে উত্তর এল।
-কে আপনারা, কাকে চান? ভায়ার্ত কন্ঠ রোকাইয়েভার।
কোন জবাব এলনা। আগের সেই ভারি কন্ঠ আরো ভারি গলায় বলল, তাড়াতাড়ি খুলুন নইলে ভেঙ্গে ফেলবো।
জবাব না পেলেও রোকাইয়েভা বুঝল এরা সরকারের লোক। সরকারী লোক না হলে এমন উদ্ধত কন্ঠ আর কারোরই হতে পারে না। রোকাইয়েভা তার দাদীকে বলল ওরা সরকারের লোক না খুলে উপায় নেই। কিন্তু এই কথা বলার সাথে সাথে অন্তরটা ভীষণ কেঁপে উঠল রোকাইয়েভার। সেদিন সরকারি লোকেরা যে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল তা মনে পড়লো। দাদী ওরা নিয়ে যেতে এসেছে।
দাদীকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছে রোকাইয়েভা। আবার প্রবল ধাক্কা এল দরজায়। ভীত- চকিত রোকাইয়েভা যন্ত্রের মত খুলে দিল।
দুজন লোক দীর্ঘাংগ। মাথাই ফেল্ট হ্যাট। মুখটা ভালো করে দেখা যায় না। দাদী এবং রোকাইয়েভা দেখেই বুঝতে পারলো ওরা পুলিসের লোক। দরজা খুলতেই একজন সেই ভারি গলায় রোকাইয়েভাকে বলল, আপনি আমাদের সাথে আসুন।
রোকাইয়েভা দু’পা পিছিয়ে গেল ঘরের ভিতর। বলল, কোথায় যাব, কেন যাব? কাঁপছে রোকাইয়েভা।
-সময় নষ্ট করবেন না, লাভ নেই। বেরিয়ে আসুন। রোকাইয়েভা গিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরল। ঢুকরে কেঁদে উঠল। বলল, আমি যাব না, আমি দাদীকে ছেড়ে যাব না। দাদী পাথরের মত। তার চোখে কোন আশ্রু নেই। যেন কোন অনুভুতিই নেই তার। দু’জনের একজন ঘরে ঢুকল। বলল সময় আমাদের নেই, মাফ করবেন আমাদের।
বলে হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে গেল রোকাইয়েভাকে। রোকাইয়েভা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। বলল দাদীর কেউ নেই, দাদীকে ছেড়ে একা আমি যাবনা। দাদীকেও নিয়ে চল।
কিন্তু সেই নিস্ফল চিৎকার। নিস্ফল আবেদন নিরব রাতে একটা বড় প্রতিধ্বনিই তুলল শধু। কোন ফলই হল না।
রাস্তায় একটা কাল গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। রোকাইভাকে তারা সেখানে নিয়ে তুলল। ছোট্ট একটা হিস হিস হিস হিস শব্দ তুলে চলতে শুরু করল গাড়ী।
দু’পাশে অনেক ফ্লাটের সারি। কিন্তু একজন অসহায় নারীর আর্ত চিৎকার কোথাও কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল না। একটা কৌতুহলি মুখ কোন জানালায় উঁকি দিলোনা। একটা জানালার পর্দাও একটু নড়ল না। যেন একটা মৃত্যু পুরী। কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের এটাই বাস্তবতা। ভয় এবং প্রতি মুহুর্তের উদ্বেগ কারো মধ্যে কোন জীবনাবেগ রাখেনি, সবাইকে একটা জীবন্ত লাশে পরিনত করছে। এ লাশে যন্ত্রিক কর্মক্ষমতা আছে, কিন্তু হৃদয় নেই, কোন অনুভুতি নেই।
সে দিন নাইট ডিওটি ছিল যুবায়েরভের। যুবায়েরভ গুপ্ত পুলিশ এবং বিশ্বরেড সংস্থা ‘ফ্র’ এর রেকর্ড সেকশনের একজন কর্মী। উল্লেখ্য, কম্যুনিস্ট সরকারের গুপ্ত পুলিশ এবং বিশ্বরেড সংস্থা ‘ফ্র’ এখন মধ্য এশিয়ায় এক হয়ে কাজ করছে।
যুবায়েরভের অফিসিয়াল নাম ভিক্টর কুমাকভ। তার দেহে রয়েছে মিশ্র রক্ত মা তুর্কি উজবেক। রুশ উজবেক মৈত্রির প্রমান দিতে গিয়ে তার মা হামুদা নাজিয়ানভাকে একজন রুশকে বিয়ে করতে হয়। সেই রুশ যুবক পেট্রভের কোন ধর্ম ছিল না। কিন্তু স্ত্রী হামুদা নাজিয়ানভার ধর্মনিষ্ঠা তাকে ধীরে ধীরে আকৃষ্ট করে এবং অবশেষে স্ত্রীর কাছে সে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। তাদের একমাত্র ছেলে যুবায়েরভ। কিন্তু পেট্রভের ধর্মবিশ্বাস যেমন গোপন ছিল, তেমনি যুবায়েরভের নাম তারা গোপন রাখে। যুবায়েরভের সরকারি নাম ভিক্টর কুমাকভ। সব সরকারী খাতায়, সরকারী ও সামাজিক মহলে সে এই নামেই পরিচিত।
যুবায়েরভ মায়ের কাছে কুরআন পাঠ ও ধর্ম শিক্ষা লাভ করেছে। ইসলামের সোনালী কাহিনী শুনেছে সে মায়ের কাছে। যুবায়েরভ মায়ের চেয়ে বড় শিক্ষক আর কাউকে মনে করে না।
রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টা পর্য্যন্ত যুবায়েরভের নাইট ডিউটি। একজন কর্মঠ রুশ হিসাবে পরিচিত। কাজে কোন ফাঁকি না দেয়া এবং বিশ্বস্ততার জন্য সকলের প্রিয় সে। একদিকে রক্তের পরিচয়ে রুশ, অন্যদিকে কর্তব্যনিষ্ঠা এই দুই কারনে রেকর্ড সংরক্ষনের মত গুরুত্বপূর্ন বিভাগে তাকে আনা হয়েছে। জামিলের প্রানদন্ডের পর নিরাপত্তা বিভাগে যে বিশাল হয়েছে। তারপরেই যুবায়েরভ এই দায়িত্ব পেয়েছে। মধ্য এশিয়া অঞ্চলের শাস্তি প্রাপ্তরা কে কোথায়, কোথায় যাচ্ছে, কোত্থেকে আসছে এর যাবতীয় রেকর্ড এখন তার কাছে। সকল রাজনৈতিক সাজা প্রাপ্তদের ফাইলের শেষ আস্তানা এখন তার সেকশনের সেফটি ভল্টগুলো।
সাইমুমের সাথে যুবায়েরভের সম্পর্ক তার ছাত্রজীবন থেকেই। সে এখন সাইমুমের একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মী। সাইমুমের গোয়েন্দা ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল সে। চাকুরীর সময়টুকু ছাড়া সব সময় সে সাইমুমের কাজেই ব্যয় করে।
সেদিন রাত সাড়ে তিনটা। হাতে কোন কাজ নেই। বসে বসে ঝিমুচ্ছিল যুবায়েরভ। হঠাৎ টেবিলের লাল সংকেত জ্বলে উঠল। সেই সাথে পাশ দিয়ে ঘূর্ণায়মান স্বয়ংক্রিয় ক্যারিয়ারে কালো ফিতা মোড়া একটা লাল ফাইল এলো টেবিলে। কালো ফিতামোড়া দেখলেই মনটা আনচান করে ওঠে যুবায়েরভের। নিশ্চয় কেউ ফায়ারিং স্কোয়াডে গেল কিংবা কাউকে নিশ্চয় চালান করা হলো দাস শিবিরে। এ ফাইলটা দেখেও মনটা তার তেমনি হলো।
নিত্যদিনের মত বাম হাতে টেনে ফাইলটি কাছে নিয়ে পাশের ষ্টিল ভল্ট থেকে ফাইলের রেফারেন্স অনুসারে রেকর্ড রেজিষ্টার বের করলো। তারপর ফাইলটি খুলল যুবায়েরভ। ফাইলের শিরোনাম দেখেই চমকে উঠল সে। কিছুক্ষণের জন্য সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। এযে রোকাইয়েভার ফাইল। তাকে শ্রম শিবিরে চালান করা হলো। কিন্তু কখন? আজ বিকালেইতো …….।
ফাইলের পাতা উল্টালো যুবায়েরভ। দেখতে পেল ফাইলের ব্রিফ সামারি। আজ রাত দু’টায় গ্রেপ্তার। রাত তিনটায় কারগো প্লেনেই পাঠানো হয়েছে মস্কোর মস্কোভা শ্রম শিবিরে ওম্যান ব্রাঞ্চে।
যুবায়েরভের সমগ্র সত্তায় ঝড় বইছে। দু’চোখের কোণ তার সিক্ত হয়ে উঠল অশ্রুতে। বাঁচাতে পারলনা তারা অসহায় মেয়েটিকে। তাদের হিসাবে ভুল হয়েছে। তারা মনে করেছিল, বাড়ী ঘর সহায়-সম্পদ এবং যাবতীয় সুখ-ভোগ কেড়ে নেবার পর তাদের হিংসার পরিতৃপ্তি হয়েছে। আর কিছু না ঘটলে এই মুহূর্তে ঘাটাতে যাবেনা পরিবারটিকে। কিন্তু তাদের সব ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হলো যুবায়েরভের।
দুর্বল হাতে রেকর্ড রেজিষ্টার টেনে নিল যুবায়েরভ। মস্কোভা শ্রম শিবিরে ওম্যান ব্রাঞ্চে মধ্য এশিয়া থেকে চালান হওয়াদের তালিকায় রোকাইভার নাম রেকর্ড করার জন্য সেই রেকর্ড রেজিষ্টারটি খুলল। নামের তালিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে আরেকবার চমকে উঠল যুবায়েরভ। একি! আয়েশা আলিয়েভাকে তাহলে অবশেষে মারা হয়নি? সেও ঐ মস্কোর মস্কোভা শ্রম শিবিরে? অথচ সবাই জানে তার প্রাণদন্ড হয়েছে। মনে হয় সরকার তার মত একটা প্রতিভাকে হাত করার আশা ত্যাগ করেনি। দুঃখের মাঝেও আয়েশা আলিয়েভা বেঁচে থাকার সংবাদে যুবায়েরভ খুশি হলো।
রেকর্ড রেজিষ্টারে আয়েশা আলিয়েভার পাশেই রোকাইয়েভার নাম উঠল। রেকর্ড রেজিষ্টারটা বন্ধ করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হলো রোকাইয়েভার দাদীর কথা। ফাইলে তাকে গ্রেপ্তারের কথা নেই। তাহলে কোথায় তিনি? চঞ্চল হয়ে উঠল যুবায়েরভের মন। ঘড়িতে দেখল যে ভোর চারটা বেজে গেছে। টেবিলের ফাইলগুলো গুটিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এল।
আফিসের গাড়ীতে সে ন্যাশনাল পার্ক পর্যন্ত এল। তারপর পার্কে একটু বেড়াবে একথা বলে সে গাড়ী থেকে নেমে এল। সে ঠিক করে নিয়েছে, এখনই একবার রোকাইয়েভার ফ্লাটে গিয়ে সে রোকাইয়েভার দাদীর খোঁজ করবে।
রোকাইয়েভার সেই ফ্লাটে দক্ষিণ তাসখন্দে ১১ নং কলোনীতে এখান থেকে হেঁটে গেলে এক ঘণ্টার পথ। কিন্তু সেখানে সে অন্ধকার থাকতেই পৌঁছাতে হবে। কিন্তু এ সময় গাড়ি পাওয়া যায় না। মুস্কিলে পড়ল যুবায়েরভ। এ সময় পাশ দিয়ে দুধ সাপ্লাইয়ের গাড়ি যাচ্ছিল। যুবায়েরভ হাত তুলে দাঁড় করাল। জিজ্ঞাসা করে জানল গাড়িটি ডেইরী ফার্মে যাচ্ছে। ১১ নং কলোনীর পাশ দিয়েই যাবে। যুবায়েরভ নিজের আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে তাকে লিফট দেবার জন্য অনুরোধ করল। সিকিউরিটি বিভাগের কার্ড দেখে ড্রাইভার এবং ইনচার্জ একদম মোমের মত গলে গেল।
যুবায়েরভ সাড়ে চারটায় গিয়ে ১১ নং কলোনীর গেটে নামল। তারপর রোকাইয়েভাদের ফ্লাট খুঁজে নিতে তার কষ্ট হলো না।
এখনো অন্ধকার। ফ্লাটের সামনে রাস্তায় একটু দাঁড়াল যুবায়েরভ। চারদিকে তাকিয়ে দেখল কেউ কোথাও নেই। রোকাইয়েভার ফ্লাটের কাছাকাছি গিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল যুবায়েরভের। দরজা খোলা! কেন খোলা? তাহলে কি তিনি নেই? কোথায় যাবেন তিনি এই রাতে? গুম করা হয়েছে তাকে? নানা আশংকা, নানা প্রশ্নে যুবায়েরভের বুক তোলপাড় করে উঠল।
দরজায় গিয়ে দাঁড়াল যুবায়েরভ। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। যুবায়েরভ ধীরে ধীরে ডাকল ‘দাদী’। কোন সাড়া নেই। যুবায়েরভ ঘরে প্রবেশ করলো। দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর সতর্কভাবে টর্চের আলো ফেলল ঘরে। দেখল, বিছানা খালি। টর্চের আলো মেঝেই গিয়ে পড়ল। দেখা গেল লুটোপুটি করে পড়ে আছে একটা দেহ। তাড়াতাড়ি ঝুকে পড়ল যুবায়েরভ। যুভায়েরভ খুশী হলো, চোখ খুলেছেন তিনি। ক্ষীণ কন্ঠে বললেন, কে তুমি, কি চাও? আমার রোকাইয়া কোথায়?
-দাদী, আমি যুবায়েরভ। আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
-তুমি যুবায়েরভ। তোমার আগমন এতো দেরিতে কেন? আমার রোকাইয়েভা কোথায়? আমি কোথায় যাব?
-সব কথা বলব দাদী। কিন্তু এখনি আমাদের এখান থেকে সরতে হবে।
-কিন্তু রোকাইয়া যদি এসে এখানে আমাকে না পায়।
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল দাদীর কন্ঠ। যুবায়েরভেরও চোখের পাতা ভিজে এল। কিন্তু সময় নেই। অন্ধকার থাকতেই এ কলোনী থেকে তাকে বের হতে হবে। যুবায়েরভ বলল, দাদী রোকাইয়েভার চিন্তা আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আপনি উঠুন।
বলে যুবায়েরভ দাদীকে হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, দাদী আপনি আমার কাঁধে ভর দিয়ে চলুন।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে যুবায়েরভ বলল, ফুলের ঝাড়টি তো টেবিলের উপর, কিন্তু চিঠিটা কোথায়?
-ওটা তোষকের তলে। বলল, দাদী।
যুবায়েরভ দাদীকে একটু দাঁড় করিয়ে টেবিল থেকে ফুলের ঝাড়টি এবং তোষকের তলা থেকে চিঠিটি নিয়ে নিল। তারপর দাদীকে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
কলোনীর রাস্তা দিয়ে চলতে চলতেই যুবায়েরভ ঠিক করল তার সরকারী বাড়ীর চাইতে আমীর ওসমানের বাড়ীই দাদীর জন্য হবে উপযুক্ত আশ্রয়। ওখানে ভালো সঙ্গও পাবেন তিনি।
কলোনীর গেট দিয়ে যখন সে বেরিয়ে এল তখন অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। কিন্তু লোকজন কেউ বের হয়নি।
যুবায়েরভ রাস্তায় নেমেই একটা ট্যাক্সি ডেকে দাঁড় করাল।