০৬. রক্ত সাগর পেরিয়ে (পর্ব ১-২)

 ০৬. রক্ত সাগর পেরিয়ে


পর্ব ১ 

সেদিন প্রতিদিনের মতই পিয়ালং উপত্যকার জীবন শুরু হলো। উপত্যকার ও পাহাড়ের গা বেয়ে কয়েক’শ তাঁবু।
উপত্যকার বড় তাঁবু থেকে আজানের ধ্বনি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার সংগে সংগে তাঁবুগুলো জেগে উঠল। পুরুষরা ওজু করে মসজিদে গেল। মেয়েরা আবার তাবুর ভেতরেই ফিরে গেল।
বাচ্চারা তখনও ঘুমে। মেয়েরা নামাজ সেরে কেউ গড়িয়ে নিচ্ছিল, কেউ বা তাবুর বাইরে এসে পাথরে বসে গুনগুন করছিল। হয় কুরআন তেলাওয়াত। নয়তো কোন উজবেক কবিতা তাদের মুখে। আবার কেউ ঘরকন্নার কাজ শুরু করে দিয়েছিল।
আর ছেলেরা নামাজ শেষে নিত্যকার মত মসজিদেই বসেছিল। ইমাম তকিউদ্দিন আলোচনা করছিলেন সমসাময়িক প্রসংগ নিয়ে। আলোচনা তার খুবই উপভোগ্য হয়, যতক্ষণ আলোচনা হয় বিছানার সাথে আঠার মত লেগে থাকে মানুষ। আজও তাই হয়েছে। নীরবে গোগ্রাসে গিলছে লোকেরা তার বক্তৃতা।
এমন সময় আকাশ থেকে হেলিকপ্টারের শব্দ ভেসে এল।
পিয়ালং আশ্রয় শিবিরের পরিচালক আবু ওমায়েরভ উঠে দাঁড়িয়ে ইমাম তকিউদ্দিনের কানে কানে কিছু বলল।
ইমাম সাহেব তার বক্তৃতা বন্ধ করে বলল, হেলিকপ্টারের শব্দ শুনা যাচ্ছে আপনারা শান্ত হয়ে বসুন। এখনই এ ব্যাপারে খবর পাবেন। ইমাম সাহেবের কানে কানে কথা বলার পরই আবু ওমায়েরভ মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তার হাতে দূরবীন।
আকাশে তিনটি হেলিকপ্টার উপত্যকার প্রান্ত দিয়ে চক্কর দিচ্ছিল। চোখে দুরবীন লাগিয়ে ওমায়েরভ দেখল হেলিকপ্টারগুলোর গায়ে ‘ফ্র’- এর চিহ্ন আঁকা।
ওমায়েরভ দ্রুত ফিরে এল মসজিদে। সে আসার পর ইমাম তকিউদ্দিন তার কথা বন্ধ করল। কথা শুরু করল এবার ওমায়েরভ।
ওমায়েরভ পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক। তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্র সে। চাকুরী করছিল কৃষি দপ্তরের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনে। বিয়ে করেছে দু’বছর হলো। সাইমুমের কর্মী ছিল ওমায়ের ছাত্র জীবন থেকেই। তার উপরের অফিসার ছিল অ-তুর্কি, রুশীয় অঞ্চলের একজন গোড়া অফিসার। তার চোখে ধরা পড়ে যায় ওমায়েরভ। অবশেষে সে গ্রেফতার এড়িয়ে রাতের অন্ধকারে সবকিছু ফেলে স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়েটির হাত ধরে পালিয়ে আসে। সে এক বছর আগের কথা। বিশ্বস্ততা কর্মদক্ষতা গুনে সে এখন সাইমুমের একটি গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রের পরিচালক। বুদ্ধিমান ওমায়েরভ ‘ফ্র’ এর হেলিকপ্টার দেখেই বুঝতে পেরেছে, এ আশ্রয় কেন্দ্রের জন্য একটা চুড়ান্ত সময় আসন্ন। সে শান্ত কন্ঠে বলল, প্রিয় ভাইয়েরা শত্রুপক্ষের তিনটি হেলিকপ্টার আমাদের মাথার উপর উড়ছে। জানিনা তারা কি চায়। কিন্তু, যতটুকু আঁচ করা যায় তাতে বলতে পারি বোমার ভয় ওগুলো থেকে নেই, আর ওগুলো প্যারাট্রুপারস নামালে কয়জনকেই বা নামাতে পারে। সে সাহস তারা করবে বলে আমি মনে করি না। একটাই হতে পারে ওরা আরও নিচে নেমে এসে মেশিনগান দাগাতে পারে। এ অবস্থায় সকলের প্রতি আমার পরামর্শ আপনারা যে যার তাবুতে ফিরে যান, নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকুন এবং আদেশের অপেক্ষা করুন। হেলিকপ্টারগুলো থেকে যদি ফায়ার আসে তাহলে তা থেকে আত্মরক্ষা আপনাদেরই করতে হবে।
একটু থামল ওমায়েরভ। তারপর বলল, আপনারা আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে স্থান ত্যাগের জন্যেও তৈরী থাকবেন। আমার মনে হয় এই হেলিকপ্টারগুলো একটা অনুসন্ধানী দল। এদের পাঠানো খবরের পরেই আমাদের উপর আসল বিপদ আসবে।
আবার থামল ওমায়েরভ। তারপর অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল, প্রিয় ভাইয়েরা, আমরা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে সাধ্যমত চেষ্টা করব, কিন্তু যে কোন পরিণতির জন্যই আমরা প্রস্তুত। জীবন এবং মৃত্যু দুই-ই আমাদের কাছে প্রিয়। আমাদের বাঁচাটা আল্লাহর জন্য, মৃত্যুও আল্লাহর জন্য। সুতরাং, কোন কিছুতেই আমাদের দুঃখ নেই, ভয় নেই। আমাদের শুধু প্রার্থনা যুগ যুগ ধরে এই ভুখন্ডের মুসলমানরা পরাধীনতার অসহনীয় জ্বালা ভোগ করছে, আল্লাহ্ তাদের মুক্ত করুন, স্বাধীনভাবে মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ তাদের দান করুন।
কথা শেষ করল ওমায়েরভ। নীরবে এক এক করে সবাই চলে গেল যে যার তাবুতে। ইমাম তকিউদ্দিনও।
সবার শেষে বেরুল ওমায়েরভ। অনেকখানি ফর্সা হয়ে গেছে তখন। হেলিকপ্টার আরো কিছুটা নিচে নেমে এসেছে। এক সাথেই তিনটা চক্কর দিচ্ছে। হেলিকপ্টারগুলো আকারে কিছুটা বড়, গঠনটাও একটু ভিন্ন প্রকৃতির। নিছক পর্যবেক্ষনের ছোট হেলিকপ্টার এগুলো নয়।
ওমায়েরভ তার তাবুতে এসে পৌছল। তার স্ত্রী আরেফা দু’বছরের মেয়েটির হাত ধরে তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। তার চোখে একরাশ শংকা। কিন্তু দু’বছরের ফাতিমা খুবই খুশী। ওমায়েরভ যেতেই মায়ের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে এসে ওমায়েরভের হাত ধরে বলল, ঐ দেখ আব্বা, কি নাম ওটার?
ওমায়েরভ ওকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে বলল, ওটা হেলিকপ্টার।
এটুকু কথায় ফাতিমার মন তৃপ্ত হয়নি। হৈ চৈ করে আরও কিছু বলছিল সে। কিন্তু ওমায়েরভ সেদিকে কান দিতে পারলো না।
স্ত্রীর শংকাকুল চোখের দিকে চেয়ে ওমায়েরভ বলল, ওটা ‘ফ্র’ এর হেলিকপ্টার। আমাদের আশ্রয় কেন্দ্র ধরা পড়ে গেছে আরেফা। সম্ভবত আমাদের সরতে হবে। তৈরী হয়ে নাও।
বলে ওমায়েরভ তাবুর ভিতরে ঢুকে স্টেনগানটা কাধে তুলে নিল তার সাথে গুলির বাক্সও। তারপর বাইরে বেরুল সে তাবু থেকে। আবার দৃষ্টি ফেললো হেলিকপ্টারের দিকে। এবারের বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, হেলিকপ্টারগুলো গোটা উপত্যকা কভার করে তিনটি সমান্তরাল লাইনে এগিয়ে আসছে কাত হয়ে, ঠিক বোমারু বিমানগুলোর বোমা ফেলার ভংগির মত করে। তাহলে কি কিছু ফেলছে হেলিকপ্টারগুলো? কি ফেলছে? উৎকন্ঠিত হয়ে উঠল ওমায়েরভ।
হেলিকপ্টারগুলো আসছে উত্তরদিক থেকে বাতাসও উত্তরে হঠাৎ বাতাসে সুক্ষ্ণ এক অপরিচিত গন্ধ পেল সে। বিজ্ঞানের ছাত্র ওমায়েরভ সংগে সংগে বুঝতে পারল, অন্য কিছু নয় গ্যাসের গন্ধ এটা। ওরা তাহলে গ্যাস বোমা ফেলছে?
আৎকে উঠল ওমায়েরভ। দৌড়ে সে তাবুর ভিতরে ঢুকে গেল এবং ব্যাটারী চালিত সাইরেন বের করে এনে চেপে ধরল তার সুইচ।
তীব্র কন্ঠে বেজে চলল সাইরেন।
হৈ চৈ পড়ে গেল আশে পাশের তাবুগুলোতে। এ সংকেতের অর্থ সকলেই বুঝে। এ সংকেতের নির্দেশ ছুটে সরে যেতে হবে অন্য কোথাও।
হেলিকপ্টারগুলো অর্ধেকটা উপত্যকা পেরিয়ে এসেছে। ছুটে আসছে ওগুলো। বাতাসে গন্ধ বেড়ে গেছে, কেমন যেন ভারী মনে হচ্ছে বাতাস। স্ত্রী আরেফা বলল, ফাতিমা কেমন যেন করছে।
চমকে ফিরে তাকাল ওমায়েরভ। দেখল, ফাতিমার ঘাড় কাত হয়ে ঢলে পড়েছে। তার হাতে পায়ে হাত দিয়ে বুঝল ওগুলো ঠান্ডা এবং শিথিল। হৃদয়ে যন্ত্রণার এক ছোবল লাগল ওমায়েরভের। ভাবল সে, তাদেরও তো এখান থেকে সরে পড়া দরকার। কিন্তু কেমন করে পালাবে সে সবাইকে রেখে।
স্ত্রীর দিকে চেয়ে ওমায়েরভ বলল, আরেফা, শত্রুরা গ্যাসবোমা ছেড়েছে। তুমি ফাতেমাকে নিয়ে পালাও। আমি আসছি।
আরেফা স্বামীর হাত চেপে ধরে বলল, তুমি চল, তোমাকে রেখে আমি যাব না।
ওমায়েরভ উত্তরের তাবুর সারির দিকে চেয়ে বলল, আরেফা ওদিকের কাউকে তো আমি বেরুতে দেখছি না! আমি কি করে সরে যাব তাদের রেখে!
হেলিকপ্টার আরও সামনে চলে এসেছে। আরেফা চিৎকার করে উঠল, আমার ফাতিমার কি হল, দেখ কি হল। আরেফার কোলে ঢলে পড়েছে দু’বছরের ফাতিমা। গোটা দেহ তার নীল। জ্ঞান হারিয়েছে সে। ফাতিমার মুখের দিকে একবার চেয়ে ফিরে তাকাল ওমায়েরভ উত্তর দিকে। দূরবীন তার চোখে। দেখল সে। দেখে শিউরে উঠল ওমায়েরভ। তাঁবুর পাশে, পাথরের উপর ঢলে পড়েছে মানুষ। এদিকে অনেকে দেখল পাহাড় ডিঙিয়ে পথে সরে যাবার চেষ্টা করেছিল, মৃত্যু-গ্যাসের তারাই শিকার হয়েছে প্রথম। মাথা ঝিমঝিম করছে ওমায়েরভের।
এসে স্ত্রীর কাঁধে হাত রাখল। টলছে আরেফা। বুকে জড়িয়ে রেখেছে ফাতিমাকে।
ওমায়েরভ ফাতিমাকে আরেফার কোল থেকে নিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিল অত্যন্ত আদরে, তারপর একটা চুমু খেয়ে আরেফার একটা হাত ধরে বলল চল।
আরেফা চিৎকার করে উঠল, ফাতিমাকে রেখে আমি যাবনা।
ওমায়েরভ আর কথা না বলে ফাতিমাকে তুলে নিল বুকে, তারপর আরেফার হাত ধরে অনেকই যে পথে চলেছে, সে পথে যাত্রা করল ওমায়েরভ।
হেলিকপ্টার তখন মাথার উপরে। ওমায়েরভ দেখল, কয়েকশ’ গজ সামনেই একটা সিলিণ্ডার এসে পড়ল। ফেটে গেল। হাত পায়ের শক্তি নিঃশেষ হয়ে পড়েছিল ওমায়েরভের। স্ত্রী আরেফার দেহের ভার এখন তার উপর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার।
ফাতিমাকে নামিয়ে রাখার জন্যে সে নীচু হল। আরেফা পড়ে গেল।
ফাতিমাকে রেখে ওমায়েরভ দেখল জ্ঞান হারিয়েছে আরেফা। ওমায়েরভ বসে পড়ল। চারদিকে তাকাল। কয়েকগজ দূরেই দেখল, একজন মা তার শিশুকে জড়িয়ে পড়ে আছে। দু’জনেই নিস্তব্ধ। ওমায়েরভ তায়াম্মুম করল। তখনও জ্ঞান আছে তার। দু’টি হাত উপরে তুলল। বলল, হে আল্লাহ আমাদের জীবনকে কবুল কর। মুসলিম হিসাবে যে দায়িত্ব তুমি দিয়েছিলে, তা পালন করতে পারিনি। কিন্তু যখন থেকে বুঝেছি, চেষ্টা করেছি। এ চেষ্টা তুমি কবুল কর, কবুল করে তুমি আমাদের নাজাত দাও, আর আমার জাতিকে তুমি পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত কর। আর………
কথা জড়িয়ে গেল ওমায়েরভের। সে ঢলে পড়ে গেল পাশের পাথরের উপর। হেলিকপ্টার তখন আরও দক্ষিনে এগিয়ে গেছে।

সামনে পাহাড়, পাহাড়ের পরের উপত্যকা পেরুলেই পিয়ালং উপত্যকা। আহমদ মুসা খুশী হল, ‘ফ্র’ এর দলটা পিয়ালং-এ পৌঁছার আগেই তারা এখানে পৌঁছে গেছে। ওদেরকে অনেকটা ঘুরা পথে পিয়ালং-এ আসতে হবে। আহমদ মুসা ভেবে পেলনা এখানে আসার এই দুঃসাহস তারা কেমন করে দেখাতে পারছে? ওদের দলটা তাহলে কত বড়? যত বড়ই হোক শহরের বাইরে এলে ওরা অসহায় হয়ে যায়, একথা তারা তো ভালো করেই বুঝে।
সংকীর্ণ এক গিরি পথ দিয়ে সামনের পাহাড়টা অতিক্রম করল আহমদ মুসার দল। পরের উপত্যকা মাইল খানেকের মত প্রস্থের দিকে। উপত্যকা পার হয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা পিয়ালং উপত্যকার উত্তর দিকের পাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হল। পাহাড়টা বেশ উঁচু এবং দুর্গমও। বাঁ দিকের কিছুটা পথ এগুলে একটা গিরিপথ পাওয়া যায়। ঘোড়ার লাগাম টেনে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল আহমদ মুসা। চলল সেই গিরিপথের দিকে।
উত্তরের গিরিপথ দিয়ে পিয়ালং উপত্যকায় প্রবেশ করছে আহমদ মুসা। বাতাস উত্তর দিক থেকে বইছে। সে গিরি পথে তখন প্রবল বাতাস। পাহাড়ের দেওয়ালে এই করিডোর খুঁজে পেয়ে বাতাস যেন মহাখুশি। পথ শ্রান্ত আহমদ মুসাদের শরীরেও বাতাস শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে।
গিরিপথের মাঝামাঝি তখন তারা। খুব সূক্ষ একটা পরিচিত গন্ধ পেলো আহমদ মুসা। সংগে সংগে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। তার সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ল গোটা কাফেলা। হাসান তারিক পেছন থেকে আহমদ মুসার পাশে এসে দাঁড়াল।
একটা গন্ধ পাচ্ছ তারিক? বলল আহমদ মুসা।
ভ্রু কুঞ্চিত হলো হাসান তারিকের। অনুভব করার চেষ্টা করল সে। বলল, হ্যাঁ খুব সূক্ষ্ম একটা গন্ধ বাতাসে মিশে আছে।
মাথা নিচু করে ভাবছিল আহমদ মুসা। হঠাৎ তার নজর পড়ল ছোট দুই পাথরের মাঝখান দিয়ে বেড়ে ওঠা ঘাসের উপর। ঘাসটির চিকন লম্বা দুই পাতা এবং ডগা নেতিয়ে পড়েছে পাথরের উপর। ঘোড়া থেকে নেমে বসে পড়ল আহমদ মুসা। ভালো করে দেখলে ঘাসটাকে। না, সূর্যের তাপে পাহাড়ী ঘাস এমন কোন দিনই হয়না। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল একই অবস্থা। অথচ একটু বড় গাছগুলির কিছুই হয়নি। এক জায়গায় আহমদ মুসা দেখল, একদল পাহাড়ী পিপড়া সার বাধা অবস্থাতেই মরে পড়ে আছে। যে শস্যকণা তারা বহন করছিল তা পাশেই পড়ে আছে। এ সংঘবদ্ধ মৃত্যুর কোন কারণই খুঁজে পেলনা আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। তার কপাল কুঞ্চিত। হিসেব মিলাতে পারছে না সে। ঘাসের মৃত্যুর সাথে পিপড়াদের মৃত্যুর কোন সম্পর্ক আছে?
আর এদের সকলের সাথে কি এই গন্ধের কোন সম্পর্ক আছে?
উত্তরে বাতাস তেমনি তীব্র ভাবেই বইছিল সেই গিরিপথ দিয়ে।
সবাই তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার চিন্তিত মুখের দিকে। সকলেই উৎকণ্ঠিত। তারা জানে আহমদ মুসা অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না।
আহমদ মুসা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কাছে কোন যুক্তি নেই কিন্তু আমার মন বলছে, আমাদের আর সামনে এগুনো উচিৎ নয়। তারপর তারিকের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, তুমি কাফেলা নিয়ে গিরিপথের মুখে ফিরে যাও। আমি পাহাড়ে উঠব। চারদিকটা একটু দেখে আসি।
বলে ঘোড়ার লাগামটা হাসান তারিকের হাতে দিয়ে দূরবীনটা নিয়ে ঢাল বেয়ে পাহাড়ের উঁচু চূড়ার দিকে উঠতে শুরু করল আহমদ মুসা। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এলো সে। চূড়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিল।
কেমন অপরিচিত এক আশংকা শরীরটাকে মনে হচ্ছে আরও ক্লান্ত করে তুলেছে তার।
আহমদ মুসা বসে আছে দক্ষিনমুখী হয়ে। সামনেই আরো দুটো চূড়া। তার ফাঁক দিয়ে গোটা পিয়ালং উপত্যকাই তার নজরে আসছে। তাঁবুগুলোর সারি স্পষ্ট নজরে পড়ছে। আহমদ মুসা দূরবীন তুলে নিল হাতে। চোখে দূরবীন লাগিয়ে তাকালো পিয়ালং উপত্যকার দিকে। দূরবীনের প্রথম দৃষ্টিটাই গিয়ে পড়ল একটা তাঁবুর পাশে। দূরবীন ধরা হাতটা যেন কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। তাঁবু থেকে একটু দুরে তিনটা দেহ পড়ে আছে, একটা পুরুষের, একটা নারীর, আরেকটা শিশুর। পুরুষের একহাতে স্টেনগান অন্যহাতে শিশুকে ধরা, নারীরও একটা হাত আঁকড়ে ধরে আছে শিশুকে। নিশ্চল নিস্পন্দ ওদের দেহ, ওরা কেউ বেঁচে নেই। প্রবলভাবে কেঁপে উঠল আহমদ মুসার হৃদয়টা। মনের কোনে অপরিচিত আশংকা যাকে দমিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে, মুখ ব্যাদান করে উঠল হৃদয়ের সিংহ দরজায়।
আহমদ মুসার দূরবীনের চোখটা একবার ঘুরে এল গোটা উপত্যকা। একই দৃশ্য নীরব-নিথরভাবে পড়ে আছে মানবদেহগুলো। যেন কোন যাদু বলে অঘোরে ঘুমাচ্ছে পুরুষ নারী প্রত্যেকেই। আহমদ মুসার দূরবীনের অস্থির দুটি চোখ যেন পাগল হয়ে চষে ফিরছে গোটা উপত্যকায় একটা সচল দেহের সন্ধানে। না, নেই জীবনের স্পন্দন নেই কোথাও।
চোখ থেকে দূরবীন নামাল আহমদ মুসা। বেদনায় বিবর্ণ হয়ে গেছে তার মুখ। দুচোখ থেকে তার দুফোটা অশ্রু কিছুটা নেমে শুকিয়ে আছে। গোটা দেহে অপরিসীম একটা ক্লান্তি।
নেমে আসার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল আহমদ মুসা। নামতে গিয়ে আরেকবার দূরবীনটা চোখে লাগাল সে। দূরবীনের চোখটা পিয়ালং উপত্যকার চাররিদকটা আবার ঘুরতে শুরু করলো। এক জায়গায় এসে হঠাৎ আটকে গেল দূরবীনের চোখ। জায়গাটা পিয়ালং এর দুই উপত্যকার পশ্চিমের একটি পাহাড়। পাহাড়টির গিরিপথ ধরে এগিয়ে আসছে একদল মানুষ। দূরবীনের চোখ ওখানে আটকেই থাকল। জনা পঁচিশেক লোক হবে ওরা। পিঠে ঝুলানো স্টেনগান, কোমরে পিস্তল। প্রত্যেকেই সাদামুখো রুশ।
আহমদ মুসা নিশ্চত হল ‘ফ্র’-এর সেই দলটাই আসছে।
আহমদ মুসা পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল। নামতে নামতে ভাবল কেন আসছে ওরা? সবাইকে হত্যা করার পর আবার প্রয়োজন কি? হঠাৎ তার মনে পড়ল, ওদের ডকুমেন্ট চাই, সাইমুম এর পরিচয় ও অবস্থান সংক্রান্ত ডকুমেন্ট। সবাই নিহত হবার পর এখানে তো ফ্রি পড়ে আছে ওগুলো। সে সব উদ্ধারের জন্যই ওরা আসছে। তা ছাড়া এখানে সাইমুমের অস্ত্র-শস্ত্র, অর্থ সম্পদও কম নেই। হাসল আহমদ মুসা, ওদের লোভ কম নয়। সেই সাথে দৃঢ় এক শপথে তার চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে উঠল। নীচে নেমে এল আহমদ মুসা। সবাই উৎকণ্ঠিত ভাবে অপেক্ষা করছিল আহমদ মুসার। আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে তাদের উদ্বেগটা আরও বেড়ে গেল। কিন্তু কেউ কথা বলছে না। সবার চোখেই একরাশ প্রশ্ন। আহমদ মুসা ওদের দিকে তাকিয়ে ধীর কণ্ঠে বলল, প্রিয় ভায়েরা, যতদূর দেখেছি, পিয়ালং উপত্যকায় আমাদের কেউ বেঁচে নেই। খুনী ‘ফ্র’ বিষাক্ত গ্যাস বোমা ফেলে তাদের সবাইকে হত্যা করেছে।
কেউ কোন শব্দ করল না, কেউ কোন কথা বলল না। চোখ তাদের নীচের দিকে, নতমুখী তারা। নীরবে তাদের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। অসহায় মজলুম ঐ মানুষরা তাদের স্বাধীন মন ও বিশ্বাস নিয়ে বাঁচার আশাতেই আশ্রয় নিয়েছিল এখানে। কিন্তু পারলনা তারা বাঁচতে। শিকার হলো মর্মান্তিক এক মৃত্যুর। শত শত পুরুষ নারী শিশু এক সাথে।
আহমদ মুসা আবার ধীরে ধিরে বলল, প্রিয় ভায়েরা, তোমরা অশ্রু মুছে ফেল। এস আমরা প্রতিশোধ নিই। প্রতিরোধের আগুন জ্বালি এ চোখে।
একটু থেমে আহমদ মুসা বলল, একটা সুখবর তোমাদের জন্য। ‘ফ্র’ এর সেই দলটা পশ্চিমদিক থেকে পিয়ালং উপত্যকার দিকে আসছে। ওদের বড় আশা, সবাইকে হত্যা করার পর এখান থেকে সাইমুমের দলিল দস্তাবেজ ওরা হাত করবে। সেই আশাতেই ওরা ছুটে আসছে।
সবাই একসাথে চোখ তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। তাদের চোখে শপথের দীপ্তি চক চক করছে।
আহমদ মুসা হাসান তারিকের দিকে আর একটু এগিয়ে তার হাত থেকে নিজের ঘোড়ার লাগামটা নিতে নিতে কয়েকটা জরুরী নির্দেশ দিল।
হাসান তারিক নির্দেশ পেয়ে তার মুজাহিদ কাফেলাকে নিয়ে গিরিপথের মুখ থেকে একটু উত্তরে একটা দীর্ঘ টিলার আড়ালে চলে গেল। আহমদ মুসা ওয়্যারলেসে তাসখন্দে আনোয়ার ইব্রাহীম, গুলরুখ রাষ্ট্রীয় খামারে কুতাইবা, লেনিন স্মৃতি পার্কে আলদর আজিমভকে কয়েকটা নির্দেশ দিয়ে সেই টিলার আড়ালে হাসান তারিকদের সাথে একত্রিত হলো।
আহমদ মুসার নিশ্চিত বিশ্বাস ‘ফ্র’ এর ওই দলটাও পিয়ালং উপত্যকায় প্রবেশের জন্য এই গিরিপথই ব্যবহার করবে। এই একই উপত্যকা পিয়ালং এর পশ্চিম পাশের পাহাড়কেও বেষ্টন করে আছে। সুতরাং, উচু পাহাড় ডিঙানোর চাইতে উপত্যকার পথ ব্যবহারের জন্য এই গিরিপথের দিকেই তারা এগিয়ে আসবে।
যে টিলার আড়ালে আহমদ মুসারা আশ্রয় নিয়েছে তার অবস্থানটা খুবই সুন্দর। টিলাটির পশ্চিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রায় গোটা উপত্যকাটাই নজরে আসছে। সুতরাং, ‘ফ্র’ এর লোকেরা এ উপত্যকায় পা দেবার সাথে সাথেই তাদের সব গতিবিধি নজরে আসবে।
অবশেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। উপত্যকার পশ্চিম পাশের এক গিরিপথ দিয়ে ‘ফ্র’ এর বাহিনীটি উপত্যকায় নেমে এল। উপত্যকায় ওরা সোজা পিয়ালং পাহাড়ের দিকে না গিয়ে উপত্যকা ধরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। লক্ষ্য তাদের এ গিরিপথটাই। আহমদ মুসা খুশী হল।
আহমদ মুসা হাসান তারিককে বলল, তুমি তোমার লোকজনদের টিলার পশ্চিম প্রান্তে নিয়ে মোতায়েন কর যাতে ওরা এ টিলা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়। দেখ, ওদের মুখে গ্যাস মাস্ক আছে। ওদেরকে গিরিপথে ঢোকার সুযোগ দিলে আমরা বিপদে পড়বো। গ্যাস মাস্ক ছাড়া আমরা উপত্যকায় ঢুকতে পারব না।
হাসান তারিক তার সাইমুম ইউনিট নিয়ে টিলার পশ্চিম প্রান্তে চলে গেল। আর আহমদ মুসা টিলার পুর্বপ্রান্তের গিরিপথটার মুখ বরাবর ওঁত পেতে থাকল।
অনেকটা সমান্তরাল সার বেধে ওরা এগিয়ে আসছে। সকলের হাতে স্টেনগান। উপত্যকার মাঝামাঝি এসে ওরা গ্যাস মাস্ক পরে নিয়েছে। এখন ওদের পদক্ষেপ অনেক সতর্ক মনে হচ্ছে।
ওরা টিলাটির পশ্চিম প্রান্ত অতিক্রম করে এগিয়ে গেল গিরিপথটির দিকে। হাসান তারিকের নেতৃত্বে সাইমুম ইউনিট বেরিয়ে এল টিলার আড়াল থেকে। দ্রুত চন্দ্রাকার লাইনে আড়াআড়িভাবে টিলা থেকে পাহাড় পর্যন্ত গোটা জায়গায় তারা ছড়িয়ে পড়ল। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান।
হঠাৎ, ‘ফ্র’ এর একজন সম্ভবত জুতা ঠিক করতে গিয়ে নিচু হয়েছিল। তার চোখে ধরা পড়ে গেল সাইমুমের লোকেরা। ভুত দেখার মত চমকে উঠে দাড়াল সে। পাথরের মুর্তির মত সে দাড়িয়ে থাকল। কিছু করতে, কিছু বলতেও যেন সে ভুলে গেল। বোধ হয় তার কি হোল তা দেখার জন্যই আরেকজন পিছন ফিরে তাকাল। সে পিছনে তাকিয়ে সবটা ব্যাপার বুঝতে পারল। তার চমকে উঠা ভাব দুর হবার আগেই স্টেনগানটা সোজা করতে করতে হাটু গেড়ে বসে পড়ল সে।
স্টেনগানের ট্রিগারে হাত রেখেই এগিয়ে আসছিল হাসান তারিক। তাকে বসতে দেখেই হাসান তারিক চেপে ধরল স্টেনগানের ট্রিগার। এক পশলা গুলি ছুটে গেল। ছেঁকে ধরল সেগুলো দাঁড়ানো এবং বসা সেই লোক দু’টিকে। বসা লোকটিও ট্রিগার চেপেছিল শেষ মুহুর্তে। কিন্তু গুলিবিদ্ধ তার দেহ স্টেনগান ধরে রাখতে পারল না। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল গুলি। দু’জনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে।
হাসান তারিকের সাথে সাথে অন্য ১৯ টি স্টেনগানও একই সাথে গর্জন করে উঠল। আগুনের এক দেয়াল এগিয়ে গেল ‘ফ্র’ এর বাহিনীর দিকে। ওরা ফিরে দাঁড়ানোরও সময় পেল না। সার বেধে চলছিল, সার বেধেই ওরা ঢলে পড়ল মাটিতে। ১৯ টি স্টেনগান অবিরাম গুলী বৃষ্টি করছিল, সুতরাং সামনে আরও যারা ছিল পাকা ফলের মতই খসে পড়তে লাগল মাটিতে। কয়েকজন মাথা নিচু করে সামনে দৌড় দিয়েছিল। উদ্দেশ্য গিরিপথে ঢুকে পড়া, পাহাড়ের আড়াল নেয়া। কিন্তু, কাছেই ওঁত পেতে থাকা আহমদ মুসার মুখে পড়ল ওরা। আহমদ মুসার স্টেনগানের শিকার হয়ে ওরা গিরিপথের সামনেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। মাত্র এক মিনিট। এর মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল। ‘ফ্র’-এর ২৫ সদস্যের সবাই মারা গেল।
আহমদ মুসা বেরিয়ে এল টিলার আড়াল থেকে। তাকাল ২৫ টি লাশের দিকে। রক্তে ভাসছে ওরা। হাসান তারিক গিয়ে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। আহমদ মুসা তাকিয়েছিল ঐ লাশগুলোর দিকে। অনেকটা স্বগত কন্ঠে সে বলল, কার পাপে এরা এমনভাবে মরছে, কারা দায়ী এর জন্যে?
হাসান তারিক বলল, আল্লাহর সৃষ্ট স্বাধীন মানুষকে দাস বানাবার কম্যুনিস্ট ক্ষুধাই এর জন্য দায়ী।
-এ ক্ষুধা কত বড় হাসান তারিক? শুরুতেই ৫০লাখ কৃষক ওদের পেটে গেছে। আরও ১কোটি অসহায় মানুষকে ওরা সাইবেরিয়ার সাদা বরফের নিচে ফ্রিজ করে রেখেছে। তারপরও লাখ লাখ মানুষকে ওরা গুম করেছে। কতবড় ক্ষুধা ওদের? মধ্য এশিয়ার ক’জন মানুষকে এভাবে গিলে না খেলে তাদের চলত না? কবে নিবৃত্ত হবে তাদের ক্ষুধা?
-এ ক্ষুধা তাদের এক উন্মত্ত ব্যাধি। মৃত্যু ছাড়া কম্যুনিজমের এ ব্যাধি যাবে না।
আহমদ মুসা হাসল। বলল, কম্যুনিজম বেচে নেই হাসান তারিক। বাস্তবতার হাতুড়াঘাতে কার্ল মার্কসের কম্যুনিজমের স্বপ্ন-ফানুস বহু আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। বেচে আছে তাদের প্রেতাত্মা। নাম তার কম্যুনিজমই। এর মৃত্যু কত দূরে সেটাই এখন প্রশ্ন।
-ভাববেন না মুসা ভাই, পিয়ালং এর ঘটনা তাদের শেষ দশারই সংকেত দিচ্ছে।
পিয়ালং এর নাম উচ্চারিত হতেই মুখের ভাবটা বদলে গেল আহমদ মুসার। আর কোন কথা সে বলল না। একটুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর বলল, তোমরা সবাই গ্যাস মাস্কগুলো খুলে নিয়ে পরে নাও। এখন আমরা পিয়ালং উপত্যকায় ঢুকব।
আহমদ মুসাসহ ২১ জন সকলে গ্যাস মাস্ক পরে নিল। গ্যাস মাস্ক সংগ্রহ করতে গিয়ে একটা ভিডিও ক্যামেরা পাওয়া গেল। পেয়ে খুশিই হল আহমদ মুসা। বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে এই গণহত্যার একটা দলিল রাখা যাবে। প্রস্তুতি শেষ করে তারা ওই গিরিপথ ধরে পিয়ালং উপত্যকায় প্রবেশ করল।
নিঝুম-নিস্তব্ধ এক উপত্যকা। কোন প্রাণের চিহ্ন সেখানে নেই। উপত্যকার আকাশে কোন পাখি পর্যন্ত উড়ছে না। পিয়ালং এখন এক মৃত উপত্যকা। এই মৃত পুরীতে আহমদ মুসা এবং তার সাইমুম সাথীরা প্রতিটি তাবু প্রতিটি লাশের কাছে গেল। প্রতিটি দৃশ্যকে ভিডিও ক্যামেরায় ধরে রাখল তারা। ঘটনার বীভৎসতা তাদের সকলের চোখের পানি শুকিয়ে দিয়েছিল। বেদনায় যেন শক্ত কাঠ হয়ে গিয়েছিল তারা।
উপত্যকার সাইমুম অফিস থেকে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র, দলিল, দস্তাবেজ সংগ্রহ করল। তারপর সন্ধ্যা নামার আগেই বেরিয়ে এল মৃত উপত্যকা থেকে।
তাদেরকে আবার ফিরে আসতে হবে এ উপত্যকার শহীদদের দাফনের জন্য প্রস্তুত হয়ে। রাতটা তারা বাইরের উপত্যকাতেই কাটাবে।
সুর্য অস্ত গেল। অন্ধকার নেমে এল উপত্যকা জুড়ে।
সাইমুমের একজন কর্মী আযান দিল। পরিমাণ মত খাবার পানি রেখে অজু সেরে তারা সবাই নামাজে দাঁড়াল।

পিয়ালং এর ঘটনার পর আহমদ মুসা গম্ভীর হয়ে গেছে। যেন অথৈ এক ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে সে। আজ সাইমুমের জরুরী পরামর্শ সভাতেও তার মুখে চোখে সেই গাম্ভীর্য। আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু পিয়ালং এর ঘটনা এবং ভবিষ্যতের চিন্তা। আহমদ মুসা গম্ভীরভাবে এই বিষয়ের উপর সকলের মত শুনছিল। আজকের জরুরী সভায় সবাই হাজির না থাকলেও পরামর্শসভায় নেতৃস্থানীয় সবাই হাজির আছে। সবাই একে একে তাদের মত প্রকাশ করল। মতামত তাদের প্রায় একই রকম। এমন ত্যাগ ও কোরবাণীর জন্য আমাদের আরও প্রস্তুত থাকতে হবে। খুনী “ফ্র”-এর শক্তির এখন শেষ প্রদর্শনী চলছে। জনগণ আমাদের পাশে আছে। বিজয় আমাদের হবেই।
সবার বলা শেষ হলে আহমদ মুসা একটু নড়ে চড়ে বসল। ধীর কন্ঠে বলল, পিয়ালং-এর ঘটনা আমাদের জন্য আমি মনে করি একটা বড় শিক্ষা নিয়ে এসেছে। আরও ত্যাগ ও কুরবানীর জন্য আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আপনাদের এ কথার সাথে আমি একমত। তবে, তা এমন বেঘোরে আর নয়। ‘ফ্র’ এর রাষ্ট্রশক্তি আছে, তার সাথে লড়াই-এ নামতে আমরা চাই না। কম্যুনিস্ট কবলিত আমাদের জনগনকে সচেতন করা, সুসংগঠিত করাই আমাদের কাজ। এই কাজে যেকোন আক্রমনের মুখে আমরা আত্মরক্ষা করব এবং তা করব জনগণের একজন হয়ে। ‘জনতার’ সারি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র সত্ত্বা সৃষ্টি করে আলাদা কোন টার্গেটের শিকার আমরা হব না যেমনটা পিয়ালং এ হলো। হিসার দুর্গের ঘটনা ঠিক আছে, গুলরোখ রাষ্ট্রীয় খামারের ঘটনা ঠিক আছে, আরিসের ঘটনা ঠিক আছে, কিন্তু পিয়ালং আর নয়।
থামল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা থামতেই কুতাইবা বলে উঠল, আপনার কথা বুঝেছি, তবু আরেকটু খুলে বলুন।
‘আমি বলতে চাচ্ছি’, বলল আহমদ মুসা, পিয়ালং-এর মত কোন আশ্রয় কেন্দ্র আর আমরা গড়ব না, আমাদের লোকদের কোন বসতিও আমরা কোথাও সৃষ্টি করব না। আমরা জনগণের মধ্যে কাজ করব, তাদেরই মধ্যে থাকব।
-আমাদের ঘাটিগুলো? প্রশ্ন তুলল আলদর আজিমভ।
-আমাদের ঘাটিগুলো পিয়ালং নয়, আমাদের কোন বসতিও নয়, ওগুলো স্থানান্তর যোগ্য এবং ওগুলো পরিত্যাগ করেও চলে আসতে পারি।
অনেকটা হাসি মুখেই বলল আহমদ মুসা।
সকলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, আপনার চিন্তা সঠিক। একমত আমরা আপনার সাথে।
-তাহলে আমাদের ৩ নং ঘাটি পিনান্দজে আরিসের যে ৫ শ’ লোকের বসতি করলাম তা ভেঙে দিতে হয়। বলল আহমদ মুসা।
-ঠিক আছে, ভেঙে দেব আমরা। বলল হাসান তারিক।
-ওদের কি করা যায় তাহলে? প্রশ্ন আহমদ মুসার।
সবাই নীরব। কেউ কোন উত্তর দিল না। মনে হয় সবারই এ একই প্রশ্ন।
আহমদ মুসাই আবার কথা বলল। বলল সে, তাজিক সীমান্ত সংলগ্ন আফগান এলাকায় ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হোক। সেখানে আমাদের আফগান ভাইদের তত্ত্বাবধানে ওরা ভাল থাকবে। যখনই প্রয়োজন হবে ওদের নিয়ে আসতে পারব।
সবাই প্রায় এক সাথে বলে উঠল, ভাল প্রস্তাব। আপনি এই ব্যবস্থাই করুন।
আহমদ মুসার চোখে-মুখে একটা স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া যেন সরে গেল তার মুখ থেকে। তার ঠোঁটে ফুটে উঠল হাসির রেখা।



পর্ব ২


উজবেকিস্তানের সারাকায়া গ্রাম। পশ্চিম উজবেকিস্তানের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ কলখজ বা যৌথ খামারের কেন্দ্র এটা।
গ্রামের প্রবেশ মুখে বড় রাস্তাটির পশ্চিম পাশ ঘেঁষে কম্যুনিস্ট যুব সংগঠন ‘কমসমল’ এর আঞ্চলিক অফিস। সময় তখন দুপুর পেরিয়ে গেছে। কমসমল অফিসের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। জানালাগুলো খোলা।
অফিসের ইজিচেয়ারে কমসমলের সাধারণ সম্পাদক ইউরি রশিদভ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার পাশে ইজিচেয়ারের উপর পড়ে আছে ‘তুর্কিস্তান’ -এর চলতি সংস্করণ।
চোখ বন্ধ করে ভাবছে রশিদভ। ভাবছে সে, দেশ এক পরিবর্তনের দিকে গড়াচ্ছে, প্রত্যেক পরিবর্তনের পটভূমিতেই থাকে এক ঝড়, এক সংঘাত। এই সংঘাতে তার ভূমিকা কি হবে? কমসমল এবং কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে আমরা যাই বলি, আমাদের জনগণ এই পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ। তাদের হৃদয়ে একটা দগদগে ক্ষত ঘুমিয়ে ছিল, সাইমুম তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এই জাগরণ রোধ করবে কে? নিজেরই উপর আর বিশ্বাস নেই রশিদভের। গতকাল যখন জানালা দিয়ে ফেলে যাওয়া ‘তুর্কিস্তান’ সে পেল, তখন রাগ হওয়ার বদলে ভাল লাগল তার। মনে হল, মন তার যেন এর জন্য অপেক্ষা করে ছিল। আমার তো উচিত ছিল ‘তুর্কিস্তান’ পাওয়ার পরেই এটা পার্টিকে জানানো, পার্টি অফিসে জমা দেওয়া। কিন্তু মন আমার তা দিতে দেয়নি। তাই শুধু নয়, হৃদয়ের এক দুর্বোধ্য তাড়নায় সে ‘তুর্কিস্তান’ কে সযতনে সবার চোখ থেকে গোপন রেখেছে। গোপন করার পরেও তার বড় বোন গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার শাহীন সুরাইয়ার হাতে ওটা পড়ে যায়। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে উঠছিল সে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, তার আপা ‘তুর্কিস্তান’ তার হাতেই আবার ফেরত দিয়েছে। এই সাথে একটু চাপা স্বরে মুরুব্বিয়ানার ঢংয়ে বলেছে, এসব জিনিস রাখার ব্যাপারে তোর আরও একটু সাবধান হওয়া উচিত।
তার কথা শুনে মনে হয়েছে ছোট ভাইয়ের কাজটাকে সে শুধু সমর্থনই নয়, আরও ভাল ভাবে করতে পারুক তাই যেন সে চায়।
বিস্মিত চোখে রশিদভ তার বোনের দিকে তাকিয়েছে। বলেছে আপা কিছুই যে বললেন না?
-কি বলব?
-বকবেন, কোথায় পেয়েছি তা জিজ্ঞেস করবেন।
-এসব বিষয় আমি কম জানতে চাই।
-কিন্তু আপনি তো গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার? রশিদভের চোখে অনুসন্ধান।
-তুইও তো কমসমলের সাধারণ সম্পাদক এ অঞ্চলের। সুরাইয়ার কথায় পাল্টা আক্রমণ।
-আপা আমি আসলে আপনার মতটা জানতে চাচ্ছি।
-মন না থাকলে মত থাকবে কি করে?
-মন নেই? রশিদভের চোখে অপার বিস্ময়।
-একটা জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য যদি মরে যায়, আত্মপরিচয়ের অধিকার যদি শেষ হয়ে যায়, তার মন আর বেঁচে থাকতে পারে না। মন আমাদের মরে গেছে রশিদ।
রশিদভ বিস্ময়ে কেঁপে উঠেছিল। একি বলছে তার আপা! কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সে একজন দায়িত্বশীল অফিসার! সাপ্তাহিক ছুটি কাটাবার জন্য আজই সে বাড়িতে এসেছে তাসখন্দ থেকে। বিস্ময়বিমূঢ় ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়েছিল সুরাইয়া। সে আরো কাছে সরে এসে বলল, মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা যে অত্যাচার সহ্য করেছে, যুগ যুগ ধরে হাতুড়ির যে নিদারুণ আঘাত তারা পেয়েছে, কোন বিস্ময় দিয়েই তুই তার পরিমাপ করতে পারবি না রশিদ। সয়ে সয়ে আমাদের মত হুকুম বরদারদের মন ও মত দুইই মরে গেছে।
বোনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল রশিদভ। ভাবনার মধ্যে আবার তার আগের প্রশ্নই ফিরে এল। বলল, সাইমুম সম্পর্কে তোমার কোনই মত নেই আপা?
-ওরা অনেক বড়, অনেক বড় কাজ করেছে ওরা। ওদের ব্যাপারে কোন মত প্রকাশের উপযুক্ত আমি নই। সুরাইয়ার কন্ঠ যেন তখন অনেকটা ভারি হয়ে এসেছে।
রশিদভের বোন কথা কয়টি বলেই তার কাছ থেকে সরে গিয়েছিল।
রশিদভ ইজিচেয়ারে একটা পাশ ফিরল। পাশ ফিরে তুলে নিল আবার সেই তুর্কিস্তান। হিসার দুর্গে গণহত্যার সচিত্র বিবরণ ওতে আছে। গুলরোখ কৃষি খামারের জীবনকে কিভাবে লন্ডভন্ড করে দেয়া হয়েছে তার সচিত্র বর্ণনাও ওতে রয়েছে। আরও রয়েছে পিয়ালং উপত্যকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার হৃদয় বিদারক কাহিনী। সেই সাথে রয়েছে সাইমুমের মস্কো অপারেশন, আরিস অপারেশন, বখশ নগরী অপারেশন, পিয়ালং অপারেশন ইত্যাদি কাহিনী। হিসার দূর্গ, গুলরোখ খামার, পিয়ালং উপত্যকা ইত্যাদি হৃদয় বিদারক কাহিনী পড়ে রশিদভের মন যেমন বেদনায় টনটন করে উঠল তেমনি সাইমুমের অপারেশনগুলোর কাহিনী পড়ে তার হৃদয়টা গর্বে ফুলে উঠল।
নিজের মনের দিকে চেয়ে নিজের থেকেই চমকে উঠল রশিদভ। কমসমলের রিজিওনাল সাধারণ সম্পাদক সে, কেমন করে সে বিদ্রোহীদের সাথে এমন করে একাত্ম হচ্ছে? সংগে সংগে হৃদয়াবেগের এক বন্যা এসে এই চমককে একেবারেই ভাসিয়ে দিল। হৃদয় থেকে হৃদয়ের খোলা দরজায় মুখ এনে কে যেন বলল, কম্যুনিস্ট কমসমলের সাধারণ সম্পাদক তার আসল পরিচয় নয়, আসল পরিচয় সে রশিদভ, সে মুসলিম। অপরিচিত এক প্রশান্তির শিহরণ খেলে গেল তার দেহে।
এ সময় একজন যুবক কমসমল অফিসের জানালা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিল। দরজা বন্ধ রেখে সে জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে মুখে দুষ্টামির ছাপ। তাই সরাসরি দরজায় টোকা না দিয়ে রশিদভ কি করছে দরজা বন্ধ করে তা দেখার জন্য জানালায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই সময় দরজা বন্ধ করে রশিদভকে বসে পড়তে দেখে কৌতুকই বোধ করল যেন যুবকটি। কি পড়ছে রশিদভ? প্রেমের নিষিদ্ধ উপন্যাস নাকি? বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে, হাই তুলে, ভেতরে বড় ফু চালান দিয়ে দেখল রশিদভের ভাব ভাঙে না। অবশেষে সে ঠক ঠক করে টোকা দিল জানালার পাল্লায়।
রশিদভ চমকে উঠে তাকাল জানালার দিকে। দেখল, জামায়াতিন জালানায় দাঁড়িয়ে।
জামায়াতিন কমসমলের আঞ্চলিক সভাপতি। বিরাট লম্বা–চওড়া দেহ জামায়াতিনের। মাথার চেয়ে দেহই তার বেশী চলে। নাগরিক পরিবেশের চাইতে ঘোড়ার পিঠে চারণ ক্ষেত্রেই তাকে মানায় বেশী। যা বুঝে তা সোজাসুজি গড় গড় করে বলে ফেলা এবং করে ফেলাই তার স্বভাব।
রশিদভ জামায়াতিনকে দেখে ‘তুর্কিস্তানটা’ তাড়াতাড়ি লুকিয়ে রেখে, আসছি কমরেড জামায়াতিন, বলে উঠে দাঁড়াল।
দরজা খুলে দিল রশিদভ।
ঘরে ঢুকেই জামায়াতিন বলল, প্রেমপত্র পড়ার মত ওটা কি পড়ছিলে দেখি।
শংকিত হল রশিদভ। তবু মুখে স্বাভাবিক ভাব টেনে বলল, ও কিছু নয় একটা পার্টি বুলেটিন।
জামায়াতিন রশিদভের মুখের দিকে চেয়ে বলল, উঁহু কমরেড, পার্টি বুলেটিন কেউ ওভাবে পড়ে না। নিশ্চয় নিষিদ্ধ কোন লেখকের চমৎকার কোন গল্প-টল্প পড়ছিলে দেখাও না!
রশিদভ এবার তার সবটুকু শক্তি একত্র করে বলতে চেষ্টা করল, ও কিছু না কমরেড, চল বসি। পার্টি সেক্রেটারী ডেকেছেন। অল্পক্ষণ পরেই ওখানে যেতে হবে।
জামায়াতিন হাসল। বলল, তুমি বস। ঐ ওখানে তো রাখলে ওটা। বের করে আনি।
বলে জামায়াতিন নিজে ইজিচেয়ারের নীচে গুঁজে রাখা ‘তুর্কিস্তান’ বের করে আনল।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল রশিদভের মুখ।
‘তুর্কিস্তান’ হাতে নিয়ে জামায়াতিন এসে রশিদভের পাশে বসল। রশিদভের মুখ নীচু। মুখ তোলার সাহস পাচ্ছে না সে।
জামায়াতিন গম্ভীরভাবে রশিদভের আসামী সুলভ অবস্থার দিকে তাকাল। তার ঠোঁটের কোণায় একটা সূক্ষ হাসি। কিন্তু নীরস কন্ঠে বলল সে, এটা কি কমরেড?
কর্কশের কাছাকাছি জামায়াতিনের শুকনো কণ্ঠস্বরে আরো ঘাবড়ে গেল রশিদভ।
জামায়াতিনের দিকে না তাকিয়েই রশিদভ বলল, দেখতেই তো পাচ্ছো।
-দেখতে পাচ্ছি এটা ‘তুর্কিস্তান’ কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করছি, এ জিনিসটা যে কি তা তুমি জান?
-জানি।
-কি জান?
-বিদ্রোহীদের মুখপত্র।
-তোমার কাছে কেন?
রশিদভ এ প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। আরো একটু গম্ভীর কন্ঠে জামায়াতিন বলল, তোমার কাছে ‘তুর্কিস্তান’ আছে, তুমি পড়ছ, এ খবর কি পার্টি জানে?
রশিদভ এবার মুখ তুলে জবাব দিল, না জানে না।
রশিদভের কণ্ঠে এবার যেন রুখে দাঁড়াবার ভংগি।
জামায়াতিন আবার বলল, এর অর্থ কি কমরেড জান?
-জানি
-কি?
রশিদভ কোন জবাব দিল না।
জামায়াতিন আবার বলল, এর অর্থ কি এই নয় যে, তুমি বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ রাখ, কিংবা তুমি তাদেরই একজন?
কেঁপে উঠল রশিদভ। একবার ভাবল, কিভাবে সে তুর্কিস্তান পেয়েছে তা খুলে বলে। কিন্তু পরে আবার ভাবল, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না,
কারণ সে তা পাওয়ার পর পার্টিকে জানায়নি, উপরন্তু সে গোপনে তা পড়েছে এবং লুকোবারও চেষ্টা করেছে। সুতরাং ঘটনার অহেতুক কোন ব্যাখ্যায় না গিয়ে সে বলল, যা ইচ্ছে বলতে পার, আমার কিছু বলার নেই।
রশিদভ চুপ করল।
জামায়াতিনও সংগে সংগে কিছু বলল না। তার ঠোঁটের কোণে তখনও সেই সূক্ষ হাসিটা।
একটু চুপ থেকে নতমুখে রশিদভকে বলল, কমরেড, এভাবে তোমার জীবন কোন ভয়াবহ গহব্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছ তুমি জান?
-জানি
-জানার পরেও এই কথা তুমি বলছ?
-হ্যাঁ
-ভয় করছে না?
রশিদভ মুখ তুলে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে ধরল। অনেকটা স্বাগত কন্ঠেই যেন বলল, কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ভয় করেছে, এখন আর করছে না।
-কারণ
-এখন এই মুহূর্তে আমি ভাবছি, হতভাগা এই জাতির জন্য তো কিছুই করতে পারিনি। আর জাতিকে কিছু দিতে পারব এমন কোন যোগ্যতাও আমার নেই। প্রাণটাই শুধু আমার আছে, জাতির জন্য এ প্রাণটা দেবার সুযোগ পেলে জীবনটা আমার সার্থক হবে বলে মনে করছি।
জামায়াতিন রশিদভকে অবাক করে দিয়ে তার দিকে হাত বাড়াল এবং সজোরে হ্যান্ডশেক করল তার সাথে। বলল, তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি রশিদ।
রশিদভ বিস্মিত কন্ঠে বলল, এ কি বলছ তুমি জামায়াতিন?
-ঠিকই বলছি, আমি তো তোমার মত অত মাথার চাষ করি না। আমি এমন করে বলতে পারতাম না। আমার মনের আকুলি-বিকুলিকে তুমি ভাষা দিয়েছ। তাই তোমাকে অভিনন্দন।
একটু থামল জামায়াতিন। তারপর পকেট থেকে ‘তুর্কিস্তান’ বের করে বলল। বিশ্বাস কর তুর্কিস্তান আমি নিয়ে এসেছি তোমাকে পড়াব বলে।
দুদিন থেকে আমি এটা পড়ছি, অনেক ভেবেছি করণীয় নিয়ে। আমার ভাবনাকে তুমি ভাষা দিয়েছ রশিদভ।
দু’জনেই আরেক প্রস্ত হ্যান্ডশেক করল, তারপর দু’জনেই চুপচাপ। রশিদভ প্রথমে কথা বলল। বলল সে, মনে হচ্ছে ‘তুর্কিস্তান’ ওরা তুর্কিস্তানের ঘরে ঘরে পৌঁছিয়েছে।
-নিশ্চয়ই অদ্ভুত নেটওয়ার্ক সাইমুমের।
-আল্লাহ তাদের শক্তি দান করুন।
-আমিন। দু’টি হাত তুলে বলল জামায়াতিন।
জামায়াতিন তার মুনাজাতের হাতটা নামিয়ে নেবার সাথে সাথেই একটা গাড়ি এসে অফিসের দরজায় দাঁড়াল। গাড়িটা তুঘরীল তুগানের। তুঘরীল তুগান পশ্চিম উজবেকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টির প্রধান। বেশ প্রভাবশালী। সকলেই জানে রাষ্ট্রের সুপ্রীম সোভিয়েটের কংগ্রেসে পার্টির আসল মনোনয়ন তার প্রতিই। অর্থাৎ আসছে নির্বাচনে এ অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি হিসেবে সেই সুপ্রিম সোভিয়েটে যাচ্ছে। এই সারাকায়াতে তার বিশাল বাড়ি। অবশ্য এই বাড়িতেই পার্টি অফিস, কলখজ অফিস, ইউনিয়ন অফিস।
তুঘরীল তুগান বিকেলে তার বাড়িতে কমসমলের সভাপতি ও সেক্রেটারীকে ডেকেছে কি এক জরুরী ব্যাপারে। কোন জরুরী ব্যাপার হলেই কমসমল নেতৃবৃন্দকে এভাবে ডেকে সে পরামর্শ করে।
অফিসিয়াল কোন আলোচনায় যাওয়ার আগে এভাবেই সে একটা ওপিনিয়নে পৌছার চেষ্টা করে। তার এ কৌশল তাকে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে এবং তার নেতৃত্বকে পাকা পোক্ত করে দিয়েছে।
গাড়ি এসে দাড়ালে জামায়াতিন রশিদভকে বলল, চল পাঁচটা বাজতে দেরী নেই।
জামায়াতিন এবং ইউরি রশিদভ দুজনেই গিয়ে গাড়িতে উঠল।
গাড়ি ছুটে চলল গ্রামের মধ্যে দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা ধরে গ্রামের অপর প্রান্তে।
গাড়ি এসে পৌছল তুঘরীল তুগানের বাড়িতে। তার প্রাইভেট গাড়ি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ড্রাইভার নেমে জামায়াতিনদের দরজা খুলে ধরল।
জামায়াতিন বলল, এখানে কেন ড্রাইভার, সদর গেটে গাড়ি যাবেনা?
ড্রাইভার বলল, সাহেব এখানেই নামতে বলেছেন, তিনি আপনাদের জন্যে তার ব্যক্তিগত ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করবেন। জামায়াতিন ও রশিদভ দুজনেই নামল গাড়ি থেকে।
গাড়ি বারান্দা থেকে কয়েক ধাপ উপরে উঠলে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বিরাট বারান্দা। স্টিলের ফ্রেমে দামী পুরু কাঁচে ঢাকা। মাঝখানে দরজা। দরজাটাও কাঁচের।
গাড়ি বারান্দা থেকে উঠে দরজার মুখোমুখি হতেই দারোয়ান দরজা খুলে ধরল। ভেতরে প্রবেশ করল দুজন। হৃদয় জুড়ানো প্রশান্তি ভেতরে। ফুল এয়ারকন্ডিসন বাড়িটা। কাঁচ ঢাকা অর্ধচন্দ্রাকার বারান্দায় সোফা ও কুশন চেয়ার সাজানো। মাঝে মাঝে নানা গাছ ও ফুলের টব। সব মিলিয়ে সেখানে শান্তি ও সবুজের একটা আমেজ। তুঘরীলের পরিবারের সদস্যরা মাঝে মাঝে এখানে এসে বাইরের বিচিত্র দৃশ্য উপভোগ করে।
বারান্দার উত্তর পাশে ও দক্ষিণ পাশে পারিবারিক গেস্টরুম। আর সামনের বড় রুমটা ডাইনিং হল। ডাইনিং হলের পাশ দিয়ে প্রশস্ত করিডোর এগিয়ে গেছে। করিডোরটিও কার্পেটে মোড়া। তুঘরীল তুগানের অন্দরে তারা এর আগেও এসেছে, খাস ড্রইং রুমটি তারা চেনে। জামায়াতিন রশিদভ সেদিকে এগুলো।
এক জায়গায় এসে ভেসে আসা এক গানের সুরে তারা থমকে দাঁড়াল। থমকে দাঁড়াল মানে পা-টা যেন তাদের আটকে গেল। গানের সুরে নয়, গানের কথায়। উজবেক কবি ইব্রাহিম আলাউদ্দিনের এ গান আজ মৃত, কম্যুনিস্ট শাসকরা একে বহুদিন আগেই নিষিদ্ধ করে দিয়েছে।
এক নারী কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছিল সেই গানটি। নীচুগলা, অনেকটা স্বাগত কণ্ঠ তার। সেই গাইছিল;
‘তুমি একখানা কিতাব পড় আর কিতাবের লেখকের খোঁজ কর।
বিরাট অট্টালিকা দেখে নির্মাতার নাম জানতে চাও। তবে জমিন ও আসমানের কোন মালিক নেই?
হে মানুষ চিন্তা কর, বুঝে দেখ আমাদের কাছে সব জিনিসই নিশানা দিচ্ছে।
মহান সর্বশক্তিমান এক আল্লাহর।’
হৃদয়ের গভীর তলদেশ থেকে উতসারিত হচ্ছিল গানের কথাগুলো।
নরম কণ্ঠের এক মমতা মাখানো আবেগ তাতে। হৃদয়স্পর্শী এক মরমীয়া সুরে ভর করে আসছিল গানের কথাগুলো।
ইব্রাহিম আলাউদ্দিনের এ নিষিদ্ধ গান জামায়াতিন এবং রশিদভ দেখেছে কিন্তু এই প্রথম শুনল তারা। নিষিদ্ধ এই অমৃত তারা যেন গোগ্রাসে গিলছে। তন্ময় হয়ে তারা যেন নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে। গানের নরম মরমীয়া সুর নীরব পরিবেশকে করে তুলছে বেদনার্ত।
গান শেষ হলো। তন্ময়তা ভাঙল জামায়াতিন ও রশিদভের। নড়ে উঠল তারা। ফিরে তাকাতেই দেখল, তুঘরীল তুগান পেছনে দাড়িয়ে। তার চোখে-মুখে বিরাট এক অস্বস্তি।
জামায়াতিন ও রশিদভ তার দিকে তাকাতেই সে বলল, চল তো দেখি ব্যাপারটা কি? বলে সে যে ঘর থেকে গানটি ভেসে আসছিল সেদিকে চলল।
জামায়াতিন ও রশিদভ পরস্পর এক ধরনের অবুঝ দৃষ্টি বিনিময় করে তুঘরীল তুগানের পেছনে চলল।
দরজা খোলাই ছিল। ওরা ভেতরে প্রবেশ করল। প্রথমে তুঘরীল তুগান তারপর ওরা।
তুঘরীল তুগানের মেয়ে ফায়জাভা নাতাকায়ার পড়ার ঘর এটা। একটি বুকসেলফ, পড়ার জন্যে চেয়ার-টেবিল, একটা ইজিচেয়ার এবং ঘরের এক কোণে একটা ফ্রিজ।
ইজিচেয়ারে চোখ বুজে শুয়ে ছিল ফায়জাভা। উনিশ-বিশ বছরের মত হবে বয়স। তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইনিঞ্জনিয়ারিং এর ছাত্রী সে।
লাল তুর্কী চেহারা, চোখ একটু বেশীই যেন নীল।
ওরা প্রবেশ করতেই ফায়জাভা উঠে দাড়াল। ওর চোখে কিছুটা বিস্ময়। বোধ হয় পিতার সাথে জামায়াতিন ও রশিদভকে এভাবে দেখেই। উঠে দাড়িয়ে ফায়জাভা পিতাকে স্বাগত জানাল। কিন্তু পিতার গম্ভীর মুখ দেখে চমকে উঠল সে।
এত লোকের বসার জায়গা ঐ পড়ার ঘরে ছিলনা। সুতরাং দাড়িয়েই থাকল সবাই।
বিস্মিত, অপ্রস্তুত ফায়জাভার দিকে চেয়ে তার পিতা তুঘরীল তুগান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ওটা কি গান করছিলে ফায়জাভা?
ফায়জাভার মুখ আরো লাল হয়ে উঠল। কোন উত্তর দিলনা। মাথা নীচু করে দাড়িয়ে থাকল সে।
আকস্মিকভাবে এই অবস্থায় পড়ে জামায়াতিন ও রশিদভ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। তারা বুঝতে পারল, উত্তর উজবেকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টির প্রধান তুঘরীল তুগান তার মেয়ের এই নিষিদ্ধ গান গাওয়াকে স্বাভাবিক ভাবেই সহ্য করতে পারছেনা। কিন্তু আবার চিন্তা করল, তারা যেহেতু গান শুনেছে, তাই সম্ভবত তাদের সামনেই মেয়ের এ শাস্তির ব্যবস্থা।
মেয়েকে নীরব দেখে তুঘরীল তুগান আবার জিজ্ঞাস করল, এ গান নিষিদ্ধ, এ গান বিদ্রোহী কবির তুমি জাননা?
তুঘরীলের স্বর এবার আরেকটু শক্ত শোনাল।
ফায়জাভা মুখ নিচু রেখেই বলল, জানি।
জান তাহলে এ গান কেন?
আমার ভাল লাগে। মুখ না তুলেই জবাব দিল ফায়জভা।
তুঘরীল তুগানের মুখ আরো লাল হয়ে উঠল। মুহূর্তের জন্যে সে জামায়াতিনদের দিকে তাকাল। মনে হয় জামায়াতিন ও রশিদভের সামনে তার মেয়ের কম্যুনিষ্ট-নীতি বিচ্যুতির এ ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ায় সে বেশী অস্বস্তি ও অপমান বোধ করছে।
তুঘরীল তুগান মুখটা ঘুরিয়ে কঠোর কণ্ঠে বলল, এর পরিণতি কি জান?
এবার মুখ তুলল ফায়জাভা। তার রক্তাভ পাতলা ঠোট দুটি মনে হলো শক্ত হয়ে উঠছে। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। পিতার জিজ্ঞাসার জবাবে সেই উত্তরটা দিল, জানি।
তুঘরীল তুগানের মুখটা আরো লাল হয়ে উঠল। ক্রোধ এবং বিরক্তির একটা ছায়া দেখা দিল তার চোখে-মুখে। মুখ খুলল সে। মনে হল কঠোর কোন কথা ছুটে যাবে ফায়জাভার দিকে।
কিন্তু তুঘরীল তুগান কিছু বলার আগেই রশিদভ বলল, সম্মানিত কমরেড, ফায়জাভা অন্যায় কিছু বলেনি, ও গান আমরও খুব ভালো লাগে। জামায়াতিন বলল, আমারও।
তুঘরীল তুগান এদের দিকে ফিরে বলল, তোমরা বল কি! কেন ভাল লাগে?
-জানিনা, তবে মনে হয় আমাদের মনের যে কথাগুলো বলতে পারিনা, গান তাই বলে দেয়। বলল রশিদভ।
-তোমার একথার অর্থ কি দাড়ায় রশিদভ?
-কিছু আড়াল না করে মনের কথাটাই বলেছি কমরেড।
-নাস্তিক্য প্রচার, ধর্মের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা কি তোমার কমসমলের একটা বড় দায়িত্ব নয়?
-তা জানি এবং তা করছিও কিন্তু যেটা বললাম, সেটা আমার মনের কথা।
-একজনের সত্তা দুটো হতে পারে কি করে?
-পারে সম্মানিত কমরেড। সত্তা যখন বাইরের কোন শক্তির পরাধীন হয় তখন তার একটা স্বাধীন অন্তর রূপ থাকে।
-তোমাকে পরাধীন বলছ! তুমি কোথায় যাচ্ছ রশিদভ?
-আমি জানিনা, তবে আমার মনে হচ্ছে আমার পথ যেন এটাই।
আবেগে উত্তেজনায় রশিদভের মুখ লাল, চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ভারি শোনালো তার শেষের কথাগুলো।
তুঘরীল তুগান তার দিকে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফায়জাভার উজ্জ্বল চোখ দুটি রশিদভের দিকে নিবদ্ধ।
একটু পরে তুঘরীল তুগান মুখ খুলল। বলল, এখানে আর নয় চল বৈঠকখানায়। ওখানেই কথা বলা যাবে।
বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তার পিছনে জামায়াতিন ও রশিদভও যাচ্ছিল।
-এই যে।
-পিছনে থেকে ছোট্ট একটা ডাক। ফিরে দাড়াল রশিদভ।
-শুকরিয়া। উজ্জ্বল চোকে সলজ্জ ফায়জাভার ছোট্ট সম্ভাষণ।
-ধন্যবাদ। বলেই বেরিয়ে আসার জন্যে ফিরে দাড়িয়েছিল রশিদভ।
-শুনুন।
আবার ডাকল ফায়জাভা। রশিদভ ঘুরে দাড়াল। তার একটু কাছে সরে এল ফায়জাভা। বলল, আপনি বেশী বলে ফেলেছেন, এমন করে বিপদ ডেকে আনা উচিত হবে না।
মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজল রশিদভ। তারপর চোখ খুলে ফায়জাভার দিকে তাকিয়ে বলল, বিপদ কয়দিন আটকে রাখা যাবে ফায়জাভা?
-তবু সাবধান হওয়া উচিত। বলল ফায়জাভা।
-মনে রাখব তোমার কথা।
ফায়জাভার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে ঔজ্জ্বল্য যেন রশিদভের চোখকে স্পর্শ করল। নতুন করে সেদিকে একবার চোখ তুলে বেরিয়ে আসার জন্য দাড়াল রশিদভ।
তুঘরীল তুগান এবং জামায়াতিন গিয়ে বসেছিল ড্রইংরুমে। রশিদভ গিয়ে জামায়াতিনের পাশে বসল।
তুঘরীল তুগানের মুখটা গম্ভীর। শোফায় গা এলিয়ে দিয়েছিল সে। চোখ দুটি বোজা।
বয়স তার পঞ্চাশ হবে। মাথা ভর্তি চুল চুল দু’একটা পাকতে শুরু করেছে। স্ট্যালিনের মত মোচ উপরের ঠোঁটটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে। চোখের দৃষ্টি গভীর এবং তীক্ষ্ণ। সব মিলিয়ে তার চেহারায় একটা তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। নীচের লোকেরা তাকে ভালবাসার চেয়ে ভয়ই বেশী করে। আর এই কারণে সে উপরের লোকদেরও প্রিয়। কারণ কম্যুনিষ্ট শাসনে ভালবাসার মত হৃদয়বৃত্তির কোন ভূমিকা নেই, সেখানে ভয় ও কঠোরতাই বলা যায় শাসনের একমাত্র হাতিয়ার। তুঘরীল তুগানের গম্ভীর নীরবতার সামনে জামায়াতিন ও রশিদভ খুবই অস্বস্তি বোধ করছিল। রশিদভ এইমাত্র ফায়জাভার পড়ার ঘরে যে কথাগুলো বলল, তা স্বাভাবিক অবস্থায় বলার মত নয়।
কিন্তু আজ সকাল থেকে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে এবং অবশেষে ফায়জাভার গান ও তার উত্তর সবগুলো মিলেই তাকে কম্যুনিষ্ট পার্টির এক জাদরেল নেতার সামনে অমন করে বিদ্রোহাত্বক কথা বলিয়েছে। তুঘরীল তুগান কথাগুলোকে কিভাবে গ্রহণ করেছে, কি বলবে সে, ইত্যাদি কথা রশিদভ ও জামায়াতিনের মনে উঁকি দিচ্ছিল। তবে একটা জিনিস তারা লক্ষ্য করেছে, তুঘরীল তুগানের মত কম্যুনিষ্ট নেতার মধ্যে বিষয়টা যতটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা উচিত, তা করেনি। সেটা কি মেয়ের কারণেই?
এ সময় নাস্তা এল। নাস্তা পরিবশেন করল বেয়ারা। চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল তুঘরীল তুগান। তারপর জামায়াতিন ও রশিদভের দিকে চেয়ে বলল, নাও শুরু কর।
নাস্তা শেষ হল। বেয়ারা বেরিয়ে গেলে তুঘরীল তুগান উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ফিরে এল তার জায়গায়। সোজা হয়ে বসল। তারপর একটু সামনে ঝুঁকে বলল, জামায়াতিন, রশিদভ গুরুত্বপূর্ণ একটা পরামর্শের জন্যে তোমাদেরকে ডেকেছি। কিন্তু তার আগে আমি যে কথাগুলো তোমরা বললে তার ব্যাখ্যা জানতে চাই।
বলে তুঘরীল তুগান জামায়াতিন ও রশিদভের দিকে তাকিয়ে রইল। রশিদভই প্রথম বলল, সম্মানিত কমরেড, বিষয়টি যেখানে আছে সেখানেই রেখে দিলে ভাল হয়।
-কেন?
-যা বলেছি তার বেশী আমি বলতে পারব না, বলাও ঠিক হবেনা।
মনে হয় আপনার শোনাও ঠিক হবেনা।
উত্তরে তুঘরীল তুগান আর কিছু বললনা। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।
একটু পরে বলল, ফায়জাভার জবাবও কি একই রকমের?
রশিদভ বলল, আমি জানিনা কমরেড, তবে মনে হয় এ রকমেরই।
তুঘরীল তুগান আবার চোখ বন্ধ করল। চোখ খুলল কিছুক্ষণ পর।
তারপর সোজা হয়ে বসে বলল, সাইমুমের সাথে তোমাদের কোন সম্পর্ক আছে?
জামায়াতিন ও রশিদভ দু’জনেই বলে উঠল, না কোন সম্পর্ক নেই।
-তাহলে এসব কথা আজ তোমাদের মুখে আসছে কেমন করে?
দু’জনেই নীরব। সহসা কোন উত্তর তারা দিল না, বা দিতে পারল না। দুজনেরই মাথা নীচু।
একটু পরে ধীরে ধীরে মুখ তুলল রশিদভ। বলল, আমার মনে হয় হৃদয়ের যে দুয়ার আমাদের বন্ধ ছিল, সাইমুম তা খুলে দিয়েছে। বন্ধ দুয়ারের আড়ালে এতদিন আমাদের যে জীবন-চেতনা, ঐতিহ্য চিন্তা এবং জীবন-বোধ মাথা খুঁড়ে মরছিল,তা আজ মুক্ত পাখায় ভর করে বেরিয়ে এসেছে। থামল রশিদভ।
তুঘরীল তুগান চোখ বন্ধ করে রশিদভের কথা শুনছিল। কথা শেষ হলেও তার চোখ বন্ধই থাকল। এক ভাবনার সমুদ্রে যেন সাঁতার কাটছে সে। এক সময় সে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল। যেন ঘুম থেকে জাগল সবে মাত্র। সজীব মনে হল তাকে।
আমি আজ তোমাদের যে জন্যে ডেকেছি শোন, বলে সে শুরু করল, স্থানীয় গোয়েন্দা সূত্র খবর দিয়েছে আজ রাতে আহমদ মুসা অথবা সাইমুমের অন্য কোন বড় নেতা আমাদের কলখজে আসছে। আমাদের কলখজের গোপন সাইমুম ইউনিট নাকি এ সফরের বন্দোবস্ত করেছে। তাদের আঞ্চলিক নেতাদের আজ বৈঠক বসছে সারাকায়াতে। বৈঠক কোথায় হবে তা জানা যায়নি।
একটু থামল তুঘরীল তুগান। তারপর আবার শুরু করল, মুশকিলে পড়েছি, এই খবরটা আজ সরকারকে জানালে আজই এই কলখজে বিরাট একটা ঘটনা ঘটে যাবে, যার পরিণতি আমি জানিনা। তারপর শুধু এই কলখজ নয় গোটা অঞ্চলের জীবনটাই লন্ডভন্ড হয়ে যাবে সন্দেহ সংঘাতের মধ্যে পড়ে। আর এ ঘটনাটা যে আমি জানাব না তাও ঠিক মনে করছি না। এখন তোমাদের পরামর্শ বল। আমি খুব চিন্তিত এ অঞ্চলের ভবিষ্যত নিয়ে।
জামায়াতিন ও রশিদভের চোখে মুখে প্রথমে বিস্ময় ও আনন্দের চিহ্ন ফুটে উঠল তুঘরীল তুগানের কথায়। আহমদ মুসা তাদের কলখজে আসছে এই খবরে তারা প্রথমে আনন্দই বেশী পেয়েছিল। কিন্তু তাদের আনন্দটাই তুঘরীল তুগানের কথার শেষে এসে চিন্তায় রূপান্তরিত হলো।
তুঘরীল তুগান কথা শেষ করলেও তারা সংগে সংগে তার উত্তর দিতে পারলো না। চিন্তা করছে তারা।
কথা প্রথমে জামায়াতিনই বলল। বলল সে, খবরটা উপরে জানান ঠিক হবে না। আমার মতে খবরটা জানালে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী। সাইমুমরা পিঠটান দিয়ে পালিয়ে যাবার মত নয়। ফলে এক রক্তক্ষয়ী ব্যাপার ঘটে যাবে, যার পরিণতি এ অঞ্চলের জন্য ভাল হবে না। তার চেয়ে কেউ জানল না সাইমুম প্রোগ্রাম করে চলে গেল। এটাই ভাল। আমি মনে করি সাইমুমের ব্যাপারগুলো প্রকাশ করার চাইতে গোপন রাখার মধ্যেই লাভ বেশী।
থামল জামায়াতিন। কথা বলল এবার রশিদভ। বলল, ব্যাপারটাকে আমি অন্যভাবে দেখতে চাই। আমরা না জানালেই উর্ধতন কর্তৃপক্ষ খবর জানাবেন না, এটা আমি মনে করি না। সম্মানিত কমরেড যে সূত্র থেকে জেনেছেন, সে সূত্র কিংবা অন্য কোন সূত্র খবর কর্তৃপক্ষকেও পৌঁছাতে পারে। যদি এর সামান্য সম্ভাবনাও থাকে, তাহলে আমাদের তরফ থেকে খবর উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে না জানানো অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে দাঁড়াবে। সুতারাং খবর জানানই উচিত।
-তাহলে ধরে নিতে হবে এ অঞ্চলে আমরা এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সূত্রপাত ঘটাচ্ছি। আর সাইমুমকে ঠেলে দিচ্ছি বিপদের মুখে। বলল জামায়াতিন।
-সংঘাত আমরা এড়াতে পারবনা কমরেড। আজ না হয় কাল সেটা বাধবেই। আর সাইমুমকে বিপদে ফেলার কথা? সাইমুম কারো উপর নির্ভর করে প্রোগ্রাম করতে আসছে না। তাদের শক্তির প্রতি আমার আস্থা আছে। জবাব দিল রশিদভ।
রশিদভের কথা শেষ করলে মুখ খুলল তুঘরীল তুগান। বলল, তোমাদের দুজনেরই কথাতেই যুক্তি আছে, তবে রশিদভের কথা আমার কাছে বেশী বাস্তব বলে মনে হয়। কিন্তু একটা কথা আমি ভাবছি। আমি আমার জনগণের মধ্যে কাজ করছি সেই ছোটবেলা থেকে। আমি তাদেরকে চিনি। আমার ভয় হচ্ছে এখানে সরকার পক্ষের সাথে সাইমুমের কোন সংঘাত বাধলে সরকার জনগণের কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পাবেনা। এই অবস্থায় গোটা অঞ্চলের ওপর বিরাট বিপদ নেমে আসবে যেমন এসেছে গুলরুখ সহ অনেক খামার এবং অনেক জনপদের ওপর। এটা কি করে ঠেকাব?
রশিদভ বলল, যেহেতু পরিস্থিতির কোন নিয়ন্ত্রণই আমাদের হাতে নেই, তাই ঐ পরিণতি আমরা রোধ করতে পারবো না। তবে খবরটা জানালে অন্তত নেতৃত্বটা আমরা রক্ষা করতে পারি, যা আমরা নানা কারণেই প্রয়োজন মনে করি।
তুঘরীল তুগান এবং জামায়াতিন দুজনেই ভাবছিল। রশিদভ কথা শেষ করলে দুজনেরই মাথা রশিদভের কথায় সায় দিল।
রশিদভ কথা শেষ করলে তুঘরীল তুগান বলল, তাহলে এটাই ঠিক হলো, বিষয়টা আমি এখন তাসখন্দকে জানিয়ে দিচ্ছি। পার্টি লেভেলে আমি আলোচনা করেছি,তাদেরও সব শেষ মত এটাই।
একটু থামল তুঘরীল তুগান। তারপর বলল, তোমাদের ধন্যবাদ, কোন নির্দেশ এলে তোমাদের জানাব।
জামায়াতিন ও রশিদভ বুঝল কথা এখানেই শেষ। তারাও জবাবে বলল, ধন্যবাদ কমরেড।
বলে তারা উঠে দাঁড়াল। বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে তারা দেখল ফায়জাভা করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা চলতে শুরু করল। চলতে চলতে বলল, শুধু একপক্ষকে জানাবার সিদ্ধান্ত কি ঠিক হল?
-কোন এক পক্ষ? জিজ্ঞেস করল রশিদভ।
-সরকার পক্ষ। বলল ফায়জাভা।
-আর কোন পক্ষকে জানাতে হবে।
-সাইমুম।
-সাইমুমকে কেন? বলে দাঁড়িয়ে পড়ল রশিদভ। তার সাথে জামায়াতিনও। রশিদভ আবার বলল, আমরা সরকারের লোক, সাইমুমকে জানাব কেন?
রশিদভের প্রশ্নের কোন জবাব না আসতেই জামায়াতিন বলল, তুমি কি সাইমুম পক্ষের লোক ফায়জাভা?
দুজনের এ আক্রমণে বিন্দুমাত্রও অপ্রতিভ হলোনা ফায়জাভা। হাসিমুখেই বলল, আমি জনগণের পক্ষে।
আবার চলতে শুরু করেছে তারা। চলতে চলতেই রশিদভ জিজ্ঞেস করল, সরকার এবং জনগণ কি আলাদা?
সেই কাঁচের দেয়াল ঘেরা গোল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তারা।
দেয়ালের ওপর দরজার পাশে বসা দারোয়ানকে দেখা যাচ্ছে।
ফায়জাভা রশিদভের প্রশ্নের জবাবে বলল, আপনার প্রশ্ন আমি আপনাকেই করছি রশিদভ ভাই।
রশিদভ একটু দাঁড়াল। গাম্ভীর্য নেমে এল তার চোখে মুখে। সে জামায়াতিনের দিকে তাকিয়ে বলল, কমরেড জামায়াতিন তুমিই এ প্রশ্নের উত্তর দাও।
জামায়াতিন বলল, দেখ এ প্রশ্নের জবাব তুমি জান, ফায়জাভা জানে, আমিও জানি। অযথা এই জিজ্ঞেস করাটা কেন? বলে জামায়াতিন দরজার দিকে হাঁটা শুরু করল।
রশিদভ ও ফায়জাভার মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো। হাসল তারা জামায়াতিনের নাটকীয়তায়।
চলে আসার জন্যে রশিদভ ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ফায়জাভার দিকে ফিরে বলল, তোমার উদ্বেগটা বুঝেছি। আল্লাহ ভরসা। বলে রশিদভ দরজার দিকে পা বাড়াল।
একখন্ড হাসি ফুটে উঠল ফায়জাভার মুখে। কম্যুনিষ্ট যুবলীগ কমসমল এর নেতা রশিদভের মুখে ‘আল্লাহ ভরসা’ শব্দটা এই প্রথম শোনা গেলেও বেমানান মনে হলো না।
রশিদভরা বেরিয়ে গেলে সেখানেই সোফায় বসে পড়ল ফায়জাভা। দরজায় আড়ি পেতে ফায়জাভা তার পিতা এবং রশিদভদের মধ্যকার সব কথাই শুনেছে। সাইমুম নেতারা তাদের কলখজে আসছে জেনে যতখানি খুশি হয়েছে, ততখানিই উদ্বিগ্ন হয়েছে তাদের আসার খবর সরকারের কানে দেয়ার খবর শুনে। এ সব শোনার পর থেকেই তার মনটা খচ খচ করছে। সরকার তাদের এখানে আসার খবরটা জানতে পেরেছে একথা যদি সাইমুমকে জানানো যেত। কিন্তু কিভাবে? তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ‘তুর্কিস্তান’-এর নিয়মিত গ্রাহক। কিন্তু সাইমুম এর সাথে তার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তাদের কলখজেও সাইমুমের ইউনিট আছে বুঝা যাচ্ছে, তাদের সাথেও ফায়জাভার জানা শোনা নেই। হঠাৎ তার মনে পড়ল সহপাঠিনী নাজিয়ার কথা। নাজিয়া সাইমুমের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রাখে। ফায়জাভা সাইমুমের মেম্বারশীপের উপযুক্ত হয়েছে এই কথা নাজিয়াই তাকে জানিয়েছে। তাকে ব্যাপারটা জানালেইতো সাইমুম জানতে পারে। খুশি হয়ে উঠল ফায়জাভা। ঘড়ির দিকে তাকাল, দেখল বিকেল ৬টা বাজে। যথেষ্ট সময় আছে, টেলিফোনেই সে খবরটা জানিয়ে দিতে পারে।
টেলিফোন করার জন্যে ফায়জাভা উঠে দাঁড়াল। গেল সে টেলিফোনের কাছে। টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিয়েও সে রেখে দিল। পার্টি লিডারের টেলিফোন এই দেশে আনরেকর্ডেড থাকে না।
ভাবল ফায়জাভা পাবলিক কল অফিসে যাওয়াই ভাল। চিন্তার সাথে সাথেই সে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু গাড়িতে উঠে সে ভাবল, পাবলিক কল অফিসে তার টেলিফোন করাটা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। ওখানে এখন গোয়েন্দারা তো অবশ্যই পাহারায় থাকবে। হঠাৎ তার মনে পড়ল নাইট স্কুলে বেড়াতে গিয়ে একটা টেলিফোন করার সুযোগ সে সহজেই নিতে পারে। অনেক দিন হল যায়নি সে ওখানে, গেলে সবারই সে খাতির পাবে।
ফায়জাভা তার গাড়ি নাইট স্কুলের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
সারকায়া গ্রামে প্রবেশের তিনটা পথ। প্রধান সড়কটি এসেছে আরিস ও কিজিলওরদা হয়ে তাসখন্দ থেকে। এ সড়কটি গ্রামের উত্তর প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করে গ্রামকে ডান পাশে রেখে এগিয়ে গেছে কলখজের দিকে।
আরেকটা রাস্তা সমরখন্দ, বোখারা, খিভা হয়ে আমু দরিয়ার ধার ঘেঁসে চলে এসেছে। এ রাস্তা গ্রামে প্রবেশ করেছে দক্ষিণ থেকে। করখজে এসে তাসখন্দ থেকে আসা রাস্তা এ রাস্তার সাথে এক হয়ে গেছে। তৃতীয় রাস্তাটি তুর্কমেনিস্থান থেকে এসে কলখজে প্রবেশ করেছে পশ্চিম দিক দিয়ে। এ রাস্তাটা আসমান ও সাবেকী ধরনের।
আমুদরিয়া কলখজের মাঝখান দিয়ে বযে গেছে। আমুদরিয়ার উভয় তীরে প্রায় ১০০০ বর্গমাইল এলাকায় কলখজ এলাকা বিস্তৃত। আমুদরিয়ার উপর দিয়ে একটা ব্রিজ উভয় অংশকে যুক্ত করেছে।
সন্ধ্যার পর থেকেই রাস্তাগুলোর বিভিন্ন স্থানে পাহারা বসানো হয়েছে। বিশেষ করে খিভা হয়ে এবং তুর্কমেনিস্তান থেকে যে রাস্তা দুটি এসেছে সারাকায় কলখজে, সে দুটি রাস্তায় শক্ত পাহারা বসানো হযেছে। কারণ ‘ফ্র’ মনে করেছে সাইমুমের লোকেরা এলে খিভা হয়ে সহজ পথ অথবা তুর্কমেনিস্তান থেকে আসা নিরাপদ পথ হয়েই আসবে। কারণ তাদের কাছে খবর আছে, খিভা থেকে সাইমুম উজবেকিস্থানের এ অঞ্চলের উপর নজর রাখছে।
সারাকায়া গ্রামের রাত তখন ৯টা। সর্বাংগ কাপড়ে ঢাকা একটা মূর্তি গ্রাম থেকে বেরিয়ে কার্পাস বাগানের মধ্য দিয়ে তাসখন্দ রোডের দিকে এগুচ্ছে। তাসখন্দ রোড প্রায় ২০ ফিট চওড়া। পাথর সিমেন্ট মিশিয়ে তৈরী এখানে রাস্তার দু’পাশে চোখ জুড়ানো কার্পাস ক্ষেত। কার্পাস গাছগুলো বেশ বড়। এই গাছের মধ্য দিয়েই এগুচ্ছে ছায়ামূর্তিটি। গাছগুলো বড় বলে বাইরে থেকে বুঝার উপায় নেই। ছায়ামূর্তিটি রোডের কাছাকাছি গিয়ে পৌছল। রাস্তা এবং রাস্তার আশপাশটা তার পরিস্কার নজরে পড়ছে। রাস্তার বিদ্যুৎ বাতি ও চাঁদের আলো সব মিলিয়ে চারদিকে একটা স্বচ্ছতা। ছায়ামূর্তিটি আরেকটু এগিয়ে গেল। কার্পাস ক্ষেত থেকে বেরুতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। মাত্র শ’দুয়েক গজ দূরে একটা কার্পাস গাছের গোড়ায় গিয়ে কে একজনকে বসতে দেখা গেল। ছায়ামূর্তিটা আর একটুও না নড়ে ঐ খানেই বসে রইল। কোমরে জুলানো পিস্তলের অস্তিত্বটা একবার অনুভব করে তাকাল কার্পাস গাছের গোড়ায় বসা লোকটির দিকে। কার্পাস গাছের ছায়ায় ওকে একটা জমাট অন্ধকারের মত দেখাচ্ছে।
কার্পাস বাগানের পরে ৫০ গজের মত একটা ফাঁকা জায়গা, তার পরেই তাসখন্দ সড়ক। ফাঁকা জায়গা এবং পাশ দিয়ে এক শ্রেণীর কাঁটাগাছ কোথাও হাটু পরিমাণ, কোথাও কোমর পরিমাণ উঁচু। বিজলী বাতি এবং চাঁদের আলোতে তাসখন্দ সড়কটি মোটামুটি আলোকিত।
একটা গাড়ি উত্তর দিক থেকে তীরবেগে এসে দক্ষিণে মিলিয়ে গেল। পুলিশের গাড়ি। ছায়ামূর্তিটি ভাবল ওটা টহলের গাড়ি।
ছায়ামূর্তিটির ইচ্ছা ছিল সড়ক বরাবর গ্রামের প্রান্তে ব্রীজ পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। কার্পাস তলার ঐ লোকটি তার পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিল। ভাবল, সামনে পেছনে এমন লোকের দেখা হয়তো আরও পাওয়া যাবে। সুতরাং কোনদিকে অগ্রসর হওয়া নিরাপদ মনে করল না।
উত্তরদিক থেকে একটা গাড়িকে তীব্র বেগে ছুটে আসতে দেখা গেল। তার পেছনে আরও দুটো হেডলাইট।
হঠাৎ পেছনে পায়ের শব্দে পিছনে ফিরে তাকাল ছায়ামূর্তিটি। দেখল, মুখোশ ঢাকা একজন লোক। তার উদ্যত রিভলভার তার দিকে স্থির। কিন্তু শীঘ্রই উদ্যত রিভলবারটা নীচে নেমে গেল। নীচু কণ্ঠে তার মুখ থেকে বেরুল, ফায়জাভা তুমি? এখানে।
ফায়জাভা ঠোটে আঙুল ঠেকিয়ে উত্তর দিকে ইংগিত করল। ফিস ফিসে কণ্ঠে বলল, ঐখানে একজন লোক। হয়তো আরও আশে পাশে আছে রশিদ ভাই।
ফায়জাভা রশিদভকে দেখিয়ে দিল জায়গাটা। রশিদভ কিছু বলতে যাচ্ছিল ফায়জাভাকে। কিন্তু বলা হলোনা। দেখল সেই ছুটে আসা গাড়িটি সামনের লাইট পোস্টটা পেরিয়ে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বলতে গেলে একেবারে তাদের নাক বরাবর সমান্তরালে।
ছয় সিটের জীপ গাড়ি। গায়ে সেনাবাহিনীর প্রতীক আঁকা। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর গাড়ি।
তারা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করল, এ গাড়িটি দাঁড়ানোর সাথে সাথে পিছনে ছুটে আসা গাড়িটিও কড়া একটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রায় দুশ গজ পেছনে। বিজলী বাতির আলোতে এ গাড়ির গায়েও সেনাবাহিনীর প্রতীক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এই সময় দক্ষিণ দিক থেকে আরেকটা গাড়িকে ছুটে আসতে দেখা গেল। সামনে ছয় সিটের যে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল তা ব্যাক-ড্রাইভ করে পিছু হটতে লাগল। মনে হল গাড়িটি পিছনের গাড়ির কাছে যেতে চায়। গাড়িটির ব্যাক-ড্রাইভ দ্রুত হলো। পেছনের গাড়ি থেকে গুলীর শব্দ হলো, পর পর দু’টি। ভীষণ শব্দের টায়ার ফেটে গেল সামনের গাড়িটির। কিন্তু ততক্ষনে গাড়িটি পেছনের গাড়িটির অনেকখানি কাছে এসে গেছে।
টায়ার ফেটে যাবার পর গাড়িটি থেমে গেল। তার সাথে সাথেই সেই গাড়ি থেকে দু’টি গোলাকার বস্তু ছুটে গেল পেছনের গাড়ির উদ্দেশ্যে। বস্তু দু’টি অভ্যর্থভাবে আঘাত করল পেছনের গাড়িকে। একই সাথে দু’টি বিস্ফোরণের শব্দ হলো। সেই বিস্ফোরণে পেছনের গাড়টি খেলনার মত টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল চারদিকে।
দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসা গাড়িটি ততক্ষণে এসে পড়েছে। ও গাড়িটিও সেনাবাহিনীর। ক্যারিয়ার জাতীয় ভ্যান। গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে এল গাড়িটি।
টায়ার ফেটে যাওয়া জীপ থেকে চারজন লোক লাপ দিয়ে রাস্তার পশ্চিম পাশে নেমে এল। নামল তারা সেই কার্পাস গাছের গোড়ায় বসে থাকা লোকটির প্রায় নাক বরাবরই।
রশিদভ ফিস ফিস করে বলল, বুঝতে পারছ কিছু ফায়জাভা?
ফায়জাভা বলল, না। এনিক কোন সেমসাইড ব্যাপার?
-না সেমসাইড নয়। আমার মনে হচ্ছে মাঝের অর্থাৎ টায়ার ফাটা গাড়িটা সাইমুমের। ওরা সেনাবাহিনীর জীপ ব্যবহার করছে। বলল রশিদভ।
-কি বললে সাইমুমের! এক রাশ বিস্ময় ঝরে পড়ল ফায়জাভার কণ্ঠে। একটা উষ্ণ শিহরণ খেলে গেল তার গোটা দেহে।
চারজন লোক জীপ থেকে রাস্তার পাশে লাফিয়ে পড়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছিল দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে আসা গাড়ির দিকে।
এই সময় রশিদভ এবং ফায়জাভা লক্ষ্য করল, সেই চারজনের ঠিক পেছনেই একজন লোক যেন ঠিক মাটি ফুঁড়েই উদয় হলো তার হাতের মিনি সাবমেশিনগান মাথা তুলেছে সেই চারজনকে লক্ষ্য করে। কিন্তু হঠাৎ একটা গুলীর শব্দ হলো তার পিছন থেকে। স্টেনগান ওয়ালা লোকটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটিতে।
গুলীর শব্দের সেই চারজন মুখ ফিরিয়ে তাকাল। একজন মাথা নিচু করে ছুটে এল মুখ থুবড়ে পড়া লোকটির কাছে। এ সময় কার্পাস ক্ষেত থেকে একজন লোক বেরিয়ে “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি দিয়ে তার দিকে এগুলো। তার হাতে রিভলবার। মনে হলো এই লোকটিই স্টেনগান ওয়ালা লোকটিকে মেরেছে। মুখ থুবড়ে পড়া লোকটির কাছে এসে পড়া সাইমুমের লোকটি তার অস্বাভাবিক লম্বা ধরনের ব্যারেল ওয়ালা বাঘা রিভলবারটি আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে এগিয়ে আসা লোকটির দিকে তাক করে আবার নামিয়ে নিল।
লোকটির ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি শুনে রশিদভ এবং ফায়জাভা চিনতে পারল ও জামায়াতিন।
জামায়াতিন কার্পাস ক্ষেত থেকে সড়কের অর্ধেকটা পথ এগিয়েছে। এমন সময় কার্পাস ক্ষেতের দিক থেকে একটা গুলির শব্দ হলো। গুলীবিদ্ধ জামায়াতিনের দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
ফায়জাভা চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। রশিদভ তার মুখ চেপে ধরে বলল, সামনে ও উত্তর দিকে চেয়ে দেখ। দেখা গেল দক্ষিণ দিকে চুটে আসা গাড়ি থেকে দশ বারজন সৈনিকের ইউনিফর্মধারী লোক লাফিয়ে পড়ল সড়কে। আর উত্তর দিকে সেই কার্পাস গাছের নীচের লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে উদ্যত রিভলবার তাক করেছে সেই সাইমুমের লোকটিকে।
রশিদভ এবং ফায়জাভার রিভলবার এক সাথে অগ্নিবৃষ্টি করল কার্পাস তলার সেই লোকটির দিকে। লোকটি একটি ‘আ-আ’ চিৎকারে উপুড় হয়ে সামনে আছড়ে পড়ল।
এদিকে দক্ষিণের দিক থেকে আসা গাড়ি থেকে যারা নেমেছিল তারা দক্ষিণ দিকে অগ্রসররত সাইমুমের তিনজন লোকের গুলীর মুখে পড়ল। তাদেরও অটোমেটিক এম-১০ রিভলবার গুলী বৃষ্টির এক দেয়াল সৃষ্টি করল। ঝড়ের তোড়ে গাছের পাকা আমের মতই ঝরে পড়ল লোকগুলো মাটিতে।
রশিদভ এবং ফায়জাভা গুলী করেই ছুটল উত্তর দিকে যেখানে জামায়াতিন গুলী খেয়ে পড়ে আছে সেদিকে। তারা সেই কার্পাস গাছ পার হতেই দেখল একটা উদ্যত রিভলবার তাদের দিকে ছুটে আসছে।
রাশিদভ বাম হাতে ফায়জাভাকে এক হ্যাচকা টান মেরে মাটিতে শুয়ে পড়ল। তার সাথে সাথে ফায়জাভাও পড়ে গেল। তাদের মাথার উপর দিয়ে চলে গেল একটা বুলেট। দ্বিতীয় গুলীর জন্য ঐ লোকটা তাক করেছিল। কিন্তু পারল না। সাইমুমের সেই লোকটির দীর্ঘ ব্যারেলওয়ালা রিভলবার উঁচু হলো। সংগে সংগে এম-১০ থেকে গুলীর ঝাঁক এসে ঝাঁঝরা করে দিল লোকটিকে।
রশিদভ এবং ফায়জাভা উঠল। ছুটে গেল জামায়াতিনের কাছে। পিঠে গুলী লেগেছে তার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রশিদভ এবং ফায়জাভা ঝুকে পড়ে ব্যাকুলভাবে পরীক্ষা করল জামায়াতিনকে। না, জামায়াতিন আর নেই। রশিদভ এবং ফায়জাভা দুজনারই চোখ ফেটে নেমে এল অশ্রুর বান। রক্তের সম্পর্কে জামায়াতিন তাদের কেউ নয় কিন্তু জামায়াতিন তাদের বহুদিনের সাথী, তাদের সব চিন্তার শরীক। তার এমন মর্মান্তিক বিদায় তারা কল্পনা করেনি।
সাইমুমের সেই চতুর্থ লোকটি এবং অপর তিনজন তাদের চারপাশে এসে দাড়িয়েছে। দেখছে তারা এই দৃশ্যকে।
সাইমুমের একজন বলল, আপনারা কে জানতে পারি?
রশিদভ মুখ তুলল। বলল, আমি হতভাগা রশিদভ কমসমলের সাধারণ সম্পাদক, এই বোন তুঘরীল তুঘানের মেয়ে ফায়জাভা। আর এই ভাই কমসমলের পশ্চিম উজবেকিস্তান ইউনিটের সভাপতি। আমরা সাইমুমের কেউ নই কিন্তু ভালবাসি সাইমুমকে।
সাইমুমের সেই লোকটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং মুখে উচ্চারণ করল, আলহামদুলিল্লাহ।
একটু থেমে সে আহমদ মুসার দিকে ইংগিত করে বলল, ইনি সাইমুম নেতা আহমদ মুসা আর ইনি সাইমুম নেতা কর্ণেল কুতাইবা আর আমরা দু’জন নগণ্য কর্মী।
রশিদভ এবং ফায়জাভা বিস্মায়াবিষ্টের মত তাকিয়ে রইল আহমদ মুসার দিকে। যেন অবিশ্বাস্য কোন এক দৃশ্যের তারা মুখোমুখি। যেন স্বপ্নের কোন এক নায়ককে তারা দেখছে। হাজারো কথা-কিংবদন্তী যাকে ঘিরে- সেই মহানায়ক তাদের সামনে।
নিরবতা ভাঙল আহমদ মুসা নিজেই। তাদের বিস্ময়াবিষ্ট চোখে চোখ রেখে বলল, প্রিয় ভাই বোনেরা, তোমাদের কাছ থেকে যে সাহায্য পেয়েছি তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে খাট করবো না। যা তোমরা করেছ জাতির একজন হয়ে জাতির জন্য করেছ। অসীম দুর্ভাগ্যের শিকার জাতি তোমাদের কাছ থেকে এটাই আশা করে।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর ঝুকে পড়ে জামায়াতিনের কপালে একটা চুম্বন দিয়ে বলল, পশ্চিম উজবেকিস্তানের প্রথম শহীদ আমার এ ভাই। আমি প্রার্থনা করি তার প্রতি ফোঁটা রক্ত আমাদের মধ্যে সংগ্রামের একজন করে সৈনিক গড়ে তুলুক। এর কে কে আছে আমি জানি না। তাদের কাছে তোমরা আমার শ্রদ্ধা জানিও।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর আবার বলল, তোমাদের কাছ থেকে আমাদের আরও অনেক কথা শুনার আছে। আল্লাহ সে সুযোগ আমাদের দিন। এখন আমরা বিদায় নিতে চাই, এই মুহুর্তে অনেক কাজ।
ফায়জাভা বলল, এর মধ্যেই আপনারা মিটিং-এ যাবেন?
-হ্যাঁ বোন, আমরা আশা করি।
-কিন্তু কিভাবে?
-চিন্তা কর না। ঐ যে ক্যারিয়ারটা দাঁড়িয়ে আছে ওটা নিয়েই আমরা যাব। আগের গাড়ির নাম্বারটা সম্ভবত আমরা ওটা দখল করার সময়ই ওরা চার দিকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। তাই কিছু অসুবিধা হয়েছে। আমরা ওদের সৈনিকদের পোশাকেই আছি। ওরা যে পরিমাণ দিশাহারা হয়ে পড়েছে তাতে কিছুই ঠিক করতে পারবে না।
-কিন্তু আপনারা আসছেন এ খবর এরা জানে এবং সেভাবেই এরা প্রস্তুত।
-জানে? বিস্মিত কন্ঠ আহমদ মুসার।
-জানে। আমরাও জানি বলেই ঔৎসুক্য নিয়ে বেরিয়েছি। এ খবর তো আমি আজ সন্ধ্যায় তাসখন্দের আমার এক বান্ধবী সাইমুম কর্মীকে জানিয়েছি, যাতে এ বিষয়টা আপনারা জানতে পারেন।
সন্ধ্যার আগেই আমরা তাসখন্দ থেকে বেরিয়ে এসেছি।
এ সময় উত্তর দিগন্তে একটি গাড়ির হেডলাইট স্পষ্ট হয়ে উঠল। উত্তর দিক থেকে এ পথেই একটি গাড়ি আসছে। সেদিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, আসি বোন, খোদা ভরসা।
বলে আহমদ মুসা সালাম দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। ফায়জাভা জিজ্ঞেস করল, আমাদের জন্য কোন পরামর্শ, কোন নির্দেশ?
আহমদ মুসা থমকে দাঁড়িয়ে আবার এদিকে ফিরল। বলল, তোমরা সাইমুমের সৈনিক হিসেবে মুসলিম জনগনের কাছে একটা কথাই বল, শোষকদের শোষণের দিন শেষ হয়েছে, মুসলমানদের ঈমান জেগে উঠেছে, ঈমানের শক্তির কাছে পশুর শক্তির পরাজয় যাত্রা শুরু হয়েছে। এ কথা বলে আহমদ মুসা ঘুরে চলতে শুরু করল দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিক ভ্যানের দিকে।
রশিদভ এবং ফায়জাভা সে দিকে তাকিয়ে রইল অপলক চোখে। তাদের চোখে উজ্জ্বল আলো। তার চেয়েও বড় আলোর দেয়ালী চলছে তাদের হৃদয়লোকে। মনে হল তারা যেন নতুন মানুষ। আর আদিগন্ত এক নতুন পথ তাদের সামনে।

সৈনিক ভ্যানটি এগিয়ে চলছে আহমদ মুসাদের নিয়ে। আহমদ মুসা ড্রাইভিং সিটে। পাশে কুতাইবা। পেছনে দু’জন।
ড্রাইভিং সিটে একটা অয়্যারলেস সেট পড়েছিল। আহমদ মুসা সেটা কর্ণেল কুতাইবার হাতে তুলে দিয়ে বলল, দেখ কোন কাজে লাগে কিনা?
সামনেও একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। অর্থাৎ উত্তর দিকের মত দক্ষিন দিক থেকেও আরেকটা গাড়ি আসছে। আহমদ মুসা বলল, আমরা আসছি যখন ওরা জানে তখন ফাঁদে ফেলার কোন আয়োজনই ওরা বাদ রাখেনি কুতাইবা।
একটু থামল আহমদ মুসা। তারপর বলল, আমুদরিয়া ব্রিজের অপর মাথায় আমাদের লোকেরা অপেক্ষা করছে। ওখানে আমাদের পৌছতেই হবে।
এ সময় কুতাইবার হাতের ওয়্যারলেস কথা বলে উঠল। আর্মি কোডে কথা বলছে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর জানতে চাচ্ছে, কি হয়েছে, কি ঘটেছে?
কর্নেল কুতাইবার আর্মি কোড মুখস্থ। সে উত্তর দিল, ঘটনাটা পরিষ্কার অন্তর্ঘাতমুলক, অন্য কিছু নয়। আমরা ফিরে আসছি। একবার আমুদরিয়ার ওপারটা ঘুরে আসব।
কুতাইবার দিকে চেয়ে হাসল আহমদ মুসা। বলল, শুকরিয়া, কুতাইবা। ওয়েল ডান।
সামনে থেকে যে গাড়ি দু’টো আসছে ও দুটোও আর্মির গাড়ি। আলোক সংকেতে এটা জানিয়ে ওরা এ গাড়ির পরিচয় জানতে চাচ্ছে।
কর্নেল কুতাইবার দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসা আলোক সংকেত দিল, সব ঠিক আছে, আমরা ওদিকের পেট্রলে যাচ্ছি।
কুতাইবা আহমদ মুসার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, ধন্যবাদ মুসা ভাই। আপনার আলোক-সংকেত নিখুঁত হয়েছে।
আহমদ মুসা কম্যুনিস্ট সেনাবাহিনীর শব্দ, আলো এক কথায় আর্মি কোড কর্নেল কুতাইবার কাছ থেকেই শিখেছে।
সামনে অর্থাৎ দক্ষিন দিক থেকে আসা গাড়িটি সাইড নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল উত্তর দিকে। আহমদ মুসার গাড়ি সাইড নিয়ে ও গাড়িটাকে পেরিয়ে এসে দ্রুত ছুটে চলল দক্ষিন দিকে। আহমদ মুসা তার গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। কুতাইবার দিকে তাকিয়ে বলল, ও গাড়িটা স্পটে গিয়েই সব বুঝতে পারবে এবং বুঝতে পেরে শুধু পাগলের মত ফিরে আসা নয়, খবরটা সে রিলে করবে সব জাগায়। তার আগেই আমাদের ব্রীজ পেরুতে হবে।
তীর বেগে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। দূরে আমুদরিয়া ব্রীজের উপর আলোর সারি দেখা যাচ্ছে। গাড়ি এগিয়ে চলেছে ঐ ব্রীজ লক্ষ্যে। ব্রীজের ওপারে সাইমুমের যে লোকেরা তাদের রিসিভ করার কথা তারা কি আসতে পারবে এদের মারমুখো-মরিয়া এই আয়োজনের মধ্যে?
আর এক মিনিটের মধ্যে গাড়ি পৌছে যাবে ব্রীজের মুখে। আরো কিছুটা পথ এগিয়েছে গাড়ি। এমন সময় ব্রীজের মুখে লালবাতি জ্বলে উঠল। ছ্যাঁৎ করে উঠল আহমদ মুসার মন। খবর কি এখানে ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে? না এটা কোন রুটিন ব্যাপার?
স্টিয়ারিং হাতে আহমদ মুসা কুতাইবার দিকে মুখ না ঘুরিয়েই বলল, তুমি সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেল। এ হিসেবেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে। এখানে যাদের পাবে তারা নিশ্চয়ই জুনিয়র অফিসার।
গাড়ির হেডলাইটে দেখা যাচ্ছে ব্রীজের মুখে একজন অফিসার দাঁড়িয়ে, তার পাশেই একটা গাড়ি দাঁড়ানো। আহমদ মুসা পকেট থেকে মিনি দূরবীনটা বের করে চোখে লাগাল। দেখল, দাঁড়ানো অফিসারের কাঁধে পুলিশ অফিসারের ইনসিগনিয়া, গাড়িটাও পুলিশের। খুশি হলো আহমদ মুসা। বিষয়টা কুতাইবাকে জানিয়ে বলল, ওদের ধমক দিলেই চলবে। আর ওরা যখন অস্ত্র বাগিয়ে নেই, তখন নিশ্চয় ওরা সব খবর জানে না।
আহমদ মুসা গাড়িটা একদম পুলিশ অফিসারটির পাশে দাঁড় করাল, যাতে কুতাইবা তার মুখোমুখি হতে পারে।
কুতাইবার বাম বাহুটি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আছে। তাতে কর্ণেলের ইনসিগনিয়া জ্বল জ্বল করছে। পুলিশ অফিসারটি তা দেখেই লম্বা একটা স্যালুট দিল।
কুতাইবা মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই লাল সংকেত কেন?
পুলিশ অফিসারটি নরম কন্ঠে বলল, স্যার এই মাত্র নির্দেশ এল সব গাড়ি আটকে রাখার জন্য।
-ও অল রাইট। শত্রুরা ঢুকে পড়েছে কিনা, এর দরকার আছে। কোন গাড়ির নাম্বার কিছু জানিয়েছে?
না স্যার বলেছে চেষ্টা করছে। তবে গাড়িটা সেনাবাহিনীর ক্যারিয়ার ভ্যান।
ছ্যাৎ করে উঠল কুতাইবার মন। কিন্তু বাইরে তার কোন প্রকাশ ঘটল না। খুশী হলো যে নাম্বারটা তারা এখনও পায়নি।
এ সময় আহমদ মুসা স্টার্টারে একটু চাপে দেয়ায় ইঞ্জিন শব্দ করে নড়ে উঠল গাড়িটি। সংকেত বুঝতে পেরে কুতাইবা পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে বলল, ওকে, চারদিকে নজর রাখ আমরা আসছি।
পুলিশ অফিসারটিকে একটু বিহবল মনে হল। সে যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু পারল না। তার সামনে দিয়ে গাড়িটি তীরের মত উঠে গেল ব্রীজে।
আহমদ মুসা বলল, আলহামদুলিল্লাহ, তোমার অভিনয় ভাল হয়েছে। ব্রীজের সামনের মুখেও এ ধরনের বাধা নিশ্চয় আছে কিন্তু ওখানে আর দাঁড়াতে চাই না।
ব্রীজের মাঝামাঝি এসে আহমদ মুসা সাইমুমের কোডে একবার হর্ণ বাজালো। মুহুর্তকাল পরে সামনে ব্রীজের ওপারে অনেক দুর থেকে আরেকটা হর্ণ বেজে উঠল সাইমুমের কোডে।
আহমদ মুসা এবং কুতাইবা দুজনের মুখই খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ব্রীজের সামনের প্রান্তটি এখন দেখা যাচ্ছে। ওখানে সেই লাল আলো। অর্থাৎ দাঁড়াতে হবে।
দেখা গেল ব্রীজের মুখের পাশেই একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে দুজন পুলিশ অফিসার। হঠাৎ এ সময় আরেকটা গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়াল। সেনাবাহিনীর একটি সুদৃশ্য জীপ। নিশ্চয় গাড়িটি কোন উচ্চপদস্থ অফিসারের।
জীপটি দাঁড়াল রাস্তার ডান ধার ঘেঁষে। বাম দিকে প্রচুর জায়গা। আহমদ মুসা ঠিক করল এদিক দিয়েই সে স্লিপ করবে।
এ সময় সেখানে থেকে আহমদ মুসার গাড়ির প্রতি সংকেত এল গাড়ি দাঁড় করাবার জন্য। আহমদ মুসা বলল, কুতাইবা আমরা না দাঁড়ালে অবশ্যই ওরা গুলি করবে।
একটু থামল আহমদ মুসা। একটু হাসল। তারপর নিজেই আবার বলল, আশা করি এ সুযোগ তারা পাবে না।
আর দু’শ গজ দুরেই ব্রীজের মুখ, ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে জীপটি। আহমদ মুসা গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। বোঝা যাচ্ছে ব্রীজের মুখে গিয়েই গাড়িটি দাঁড়াবে। বিস্ময়ে একবার কুতাইবা কিছু বলতে সাহস পেল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল কুতাইবা। ঐ জীপের উর্ধ্বতন সামরিক অফিসারের সন্মুখে পড়লে তার কিছুই বলার থাকবে না সেখানে।
আহমদ মুসার গাড়িটি ধীর গতিতে ব্রীজের মুখ পেরিয়ে জীপটির সমান্তরালে দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে।
ব্রীজের ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পুলিশ অফিসার আহমদ মুসার গাড়ির দিকে এগুবার জন্য নড়ে উঠল। জীপটির দরজাও নড়ে উঠল। মাঝ বয়সি একজন জেনারেল গাড়ি থেকে নামার জন্য তৈরী হলেন। জীপের পেছনে জেনারেলর ৪ সদস্যর স্কোয়াডটিও জীপের দরজায় হাত দিল তা খোলার জন্য।
গড়িয়ে গড়িয়ে আহমদ মুসার গাড়িটি জীপের সমান্তরালে এসেই যেন প্রচন্ড এক লাফ দিয়ে উঠল। প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটি তীরের মত ছুটে চলল সামনে।
পুলিশ অফিসার দুজন জীপের ঐ পাশ দিয়ে জীপের মাথা বরাবর পৌঁছেলিল। হাতের স্টেনগান তাদের মাথার উপর উঠল কিন্তু সামনে জীপের আড়াল থাকায় আহমদ মুসার গাড়িকে তাক করতে পারল না।
জেনারেল এবং তার স্কোয়াড জীপ থেকে নামছিল। যখন নামা তাদের শেষ হলো, তখন আহমদ মুসার গাড়ি অনেক দুর এগিয়ে গেছে। স্টেনগানের গুলী তখন সেখানে অকেজো।
জেনারেল জীপটি ঘুরিয়ে পিছু নেবার নিদেশ দিল। কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, গাড়ির পেছনের যে আলো দেখা যাবার কথা তা দেখা যাচ্ছে না। অথাৎ সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্ধকারে হাতড়ানো নিরর্থক।
জেনারেল অয়্যারলেস তুলে নিল হাতে।
ঝড়ের বেগে চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি। সব লাইট নিভানো। অন্ধকারে এক দৈত্যর মতই মনে হচ্ছে গাড়িটাকে।
অনেক খানি এগিয়ে সাইমুম কোডে আবার হর্ণ বাজালো আহমদ মুসা। মুহুর্তেই উত্তর এল পাশের এলাকা থেকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দক্ষিণ থেকে একটা হেডলাইট এগিয়ে এল। আলোর সংকেত দেখে বুঝল ওটা সাইমুমের গাড়ি।
আহমদ মুসা ও কুতাইবা গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। পেছন থেকে ওরা দুজনও নামল।
ক্যারিয়ার ভ্যানটি ফেলে রেখে সাইমুমের জীপটিতে চড়ে আহমদ মুসা এবং অন্যরা একটা ছোট রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল পশ্চিম দিকে। আঁকা-বাঁকা পথে দশ মিনিট ড্রাইভের পর তারা কলখজের লিগ্যাল এইড অফিসে এসে পৌঁছল।
গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আবদুল্লাহ জমিরভ গাড়ির দরজা খুলে আহমদ মুসা ও কুতাইবাকে নামিয়ে নিয়ে বলল, এখন আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আমার সাথী রসুলভ। আমি গাড়ি নিয়ে এখানে আমার অফিসেই থাকব। জমিরভ সারাকায় কলখজের লিগ্যাল এইড অফিসের জাজ এডভোকেট।
আহমদ মুসা বলল, তুমি যাচ্ছ না তাহলে?
-না জনাব, আমার দায়িত্ব পথের এ দিকটা পাহারা দেয়া। যদি কেউ ফলো করে থাকে, কিংবা জানতে পেরে থাকে, তাহলে আমার অফিস পর্য্ন্ত এসেই যেন সে ঠেকে যায়।
আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে রসুলভের পিছনে পিছনে লিগ্যাল অফিসের পাশের গলিপথ ধরে কলখজের বিশাল গোডাউন চত্বরের দিকে এগিয়ে চলল। সাইমুমের আজ বৈঠক বসেছে ঐখানেই।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.