০৫. রক্তাক্ত পামির
পর্ব ৫
মস্কোতে ফিরে আসার পর ফাতেমা ফারহানা লাইব্রেরীতে আগের চেয়ে নিয়মিত। প্রতিদিন উম্মুখ হয়ে লাইব্রেরীতে যায়, তারপর সুযোগ বুঝে সন্ত্মর্পনে গিয়ে ঐ বইটি খোলে। না, সাইক্লোষ্টাইল করা ‘তুর্কিস্তান’ নামের সেই পত্রিকা আগের মত আর পায়না। বইটি খুললেই তার শূন্য বুক ফাতিমা ফারহানার হৃদয়কে নিদারুন ধাক্কা দেয়।
ফাতিমা ফারহানা অস্থির হয়ে পড়ল। কেন এমন হচ্ছে? পত্রিকা কি বন্ধ হয়ে গেছে? কিংবা পত্রিকাটি তারা পৌছাতে পারছে না! না এখানকার নেট ওয়ার্ক তাদের ভেঙে গেছে? তার ছুটিতে থাকাকালে কি কোন অঘটন ঘটে গেছে এখানে?
ইত্যাকার চিন্তা ফাতেমা ফারহানাকে যেন পাগল করে তুলল। যেন সে গোটা জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে সে এক দ্বীপে দাঁড়িয়ে, আর সবাই তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে। আবেগে ক্ষোভে উপায়হীনতায় টস টস করে তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার বড় আশা ছিল, ঐ ‘তুর্কিস্তান’ এর মাধ্যমে সে আহমদ মুসার খবর পাবে, তার নির্দেশও সে পাবে এই পথে। উনি সেদিন বলেছিলেন, যথাসময়ে নির্দেশ তিনি পৌছাবেন। কিন্তু কিভাবে? পথই যে তার সামনে বন্ধ হয়ে গেল।
অনেক সময় সে ভাবে, তার কি দোষ হয়েছে? সেদিনের অন্ধকার রাতের কথা মনে পড়ে ফাতিমা ফারহানার। সেদিন অহেতুক কোন প্রশ্ন করে কি তাকে বিরক্ত করেছে ফারহানা? বিশ্ব বিপ্লবের সিপাহসালার তিনি। তার মত ছোট মানবী তার কাছে কিছুই নয়। তার কোন দুর্বলতায় কি সেদিন তিনি রাগ করেছেন? বিদায়ের সময় নিজের অপ্রতিরোধ্য কান্নার কথা মনে পড়ল ফাতিমা ফারহানার। আমি তো কাঁদতে চাইনি। কান্না এল কেন? আমি তো ওঁকে চিনতাম না, কিন্তু মনে হলো কেন সেদিন ও আমার সব! ও চলে যাবার সময় কেন হৃদয়ের সব গ্রন্থিতে অমন করে টান পড়ল আমার। ছিড়ে গেল কেন সব গ্রন্থি? ওগুলো তো সেদিন কান্না ছিল না, সেই রক্তাক্ত হৃদয়েরই অশ্রু ছিল ওসব।
পড়াশুনায় মন বসে না ফাতিমা ফারহানার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশে যায়, লাইব্রেরীতে যায়, নিজের রুমে টেবিলে পড়তে বসে, কিন্তু পড়ায় মন বসাতে পারেনা।
কত চিন্তা তার মনে? আহমদ মুসা এসেছে, কাজতো এখন বাড়ার কথা, কাজ বন্ধ হলো কেন? কোন বড় অঘটন কিছু ঘটে যায়নি তো? আহমদ মুসা কোথায় কেমন আছে? সেদিন আহত অবস্থায় জ্বর নিয়ে তিনি চলে গেলেন। কিছু হয়নি তো তার? এমনটা ভাবতেই তার মন কেঁপে ওঠে। এখানে নিজের স্বার্থ চিন্তার চেয়ে জাতির স্বার্থ চিন্তাই তার কাছে বড় হয়ে ওঠে। মধ্য এশিয়ার হতভাগ্য মুসলমানদের জন্য আজ তার বড় প্রয়োজন। যুগ যুগান্তের অত্যাচারে সংগ্রামী এই জাতির ঐতিহ্যবাহী প্রতিরোধ কাঠামোর মেরুদন্ড ভেংগে গুঁড়ো হয়ে গেছে। লাখ লাখ সংগ্রামী যুবক কম্যুনিষ্ট বাহিনীর হাতে জীবন দিয়েছে। লাখো মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়েছে। তুর্কিস্তান থেকে চালান দেয়া কত লাখ তুর্কি মুসলিম যুবক যে সাইবেরিয়ার সাদা বরফের তলে ঘুমিয়ে আছে, এ হিসাব কোন দিনই মিলবেনা। বিপর্যয়ের এ গোরস্তান থেকে আজ সংগ্রামের নতুন জেনারেশন মাথা তুলেছে। জেঁকে বসা কম্যুনিষ্ট ব্যবস্থা ভাষা পাল্টিয়ে, ইতিহাস পাল্টিয়ে, ধর্মশিক্ষা বন্ধ করে, চাকুরী, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও ভোগবাদী জীবনের মায়াজালে আটকিয়ে মুসলমানদের হজম করে ফেলেছে ভেবেছিল। কিন্তু তাদের আশা মিথ্যা হয়েছে। গোটা মধ্য এশিয়ার মুসলমানরা মুক্তির আশায়, মুক্ত বাতাসে স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেবার জন্য আজ ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সংগ্রামী কাফেলার যাত্রা শুরু হয়েছে। আজ তার নেতৃত্ব প্রয়োজন। ফিলিস্তিন বিজয়ী, মিন্দানাও বিজয়ী আহমদ মুসাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এদের নেতৃত্বের জন্য পাঠিয়েছেন। তিনি ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
সেদিন ফাতিমা ফারহানা লাইব্রেরীতে যাবার জন্য হল থেকে বেরিয়েছে। যাচ্ছিল সহপাঠিনী বান্ধবী কিরঘিজিস্তানের মেয়ে সুমাইয়া সুলতানাভার রুমের পাশ দিয়ে।
একটা ঢু মেরে যাবে মনে করে ঢুকে পড়ল তার রুমে। দেখল সেখানে সুমাইয়া ছাড়াও রয়েছে সুফিয়া সভেৎলানা, খোদেজায়েভা, কুলসুম ত্রিফোনভা, রইছা নভোস্কায়া এবং তাহেরভা তাতিয়ানা। এদের মধ্যে খোদেজায়েভা, তাহেরভা তাতিয়ানা উপরের ক্লাসে পড়ে। সুফিয়া সভেৎলানা নীচের ক্লাসে, আর কুলসুম ও রইছা তার সাথে পড়ে। কুলসুম তাতার মেয়ে। তাজিক মেয়ে সুফিয়া। তাহেরভার বাড়ী হলো কাজাকিস্তানে। আর বাকি খোদেজায়েভা এবং রইছা উজবেক। এরা সবাই আঞ্চলিক পার্টির বড় বড় কর্মকর্তার মেয়ে। বিলাসী জীবন এদের। সবার সাথেই ফারহানা পরিচিত।
সবাইকে এখানে একসাথে দেখে ফাতিমা ফারহানা বিস্মিত হলো, কিন্তু তার চেয়ে বেশী হলো অপ্রস্তুত। ওরা আলাপ করছিল। ফারহানার আগমনে ওদের আলাপটা হঠাৎ থেমে গেল। ওদের মুখ চোখ দেখে নিজেকে বড় অনাহূত মনে হলো তার।
তবু মুখে হাসি টেনে ফারহানা বলল, এদিক দিয়ে লাইব্রেরীতে যাচ্ছিলাম তাই একবার এলাম। চলি, তোদের ডিসটার্ব করবোনা। বলে রুম থেকে বেরুবার জন্য উদ্যত হলো ফারহানা। সুমাইয়া হেসে হাত তুলে বলল, দাঁড়া, দাঁড়া, আমরা কম পড়ি বলে কি আমাদের সাথে বসতে তোর আপত্তি?
-কোন আপত্তি নেই। কম পড়ার কথা বলছিস কেন? কম পড়েই বুঝি তোরা তোদের ডিষ্টিংশন গুলো পেয়েছিস? কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে বলল ফারহানা।
-তর্ক রেখে বস না। বলল সুমাইয়া।
-না, বসবনা এখন। সবাইকে এক সংগে পেয়ে কথা বলতে লোভ হচ্ছে, কিন্তু লাইব্রেরীতে যাওয়া দরকার।
বলে সবার কাছে বিদায় নিয়ে ফারহানা বেরিয়ে এল রুম থেকে। চলল লাইব্রেরীর দিকে। কিন্তু রুমে ঢোকার সময় যে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা তাকে পেয়েছিল তা দূর করতে পারলোনা। সে যখন ঘরে ঢুকছিল, ‘আহমদ মুসা’ শব্দটা তখন তার কানে আসে। এ নাম এখানে কেন? ওরা কি আলোচনা করছিল? অমনভাবে ওরা থেমে গেল কেন? ওরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফ্র’ এর এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে? এটা হওয়া স্বাভাবিক। ওরা সকলেই সরকারী সুবিধাভোগীদের সন্তান। ফারহার দুঃখ হলো মুসলিম নামের এ মেয়েদের জন্য। আবার ভেবে খুশী হলো, এদের থেকে সাবধান থাকা যাবে।
লাইব্রেরীতে এসে বসল ফারহানা। বই এবং নোটখাতা নিয়ে বসে থাকল কিছুক্ষণ। না, মন বসছেনা। কিছুক্ষণ বসে এদিক-ওদিক চেয়ে শেষ পর্যন্ত সে উঠে গেল এ বইটির কাছে। ভিতরের একটি সেলফে বিশ্ব-ভূগোলের উপর একটা পুরোনো বই। এর বহু নতুন এডিশন হয়েছে, এ পুরোনো এডিশন আর পড়েনা কেউ।
অনেকটা হতাশ ভাবেই বইটা সেলফ থেকে নামাল। বইটা খুলল সে। খুলেই চোখ দু’টি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘তুর্কিস্তান’ নেই বটে কিন্তু একটা চিরকুট। তাতে লেখা, ‘তুর্কিস্তানের বার্ষিক চাঁদা একহাজার রুবল।’
লেখাটা কয়েকবার পড়ল ফারহানা। হারিয়ে যাওয়া কিছু পাওয়ার মত আনন্দে মুখটা তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেখল। হ্যাঁ টাকা আছে। সে এক হাজার রুবলের একটা নোট বইয়ের ঐ পাতাতেই রেখে দিল। বইটা যথাস্থানে রেখে চলে এল ফারহানা। খুশিমনে অনেকক্ষণ ধরে পড়ল, নোট করল ফারহানা। ফারহানা উঠতে যাবে এমন সময় তার সহপাঠি ইউরি অরলভ ধীরে ধীরে এল। বলল, তোমার পাশে কি বসতে পারি?
-হাঁ। সম্মতি দিল ফারহানা। যদিও মনে মনে বিরক্ত হল ভীষণ। ওর শরীর থেকে মদের গন্ধ আসছিল। অরলভ বসল। বসে চেয়ারটায় একটু হেলান দিয়ে বলল, আচ্ছা কম্যুনিটি হলে তোমাকে আজ-কাল দেখছিনা কেন?
-আমি কোন সময়ই তো নাচের আসরে যাইনি অরলভ।
-ঠিক, কিন্তু যাওনা কেন?
-এটা পড়াশুনার সময়, পড়াশুনা করে আমি সময় পাইনা। হো হো করে হাসল অরলভ। বলল, হাসালে খুব। বিনোদনের একটা সময় আছে না! তখন বুঝি কেউ পড়ে?
-বিনোদনের সংজ্ঞা বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন রকম।
-যেমন?
-যেমন আমি পড়ায় আনন্দ পাই, কেউ নাচে আনন্দ পায়।
-বিনোদনের একটা কম্যুনিষ্ট সংজ্ঞা আছে, জানত?
-জানি।
-মানোনা?
-সংজ্ঞাকে তো আইনে পরিণত করা হয়নি।
আবার হাসল ইউরি অরলভ। বলল, হাঁ ফাঁক একটা আছে। একটু থামল অরলভ। তারপর বলল, তোমাদের কি একটা ইথিকস ছিল, এমন নাচ-গান নাকি সেখানে অবৈধ। এ সন্মন্ন্ধে তোমার মত কি?
ভেতরে ভেতরে ঘেমে উঠেছিল ফাতিমা ফারহানা। কম্যুনিষ্ট যুব সংগঠন ‘কমসমল’ এর সদস্য এই ইউরি অরলভ সে জানে। এরা বিশ্ব কম্যুনিষ্ট সংস্থা ‘ফ্র’ -এর এজেন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাহারা দেয়া এবং রিপোর্ট করাই এদের কাজ। বন্ধু সেজে গল্প-গুজবের মাধ্যমে এরা কথা জেনে নেয়, তারপর রিপোর্ট করে। ছাত্ররা এদেরকে পুলিশের চেয়েও বেশী ভয় করে। কারণ, পুলিশকে চেনা যায়, এদের চেনা যায় না।
-ওটাও একটা মূল্যবোধ।
-আমি জানতে চাচ্ছি তোমার মত।
-যা চালু নেই, যাকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনায় সময় নষ্ট না করে জীবিত বিষয় নিয়েই আমাদের আলোচনা করা উচিত।
-ঠিক আছে। বলল অরলভ।
তারপর একটু থেমে আবার বলল, আচ্ছা বলত ফারহানা, তোমাদের দক্ষিণাঞ্চলে নাকি বাতাস গরম?
-বুঝলাম না।
-বলছি, সে অঞ্চলে অসন্তোষ, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ নাকি দ্রুত ছড়াচ্ছে?
মনে মনে ভীষণ চমকে উঠল ফারহানা। এসব প্রশ্ন কেন করা হচ্ছে তাকে, সে জানে। সে উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, এসব খবর কি ঠিক? তুমি পেলে কোথায় এমন সব উদ্বেগজনক কথা?
অরলভ কোন উত্তর দিলনা। প্রসংগ পাল্টিয়ে বলল, সেখানে অসন্তোষের কি কোন কারণ আছে ফারহানা?
ফারহানার জন্য এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। মিথ্যা না বলে কেমন করে এর উত্তর দেয়া যায়? কিন্তু কেমন করে মিথ্যা বলবে সে? দিনের আলোর মত যা সত্য তাকে মিথ্যার আবরণে সে চাপা দেবে কেমন করে? আহমদ মুসার মত জাতিগতপ্রাণ নেতারা হলে এখানে কি করতেন? ওরা তো মিথ্যা বলে নিজেদের রক্ষা করেন না। সে এ পরীক্ষায় কি করবে? মন বলছে, এসময় নিজেকে প্রকাশ করাও তার ঠিক হবে না।
ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করার ভান করছিল ফারহানা। তারপর চেয়ারে একটু গা এলিয়ে বলল, এ ব্যাপারে তোমার চেয়ে বেশী কিছু আমি জানিনা।
এমন উত্তর দিতে পেরে খুশী হলো ফারহানা। মিথ্যা বলতে হয়নি।
-জানা দরকার ফারহানা। নিজেদের অঞ্চল সম্পর্কে জানবেনা?
-আমার পনর আনা সময় আমি লেখাপড়া নিয়ে মস্কোতেই থাকি।
আর কোন কথা বলল না অরলভ। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, দুঃখিত, তোমার পড়ার অনেক ক্ষতি করলাম।
অরলভ চলে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ফারহানা। একটু নড়েচড়ে বসল সে। তারপর হিসেব কষে দেখল ঠিকঠিক রিপোর্ট করার মত কিছু নিয়ে যেতে পেরেছে কি না। হিসেব কষে সে খুশীই হল,কিন্তু উদ্বিগ্ন হল এই ভেবে যে, এমন প্রশ্ন আর কোন সময় এদের তরফ থেকে আসেনি। ওরা কি তাহলে সব মুসলিম ছাত্রকেই আজ সন্দেহ করছে? তাই কি এমন ভাবে বাজিয়ে দেখছে তাদের? হাসিও পেল ফারহানার। এসব প্রশ্ন করে ওরা তাদের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করছে। মুসলিম ছাত্ররা এতে উৎসাহিত হবে বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে ফারহানা একটু মার্কেটিংয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফিরল রুমে। কাপড়-চোপড় ছাড়ার পর অভ্যাস অনুযায়ী দরজার ভেতরের অংশে লেটার বক্স পরীক্ষা করল ফারহানা। ভাঁজ করা বড় একটা কাগজ পেয়ে তাড়াতাড়ি মেলে ধরল। বিস্ময় ভরা চোখে দেখল তার ‘তুর্কিস্তান’। ফুল স্কেপ সাইজের চার পৃষ্ঠার কাগজ।
ভেবে পেল না সে, পত্রিকাটি এখানে এত তাড়াতাড়ি এল কি করে? চাঁদা পরিশোধের পর তিন ঘন্টাও যায়নি। এর মধ্যে চাঁদা পরিশোধের কথা জানল কি করে? তার হলের রুম নাম্বারই বা তাদের দিল কে? সে ভাবল, অত্যন্ত শক্তিশালী নেট ওয়ার্কেই মাধ্যমেই শুধু এটা সম্ভব।
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল ফারহানা। তারপর দরজাটা ভাল করে বন্ধ করে সে পত্রিকা নিয়ে বসল টেবিলে।
কয়েক দিন পর-
ক্লাসের অবসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে এক কোণায় বসেছিল ফারহানা। একাই এক বেঞ্চে বসে ছিল। সামনে আরও একটা বেঞ্চ। প্রায়ই সে এখানে বসে। অনেকেই থাকে। কিন্তু আজ কেউ গেছে টিভির নতুন সিনেমা দেখতে, কেউ গেছে স্পোর্টস কমপ্লেক্সে ব্যালে প্রতিযোগিতা দেখতে। পিছন থেকে সুমাইয়া, খাদিজায়েভা, তাতিয়ানা এবং রইছা চুপি চুপি ফারহানার দিকে আসছিল।
ফারহানা আসলেই চোখ বুজে বিশ্রাম নিচ্ছিল। একেবারে পিছনে এসে ঘাড়ে একটা চিমটি কেটে রইছা বলল, লক্ষণ তো ভাল নয় ফারহানা?
ফারহানা চমকে পিছন ফিরে তাকিয়ে ওদের দেখতে পেল। ওদের সাথে সাথে হেসে উঠল ফারহানাও। সে সংগে ওদেরকে একসাথে দেখে ফারহানার সেদিনকার কথা মনে পড়ল। অস্বস্তির একটা কাল মেঘও তার মনে ঘনীভূত হল। সামনে ফারহানার এক পাশে রইছা ও অন্য পাশে সুমাইয়া বসল। সামনের বেঞ্চিতে বসল খাদিজায়েভা এবং তাহেরভা তাতিয়ানা।
প্রথম কথা বলল রইছা। বলল, কখন মানুষ একা থাকতে ভালোবাসে ফারহানা।
-জানি না। বলল, ফারহানা।
-আমি জানি। বলল রইছা।
-কখন?
-যখন মানুষ প্রেমে পড়ে।
ফারহানার মুখ হঠাৎ লাল হয়ে উঠল। খাদিজায়েভা রইছাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সময় নষ্ট করোনা রইছা। অনেক কথা আছে। তারপর গম্ভীর ভাবে বলল, তুমি কেমন আছ।
-ভাল।
-‘তুর্কিস্তান’ তুমি পাচ্ছ।
চমকে উঠল ফারহানা। চমকে উঠে তাকাল খাদিজায়েভার দিকে। ভয়মিশ্রিত বিমূঢ়তা এসেছে ফারহানার মধ্যে। সেদিনের সে আশংকার কথা তার মনে হল। সরকারের লোক সে মনে করেছিল এদেরকে। তার উপর সেদিন অরলভের জিজ্ঞাসাবাদ। সব মিলিয়ে নিদারুণ একটা উদ্বেগের ভাব ফুটে উঠল ফারহানা চোখে মুখে।
খাদিজায়েভা সেটা বুঝতে পারল। সে হেসে বলল, ‘তুর্কিস্তান’ আমরাও পাই। ভয় করোনা। আমরা সবাই একদল।
এতক্ষণে খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফারহানার মুখ। সে খুশীতে উঠে দাঁড়িয়ে কোলাকুলি করল সবার সাথে। তারপর সে প্রশ্ন করল, সুফিয়া, সভেৎলানা এবং কুলসুম ত্রিফোনোভাও?
-তারাও আমাদের সাথে। শুধু তারা নয়, এখানকার মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের আঙ্গুলে গোনা কিছু ছাড়া সবাই আমরা এক সাথে। বলল খাদিজায়েভা।
ফারহানা হেসে বলল, সেদিন সুমাইয়ার রুমে তোমাদের দেখে আমি তোমাদেরকে কম্যুনিষ্টদের চর মনে করেছিলাম।
-কেন?
-আমার মনে হয়েছিল তোমরা কোন গোপন শলা-পরামর্শ করছিলে, তাছাড়া তোমাদের মুখে একটা নাম শুনেছিলাম আমি। আরেকটা কারণ ছিল, সবাই তোমরা বড় বড় পার্টি ও সরকারী কর্মকর্তার সন্তান।
খাদিজায়েভা প্রশ্ন করল, কোন নাম শুনেছিলে আমাদের মুখে?
-আহমদ মুসা।
সুমাইয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাহেরভা তাতিয়ানা তাকে বাধা দিয়ে ফারহানাকে জিজ্ঞাসা করল, বড় বড় পার্টি ও সরকারী কর্মকর্তাদের সন্তান হওয়ায় আমাদের উপর তোমার সন্দেহ হলো কেন?
-তোমরা সুবিধাভোগীর দল। তোমরা সরকারকে সহযোগিতা করবে এটাই স্বাভাবিক।
তাহলে তুমি আসল অবস্থা জান না ফারহানা, বলল তাহেরভা তাতিয়ানা, তুমি যে সুবিধাভোগীদের কথা বলছ তাদের ছেলেমেয়েরাই সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসছে এ আন্দোলনে। কারণ, কম্যুনিস্ট সরকারের পলিসি প্রোগ্রাম এবং তাদের সব কীর্তিকথা তাদের কাছে পরিষ্কার থাকায় তাদেরকে বোঝানো সহজ হচ্ছে। অবশ্য জীবন দেয়ার মত ঝুকিপুর্ণ কাজে শ্রমিক কৃষক এবং গ্রামাঞ্চলের কর্মীরাই এগিয়ে আসছে বেশী। থামল তাহেরভা তাতিয়ানা।
এবার কথা বলল সুমাইয়া। বলল, তুই আহমদ মুসাকে জানিস ফারহানা?
-জানি! মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল ফারহানার।
প্রায় সমস্বরেই সকলে বলে উঠল, কি জান? কেমন করে জান?
-সে এক কাহিনী।
-কি সে কাহিনী? বলল রাইছা।
সকলের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ঘিরে ধরল ফারহানাকে। ফারহানা ধীরে ধীরে গোটা কাহিনীটা বলল। শুধু বিদায় দেয়ার মুহুর্তের কথা ছাড়া। কাহিনী শেষ হলো, কিন্তু কেউ সহসা কথা বলতে পারলো না। কথা বলল প্রথমে খাদিজায়েভা। বলল, আল্লাহ্ চাইলে এইভাবেই মানুষকে বাঁচান। আমার মনে হচ্ছে ফারহানা, আল্লাহ্ তাকে হাত ধরে এনেছেন এদেশে আমাদের মধ্যে। আল্লাহ্ আমাদের আন্দোলনকে কবুল করেছেন। তা না হলে তাকে এমন এক অকল্পনীয় পথে আমাদের মধ্যে এনে দেবেন কেন?
-অন্য কোথাও, অন্য কোন মানুষের ব্যাপারে হলে এ গল্প আমি বিশ্বাসই করতাম না। সত্য ঘটনার এ এক অপরূপ রূপকথা। বলল সুমাইয়া।
-কিন্তু এ রূপকথার শুধু নায়ক আছে, নায়িকা নেই। বলল রইছা। তার চোখে একটা দুষ্টুমী।
-নায়িকা আছে। সুমাইয়া জবাব দিল।
তারপর একটু মুখ টিপে হেসে ফারহানার হাত দুটি ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল, নেই ফারহানা?
রইছা কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল। তাকে বাধা দিয়ে খাদিজায়েভা বলল, এ সব কথা তোমরা থামাও।
বিব্রত ফারহানা রক্ষা পেল। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকাল সে খাদিজায়েভার দিকে। আহমদ মুসাকে সে এসব আলোচনার অনেক উর্ধে মনে করে। তার মর্যাদা সম্পর্কে সে সচেতন। আর আশা নিরাশায় ক্ষত বিক্ষত ফারহানা তার হৃদয়ের এই স্পর্শকাতর এলাকায় একাই থাকতে চায়, কাউকে নাক গলাতে দিতে চায় না।
খাদিজায়েভা আবার মুখ খুলল। বলল, আসল কথায় আসি ফারহানা। আহমদ মুসা মধ্য এশিয়ার মুসলিম মুক্তি আন্দোলন সাইমুমের নেতৃত্ব গ্রহণের পর তার প্রথম সার্কুলার আমরা পেয়েছি। তাতে তিনি তোমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন, তুমি কেমন আছ, কোথায় আছ। আর মস্কোর সাইমুম ইউনিটের ছাত্রী শাখায় তোমাকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
-তিনি জানতে চেয়েছেন আমার কথা? কথাগুলোর সাথে বন্ধ একটা আবেগ যেন বুক ফেড়ে বেরিয়ে এলো ফারহানার। বলেই কিন্তু লজ্জায় লাল হয়ে গেল সে।
রইছা কথাটা লুফে নিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল, খুশি হয়েছিস ফারহানা?
ফারহানা নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর হলো। বলল, তার মত বিশ্ব বিপ্লবের একজন সিপাহসালারের কথায় তুই খুশী হতিস কিনা?
-অবশ্যই খুশী হতাম। তুই খুশী কিনা?
বিব্রত ফারহানাকে বাঁচিয়ে খাদিজায়েভাই আবার কথা বলে উঠল। বলল, আমাদের সংগঠনের নিয়ম অনুসারে আমরা পরোক্ষ কোন পথে একজনের কাছে ‘তুর্কিস্তান’ পৌছাই। তারপর দেখি সে নিয়মিত তা পড়ছে কিনা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করছে কিনা। অতঃপর তুর্কিস্তান বন্ধ করে দিয়ে আমরা তার আবেগ, আন্তরিকতা, স্বভাব-চরিত্র, ইসলামী অনুশাসনের প্রতি আনুগত্য, ইত্যাদি পরীক্ষা করি। এরপর তার সাধ্য বিচার করে তার কাছ থেকে তুর্কিস্তানের জন্য টাকা চাওয়া হয়। সে যদি এ কোরবানী স্বীকার করে, তাহলে আমরা বুঝতে পারি সে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের পর্যায়ে এসেছে। তুমি এ পর্যায়গুলো পার হয়েছ ফারহানা। তার উপর নেতার তরফ থেকে এই সার্কুলার। আমরা তোমাকে সংগঠনের সদস্য করে নিয়েছি।
ফারহানা ঝুঁকে পড়ে খাদিজায়েভার হাত তুলে নিয়ে চুমু খেয়ে নিরব আনুগত্য জ্ঞাপন করল। খাদিজায়েভা সহ সবাই চুমু খেল ফারহানাকে।
রইছা বলল, আমার খুব ভাল লাগছে ফারহানা। তুই আমাদের নেতাকে দেখেছিস, তার সাথে কথা বলেছিস। ইয়ার্কি নয়, তোর মধ্য দিয়ে তাকে আমাদের খুব নিকটে মনে হচ্ছে। রইছার চোখ দু’টি বোজা, একটা আবেগ তার কথায়।
ফারহানার মুখ নিচু। তাহেরভা তাতিয়ানা বলল, ঠিক বলেছ রইছা। এটা আমাদেরকে কাজে উৎসাহ দেবে। খাদিজায়েভা আবার শুরু করল, সময় হাতে বেশী নেই, সার্কুলারে আরেকটা জরুরী বিষয় আছে। মস্কোভা বন্দী শিবিরে, সরকারীভাবে যার নাম মস্কোভা স্কুল অব রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম, আমাদের দু’জন বোন বন্দী হয়ে এসেছে। তারাও এ মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী ছিল। নাম আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা। দু’জনের বায়োডাটাও সার্কুলারে আছে। এদের কাছে সাধ্যমত সাহায্য পৌছানো এবং মুক্তির ব্যাপারে চেষ্টা করার জন্য এখানকার সাইমুমের সব ইউনিটকেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তাহেরভা তাতিয়ানা বলল, মস্কোভা বন্দী শিবির সম্পর্কে তথ্য যোগাড় করা দরকার এবং এ অঞ্চলটায় একবার আমাদের যাওয়া প্রয়োজন। তারপর আমরা কর্মপন্থা নিয়ে যদি চিন্তা করি তাহলে ভাল হয়।
খাদিজায়েভা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, এস সবাই মিলে আমরা চেষ্টা করি তথ্য যোগাড়ের, আর খুব সত্ত্বর ওদিকে বেড়াবার একটা প্রোগ্রামও আমাদের করতে হয়।
সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। খাদিজায়েভা বলল, ক্লাশের সময় হয়ে গেছে। চল এখনকার মত ওঠা যাক।
সবাই উঠে দাড়াল।
ভলগা নদীর তীরে গোরকিয়াতে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র-ছাত্রী এসেছে বিনোদন সফরে। মস্কো থেকে ১০০ মাইল পূর্বে গোর্কিয়ার মনোরম পরিবেশে মুক্ত বিহঙ্গের মত আনন্দে মেতে উঠেছে ছাত্র-ছাত্রীরা। তারা উঠেছে ভলগা তীরের কম্যুনিটি রেস্ট হাউজে।
এই দলে ফারহানাও আছে। না এসে উপায় থাকেনি তার। সরকারী এই প্রোগ্রামে ‘না’ বলার সাধ্য নেই কোন ছাত্র-ছাত্রীর। তাছাড়া সেদিন বিনোদন নিয়ে ইউরি অরলভের কথা মনে আছে। না আসার পক্ষে কোন ওজর তুলতেও সাহস করেনি।
রেস্ট হাউজে প্রতি দু’জন একটা করে রুম পেয়েছে। কয়েকদিন থাকতে হবে এ বিনোদন সফরে। কেমন সঙ্গিনী পায় এ নিয়ে চিন্তা ছিল ফারহানার। কিন্তু সঙ্গী পেয়ে স্বস্তি পেল সে।
ওলগা তারই ক্লাশের মেয়ে। ওর মধ্যে একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। রুশ মেয়েরা যেমন সারাক্ষণই হৈ চৈ নিয়ে উড়ে বেড়ায়, তেমনটা সে নয়। একেবারেই অন্তর্মুখী, চুপচাপ থাকে। লাইব্রেরিতে ও দেখেছে এক কোণায় বসে লেখাপড়া করে। গতানুগতিক স্রোত থেকে তাকে আলাদাই মনে হয়। ওলগার অন্তর্মুখীতার কারণে তার সাথে অন্তরঙ্গতা হয়নি, কিন্তু সাধারণ আলাপ আছে। ওলগাকে পেয়ে খুশী হয়েছে ফারহানা।
রুম বন্টন ও গ্রুপ ঘোষণা হওয়ার পর ফারহানাকে খুঁজে নিয়ে তাকে স্বাগত জানিয়েছে ওলগা। ফারহানাও ওলগার কপালে চুমু দিয়ে নিজের খুশী প্রকাশ করেছে।
সেদিন বিকেলে গোর্কিয়ায় পৌছার পর ঐ দিনের জন্য আর কোন প্রোগ্রাম রাখা হয়নি। গোটা সময়টাই বিশ্রাম। সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে রুমে চলে এলো ফারহানা ও ওলগা।
রুমের দু’পাশে দু’টি বেড। মাথার দিকে একটা হাফ টেবিল। টেবিলের দু’পাশে দু’টি সোফা চেয়ার। পেছনের দিকে একপাশে বাথরুম, অন্যপাশে একটা ওয়ার্ডরোব। মেঝে কার্পেটে ঢাকা। হিটার ঘরটাকে আরামদায়ক করে রেখেছে। ওলগা বিছানায় গা এলিয়ে বলল, ফারহানা তুমি কি পছন্দ কর, পড়া না গল্প করা?
বিছানায় গা স্পর্শ করেছিল ফারহানারও। ওলগার প্রশ্ন শুনে হেসে উঠে বসে বলল, বিশ্বাস কর ওলগা, এই প্রশ্নটাই আমি তোমাকে করতে যাচ্ছিলাম।
-বেশ তুমিই আগে বল। বলল ওলগা।
-না তুমিই আগে বল। ফারহানা উল্টো চাপ দিল ওলগাকে।
ওলগা হাসল। বলল, প্রশ্নটা আমি আগে করেছি, অতএব
উত্তর জানার অগ্রাধিকার আমিই পাব। হাসল ফারহানাও। ঠিক আছে, বলল ফারহানা, তোমার সাথে গল্প করাই আমি পছন্দ করব।
-আমার কথাও এটাই। শোয়া থেকে উঠে বসে বলল ওলগা।
-বেশ তাহলে গল্প করা যাক।
-কি গল্প করা যায় বল।
একটু চিন্তা করে ফারহানা বলল, যখন ভাল লাগা লাগির কথা উঠেছে, তখন এ নিয়েই আলোচনা হোক। বল, দুনিয়ার কোন জিনিস তোমাকে আনন্দ দেয় বেশি?
শক্ত প্রশ্ন ফারহানা, বলল ওলগা। একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, গাছ আমাকে আনন্দ দেয় সবচেয়ে বেশি।
গাছ! বিস্মিত কন্ঠ ফারহানার। বলল, এমন অদ্ভূত চয়েসের পিছনে তোমার যুক্তি কি ওলগা ?
ওলগা বলল, যুক্তি খুব সোজা। গাছ কারও কোন ক্ষতি করেনা শুধু উপকারই করে। কারো বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র তার নেই, পরার্থেই তার জীবন।
ওলগা থামল। ফারহানা তার দিকে তাকিয়ে ছিল, তাকিয়েই থাকল। ওলগা বলল, কি দেখছ ফারহানা?
-তোমাকেই দেখছি, আচ্ছা ওলগা, মানুষ সম্পর্কে কি তুমি হতাশ ?
-হতাশ কিনা জানি না, তবে মানুষ আজ গাছ-পালা, পশু-পাখির অনেক নীচে। বিস্মিত ফারহানা ওলগার দিকে তাকিয়েই আছে। ধীরে ধীরে বলল এই অবস্থা কি স্বাভাবিক ওলগা ?
-আমি জানিনা। বলল ওলগা।
-কারন জান কিছু এই অবস্থার ? আবার প্রশ্ন করল ফারহানা।
-উঁহু, আমি আর কোন উত্তর দেবনা, প্রশ্নতো আমারও আছে। কৃত্তিম গাম্ভীর্য টেনে বলল ওলগা।
-বেশ প্রশ্ন কর।
-আমারও ঐ প্রশ্ন, দুনিয়ার কোন জিনিস তোমাকে আনন্দ দেয় বেশী?
ফারহানা একটু হাসল। একটু ভাবল। তারপর বলল, মানুষ ভূল করে কিন্তু তা স্বীকার করে সেটা থেকে ফিরে আসে, এ বিষয়টিই আমাকে সবচেয়ে বেশী আনন্দ দেয়।
ওলগা একটু চোখ বুঝল যেন। তারপর ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলল, এর মধ্যে বড় কথা কি আছে ফারহানা?
-মানুষ্যত্বের স্বভাবমুখী বিকাশের মূল কথাই তো এখানে নিহিত।
-মানুষ্যত্বের স্বভাবমূখী বিকাশ কি ?
-মানুষকে যে প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে তার স্বাভাবিক বিকাশ।
-একটু বুঝিয়ে বল ফারহানা।
-দেখ মানুষকে একটা নির্দিষ্ট পরিসরে স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি এবং সৃষ্টিশীল ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। কিন্তু সীমিত ক্ষমতাকে সে সার্বভৌম ক্ষমতা ভেবে বাড়াবাড়ি করে, সীমালংঘন করে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, ইত্যাদির জন্ম দেয়। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অধিকারী যেহেতু তাই এ ভূল ও তার একটা নেতিবাচক প্রকৃতি, যা তার জন্য ধ্বংসকর। মানুষ যখন তার এ ভূল স্বীকার করে সত্য অর্থাৎ তার স্বভাবিক অধিকারের মধ্যে ফিরে আসে, তখন মানবতা ধ্বংসকর অবস্থা থেকে রক্ষা পায়। জুলুম, শোষণ এবং দ্বন্দ্ব সংঘাত ও হিংসা বিদ্বেষের থেকে বেঁচে যায় মানুষের সমাজ। তাই বলেছিলাম, মানুষ ভূল স্বীকার করে ফিরে আসাটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়।
ওলগা কোন কথা বলল না। ভাবছিল সে। ধীরে ধীরে এক সময় সে বলল, তোমার কথা কিছু কিছু আমি বুঝেছি। কিন্তু একটা বুঝতে পারছিনা তুমি বলছ মানুষ স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়।
-নয়তো বটেই। দেখোনা চন্দ্র, সূর্য থেকে শুরু করে সৃষ্টির সব কিছুর কেউই স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নয়, একটা নির্দিষ্ট অর্পিত ক্ষমতার অধিকারী মাত্র। এই সৃষ্টিরই একটি মানুষ স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হবে কেমন করে?
-বুঝেছি তোমার কথা ফারহানা। তুমি বলতে চাচ্ছ, চন্দ্র,সূর্য, তারকা যদি তাকে দেয়া অধিকারের সীমা লংঘন করে কক্ষপথ ছেড়ে ইচ্ছামত বিচরণ শুরু করে তাহলে যেমন আকাশ প্রকৃতিতে বিপর্যয় ঘটবে তেমনি মানুষকে দেওয়া তার ‘অর্পিত ক্ষমতার’ সীমা লংঘন মানব সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, কথাটা এই তো?
-ঠিক বুঝেছ ওলগা। আমি আরও বলতে চাই, এই বিপর্যয় সৃষ্টি যদি মানুষ না করে তাহলে মানুষ সম্পর্কে তোমার হতাশ হবার প্রয়োজন নেই। তবে তুমি ঠিক বলেছ, মানুষ যদি তার অধিকারের সীমা ডিঙিয়ে যায়, ভূলের সমূদ্রে যদি ভেসেই চলে, তাহলে সে গাছ-পালা, পশু-পাখীর চেয়েও নীচে নেমে যায়। কারণ ওগুলো তাদের দেয়া অধিকারের তিল পরিমাণও লংঘন করে না। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বলেছে, ‘আহসনে তাকরীম’ -অর্থাৎ সর্বোত্তম রূপ প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, কিন্তু আবার সে তার কর্মের জন্য ‘আসফালা সাফেলীন’ অর্থাৎ নিকৃষ্টতম পর্যায়ে নেমে যেতে পারে। ওলগা ‘আসফালা সাফেলীন’ ধরনের মানুষেরাই তোমার হতাশার কারণ।
ওলগা কিছুক্ষন চুপ থাকল। তারপর বলল, তোমার সব কথাই বুঝলাম কিন্তু সৃষ্টির হাতে অর্পিত ক্ষমতার যিনি উৎস সেই ‘সর্বময় ক্ষমতাধর অর্পণকারী’ কে?
ফারহানা ওলগার দিকে তাকিয়ে বলল, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ওটা। এর উত্তর আমি এখন দিতে পারবনা। এস দু’জনেই সন্ধান করি। আজ আর নয়।
বলে ফারহানা বিছানায় গা এলিয়ে দিল।
ওলগা কোন আপত্তি করলনা। কি যেন ভাবছে সে। সেও গা এলিয়ে দিল বিছানায়।
পরদিন ভোর।
বাইরে পূর্ব দিগন্তে সোবহে সাদেকের স্পষ্ট রেখা ফুটে উঠলেও তখনও বেশ অন্ধকার। ওলগা জেগে উঠেছিল। চোখ মেলে তাকাল সে। ঘরে তখন জমাট অন্ধকার। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, না রাত নেই, ভোর হয়ে গেছে।
ফারহানার বিছানার দিকে তাকিয়ে ভাবছিল তাকে ডাকবে কিনা। হটাৎ সে দেখল মেঝেতে অন্ধকারের মধ্যে একটা জমাট অন্ধকার নড়ছে। সে তাকিয়ে থাকল। দেখল, অন্ধকারটি উঠছে, বসছে। গত রাতের কথা তার মনে পড়ল। দু’জনে শোবার অনেক পরে ফারহানা ওঠে। সে বাথরুমে যায়। কোন শব্দ হয়না। মনে হয় কাউকে সে জানতে দিতে চায় না।তারপর বাথরুম থেকে এসে সে মেঝেতে দাঁড়ায়। এই ভাবেই ওঠাবসা করে, প্রথমে ওলগা বিস্মিত হয়, ওর এই সন্তর্পন ভাব গতিতে কিছুটা ভয়ও পায়। পরে বুঝতে পারে ফারহানা ব্যায়াম করছে কিংবা প্রার্থনা করছে। রাতে শেষটা না দেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। ওলগা দেখল, ফারহানা বসেছে আর উঠছেনা। স্থির বসেই আছে। ওর কাজ শেষ হয়েছে কি?
ওলগা তার বাম হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ টিপে দিল।উজ্জ্বল আলোয় ভোরে গেল ঘর।
ফারহানা দু’টি হাত তুলে প্রার্থনারত। সামনে থেকে আলো গিয়ে আছড়ে পড়েছে তার মুখে। সে আলোয় চক চক করে উঠল তার চোখের অশ্রু। চোখ দু’টি তার বোজা।
কাঁদছে ফারহানা? বিস্মিত হলো ওলগা! ফারহানা আস্তিক? সে প্রার্থনা করে? গতকালের আলোচনায় অবশ্য বুঝা গিয়েছিল সে ঈশ্বর মানে কিন্তু এতটা মানে সে?
ফারহানা মুনাজাত শেষ করল। হাসি মুখে উঠে দাড়াল। তারপর ওলগার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?
ওলগা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ফারহানার দিকে। ফারহানা তার বিছানায় গিয়ে বসল। ওলগা ফারহানার দিকে তাকানো অবস্থায় ধীর কন্ঠে বলল তুমি প্রার্থনা কর বুঝি?
-হ্যাঁ।
-রাতেও বোধ হয় প্রার্থনা করেছিলে?
-হ্যাঁ, দেখছ তুমি ?
-ক’বার প্রার্থনা দিনে?
-পাঁচবার প্রার্থনা করতে হয়।
-এটাই কি বিধান ?
-হ্যাঁ
-ধর্ম বিশ্বাস এবং প্রার্থনা একটা ডিসকোয়ালিফিকেশন। তোমার ভয় করেনা ?
-করে, তাইতো গোপনে প্রার্থনা করি।
-এই তো আমি দেখে ফেললাম। আমি যদি রিপোর্ট করি?
-আমি আমার প্রার্থনা গোপন রাখতেই চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি।
-এখন রিপোর্ট করলে কি হবে জান?
-জানি।
-এর পরও এমন ঝুঁকি নিয়ে প্রার্থনা না করলেই কি নয়?
-একমাত্র মৃত্যু এবং বেহুঁশ হয়ে পড়া ছাড়া পাঁচবার প্রার্থনা ছাড়া যাবেনা। আর এই কাজে জাগতিক কোন শক্তিকে ভয় না করতে বলা হয়েছে।
-তোমাদের মধ্যে সবাই কি এটা মানে?
-না।
-কেন?
-গতকাল আমি বলেছি না ভুল বিচ্যুতি মানুষের আছে।
কম্যুনিষ্ট শাসনাধীনে আমাদের অধিকাংশ এরই শিকার।
ওলগা চুপ। যেন অন্যমনস্ক সে। ভাবছে কিছু।
ফারহানা ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। জানালর ভারী পর্দাটা গুটাতেই ভোরের স্বচ্ছ আলো এসে প্রবেশ করলে ঘরে।
বিছানায় ফিরে এসে ফারহানা ওলগার দিকে চেয়ে বলল, কি ভাবছ ওলগা?
-ভাবছি তোমাদের স্রষ্টার কথা। তুমি যদিও কাল আমার শেষ প্রশ্নের উত্তর দাওনি, তবু আমার কাছে পরিষ্কার। স্রষ্টাকেই তুমি সৃষ্টির হাতে অর্পিত সকল ক্ষমতার উৎস মনে কর, তিনিই সর্ব্ময় শক্তির অধিকারী; মানুষ নয়। তিনিই একমাত্র সাবভৌম ক্ষমতার মালিক। বল, আমি ঠিক বলেছি কিনা?
-হ্যাঁ ফারহানা বলল।
ওলগা উঠে এল বিছানা থেকে ফারহানার পাশে। তার মুখটা গম্ভীর চোখে যেন বেদনার একটা নীল ছায়া। সে ফারহানার চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি কি আমাকে এটা বিশ্বাস করতে বল ?
-হ্যাঁ বলি। বলল ফারহানা।
-বল তাহলে, আমার মা আজ পাঁচ বছর ধরে বন্দী শিবিরে কেন? কথার সাথে সাথে ওলগার দু’গন্ড বেয়ে ঝরে পড়ল অশ্রুর দু’টি ধারা। ফারহানা ওলগার একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, এ কি বলছ তুমি ওলগা ?
-ঠিকই বলছি, আমার মা লমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডঃ নাতালোভা আজ পাঁচ বছর ধরে মস্কোভা বন্দী শিবিরে। তার অপরাধ ছিল, তিনি ধর্ম বিশ্বাসকে মানব প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য বলেছিলেন, তিনি ধর্ম বিশ্বাসকে মানব প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য বলেছিলেন, তিনি ধর্ম বিশ্বাসে ফিরে এসেছিলেন।
চাদরে মুখ গুজে কাঁদছিল ওলগা। অনেক দিনের অবরুদ্ধ কান্না যেন প্রকাশের পথ পেয়েছে। স্তম্ভিত ফারহানা কিছুক্ষন কথা বলতে পারলনা। এই ওলগা কি সেই ওলগা। এত বড় জমাট বেদনা নিয়ে সে ঘুরে বেড়ায়। এই জন্যই কি সে এত নিরব, এত অন্তর্মুখী।
ফারহানা ওলগাকে টেনে নিল কাছে। সান্তনা দিল অনেক। ওলগা কিছুটা শান্ত হলে ফারহানা বলল, বোন ওলগা, তুমি যে প্রশ্ন করেছ তা খুবই পুরাতন প্রশ্ন। জুলুম, অত্যাচার, অবিচার আর প্রতিকারহীন অবস্থায় মানুষ যখন অতিষ্ঠ হয়, তখন স্রষ্টা সম্পর্কে এ প্রশ্নই মানুষ বার বার করে। আমি আগেই বলেছি, ওলগা , এসব জুলুম, অবিচারের কারণ স্রষ্টার দেয়া বিধান বা অধিকার থেকে মানুষের সরে আসা। তোমার প্রশ্ন, এখানে স্রষ্টা কি করেন? কিছু করেন না কেন? স্রষ্টা অবশ্যই করেন।দেখ তুমি পৃথিবীর জালেম, অত্যাচারীদের ইতিহাস পড়ে। তাদের কি করুণ পরিণতি হয়েছে। তবে স্রষ্টা সবাইকে একটা সীমা পর্য্ন্ত সুযোগ দেন। হয়তো বলবে, যারা অত্যাচারিত হয় তাদের কি লাভ হয় এতে। লাভ ক্ষতির হিসেব যদি এ দুনিয়াতেই শেষ হয়ে যেত, তাহলে একথা ঠিক হতো। কিন্তু তা নয় ওলগা, দুনিয়ার জীবনটা স্বপ্নের মতোই সংক্ষিপ্ত, সুতরাং এখানকার দুঃখ প্রকৃতই দুঃখ নয় এবং সুখও প্রকৃত সুখ নয়, পরজগতের চিরন্তন যে জীবন সেখানকার সুখই প্রকৃত সুখ এবং সেখানকার দুঃখই প্রকৃত দুঃখ।
ক্ষণস্থায়ী দুঃখের বিনিময়ে স্রষ্টা যদি চিরন্তন সুখ দান করেন, তাহলে সেটা স্রষ্টার অবিচার নয়, করুণাই তোমাকে বলতে হবে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে ওলগা, যারা জালেম তারা স্রষ্টার দেয়া সীমা বা অধিকার লংঘনের জন্য শাস্তি এখানে পাচ্ছে এবং পরকালেতো পাচ্ছেই। আর যারা জালেমের অত্যাচারে অধিকার হারাল, তাদের দুঃখের সীমা এখানকার সংক্ষিপ্ত জীবন পর্য্ন্তই। তুমি আমি জীবনটাকে এমন সামগ্রিক ভাবে দেখিনা বলেই সাময়িক দুঃখে হতাশ হই, ভেংগে পড়ি।
-তাহলে এই জীবনের দুঃখ-কষ্ট, জুলুম-অত্যাচারকে যে শিরোধার্য করে নিতে হয়। শুকনো কন্ঠে বলল ওলগা।
-কখনও না, যারা আল্লাহর দেয়া সীমা লংঘন করে, তাদেরকে সীমার মধ্যে রেখে সমাজকে , মানুষকে জুলুম, অত্যাচার থেকে রক্ষা করা স্রষ্টার তরফ থেকে মানুষের উপর অর্পিত একটা দায়িত্ব। এ স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন না করাও মানুষের দুঃখ কষ্টের একটা বড় কারণ। জুলুম যেমন একটা বিচ্যুতি, জুলুম মাথা পেতে নিয়ে চলাও একটা বিচ্যুতি। এই বিচ্যুতির কারনেই মানব সমাজের তাদের স্বউপার্জিত, দুঃখ-কষ্ট, জুলুম, অত্যাচার জেঁকে বসে।
ওলগা ভালো করে চোখ মুছে ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা বুঝেছি, কিন্তু এ পথ তো বিদ্রোহের।
-স্রষ্টা এ বিদ্রোহ চান। মুসলমানদের কলেমা বিদ্রোহের আপোষহীন এক আহ্বান। এ কলেমা উচ্চারণের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহ ছাড়া সকল কর্তৃত্ব ও শক্তিকে অস্বীকার করে।
ওলগা বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে ছিল ফারহানার দিকে। বলল, তোমার কথা খুবই ভালো লাগছে ফারহানা। আমার অনেক প্রশ্নও জিজ্ঞাসার আজ তুমি সমাধান করে দিয়েছ। কিন্তু চার-পাশের বাস্তবতা আমি ভুলতে পারছি না ফারহানা। আমার মা সোভিয়েত বিজ্ঞান একোডেমীর সদস্যা ছিলেন। লেনিন পুরষ্কারও তিনি লাভ করেছেন। তাঁর বন্ধু বান্ধব ও ভক্তের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু মা আজ পাঁচ বছর ধরে বন্দী শিবিরে। তাঁর পক্ষে একটি কথাও কেউ বলেনি। কারো কাছে সামান্য সহানুভুতিও আমি পাই নি।
আবার চোখ দু’টি ছল ছল করে উঠল ওলগার। ফারহানা তার কাঁধে হাত রেখে বলল, কমিউনিষ্ট ব্যবস্থা মানুষের সকল স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে, সেই জন্যই এই অবস্থা। কিন্তু ওলগা, মানুষের বিবেকের এবং তাদের স্বাধীনতার চারদিক ঘিরে তারা যে বাঁধ দিয়ে রেখেছে, তা আর বেশীদিন টিকবেনা মনে রেখ।
-কেমন করে বলছ এ কথা ? ফিস ফিসে কন্ঠ তার।
-কান পেতে শোন, চোখ মেলে চারদিকে দেখ, তুমিও বলবে একথা।
কোন কথা বলল না ওলগা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফারহানা উঠল। বলল, ওলগা, তৈরী হও। ১৫মিনিটের মধ্যে আমাদের হল রুমে উপস্থিত হতে হবে। আজকের প্রোগ্রাম ব্রিফিং হবে সেখানে।
কয়েক দিন পর। পরদিনই ফিরতে হবে মস্কোতে। তখন বিকেল। ভল্লার তীরে যার যেমন ইচ্ছা প্রোগ্রাম চলছে। কেউ হাঁটছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ জোড়া বেঁধে গল্প করছে।
এই কোলাহল থেকে একটু দুরে ভলগার তীরে ওলগা এবং ফারহানা বসে। দু’জনে চেয়ে বহমান ভল্লার নীল পানির দিকে। একদম শান্ত নদী। একটা ছোট পখি এসে চকিতে এক ছোঁয়ে ঠোঁটটা পানিতে ডুবিয়ে আবার উড়ে গেল। নীল পালকে হলুদের ছোপ দেয়া তার। ফারহানা চিনেনা পাখিটাকে। ওলগাও নাম বলতে পারলোনা। ওটা নাকি সাইবেরিয়ার পাখি। এই সিজনে এদিকে আসে।
গোঁ গোঁ একটা শব্দে ওরা বামদিকে ফিরে তাকাল। দেখল একটা স্পীড বোট আসছে। সামনে এসে গেল বোটটা। শান্ত নদীর বুক চিরে এগিয়ে এল। ঢেউ এর মিছিল ছড়িয়ে পড়ছে বোটের দু’পারে। নদীর শান্ত জীবনে যেন একটা ঝড়।
বোটটা সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। দেখেই বুঝা গেল পুলিশ বোট। সামনে বোট ড্রাইভার। পেছনে ষ্টেনগান ধারী দু’জন পুলিশ। অবশিষ্ট ডজন খানেক লোক কয়েদীর পোশাক পরা। তাদের হাতে পায়ে হালকা শিকল। বোধ হয় সরকারী কোন প্রজেক্ট তারা বিনে পয়সায় শ্রম দিয়ে এল।
ওদিকে তাকিয়ে ওলগা আনমনা হয়ে পড়েছিল। বোট যতদূর দেখা গেল তার চোখ ততদুর অনুসরণ করল। কে জানে, ঐ কয়েদীদের মধ্য দিয়ে ওলগা তার মাকেই দেখছিল কি না।
বোট চোখের আড়ালে চলে গেল। ফিরে এল ওলগার চোখ। মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল সে। তারপর চোখ খুলে বলল, ফারহানা, কয়দিন থেকে তোমাকে একটা কথা বলব বলব মনে করছি।
কি কথা? আগ্রহে মুখ তুলল ফারহানা।
জবাব এলনা ওলগার কাছ থেকে। সে চিন্তা করছিল।
-কি কথা ওলগা?
ওলগা ফারহানার দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, তোমাকে বলতে চাই, তুমি হয়তো ওদের কোন উপকার করতে পার। তোমার জাতির লোক ওরা।
ওলগা থামল। ফারহানা উৎসুক চোখ দু’টি তার দিকে মেলে ধরল। ওলগা চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল। তারপর ফিস ফিস করে বলল, মস্কোভা বন্দী শিবির থেকে দু’জন বোন পালিয়ে এসেছে। মা একটা চিঠি দিয়েছিলেন, ওরা আমার ওখানেই উঠেছে। এখন পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছি। কি করব বুঝতে পারছিনা।
সত্যই বিস্ময়ে ফারহানার চোখ দু’টি কপালে উঠল। বলল, বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে এসেছে?
-হাঁ।
-কি বললে, ওরা আমার জাতির লোক?
-হাঁ, দু’জনেই উজবেক মেয়ে, তোমার মতই মুসলমান।
-কি নাম ওদের ওলগা?
-আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা।
নাম দু’টি শোনার সাথে সাথেই ফারহানার গোটা দেহ বিস্ময় ও আনন্দের একটা ঢেউ খেলে গেল। একটা অভাবিত আবেশ যেন তাকে আচ্ছন্ন করল। কান দু’টিকে বিশ্বাস হতে চাইলনা। তারা যে দু’জন বোনের জন্য উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে, তাদেরকে আল্লাহ্ এমন করে তাদের হাতের কাছে এনে দিয়েছে।
বিস্ময় ও আনন্দের উচ্ছাসটা চেপে গেল ফারহানা। ওদের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়টা গোপন থাকাই দরকার। যেন চিন্তা করছে ফারহানা, এমন একটা টানা কণ্ঠে সে বলল, খুশি হলাম ওলগা, ওরা আমার জাতির লোক। ওদের অবস্থা জানিনা, দেখা হলে বুঝতে পারব কি করা যায় ওদের জন্য।
-ফেরার পথেই চলনা আমাদের বাসায়। সাগ্রহে বলল ওলগা।
এমন আমন্ত্রণ আসুক ফারহানা কামনা করছিল। বলল, ঠিক আছে, সেটাই ভাল হবে।
ওলগার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, জান, ওরা আসার পর থেকে আমার বুক কাঁপছে, জেল পালান এবং পলাতককে আশ্রয় দেয়া যে কত বড় অপরাধ তা তুমি জান। কিন্তু মা’র আমানত ওরা আমার কাছে। আমার নিরাপত্তার চেয়ে ওদের নিরাপত্তাকে আমি বড় মনে করি। আমি চাই, ওরা নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে সমর্থ হক।
দিনের আলো তখন ফিকে হয়ে এসেছে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে পশ্চিম আকাশে। কালো ছায়া নামছে ভল্গার বুকে।
রেস্ট হাউজে ফিরে যাওয়ার জন্য সবাই তৈরী হচ্ছে। উঠে দাঁড়াল ওলগা এবং ফারহানাও।
পর্ব ৬
ওলগা এবং ফারহানা রেস্ট হাউজের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল তাদের রুমে যাবার জন্য। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে, এখন যাওয়ার জন্য গোছ গাছ করার পালা। আজ রাতের খাওয়ার আগে সমাপনী আনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। এখন যার ইচ্ছা আজ যেতে পারে, কাল সকালেও যেতে পারে। আজ গেলে তাকে নিজের ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে।
ওরা দোতালায় উঠে গেছে, এমন সময় বেয়ারা গিয়ে ওলগাকে খবর দিল, স্যার তাকে তাঁর অফিসে ডাকছেন। ফারহানা চলে গেল তার রুমে। ওলগা স্যারের সাথে দেখা করার জন্য নীচে নেমে গেল।
ফারহানা গিয়ে তার বিছানায় গা এলিয়ে ওলগার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওলগা এলেই দুজনে মিলে গোছ-গাছে লাগবে। ওলগা পনের মিনিট পরে এল। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। ওলগার মুখ ফ্যাকাশে। চোখ দু’টিতে তার উদ্বেগ ও ভীতি।
ফারহানা তার দিকে চেয়ে বিস্মিত হলো। উদ্বিগ্ন ভাবে উঠে বসল সে। বলল, কিছু হয়েছে ওলগা তোমার?
কিছু উত্তর দিলনা ওলগা। নীরবে এসে তার পাশে বসল। ফিস ফিস করে বলল, গোয়েন্দা পুলিশ এসেছে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য। বোধ হয় আমাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করবে এবং বাড়ি সার্চ করবে।
-কেন? জিজ্ঞাসা করল ফারহানা।
-ব্যাপারটা পরিষ্কার। ঐ ওরা দু’জন আমার মা’র সেকশনে এবং পাশের চেয়ারে বসে কাজ করত। সুতরাং মা’র সাথে তাদের কোন যোগশাজস থাকতে পারে। যদি থাকে আমিও তাহলে তার সাথে যুক্ত আছি। সুতরাং ওদের সন্ধানে আমার এখানে আসা স্বাভাবিক।
আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভার জন্য উদ্বিগ্ন হল ফারহানা। ওলগার বাড়ী সার্চ হলেই তো ওরা ধরা পড়ে যাবে। এখন কি করবে সে। কিন্তু ফারহানা কিছু বলার আগেই আবার কথা বলল ওলগা। বলল, আমার বেশী সময় নেই ফারহানা, তোমাকে একটা দায়িত্ব দিতে চাই।
-কি দায়িত্ব? দ্রুত কণ্ঠে বলল ফারহানা।
-আমি আসার সময় ওদের দু’জনকে আমার খালার বাড়ীতে সরিয়ে রেখে এসেছি। আমার বাড়ী সার্চ করার পর, এরা তাঁর বাড়ীও সার্চ করবে। তারা সেখানে পৌঁছার আগেই তোমাকে গিয়ে ওদের সেখান থেকে সরাতে হবে। পারবে? ফারহানা খুশী হলো। আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাকে নিরাপদে সরিয়ে নেবার পথ একটা আছে জেনে আল্লাহ্র শুকরিয়া আদায় করল। ফারহানা ওলগাকে জরিয়ে ধরে বলল, চিন্তা করোনা বোন, এ দায়িত্ব আমি নিলাম।
খুশীতে ওলগার মুখটি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল সে, আমার মায়ের জন্য আমি কোন দিন কিছু করতে পারব কিনা জানিনা, এদের জন্য কিছু করতে পারলেও আমি শান্তি পাব এই ভেবে যে, মায়ের দেয়া একটা দায়িত্ব পালন করেছি। তার দু’চোখে দু’ফোটা জল টল টল করে উঠল।
ফারহানা ওলগার কাঁধে একটা হাত রেখে সান্তনা দিয়ে বলল, কেঁদোনা বোন, মজলুমদেরই অবশেষে জয় হবে।
-হবে বলছ? আমার মা আবার ফিরে আসবেন?
-নিরাশ হতে আল্লাহ্ নিষেধ করেছেন। সুতরাং আমরা অবশ্যই করব।
-তোমাদের আল্লাহ্ সম্পর্কে আমি জানতে চাই ফারহানা। তোমাদের জীবন্ত ধর্ম বিশ্বাস আমার ভাল লাগে।
-বেশ তুমি জানবে।
ওলগা আর কোন কথা বলল না। তাড়াতাড়ি কাগজে খালার ঠিকানা লিখে ফারহানার হাতে দিয়ে বলল, আমার বাড়ী সার্চ করার সময়টুকু হয়তো তুমি পাবে ওদের সরিয়ে নেবার জন্য।
ফারহানা বলল, আমি সব বুজেছি ওলগা, তুমি চিন্তা করোনা। ওলগা সবে কাপড়-চোপড় গোছ-গাছে হাত দিয়েছে। দরজায় নক হলো। দরজা খুলে দিল ওলগা। দেখল, স্বয়ং স্যার দাঁড়ীয়ে। ওলগা বলল, আসছি স্যার, হয়ে গেছে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল ফারহানা। সেও স্যারকে বলল, স্যার আমিও চলে যাচ্ছি, সব ঠিক করে নিয়েছি।
মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিষয়ক অধ্যাপক নিকোলাই ষ্টেপনাভ বলল যেতে পার, আমরা তো বলেই দিয়েছি।
একটু থামল ষ্টেপনাভ। তারপর ওলগার দিকে তাকিয়ে নীচু কণ্ঠে বলল, ভয় করোনা ওলগা, ভয় করেও কোন লাভ নেই। স্রষ্টাকে ডাক। ওলগা হাতের কাজ থামিয়ে বিস্ময়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনিও ইশ্বরের কথা বলছেন?
অধ্যাপক ষ্টেপনাভ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, তোমার মা’র মত আমরা সাহসী নই, তাই উচ্চ কণ্ঠে বলতে পারিনা। কিন্তু আমরা কেউ না বললেও ঈশ্বর আছেন এবং থাকবেন।
ওলগা কিছু বলতে যাচ্ছিল। অধ্যাপক ষ্টেপনাভ বাধা দিয়ে বলল, কোন কথা নয়। তৈরী হয়ে নাও। তাড়াহুড়া করছে ওরা। এসে পড়বে হয়তো এখানেই।
ওলগা তৈরী হয়ে স্যারের সাথেই বেরিয়ে গেল। পরে ফারহানাও বেরিয়ে এল। ফারহানা নীচে এসে দেখল, একটা চকচকে গাড়ী, গাড়ী-বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেল। গাড়ী বারান্দার এক পাশে দাঁড়ীয়ে অধ্যাপক ষ্টেপনাভ। ফারহানা বুঝল এই গাড়ীতেই ওলগা গেল। ফারহানাকে দেখে অধ্যাপক ষ্টেপনাভ বলল, কিসে যাবে?
-বিমানে সিট তো মিলবেনা, গাড়ীতেই যাব স্যার।
-একা যাচ্ছ, বিমানেই যাও। এখনই আলাপ হলো সিট একটা আছে।
খুশী হল ফারহানা। ১৫ মিনিট পর বিমান ছাড়বে। সব মিলিয়ে অন্ততঃ আধা ঘন্টা আগে মস্কো পৌছা যাবে। ফারহানা বলল স্যার আপনি একটু টেলিফোনে বলে দিন।
অধ্যাপক স্টেপানাভ বলল, তুমি যাও আমি বলে দিচ্ছি। ফারহানা গাড়ীতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এয়ারপোর্ট চলল। বিমানে সিট পেয়ে গেল ফারহানা। পিছনের দরজার কাছাকাছি একটা সিট পেল সে।
বিমান উড়ল আকাশে। টয়লেটে যাবার সময় ফারহানা কয়েক সারি সামনে দেখতে পেল ওলগাকে। দেখে সে চমকে উঠল। তা হলে সড়ক পথে তারা যায়নি। অথচ সে মনে করেছিল ওরা গাড়ীতেই যাচ্ছে। ব্যাপারটা চিন্তা করতেই শিউরে উঠল সে। বিমানে সে সিট না পেলে কি অবস্থা দাঁড়াত। তার মিশন নির্ঘাত ফেল। কিছুতেই সে ওদের আগে অলগার খালাম্মার বাড়ীতে পৌঁছাতে পারতো না। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল ফারহানা। আল্লাহ্ যেন বিশেষ করুনায় বিমানে আসার সু্যোগ করে দিয়েছেন।
বিমান মস্কো বিমান বন্দরে এসে ল্যান্ড করল। ফারহানা ওলগাদের পিছু পিছুই নামল বিমান থেকে। বিমান বন্দর থেকে বেরুতেই একটা কার এসে তাদের সামনে দাঁড়াল। ওলগাকে ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে তুলে দিয়ে গোয়েন্দা অফিসার দু’জন পিছনের সিটে বসল। ওরা চলে গেলে ফারহানা ভাল চকচকে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ল। ড্রাইভার একজন মাঝারী বয়সের রাশিয়ান। ফারহানা তাকে বলল, গোর্কি রোড থেকে আমার দু’জন বান্ধবীকে নিয়ে কারকোভভ রোডে যাব।
চলতে চলতে ভাবল ফারহানা, ওলগার খালাম্মা কেমন হবে? আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা তার সাথে আসতে চাইবে কি না? সময় হাতে বেশী নেই। অনুমান সত্য হলে ওলগার বাড়ী সার্চ করার পরপরই তারা ওলগার খালাম্মার বাড়ীতে যাবে। সুতরাং মিনিট পনেরর বেশী সময় নেয়া তার কিছুতেই ঠিক হবে না।
গোর্কি রোডে ওলগার খালাম্মার বাড়ীর ঠিকানা ফারহান আবার মনে মনে আওড়ালো, বই-২১/১১।
তখন রাত সাড়ে ন’টা বাজে। ফারহানা গোর্কি রোডের ২১ নম্বর ব্লকে গিয়ে পৌছাল। গাড়ী বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে ফারহানা উপরে উঠে গেল লিফটে চড়ে। ১১নং ফ্ল্যাট ৪তলায়। ফারহানা ১১নং ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়ে নক করলো। একবার, দু’বার, তিনবার।
-আমি ওলগার কাছ থেকে এসেছি। আপনি কি ওলগার খালাম্মা?
-হ্যাঁ। বলল মহিলাটি।
-জরুরী কথা আছে, ভেতরে আসতে চাই।
-আসুন। বলে স্বাগত জানাল মহিলাটি।
ভেতরে ঢুকেই ফারহানা বলল, আমাকে আয়েশা ও রোকাইয়েভার কাছে নিয়ে চলুন।
ওলগার খালাম্মা আরেকবার ফারহানার দিকে তাকাল। সন্ধানী দৃষ্টি তার।
আমাকে বিশ্বাস করুন, বলে খালাম্মার ঠিকানা লেখা ওলগার হস্তাক্ষর খালাম্মার হাতে দিল। সেদিকে একবার তাকিয়ে খালাম্মা ফারহানাকে নিয়ে তার বেড রুমে গেল। ডেকে আনল আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাকে। তারা আসতেই সালাম দিয়ে বলল ফারহানা, আমি ফাতেমা ফারহানা, আমি মুসলিম তাজিক।
আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা দু’জনেই তাকে জড়িয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে স্বাগত জানাল। ফারহানা খালাম্মার দিকে তাকিয়ে বলল, এই মুহুর্তে ওলগার বাড়ী সার্চ হচ্ছে, সেখান থেকে তারা এখানে আসতে পারে। আমি এদের দু’জনকে নিয়ে যেতে চাই। ওলগার মত এটাই।
সার্চ হওয়ার কথা শুনে খালাম্মার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আতংকের একটা চায়া নামল তার চোখে। সে বলল, ওলগার এটাই মত হলে আমার আপত্তি নেই, কিন্তু তোমার পরিচয় কি মা, কোথায় কি ভাবে এদের নিয়ে যাবে?
ফারহানা বলল, আমি এদের বোন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
ফারহান মাথা নীচু করে খালাম্মার হাতে একটু চুমু খেয়ে বলল, চলি খালাম্মা। আর ওদিকে চেয়ে বলল, চলুন বোনেরা।
আয়েশা আলিয়েভা ফারহানাকে দেখেই তাকে বিশ্বাস করেছে। সে যাবার জন্য ঘুরে দঁড়াবার আগে খালাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওলগাকে আমার ভালোবাসা দিবেন। কোন দিনই আপনাদের কথা ভুলবনা।
লিফট দিয়ে তিঞ্জনেই নেমে এল গাড়ী-বারান্দায়। ড্রাইভার গাড়ী খুলে ধরল। ওরা তিনজনেই পেছনের সিটে উঠছিল। তারা কেউই লক্ষ্য করলনা, আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভার দিকে চোখ পড়তেই ড্রাইভারের ভ্রুটা কেমন কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল।
গাড়ীর দরজা বন্ধ করে ড্রাইভার তার সিটে গিয়ে বসল। ছেড়ে দিল গাড়ী।
পিছনের সিটের মাঝখানে বসেছে আয়েশা আলিয়েভা। সামনের দুই আসনের ফাঁক দিয়ে স্পিডোমিটার, গাড়ীর গিয়ার পরিবর্তন, ষ্টিয়ারিং হুইলে রাখা ড্রাইভারের দুটি হাত সবই দেখতে পাচ্ছে সে।
স্পিডোমিটারের কাঁটা ফিফটিতে। বলা যায় আস্তেই চলছে গাড়ী। এক জায়গায় এসে সামনের গাড়ী গুলো মনে হয় কোন কারনে থেমে গেল। এ গাড়ীটাও দাঁড়িয়ে পড়ল। হর্ন দিচ্ছে বার বার ড্রাইভার। এ গাড়ীর হর্ন শুনে চমকে উঠল আয়েশা আলিয়েভা। একটা নির্দিষ্ট কোডে হর্ন বাজানো হচ্ছে, এ কোড তার কাছে পরিছিত। ‘ফ্র’ এবং কম্যুনিস্ট সরকারের গোয়েন্দারা এই কোডে হর্ন বাজায়। ট্রেনিং-এর সময় সেও এটা শিখেছে।
তা হলে এ গাড়ী কম্যুনিস্ট গোয়েন্দা অথবা ‘ফ্র’ এর। এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার পর শিউরে উঠল আয়েশা আলিয়েভা। সে মাথা কাৎ করে ফারহানার কানে কানে বলল, এ গাড়ী আপনার ভাড়া করা নিশ্চয়?
-হ্যাঁ। বলল ফাতিমা ফারহানা।
-কোথা থেকে ভাড়া করেছেন?
-বিমান বন্দর থেকে।
-এ গাড়ী গোয়েন্দা বিভাগের।
শুনেই ফারহানা উদ্বেগের মধ্যেও একটা সান্তনা খুঁজল, আমাদের পরিচয় ও জানবে কি করে?
আয়েশা আলিয়েভা তার রিভলভার হাতে তুলে নিয়েছে। ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। তার চোখ দু’টোকে ড্রাইভারের সিটের সমান্তরালে নিয়ে গেছে। এখন ড্রাইভারে সব কিছু সে দেখতে পাচ্ছে।
হঠাৎ সে দেখল ড্রাইভার তার পকেট থেকে একটা ছোট অয়্যারলেস সেট বের করে মুখের কাছে ধরল। সে কিছু ইনফরমেশন পাচার করবে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হোল আয়েশা আলিয়েভা। তাহলে আমাদের চিনতে পেরেছে?
চিন্তা করার সাথে সাথে আয়েশা আলিয়েভা পায়ে ভর দিয়ে একটু উঁচু হলো এবং ড্রাইভারের ঘাড়ের বিশেষ স্থান লক্ষ করে সজোরে রিভলবারের বাঁট চালাল সে। এবং সাথে সাথেই সিট টপকে ষ্টিয়ারিং হুইল হাতে নিল। গাড়িটা একটু ঝাঁকুনি খেয়ে একটু বেঁকে গিয়ে আবার ঠিক হয়ে গেল।
ঘাড়ের বাম পাশে কানের নীচে ঠিক মোক্ষম জায়গাতেই আঘাত লেগেছিল। আঘাত লাগার সাথে সাথেই দান পাশে দলে পড়েছিল ড্রাইভার। মাথাটা সিট এবং গাড়ীর দেয়ালের পাশে দুকে গিয়েছিল। দেহের মধ্যে ভাগটা সিটের উপর ছিল। আয়েশা আলিয়েভা সেটা ঠেলে নিচে নামিয়ে দিল। ড্রাইভারের দেহটা বেঁকে সিটের পাশে এমন করে ঠেসে গেছে যে, তার পক্ষে উঠা অসম্ভব।
সিটে ভাল করে বসে গড়ীর স্পীড বাড়ীয়ে দিল সে। পিছনের সিটে বসে ফাতিমা ফারহান এবং রোকাইয়েভা কাজ গুলো দেখছিল। আলিয়েভার হাতে গাড়ীর নিয়ন্ত্রন আসার পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ফাতিমা ফারহানা এবং রোকাইয়েভা।
অন্যদিকে আয়েশা আলিয়েভা ভাবছিল অন্য জিনিস। গোয়েন্দা ড্রাইভার ইতিমধ্যেই কোন অথ্য পাচার করেছে কিনা? গাড়ীতে উঠার পর যত দূর মনে পড়ে গোয়েন্দা সে সুযোগ পায়নি। তার এ চিন্তা ঠিক কি না সে বিষয়ে নিশ্চিৎ হবার জন্য সে রিয়ারভিউ -এর দিকে উদ্ভিগ্ন ভাবে তাকিয়েছিল। সে গাড়ীর স্পীড বাড়ীয়ে, স্লো করে দিয়ে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করল। না, কেউ ফলো করছেনা। তা হলে সে খবর পাচার করতে পারেনি। সবে সে চেষ্টা করতে যাচ্ছিল বলে মনে হয়।
আশ্বস্ত হল আয়েশা আলিয়েভা। ড্রাইভার তার গড়ীর নম্বরটা এবং অবস্থানটা যদি হেড অফিসে দিয়ে দিতে পারত, তাহলে এতক্ষনে ওরা চারদিক থেকে এসে ঘিরে ফেলত। ওদের সে ট্র্যাপ থকে বেরুনো কঠিন হতো। আল্লাহ্ একটা বড় সাহায্য করেছেন।
মুখ ফিরিয়ে ফারহানাকে লক্ষ্য করে আয়েশা আলিয়েভা বলল, যে ঠিকানায় যাচ্ছি সেখানে ড্রাইভার এবং গাড়ী সামাল দেয়ার ব্যবস্থা আছে তো?
আয়েশা আলিয়েভা কি বলতে চায় তা ফাতিমা ফারহানা বুঝল। বলল, আছে, নিশ্চিত থাকুন।
কারকভ সড়ক আলিয়েভা চেনে। এখানে বড় বড় কর্তাদের বাস। অনুসরণ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার জন্য অনেকটা পথ ঘুরে আলিয়েভা জিজ্ঞেস করল, কত নম্বর।
-বি-৭০০। আরেকটু সামনে। বলে দিব আমি। বলল ফারহানা। বি-৭০০ কম্যুনিস্ট পার্টি সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য এবং পলিটব্যুরোর সদস্য কনষ্টাইন করিমভের বাসা। তিনি সরকারী বাড়িতে থাকেন, এখানে থাকে তাঁর বড় ছেলে ফরিদভ। তাঁর বয়স ৫০ এবং মস্কো মহানগরী কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সে। আজ পাঁচ বছর ধরে সে সাইমুমেরও সদস্য। তাঁর স্ত্রী হামিদাও সাইমুমের মহিলা ইউনিটে কাজ করে। মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের মুক্তির চাইতে তাদের বড় কামনা আর কিছুই নাই।
ফরিদভ-এর বাড়ী সাইমুম প্ল্যাটফরম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কারকভ রোডের অপজিটে ষ্ট্যালিন এভিনিউ। ফরিদভের বাড়ীর পেছন দিকের গোপন দরজাটা খুললে ষ্ট্যালিন এভিনিউতে দাঁড়ানো অশতিপর কূটনীতিক ফেদর বেলিকভ এর বাসায় পৌঁছানো যায়। তিনি জাতিতে রাশিয়ান, কিন্তু বিয়ে করেছিলেন তাঁর সহপাঠী এক কাজাখ মেয়েকে। দীর্ঘ কয়েক যুগ তিনি বিভিন্ন আরব দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় থেকেই তিনি একদিকে স্ত্রীর প্রভাব অন্যদিকে ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেন। তারপর তিনি মধ্যপ্রাচ্য থাকতেই সাইমুমের আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি আজ মস্কোর সাইমুম ব্রাঞ্চের প্রধান উপদেষ্টা। তিনি সবকিছুই ছেড়ে দিয়েছেন সাইমুমকে। তাঁর বাড়ীতেই সাইমুম মহিলা ব্রাঞ্চের অফিস। তাঁর একমাত্র নাতনী হাসনা আইরিনা মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মহিলা ইউনিটের সে অফিস সেক্রেটারী। এই মহিলা ইউনিটের অফিসে আসার জন্য ফরিদভ এবং বেলিকভ উভয়ের বাড়ীর পথই ব্যবহার করা হয়।
ফরিদভ এর বিরাট গেট পার হয়ে আলিয়েভার গাড়ী ফরিদভের গাড়ী-বারান্দায় প্রবেশ করল। গাড়ী থামতেই ফারহানা নেমে ভিতরে গেল। কয়েক মিনিট, তারপরই ফরিদভ এবং তাঁর স্ত্রী হামিদা ফারহানার সাথে বেরিয়ে এল। গাড়ীতে চাবি দিয়ে গাড়ী থেকে নামল আয়েশা আলিয়েভা। নামল রোকাইয়েভাও। হামিদা এগিয়ে এসে প্রথমে জড়িয়ে ধরল আয়েশা আলিয়েভাকে, তারপর রোকাইয়েভাকে।
কুশল বিনিময়ের পর আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়ী ও ড্রাইভারের বিষয় বলছেন?
ফরিদভ এগিয়ে এসে বলল, তোমরা ভিতরে যাও মা, আমি জানি গাড়ী এবং ড্রাইভার দু’টোর অস্তিত্বই আমাদের জন্য বিপজ্জনক। আয়েশা আলিয়েভার হাত থেকে চাবি নিয়ে ফরিদভ গিয়ে গাড়ীতে বসল। বেরিয়ে গেল গাড়ী।
হামিদা সবাইকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল। হামিদার বাড়ী পেরিয়ে সেই গোপন দরজা দিয়ে মহিলা সাইমুমের অফিস অর্থাৎ-ফেদর বেলিকভের বাড়ীতে গিয়ে বসল। তাদের সাথে হাসনা আইরিনা এসে যোগ দিল। তাঁর সাথে এল কিছু বিস্কুট ও গরম দুধ।
ফাতিমা ফারহানা সবার হাতে বিস্কুট তুলে দিয়ে দুধের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে নিজে একটা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, আমি গোয়েন্দা বইতে এতদিন যা পড়েছি, তা আজ নিজ চোখে দেখলাম। বোন আয়েশা যেভাবে পেছনের সিট থেকে গিয়ে ড্রাইভারকে কাবু করে সিট দখল করল তা এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। সবচেয়ে বড় কথা ড্রাইভারকে সরকারী গোয়েন্দা বলে চিনতে পারাটা আমার কাছে এখনও এক স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে।
ফারহানার কথা শেষ হতেই রোকাইয়েভা বলল, মস্কোভা বন্দী শিবির থেকে সরকারী গাড়ীতে করে সরকারী প্রসাদে আসার পথে বোন আয়েশা যে ভাবে একাই তিন সশস্ত্র রক্ষীকে কাবু করেন সেটা বোন ফারহানা জানলে আজকের ঘটনাকে কোন ঘটনাই বলতেন না।
রোকাইয়েভা থামতেই সবাই বলে উঠল, কি সেই ঘটনা।
গরম দুধে চুমুক দিতে দিতে গোটা কাহিনী বলল রোকাইয়েভা, তারপর আজকের কাহিনী শোনাল ফারহানা।
সবাই যখন আনন্দ-বিস্ময় নিয়ে আয়েশা আলিয়েভার প্রশংসায় মুখ খুলছে, তখন আলিয়েভা ধীর কণ্ঠে বলল, আপনাদের মত আমিও বিস্ময় বোধ করছি। যা করেছি তাঁর যোগ্যতা আমার নেই, আল্লাহই নিজ হাতে আমাদের সাহায্য করেছেন। সুতরাং প্রশংসা কিছু করতে হলে তারই করতে হবে।
আয়েশা আলিয়েভার কথায় সবাই চুপ করল।
ফারহানা মুখ খুলল প্রথম। বলল আয়েশা আপা ঠিকই বলেছেন। আমাদের প্রতি পদক্ষেপই আমরা এটা দেখেছি। হামিদা বলল, আল্লাহ্ আমাদের কবুল করেছেন, তারই প্রমান এটা।
একটু থেমে আবার হামিদাই বলল, আল্লাহ্র এ সাহায্য পাওয়ার যোগ্যতা যদি আমরা বাড়াতে পারি, তাহলে দেখব বিজয় আমাদের খুবই নিকটে। মধ্য এশিয়ার মানুষের সাথে কম্যুনিস্ট সরকারের মানসিক বিভাজন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এবং তাঁর ফলে একটা দৈহিক ভাঙ্গনও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটা চূড়ান্ত হওয়া একটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
হামিদা খালাম্মা থামল। কিন্তু কেউ আর কোন কথা বলল না। সবারই শূন্য দৃষ্টি সামনে। যেন সন্ধান করছে মুক্তির সেই সোনালী দিগন্ত কতদূর।
মস্কোতে ওয়ার্ড রেড ফোর্সেস- ‘ফ্র’-এর বড় বড় মাথাগুলো কয়েক দিনে ঘেমে উঠেছে। গেল কোথায় মেয়ে দুটি। বিমান বন্দর, বাস ষ্টেশন এবং রেলওয়ে ষ্টেশনগুলোকে বলতে গেলে সিল করে দেয়া হয়েছে, মস্কো থেকে তারা বেরুতেই পারেনা। মস্কোতেই তারা আছে। ড্রাইভার সমেত ট্যাক্সি লাপাত্তা, তারপর মস্কোভা নদী থেকে তাদের উদ্ধার থেকেও যে প্রমান পাওয়া গেছে তাতে এ বিশ্বাস আরও প্রবল হয়ে উঠেছে তারা মস্কোতেই আছে। কিন্তু কোথায় আছে, প্রাণপণ চেষ্টা করেও এর কোন হদিস তারা করতে পারেনি। মস্কোভা বন্দী শিবিরে যারা আছে তাদের সবার আত্মীয় স্বজনের বাড়ী সার্চ করা হয়েছে, কিন্তু কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। মস্কোভা বন্দী শিবিরেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কিন্তু কিছুই বের করা যায়নি। এই ব্যর্থতাকে মস্কোর কম্যুনিস্ট পার্টির মহাশক্তিধর ফার্ষ্ট সেক্রেটারী, যিনি দেশের সব কিছুর ভাগ্য বিধাতা, বিষয়টাকে নিজের প্রেষ্টিজের সাথে যুক্ত করে ফেলেছেন। সরকারী প্রসাদের নিরাপত্তা প্রধানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। মস্কোর নিরাপত্তা প্রধানকে ডেকে ধমকানো হয়েছে। সব মিলিয়ে বিষয়টা নিয়ে উপর তলা এখন আগুন। মস্কোর ঘরে ঘরে সার্চ ছাড়া মস্কোর নিরাপত্তা বিভাগ আর সব কিছুই করেছে।
এ ব্যাপারগুলোর সবই সাইমুমের নজরে আছে। আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাকে বেশীদিন মস্কো রাখা ঠিক হবেনা, এটা চিন্তা করেই মস্কোর সাইমুম শাখা একটা প্লান তৈরি করেছে ওদের মধ্য এশিয়ায় পাঠাবার জন্য।
প্রতি ১৫দিনে একবার একটা বিশেষ ট্রেন মস্কো থেকে তাসখন্দ যায়। বিলাসবহুল এ বিশেষ ট্রেনটি মূলত ভ্রমণকারীদের জন্য, যারা বৈচিত্রময় ল্যান্ডস্কেপ দেখতে ভালবাসে। বিদেশীদের জন্য এ ট্রেনটি একটা বড় আকর্ষণ। যারা সোজা তাসখন্দ যেতে চায় এমন স্বদেশী যাত্রীও এতে ওঠে। এ ট্রেন্টির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো মাঝখানে তেল নেবার জন্য একবার দাঁড়ানো ছাড়া আর থামে না, যাত্রি উঠানামা কোথাও আর করেনা।
নিয়ম হলো, এ ট্রেনে টিকেটের জন্য ফটো সমেত দরখাস্ত করতে হয়। দরখাস্তের পর বিশেষ টিকিট কার্ড ইস্যু করা হয়। সে কার্ডে প্যাসেঞ্জারের ফটো জুড়ে দেয়া থাকে। এই টিকিট কার্ড মূলত একটা আইডেন্টিটি কার্ডই। সাইমুম ঠিক করছিল ট্রেনেই আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভার জন্য নিরাপদ হবে। এর সব চেয়ে ভাল যে দিকটা সাইমুম বিবেচনা করছে সেটা হলো, সামনের তারিখে এ ট্রনের ডাইরেক্টর যিনি তিনি একজন উজবেক। নাম আবু আলী সুলেমানভ। আফগানযুদ্ধে তার দুই ছেলে মারা গেছে। যুদ্ধের শুরুতে যে উজবেক ব্রিগেডকে আফগানিস্তানে পাঠানো হয়, তাতে তার দুই ছেলে শামিল ছিল। সুলেমানভ মনে করে তার ছেলেদের জোর করে যুদ্ধে পাঠিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। লাশ পর্যন্ত সে পায়নি। সেই থেকে সুলাইমানভ কম্যুনিস্ট সরকারের উপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারপরই সাইমুমের সাথে তার যোগাযোগ হয়। মুসলিম মধ্য এশিয়াকে কম্যুনিস্ট অক্টোপাস থেকে মুক্ত করার জন্য সুলেমানভ এখন একনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এই সুলেমানভই আশ্বাস দিয়েছে এই ট্রেন অন্য মাধ্যমের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। ট্রেনে বেশ কিছু রেলওয়ে পুলিশ থাকে। এরাই পথের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু ভয়ংকর কিছু নয়। এরা দুরনিতিবাজ, বেশীর ভাগ সময় ঘুমিয়েই কাটায় এই বিশেষ ট্রেনটির জন্য টিকিট কার্ড ইস্যু করে রেলওয়ে বিভাগ, কিন্তু OK করে নিরাপত্তা বিভাগ।
ঠিক হয়েছে আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাদের জন্য নকল ফটো দিয়ে টিকিট কার্ড তৈরী হবে। নকল ফটোর টিকিট কার্ড যাবে নিরাপত্তা বিভাগে পাশের জন্য। সেখান থেকে পাশ হয়ে আসার পর ফটোর উপরের অংশ পাল্টে ফেলা হবে। এ কাজ রেলওয়ে দফতরে অনেক হয় পয়সার বিনিময়ে। শেষ মূহুর্তে টিকিট কার্ড বদলের ব্যাপারটা সম্ভব হয়না বলে, নতুন কাউকে এ্যাকোমোডেট করার জন্য এটা করা হয়। সেখানকার দায়িত্ব সুলেমানভ নিজেই নিয়েছে। কার্ড হয়ে গেল।
মস্কোর মহিলা ইউনিট, ছাত্রী ইউনিট সকলের কাছে বিদায় নিল আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা। গাড়ীতে করে ফাতিমা ফারহানা খাদিজায়েভা এবং হাসনা আইরিনাই তাদের পৌছে দিল দক্ষিণ মস্কোর রেল ষ্টেশনের সুলাইমানভের অফিস বারান্দায়। পৌছে দিয়ে বিদায় নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়াল আসার জন্য। আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার হাত ধরে এক পাশে টেনে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কিছু বলবে তাঁকে? মুখে তার দুষ্টুমির হাসি।
-কাকে? তার চোখে কিছুটা বিস্ময়।
-তাঁকে।
-কাকে?
-ইস, কাকে আবার নেতাকে।
মুখে এক ঝলক রক্তের ছোপ লাগল যেন ফারহানার। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল তার মুখ। কিন্তু নিজকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, এসব কথায় তার অবমাননা হয়, তিনি অনেক বড়।
আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার হাত দুটি টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, এটা আমার একটা নির্দোষ আবেগ মাত্র। মাফ কর বোন, আল্লাহ নিশ্চয় আমাকে ক্ষমা করবেন।
ফাতিমা ফারহানা আয়েশা আলিয়েভার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, আমরা দূর্বলতার উর্ধ্বে নই। সে জন্য সব সময় আমাদের আল্লাহর সাহায্য চাওয়া উচিত।
-এ দূর্বলতা কি সব সময় অন্যয়? বলল আয়েশা আলিয়েভা।
-মানব মনের এ এক স্বভাব অনুভূতি। শরীয়তের সীমা না ডিঙালে এটা অপরাধ নয় বলে আমি মনে করি।
এ সময় রেলওয়ের ষ্টেশন মাইকে তাসখন্দ ট্যুরিষ্ট এক্সপ্রেসে যাত্রীদের আসন নেয়ার জন্য অনুরোধ করা হল।
আর কথা বলল না কেউ। আয়েশা আলিয়েভা ফারহানার একটা হাত টেনে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, আসি বোন, আবার দেখা হবে খোদা হাফেজ।
ফারহানাকে বিদায় দিয়ে রোকাইয়েভার হাত ধরে দু’জনে এক সাথে প্রবেশ করল সুলাইমানভের অফিসে। লংকোটে ঢাকা তাদের গোটা শরীর। মাথায় পশমের টুপি। তা কপাল এবং দু’গালের একাংশ পর্যন্ত ছাড়া গোটা দেহটাই ঢাকা।
সুলেমানভ তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারা ঘরে ঢুকতেই সে উঠে দাঁড়াল। কাছে এসে মুখ নিম্নমুখী রেখেই বলল, আমরা প্রাইভেট দরজা দিয়ে প্ল্যাটফরমে ঢুকব। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তবু কেউ জিজ্ঞেস করলে নতুন নাম বলবেন। আয়েশা আলিয়েভা হবেন লিলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা হবেন নিনিয়েভা। এই নামেই টিকিট কার্ড হয়েছে। ট্রেনের গোটা সময়ে আপনারা এ নামেই পরিচিত হবেন। কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াল সুলেমানভ। তারপর ‘আসুন’ বলে চলতে শুরু করল।
খুব স্বাভাবিক ভংগিতেই হেঁটে চলছিল। দেখলে মনে হয় তিনজন রেলওয়েরই কেউ হবেন। রেলওয়ে সিকুইরিটি ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই তারা চলছিল। প্রবীন সুলেমানভকে দেখে সবাই রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে। প্ল্যাটফরমে এসে পৌঁছল ওরা। বামদিকে প্ল্যাটফরমের গেটটি দেখতে পেল আয়েশা আলিয়েভা। সেখানে বিরাট লাইন। রেলওয়ে কর্মচারীদের সাথে সিকুইরিটির একদল লোক সবার টিকিট কার্ড পরীক্ষা করছে। কার্ডের ফটোর সাথে মিলিয়ে দেখছে বিশেষ মানুষকে। অনেকের মাথায় টুপি, হ্যাট খুলে মিলিয়ে দেখছে। বিশেষ করে মহিলা যাত্রীদের ক্ষেত্রেই এ কড়াকড়িটা বেশী দেখা যাচ্ছে।
প্ল্যাটফরমে পাশাপাশি চলতে চলতে সুলেমানভ নিম্ন স্বরে বলল, ট্রেনে উঠার পর আপনাদের দায়িত্ব আমি অবশ্যই পালন করব। তবে কোন অসুবিধা না হোক, আমি প্রার্থনা করি।
ট্রেনে দুই সিটের বেশ কিছু রিজার্ভ বার্থ আছে। স্বস্ত্রীক এবং বিলাসী পার্টি বস অথবা বিশেষ বিদেশী কোন রাষ্ট্রীয় মেহমানের জন্য এসব বার্থ রাখা হয়েছে। সুলেমানভ এ ধরনেরই একটি বার্থ যোগাড় করেছে আয়েশা আলিয়েভাদের জন্য। ইঞ্জিনের পরে কয়েকটি লাগেজ ভ্যান। তারপর প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টের প্রথম বার্থ সেটা। সুলেমানভ বার্থটি আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভাকে দেখিয়ে চলে গেল।
বার্থ দেখে দু’জনে খুশী হলো। দীর্ঘ পথ আরামেই যাওয়া যাবে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লে ঝামেলা থেকেও বাঁচা যাবে। বিশেষ করে একপ্রান্তের ঘর হওয়ার কারণে নিরিবিলিই থাকা যাবে। ঠিক ন’টায় ট্রেন ছেড়ে দিল। ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলের মধ্যে এটা অত্যন্ত দ্রুতগামী ট্রেন। ঘন্টায় একশ’ মাইল চলে। মস্কো থেকে তাসখন্দ রেলপথ দু’হাজার মাইল। সময় লাগবে বিশ ঘন্টা। মাঝখানে ট্রেন একবার থামবে। ইউরোপ থেকে এশিয়ার প্রবেশ মুখে ইউরাল পর্বতমালার গোড়ায়। ইউরাল নদীর তীরে। ইউরাল শহরে তেল নেবার জন্য। সেটা সকাল ৭টায়। তারপর একেবারে গিয়ে তাসখন্দে থামবে সন্ধ্যা ৫টার দিকে।
ট্রেন এখন ফুলস্পীডে চলছে। বার্থের দরজা বন্ধ করে দু’জন শুয়ে পড়ল। ভোর পাঁচটায় তাদের ঘুম ভাঙল। উঠে ওজু করে নামাজ পড়ল। ভালই কাটল রাতটা। সামনে একটা দিন বাকী। ট্রেনে কি আর কোন চেকিং হবে? রেল পুলিশকে তেমন ভয় নেই, কিন্তু ‘ফ্র’ -এর লোক কি ট্রেনে নেই? না থাকাটাই অবিশ্বাস্য। আলিয়েভা জানে কম্যুনিষ্ট সরকারের গোয়েন্দা থাকেনা এমন কোন জায়গা নেই। বিশেষ করে পাবলিক প্লেস, গণ-সমাবেশের ক্ষেত্রগুলোতে তারা না থেকেই পারেনা। ট্রেন এমনই একটি জায়গা। এই ট্রেনে বিদেশীরা, গণ্যমান্য পার্টির বসরা থাকেন, অতএব তারা না থেকেই পারেনা।
এসব নানা কথা ভেবে আয়েশা আলিয়েভা রোকাইয়েভাকে বলল, রিভলভার কাছে রেখো, সাবধান থাকতে হবে আমাদের। দিনের আলোতে কারো নজরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা আমাদের আছে।
এ ট্রেনে রুম সার্ভিসের ব্যবস্থা আছে। সুতরাং বাইরে না বেরুলেই চলে। তারা ঠিক করল, খাওয়া-দাওয়া সেরে আরেকবার আচ্ছা করে ঘুমাবে তারা। রোকাইয়েভা বলল, ট্রেনের কোথায় কি আছে, কারা কোথায় রয়েছে, এসব একবার দেখে নিলে হতোনা?
আলিয়েভা খুশী হয়ে বলল, ঠিক আছে রোকাইয়েভা।
ওরা বেরিয়ে গোটা ট্রেনটা একবার দেখে এল। ট্রেনের ডাইরেক্টরের রুমের পাশেই রেলওয়ে পুলিশের রুম। এরপর ট্রেনে একটা ক্যানটিন আছে। এ কয়টি বাদে অন্য সবগুলো প্যাসেঞ্জারদের জন্য ট্রেনে লম্বালম্বী দীর্ঘ করিডোর রুমগুলোর সামনে দিয়ে এসেছে। এ করিডোর দিয়েই একবার ঘুরে এল আয়েশা আলিয়েভা ও রোকাইয়েভা। অধিকাংশ রুমের দরজা বন্ধ। কারো কারো সাথে দেখা হল করিডোরে। পাঁচজন পুলিশকে পুলিশ রুমের সামনেই দেখা গেল।
ঘুরে এসে তারা নাস্তা খেতে বসল। গাড়ির গতি এ সময় কমে এল, এক সময় থেমে গেল গাড়ী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আয়েশা আলিয়েভা সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল সামনেই ব্রিজ–ইউরাল নদীর উপর। নদীটি ইউরাল পর্বতমালা থেকে বেরিয়ে কাস্পিয়ান সাগরে গিয়ে পড়েছে। ইউরালস্ক নগরীর নদী তীরের সামান্য অংশ নজরে আসছে। ঘরবাড়ী ও মানুষের আচার আচরণে এখানে ইউরোপীয় ধাঁচটাই মূখ্য। তবে এখানকার পল্লী জীবনে কাজাখদের অনেক বৈশিষ্ট্যই চোখে পড়ে। বহুদিন আগে আয়েশা আলিয়েভা মস্কো যাবার পথে এই ইউরালস্কে ক’দিন ছিল। গাড়ীর জানালা দিয়ে রোকাইয়েভাও একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল বাইরে, কিন্তু তার দৃষ্টি যেন এখানে নেই, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
রোকাইয়েভার দিকে তাকিয়ে আয়েশা আলিয়েভা বলল, কারও কথা নিশ্চয় মনে পড়ছে রোকাইয়েভা?
-পড়ছে।
-কার কথা?
-দাদীর কথা। আর কেউ নেই আমার। জানিনা কোথায় আছেন তিনি, দেখতে আর পাব কিনা?
-ভেবনা রোকাইয়েভা, সাইমুম আমার এবং তোমার খোঁজ যখন পেয়েছে, তখন তোমার দাদী তাদের নজরের বাইরে নয়।
-ঠিক বলছব। আমার দাদীকে গিয়ে দেখতে পাব?
-আমার ধারণা মিথ্যা না হলে জুবায়েরভ তার ব্যবস্তা করেছে। এতক্ষণে রোকাইয়েভার মুখে হাসি ফুটে উঠল। টিক বলেছ। জুবায়েরভ প্রতিটি বিপদ মুহূর্তে অদৃশ্য থেকেও আমাদের পাশে দাডিয়েছেন।
-দেখেছ তাকে?
-না।
ইচ্ছা হয়নি কখনও?
রোকাইয়েভা আলিয়েভার দিকে চেয়ে একটু ভ্রকুটি করে বলল তোমার প্রশ্নটা সরল নয়। জুবায়েরভ নিশ্চয় সাইমুমের ভালো কর্মী।
আয়েশা আলিয়েভা একটু মুখ টিপে হাসল। কোন জবাব দিল না। কথা বলল রোকাইয়েভাই আবার। বলল দেশে যাচ্ছি, তোমার কারও কথা মনে পড়ছেনা ?
-আমার কেউ নাই।
-কেউ নাই?
-নেই।
বুকে হাত দিয়ে বল, কেউ নেই? কারও কথাই তোমার মনে পডছেনা?
আয়েশা আলিয়েভা কথা বলল না। তার চোখটা উজ্জল, মুখটা কেমন আরক্তিম হয়ে উঠল। বলল, তোমার ইংগিত বুঝেছি রোকাইয়েভা, এমন কতই তো ভাবতে পারি।
-কত নয়, একটাই ভাবতে পার।
-কিন্তু সে ভাবাটা যদি অন্যায় হয়। তার প্রতি অবিচার হয়? গলাটা একটু ভারী আয়েশা আলিয়েভার।
-এ প্রশ্নের জবাব কি তোমার চাই আলিয়েভা?
আমি আর কোন কথা বলব না, বলে রোকাইয়েভার পিঠে একটা ছোট কিল দিয়ে উঠে গিয়ে বাথে শুয়ে পড়ল সে।
গাডী তখন নডে উঠেছে চলতে শুরু করেছে। রোকাইয়েভাও উঠে গিয়ে তার সিটে শুয়ে পড়ল।
ট্রেন চলছে তখন ইউরাল পার্বত্য ভুমির উপর দিয়ে। এ পার্বত্য অঞ্চল পেরুলেই তুরান সমভূমি কাজাখদের এলাকা।
ঘুমিয়ে পড়েছিল আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা দু’জনেই। দরজার ঠক ঠক শব্দে তাদের ঘুম ভাঙল। ঘুম থেকে উঠে দু’জনে দু’জনার মুখের দিকে তাকাল। উভয়েরই চোখে জিজ্ঞাসা, কে হতে পারে? টিকিট চেকার? নাকি পুলিশ? অথবা ডাইরেক্টর সুলেমানভ? আয়েশা আলিয়েভা উঠে দাড়াল। কাপড়-চোপড় ঠিক করে নিয়ে দরজার দিকে গিয়েও আবার ফিরে এল। এসে ওভার কোটটি গায়ে চাপাল সে।
দরজার খুলল আলিয়েভা। দরজার মাঝারী বয়সের সুঠাম স্বাস্থ্যের দু’জন লোক। তারা খোলা দরজা পথে ঘরে ঢুকল। আনুমতির অপেক্ষা করল না। আলিয়েভা তাদের পিছনে পিছনে এল ঘরে। ওরা ঘরের চারদিকে একবার নজর করে ওদের দু’জনের দিকে আরেকবার ভালো করে তাকিয়ে বলল আপনাদের টিকিট কার্ড দেখি।
দু জনে টিকিট কার্ড বের করে ওদের হাতে দিল। কার্ড দু’টির উপর নজর বুলিয়ে আয়েশা আলিয়েভার দিকে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম?
-কার্ডই তো লিখা আছে। বলল আয়েশা আলিয়েভা।
তারপর ঐ লোকটিই রোকাইয়েভার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল আপনার নাম?
-নিনিয়েভা। বলল রোকাইয়েভা।
ওদের দু’জনের চোখে একটা সংশয়-সন্দেহ স্পষ্টই ধরা পড়ল আয়েশা আলিয়েভার কাছে।
ওরা পরিচিতি কার্ড নিয়ে ঘর থেকে বেরুবার জন্য ফিরে দাঁড়াল। তারপর বলল, আপনারা দু’জনে এখনি আসুন আমাদের সাথে। বলে তারা রুম থেকে বেরুল।
আয়েশা ওভারকোট পরেই ছিল রোকাইয়েভাও পরে নিল। তারপর ওদের পিছু পিছু বেরিয়ে এল রুম থেকে। আয়েশা আলিয়েভার দুটো হাত ওভারকোটের দুই পকেটে। পকেটের দু’টো হাত গিয়ে স্পর্শ করেছে সাইলেন্সার লাগানো দু’টো রিভলভারকে। সেই পুলিশ রুমে তারা এল। ওদের সাথে সাথে আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভাও প্রবেশ করল সে ঘরে। পুলিশ পাঁচজন ঘরে বসে ঝিমুচ্ছিল। সেই দু’জন ওদেরকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। বুঝা গেল পুলিশরা অনিচ্ছা সত্বেও উঠে দাঁড়াল এবং এমন করে তাকাল যাতে মনে হল কেউ বসে মজা করবে, কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে সময় গুনবে এতে তাদের ঘোর আপত্তি।
ওরা বেরিয়ে গেল। সাথে সাথে অটোমেটিক দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আয়েশা আলিয়েভা নিশ্চিত হল এরা রেলওয়ের নয় গোয়েন্দা বিভাগের লোক। আর দেখলেই বুঝা যায় লোক দু টি লম্পট চরিত্রের। গোয়েন্দা দু’জন গিয়ে পাশাপাশি চেয়ারে বসল। ধীরে সুস্থে মুখ খুলল একজন, আমরা আপনাদের সাহায্য করতে চাই। কথা বলার ধারাটাই কেমন কুৎসিত ধরনের, আয়েশা আলিয়েভা সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে জিজ্ঞেস করল কি সাহায্য ?
-আপনাদের পরিচয় আমরা জানি। দাঁত বের করে উত্তর দিল সাথের লোকটি।
-কি পরিচয় ? জিজ্ঞেস করল আয়েশা আলিয়েভা।
তাদের একজন তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিয়ে দু’টো ফটো বের করল। বলল এই দেখুন আপনার ছবি। আপনারা মস্কুভা বন্দি শিবির থেকে… কথা শেষ না করেই লোকটা উঠে দাঁড়াল এবং একটা কুৎসিত হাসির সাথে আলিয়েভার দিকে এগিয়ে এল। আয়েশা আলিয়েভা একটু সরে দাঁড়াল। পাশের লোকটাও উঠে দাঁড়িয়েছে। খপ করে একটা হাত ধরে ফেলেছে সে রোকাইয়েভার। রোকাইয়েভা এক ঝটকায় তার হাত খুলে নিয়েছে।
এদিকের লোকটা বলল দেখুন আপনারা আবার সেই জেলে জান তা আমরা চাইনা। যদি….
কথা শেষ না করেই লোকটা আবার এগিয়ে এল আয়েশা আলিয়েভার দিকে। ওদিকের ঐ লোকটি এক পা এক পা করে আগুচ্ছে রোকাইয়েভার দিকে। ওদের চোখে মুখে লাম্পট্যের শয়তানী নাচ।
আয়েশা আলিয়েভার দু হাত তখনও ওভার কোটের পকেটে। বিদ্যুৎ বেগে রিভলভার সমেত তার একটি হাত বেরিয়ে এল। লোকটার বুক বরাবর তাক করে বলল আর এক পা এগুলে…
মুহূর্তের জন্য লোকটির চোখ ছানাবড়া হয়ছিল। কিন্তু তার পর সে দ্রুত হাত দিল পকেটে। কিন্তু তার হাত পকেট থেকে বেরুবার আগেই আয়েশা আলিয়েভার রিভলভার অগ্নি উদগীরন করল। লোকটি ঝরে পড়ল মেঝের উপর।
গুলি করেই আলিয়েভা আপর লোকটির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল লোকটি ঝাঁপিয়ে পড়েছে রোকাইয়েভার ওপর। রোকাইয়েভার হাতেও রিভলভার। আলিয়েভা তার রিভলভারের ট্রিগার চেপে ধরল আরেকবার। সেই সাথে রোকাইয়েভার রিভলভারও অগ্নি উদ্গীরন করল। লোকটা বোটা থেকে খসে পড়া পাকা ফলের মতই ঝরে পড়ল মেঝের উপর। লাফ দেয়া অবস্থাতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
তাড়াতাড়ি রিভলভার পকেটে ফেলে তারা দরজা খুলে বেরিয়ে এল রুম থেকে। সাইলেন্সার থাকায় গুলির কোন শব্দ হয়নি। কিন্তু দরজা খোলার সাথে সাথে বারুদের গন্ধ বেরিয়ে এল।
তাদের তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে দেখে মনে হল পুলিশরা একটু কৌতুক আনুভব করল। দু’জন পুলিশ দরজার দিকে এগিয়ে এল। ঘরের ভেতর চাইতেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। তাদের এ অবস্থা দেখে অন্য তিনজনও এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। বিস্ময়-আতংকে হা হয়ে গেল তাদেরও মুখ।
আয়েশা আলিয়েভা এবং রোকাইয়েভা তাদের পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। তারা আবার রিভলভার হাতে তুলে নিল। আয়েশা আলিয়েভা তার দুহাতে দুটি রিভলভার উঁচিয়ে চাপা স্বরে বলল ঘরে ডুকে যাও, একটু এদিক ওদিক করলে সবার মাথা উড়ে যাবে। দু জন পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর সুড় সুড় করে সবাই ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে ঢুকলে আয়েশা আলিয়েভা দ্রত দরজা বন্ধ করে দিল। দেখল ঘরের চাবিটা দরজাতেই ঝুলছে। দরজায় চাবি লাগিয়ে দিল সে।
মাত্র দু তিন মিনিটের মধ্যে সাংগ হয়ে গেল এসব ঘটনা। পুলিশ রুমটি পেছনের দিকের শেষ রুমে বলে এদিকে মানুষের আনাগোনা কম। আয়েশা আলিয়েভা খুশি হল। কারো চোখেই এ ঘটনা পড়েনি।
পাশেই ডাইরেক্টর সুলেমানভের রুম। তার রুম বন্ধ। আয়েশা আলিয়েভা একবার মনে করল তাকে সব কথা বলে আসে, কিন্তু পরে বল তার কিছু না জানাই ভালো। জওয়াবদিহী করতে সুবিধা হবে তার। রোকাইয়েভা বলল চল তাহলে এখন আমাদের রুমে যাই।
আয়েশা আলিয়েভা মাথা নেড়ে বলল না, আর রুমে নয়। অবশিষ্ট কয়েকঘন্টা এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়েই কাটাতে হবে। শত্রুর শেষ হয়েছে কি না আমরা এখনও জানিনা।
ট্রেন তীব্র গতিতে এগিয়ে চলছে। অরল হৃদকে ডান পাশে রেখে তুরান সমভূমি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। অরল হৃদের পূর্ব পাশে পৌঁছে আর একশ মাইল দক্ষিণ পূর্বে এগুলেই সির দরিয়া পাওয়া যাবে। তারপর সির দরিয়ার তীর ধরেই ট্রেন চলবে প্রায় সাড়ে তিন শত মাইল। তাসখন্দের দেড়শ মাইল উত্তরে পৌঁছে ইসর দরিয়া একটু পশ্চিমে সরে গিয়ে তাসখন্দের মাইল পঞ্চাশেক দক্ষিণ দিয়ে এগিয়ে তাজিকিস্তানে প্রবেশ করবে। আর ট্রেন সোজা এগিয়ে যাবে তাসখন্দে।
বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করল আয়েশা আলিয়েভা। ট্রেনে তাদের উপর আর কোন আক্রমন হবে বলে মনে হয় না। অরল হৃদের অরলঙ্ক শহর তারা পেরিয়ে এসেছে। তাসখন্দের কাছাকাছি অরিস জংশন ছাড়া মাঝখানে কিজিল ওরস নামে একটা ছোট্ট শহর আছে। কিন্তু ট্রেন থেকে ওয়ারলেস না করলে সেখান থেকে বিপদের সম্ভাবনা নেই, কারণ ট্রেন সেখানে থামেনা। আর ওয়ারলেসতো সুলেমানভের কাছে। গোয়েন্দা দুজনের কাছেও হয়তো ওয়ারলেস ছিল, কিন্তু সেগুলো আর কোন কাজে আসছে না। এসব ভেবে খুব খুশী হলো আয়েশা আলিয়েভা।
কিন্তু এরপর কি, তার কিছুই জানে না আলিয়েভারা। শুধু এতটুকু তাদের বলা হয়েছে। ট্রেন সির দরিয়া এলাকায় পৌঁছার পর তাদের সব দায়িত্ব তাসখন্দ সাইমুমের উপর বর্তাবে। তারাই সব ব্যবস্থা করবে। বাইরের বাতাসে যেন সির দরিয়ার স্নিগ্ধ পরশ অনুভব করল আলিয়েভা। ওতে যেন নতুন জীবনের এক আশ্বাস। রোকাইয়েভা বাইরে তাকিয়েছিল। আলিয়েভাও তার দৃষ্টি মেলে ধরল বাইরে। তার চোখ দুটি খুঁজে ফিরছে সির দরিয়ার সবুজ উপত্যকা, তার রুপালী বুক।