০৪. পামিরের আর্তনাদ
পর্বঃ ২
জাম্বুয়াংগো বন্দর থেকে একটা রাস্তা সোজা তীরের মত এগিয়ে গেছে উত্তর দিকে। এই রাস্তা ধরে পাঁচ মাইল যাবার পর একটা উঁচু টিলার কাছে এসে দেখা যাবে রাস্তা পূর্ব দিকে বেঁকে গেছে। রাস্তাটি ছয় মাইল পূর্বে আর্মি হেড কোয়াটার্সে গিয়ে শেষ হয়েছে। আর্মি হেড কোয়াটার্স পাবার আগেই রাস্তার উত্তর পাশে একটা বিশাল বাড়ী। বাড়ীটার সামনে এর পরিচয় সূচক কোন সাইনবোর্ড নেই। বাড়ীর দেয়ালে অনেক উঁচুতে পিতলের প্লেটে খোদাই করা অক্ষরে লেখা আছে, ‘ফিলিপিন আর্মির সম্পত্তি’। বাড়ীর চারদিক ঘিরে উঁচু দেয়াল। সামনে বিরাট ইস্পাতের গেট। গেটের গা ঘেঁষে পূর্ব পাশে গার্ডরুম। গার্ড রুমের একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। চব্বিশ ঘন্টাই এখান থেকে দু’টো সন্ধানী চোখ রাস্তার ওপরে নিবদ্ধ থাকে। একটু লক্ষ্য করলে পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের ফুটো দিয়ে মেশিন গানের তেল চকচকে মাথাও দেখা যাবে। গার্ড রুম থেকে গেট খোলার একটা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা রয়েছে। যারা বাড়ীতে ঢুকতে আসে তারা গেটের সামনে এসে এক নির্দিষ্ট নিয়মে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দাঁড়ায় এবং এক নির্দিষ্ট তালে হর্ণ দিতে থাকে। গার্ড সব দেখে নিঃসন্দেহ হবার পর সুইচ বোর্ডের নীল বোতামটা টিপে ধরে। গেটের ভারি ইস্পাতের পাল্লা নিঃশব্দে পাশের দেয়ালে ঢুকে যায়।
জাম্বুায়াংগোর উত্তপ্ত মধ্যাহ্ন। রাস্তার ওপাশের গীর্জার পেটা ঘড়ি থেকে ১২-টা বাজার ঘন্টা ধ্বনি এইমাত্র শেষ হলো। গার্ড রুমের বেয়ারা টম বেঞ্চিতে বসে সেদিনের দৈনিকটি নিয়ে নাড়া চড়া করছিল। হঠাৎ একটা খবরের ওপর তার চোখটা যেন আঠার মতই আটকে গেল। আটের পাতার শেষ কলমে সিংগল কলমের একটা নিউজ। নিউজের হেডিং ‘দিবাও ও কোটাবাটো থেকে লোক অপসারণ’। দিবাও একটা প্রাদেশিক রাজধানী শহর, আর কোটাবাটো দক্ষিণ মিন্দানাওয়ের সামরিক ও গুরুত্বপূর্ণ শহর। খবরে বলা হয়েছে, বিদ্রোহীরা দিবাও ও কোটাবাটোর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বিনষ্ট এবং শহর দু’টির সামরিক ঘাঁটিতে উপর্যুপরি হামলা চালানোর পর সরকার বেসামরিক সকল শ্বেতাংগ নর নারীকে সেখান থেকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বৃহত্তম নিরাপত্তা ও সামরিক প্রয়োজনেই এটা করা হচ্ছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
খবরটি পড়ে টমের ঠোঁটে একটি সূক্ষ্ম হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল। ঝুলে পড়া গোঁফের আড়ালে থাকায় তা বাইরে থেকে দেখতে পাওয়ার মত নয়। কিন্তু চোখের ঔজ্জ্বল্যকে ভ্রুর অপর্যাপ্ত বেড়াজাল আটকে রাখতে পারলো না। এই আনন্দের ঔজ্বল্যের মধ্যে মনে হয প্রতিহিংসার আগুনও প্রচ্ছন্ন ছিল। এই ‘টম’ তো টম নয়? তার পিতৃদত্ত নাম আবু সালেহ, তার পিতা হাজী আলী ইয়াসিন কোটাবাটোর একটা মাদ্রাসায় পড়াতেন। মাদ্রাসাটি তিনিই গড়েছিলেন, তিনিই সেখানে পড়াতেন। মাদ্রাসার পাশেই ছিল তাদের বাড়ী। সেই ছোটবেলা থেকেই মাদ্রাসায় ছিল তার জন্য অবারিত দ্বার। পিতার হাতেই আবু সালেহের হাতে খড়ি হয়। প্রতিদিন পড়া শেষ হবার পর তার পিতা ছাত্রদের নিয়ে গল্পের আসর বসাতেন। সেই আসরে তিনি কত যে গল্প শোনাতেন! কিভাবে নবী মুহাম্মদ এলেন, কিভাবে তিনি মানুষকে সকল অন্যায়-অবিচার যুলুম ও অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করলেন, কিভাবে কাদের দ্বারা ইসলাম গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল, কিভাবে কোন ভূলে শাসকের জাতি মুসলমানরা শাসিতের জাতিতে পরিণত হলো, তারপর কিভাবে পতনের অন্ধকার থেকে উঠবার প্রচেষ্ঠা শুরু হলো, ইমাম ইবনে তাইমিয়া, জামালুদ্দিন আফগানী, মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওহাব, শাহ ওয়ালীউল্লাহ প্রমূখ কিভাবে কেমন কষ্টের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের মাঝে জাগরণের দীপ জ্বালালেন, ইত্যাকার কত গল্প তিনি করতেন। গল্প শুনতে শুনতে স্বপ্নের জগতে চলে যেত সবাই। ভাবত তারা, শীঘ্রই তারা আবার দুনিয়ায় সবার থেকে বড় হবে, সবাই তাদের হুকুম মেনে চলবে। কিন্তু হঠাৎ একদিন এই স্বপ্নের নীড়, শান্তির নীড় ভেঙে গেল। আবু সালেহের এখনও সব কথাই স্পষ্ট মনে আছে। পঁচিশ বছর আগের ঘটনা, তার বয়স দশ। সমুদ্র পথে আসা খৃস্টান শ্বেতাংগদের সশস্ত্র সন্ত্রাস চলছিল তখন চারদিকে। বন্দুকের জোরে বন্দর এলাকায় তারা একটা কলোনীও গড়ে তুলেছিল।
একদিন শুক্রবার। জুমার আযান হয়ে গেছে। আবু সালেহের পিতা হাজী ইয়াসিন মসজিদে ঢুকছেন। তিনিই মসজিদের ইমাম। এমন সময় দুটো গাড়ী এসে দাঁড়াল। গাড়ী থেকে যারা নামলো সবাই সশস্ত্র। তারা এসে হাজী ইয়াসিনকে গাড়ীতে উঠতে নির্দেশ দিল। কিন্তু তিনি নামায শেষ না করে যেতে চাইলেন না। জোর করে তাঁকে গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে গেল ওরা। সেই যে হাজী ইয়াসিন গেলেন আর ফিরে এলেন না। সেদিনই রাতে মসজিদ-মাদ্রাসা সমেত আবু সালেহদের বাড়ি ঘর সব পুড়ে গেল। লুন্ঠিত হলো তাদের সব কিছু। তার বড় বোন আকলিমাকেও ওরা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। সব হারিয়ে পথে বসল আবু সালেহরা। সেদিন ভোরেই তারা কোটাবাটো শহর ছেড়ে জংগলে পালিয়ে গেল। রোগে-শোকে মাস তিনেক পরে আবু সালেহ’র মা মারা গেলেন। আবু সালেহ এখন নির্বান্ধব- বন্ধনহীন। মাকে কবরে শায়িত করে আবু সালেহ যখন পেছনে ফিরে দাঁড়াল তখন গোটা জগতটাই তার ফাঁকা মনে হলো। চোখ ফেটে দু’গন্ড বেয়ে নেমে এল অশ্রু। হঠাৎ তার মনে পড়ল তার আব্বার কথা, আকলিমার কথা। দু’হাতে বুক চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। আমি ওদের খুঁজে বের করব। তারপর সে একবার পেছনে ফিরে মায়ের কবর, আর পাশেই বাড়ি নামক পাতার ঝুপড়ির দিকে শেষ বারের মত এক নজর চেয়ে পথ ধরল কোটাবাটোর দিকে।
কোটাবাটো শহরের পথঘাট, অলিতে-গলিতে সে ঘুরে বেড়াল দিনের পর দিন। না, কোথাও তার আব্বা নেই, বোন আকলিমা নেই। সে কতদিন কত বাড়ির পেছনে, সামনের দরজায় সজল চোখে দাঁড়িয়ে থেকেছে আব্বার ডাক, বোনের গলা শোনার জন্য। চোখের পানি তার শুকিয়ে যেত, চোখ তার ক্লান্ত হয়ে পড়তো। কিন্তু তার হৃদয়ের ব্যাকুলতার ইতি ঘটত না। বন্দরের ফুটপাতে শায়িত ক্ষুধাপীড়িত জ্বরে কাতর আবু সালেহকে অজ্ঞান অবস্থায় একজন খৃস্টান ব্যবসায়ী তুলে নিয়ে গেল। সেই থেকে সে শ্বেতাংগ খৃস্টানের সার্ভেন্ট কোয়াটার্সে তার আশ্রয় হলো। নাম হলো টম। শ্বেতাংগ ব্যবসায়ী দেশে চলে যাবার সময় গার্ড রুমের এই চাকুরী জুটিয়ে দিয়ে গেছে। সে প্রায় আজ পাঁচ বছরের কথা। শুধূ জাম্বুায়াংগো নয়, গোটা মিন্দানাওয়ের শ্বেত শাসনের নার্ভ সেন্টার এই সমরিক গোয়েন্দা ভবনের একজন অতি বিশ্বস্ত কর্মচারী টম। টমের চোখে তার বড় বোন আকলিমা এবং তার আব্বার স্মৃতি আজ অনেক ব্যাপক, অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা মিন্দানাও ও সোলো দ্বীপপুঞ্জই আজ তার পিতা ও আকলিমার রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই ভুখন্ডের দুর্ভাগা মুসলমানদের মুক্তিই তার জীবনের একমাত্র ব্রত। এই মুক্তির লক্ষ্যে টম প্রায় বছর কয়েক আগে ‘পিসিডা’য় যোগ দিয়েছে। সে উত্তর জাম্বুয়াংগোর পিসিডা ইউনিটের একজন সক্রিয় সদস্য।
‘দিবাও’ ও ‘কোটাবাটো’ থেকে সন্ত্রাসবাদী খৃস্টান বাহিনীর পিছু হটার খবর পড়ে আবু সালেহের মুখে হাসি ফুটে উঠল। খুশী মনে হিসেব করল, উত্তর মিন্দানাও থেকে ওরা বিতাড়িত হবার পথে। দক্ষিণের দিবাও এবং কোটাবাটোও ওদের এখন হাতছাড়া। এখন এ জাম্বুয়াংগোই ওদের শেষ ভরসা। কিন্তু এখানেও ওদের পায়ের তলায় মাটি নেই। শুধু হুকুমের আপেক্ষা -এক রাতেই সব খেলা সাঙ্গ হয়ে যাবে ওদের।
আবু সালেহের মাথার ওপর বেসুরো শব্দের কলিং বেল তার চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে দিল। সে হাতের কাগজ পাশের বেঞ্চিতে ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল, লালমুখো, টেকো মাথা গার্ড সাইমন তখনও মদ গিলছে। আবু সালেহ সামনে দাঁড়াতেই সে বলল, কি যে এসব রাবিশ একটু ও ভালো লাগছে না, একটুও নেশা ধরাতে পারছে না। জানিসরে টম, রাজকুমারীকে কোন ঘরে কোথায় রাখা হলো?
কোন রাজকুমারী? আবু সালেহের চোখে একরাশ জিজ্ঞাসা।
বেটা ন্যাকা! জানিস না মরো রাজকুমারী এখানে তশরীফ এনেছেন। আঃ কি সুন্দর নাম ‘শিরী’। জানিস টম, ফারসী সহিত্যের ইংরেজী অনুবাদে আমার খুর আগ্রহ। শিরী-ফরহাদের কাহিনী আমি পড়েছি। ডেভিল মুর হামসারের এ বোনটি কাহিনীর শিরীকে হার মানায়।……..
সাইমন আরো কত কি বলছিল। কিন্তু টমের মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। তার পায়ের মাটি যেন সরে যাচ্ছে, সামনের জগৎটা যেন তার সামনে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। পিসিডার সহকারী প্রধান মুর হামসারের বোন এখানে! কেমন করে কিভাবে ওরা নিয়ে এল? এই সাংঘাতিক সময়ে কি তার করণীয়?
সাইমন তার দিকে চেয়ে বলল, ব্যাটা, তোরও নেশা ধরল নাকি? যা, এ রাবিশগুলো সরিয়ে নিয়ে যা। বলে পা দিয়ে টিপয়টিতে দিল এক ধাক্কা। টেবিল উল্টে গিয়ে মদের বোতল আর গ্লাস বিশ্রী এক শব্দ করে টুকরো টুকরো হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। আবু সালেহ টেবিলটি ঠিক করে, কাঁচের টুকরোগুলো কুড়িয়ে মেঝেটা ভাল করে মুছে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর বাথরুমে গিয়ে ভালো করে হাত পরিস্কার করে অজু করে নিল। দেখল, যোহরের নামাযের সময় এসে গেছে। সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে গার্ড রুমে প্রবেশ করল। চেয়ারে গা এলিয়ে উর্ধমুখী হয়ে কড়িকাঠ গুণতে থাকা মেজর সাইমনকে লক্ষ্য করে সে বলল, স্যার, শোবার ঘর থেকে একটু আসি।
শোবার ঘরে ঢুকে প্রথমে দরজা তারপর সবগুলো জানালা বন্ধ করে দিল। অতঃপর জায়নামায় বিছিয়ে কিবলামুখী হয়ে দাঁড়াল। জায়নামায সাদা একখন্ড কাপড়। জায়নামাযের সিজদা দেবার জায়গাটা তুলো দিয়ে নরম করা। যাতে কপালে সিজাদার দাগ না পড়ে সে জন্যই এই সতর্কতা। সবার সতর্ক দৃষ্টির সামনেই তাকে গোপনে নামায পড়তে হয়। অনেক সময় আসর এবং মাগরিবের নামায কাজা করতে তাকে বাধ্য হতে হয়। কিন্তু রাতের নামাযের সাথে এ কাজাগুলো সে সেরে নেয়। তার বিশ্বাস আছে, তার অসুবিধার কথা বিবেচনা করে দয়ালু আল্লাহ নিশ্চয় তাকে মাফ করে দেবেন। সবচেয়ে তার মুস্কিল হয় রমযানের রোযা নিয়ে। মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নামায পড়ার মত সময় করে নেয়া যায়, কিন্তু রোযা অসম্ভব। অন্যদিকে মানুষের ভয়ে রোযা না করে মুসলমান থাকা যাবে, এ বিশ্বাস তার নেই। মুসলমানরা সত্য প্রচারের জাতি, সত্য গোপন করার জাতি নয়। মুসলমানরা জীবন দিয়েছে, দেশ ত্যাগ করেছে, কিন্তু সত্যের পতাকা অবনত করেনি। বিলাল, ইয়াসার, সোহায়েব প্রমুখদের জীবন তো এ ত্যাগেরই স্বাক্ষর। আবু সালেহও সত্য গোপন করেত রাজি হয়নি। সে চাকরী ছেড়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু পিসিডা এ গুরুত্বপূর্ণ চাকুরি জাতির স্বার্থেই ছেড়ে দিতে নিষেধ করেছে। জাম্বুয়াংগোর ওস্তাদ ইয়হিয়া আলী তাকে বলেছেন, মাঝে মাঝে রোযা রেখে কাজাগুলো বছরে অন্য সময়ে করে নিও। আমাদের অসহায়তা ও প্রয়োজন আল্লাহ দেখছেন, তিনি অবশ্যই মাফ করবেন আমাদেরকে। আবু সালেহ তারপর থেকে ঐভাবেই রোযা পালন করে আসছে।
আবু সালেহ নামায শেষ করে উঠতেই গেটে গাড়ির হর্ণ বেজে উঠল। থেমে থেমে বাজছিলো সেই সাংকেতিক হর্ণ। তাড়াতাড়ি সে শোবার ঘর থেকে গার্ড রুমে এল! যেমন সে প্রায়ই যায়, তেমনি আজও সে উঠে গেল পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি সামরিক ভ্যান। সামরিক উর্দিপরা ড্রাইভারের পাশেই ব্রিগেডিয়ার র্যাঙ্কের জনৈক অফিসার। ভ্যানের পেছনে ছয়জন সামরিক প্রহরী। পিকআপ ভ্যানের মেঝের ওপর চোখ পড়তেই চমকে উঠলো আবু সালেহ। ওকি! লোকটির গায়ে পিসিডার ইউনিফর্ম। লোকটির মুখ দেখা যাচ্ছে না। এ সময় গাড়িটি নড়ে উঠল। ইতিমধ্যেই গেটটি খুলে গেছে। খোলা গেট-পথে এগিয়ে এল গাড়িটি। চোখের নিমেষে ভেতরে ঢুকে গেল গাড়ি। মুহূর্তের জন্য লোকটির মুখ সে দেখতে পেল। এক নজর দেখেই বুঝল, লোকটি এদেশী নয়। তাহলে? বিদেশীর গায়ে পিসিডার ইউনিফর্ম কেন?
ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার থেকে নেমে এল আবু সালেহ। রাজকুমারী এবং এই মুহূর্তের দৃশ্যটা এক সাথে মিলিয়ে বুঝল, একটা বড় ধরনের কিছু ঘটে গেছে। বুকটা তার ধক করে উঠল। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা যেন ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেহে এক অজানা আশঙ্কায়। তার মন বলল, বসে থাকার সময় এটা নয়। এই মুহূর্তে এই খবর দু’টো পিসিডা অফিসে পৌঁছানো দরকার।
জাম্বুয়াংগো বন্দরের রয়াল স্কোয়ার শহরের প্রাণকেন্দ্র। এই স্কোয়ারের পশ্চিমে সেন্ট এলিস রোড ধরে কেয়েক গজ এগুলেই টেলিফোন ভবন। তার বিশাল অয়্যারলেস টাওয়ার বলতে গেলে গোটা মিন্দানাওয়ের মুখ আর কান। বলা যায় দক্ষিণ ফিলিপিনের অয়্যারলেস যোগাযোগের রাজধানী এটা। বিশেষ করে কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোর পতনের পর ফিলিপিন সরকারের কাছে এর গুরুত্ব আজ অপরিসীম। এ টেলিফোন ভবন এখন সামরিক যোগাযোগের কাজেই বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে। তার নজীর টেলিফোন ভবনটির বিশাল গেটের দিকে তাকালেই আঁচ করা যায়। সেখানে আগে ছিল সাধারণ পুলিশ প্রহরী। তার জায়গায় এখন পাহারা দিচ্ছে বাহুতে টকটকে লাল ব্যান্ড বাঁধা মিলিটারী পুলিশ। টেলিফোন ভবনের গোটা চৌহদ্দিই এখন ফিলিপিনো সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। রয়াল স্কোয়ারের পূর্ব পাশে বিদ্যুৎ স্টেশন। জাম্বুয়াংগো হাইড্রোইলেকট্রিক প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ এখানে আসে, এখান থেকেই তা ছড়িয়ে দেয়া হয় গোটা দক্ষিণ মিন্দানাওয়ে।
এই রয়াল স্ট্রিটেরই উত্তর পাশে বিশাল গীর্জা, দক্ষিণমুখী। তীরের মত সোজা বন্দর রোড দিয়ে সাগরের বাতাস এখানে এসেই প্রথমে বড় রকমের ধাক্কা খায়। গীর্জার পশ্চিম পাশ দিয়ে একটা সরু গলি। গলির পশ্চিম পাশে একটা দ্বিতল মসজিদ। মসজিদের মিনার নেই। একটা উঁচু উন্মুক্ত সোপানে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন আযান দেয়। ভালো করে লক্ষ্য করলে একটা বিধ্বস্ত মিনারের চিহ্ন সেখানে দেখা যাবে। গীর্জা যখন তৈরী হয়, তখন এ মিনার ভেঙে ফেলা হয়। উল্লেখ্য, গীর্জাটি তৈরী মসজিদের জায়গার ওপরেই। মসজিদটির সাথে যুক্ত ছিল মার্কেট, মাদ্রাসা ও ছাত্রাবাসের একটা বিরাট কমপ্লেক্স। শ্বেতাংগ খৃস্টানরা যখন জাম্বুয়াংগো দখল করে, যখন তাদের নিষ্ঠুর হত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও অভিযানের মুখে শহরের মুসলমান ছিন্ন ভিন্ন, তখন তারা মসজিদের এ জায়গা দখল করে মার্কেট-মাদ্রাসা সব ভেংগে এখানে গীর্জা গড়ে। মসজিদের সুউচ্চ মিনার তারা ভেঙে ফেলে। কিন্তু মসজিদটি ভাঙেনি। না ভাঙার কারণ, সোনার ক্রস বুকে ঝুলানো শুভ্র কেশ শ্বেতাংগ ফাদার নাকি বলেছিল, উঁচু গীর্জার আশ্রয়ে মাথা নিচু করে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকনা মসজিদটা। এতে গীর্জার গৌরবই বৃদ্ধি পাবে।
গীর্জা ও মসজিদের মধ্যকার গলি দিয়ে কিছুদূর এগুলে একদম গলির মাথায় একটা বিশাল সাইনবোর্ড দেখা যাবেঃ ‘ফিলিপিন ওভারসীজ করপোরেশন’। ইনডেন্ট ও শিপিং এজেন্সীর সবচেয়ে বড় ফার্ম। গোটা মিন্দানাওয়ে এই ফার্মের সুনাম। কসমেটিক থেকে মিল মেশিনারী পর্যন্ত প্রায় শ’খানেক বিদেশী পণ্যের সোল এজেন্সী রয়েছে এই ফার্মের। প্রবেশ পথেই ইস্পাতের বড় গেট। গেটের পাশে গার্ড রুমে দারোয়ান। তার পাশেই সুসজ্জিত তথ্যকেন্দ্র। সবাই প্রথমে তথ্যকেন্দ্রে যায়। তথ্যকেন্দ্র প্রয়োজন জেনে নিয়ে টেলিফোনে ভেতরের সাথে যোগাযোগ করে কোথায় যেতে হবে তার স্লিপ দিয়ে লোক ভেতরে পাঠায়।
গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার পর প্রথমেই একটা ছোট্ট উঠান। উঠান পেরোলেই অফিসে প্রবেশের স্বয়ংক্রিয়ং দরজা।
ত্রিতল ভবন। মনে হবে অসংখ্য রুম। কিন্তু কোন শব্দ নেই। বহু টাইপ রাইটারের অব্যাহত খটখট গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তিনটি তলার সামনের সবগুলো রুমই কোম্পানীর বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। পেছনের অংশটা রেসিডেনসিয়াল ব্লক। প্রায় শ’তিনেক কর্মচারী অফিসে। জাম্বুয়াংগো শহরে এটাই পিসিডার হেডকোয়াটার্স। এখানকার সব কর্মচারীই পিসিডার কর্মী। কোম্পানীর মালিক মিঃ একিনো ওরফে হাজী উমর তার সবকিছু পিসিডার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছেন। হাজী উমরের বাড়ি ছিল পূর্ব মিন্দানাওয়ের দিবাও শহরে। সেখানে সব হারিয়ে খালি হাতে আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে তিনি জাম্বুয়াংগো এসে আত্মগোপন করেন। তারপর নাম ভাঁড়িয়ে খৃষ্টান নাম গ্রহণ করে ইনডেন্ট বিজনেস শুরু করেন, আর সেই সাথে স্থানীয় মুসলমানদের সাথে একটা গোপন যোগযোগের কাজও শুরু করে দেন। হাজী উমরে সেদিনের সে ছোট্ট ইনডেন্ট বিজনেস আজ ‘ফিলিপিন ওভারসিজ করপোরেশন’। সেই সাথে জাম্বুয়াংগো পিসিডার হেডকোয়াটার্সও এটা। হাজী উমরের নিরলস পরিশ্রমে জাম্বুয়াংগো এবং এই এলাকার প্রতিটি মুসলিম সংগঠিত হয়েছে। তাদের সুখ -দুঃখের সাথী হাজী উমর। হেঁটে-খেটে এবং পকেট থেকে পানির মত পয়সা খরচ করে তিনি বিভিন্ন অফিস-আদালতে মুসলিম যুবকদের চাকুরী জুটিয়ে দিয়েছেন। তার ফলে আজ সব সরকারী অফিস, পুলেশ ফোর্স, নিরাপত্তা এজেন্সী, টেলিফোন ভবন, পাওয়ার স্টেশনসহ সব জায়গায় পিসিডাকে মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে।
সেদিন বেলা তিনটা। ফিলিপিন ওভারসীজ করপোরেশনের রেসিডেন্সিয়াল ব্লকের একটি কক্ষ। একটা বড় টেবিল ঘিরে বসে আছে সাতজন। জাম্বুয়াংগো অপারেশন সেলের বৈঠক। কথা বলছেন জাম্বুয়াংগোর পিসিডা প্রধান এহসান সাবরী। সবার অখন্ড মনোযোগ তাঁর দিকে।
তিনি বলছিলেন আবু সালেহের কাছ থেকে নিশ্চিত খবর পাওয়া গেল, আহমদ মুসাকে ওরা জাম্বুয়াংগো নিয়ে এসেছে। আল্লাহর হাজার শোকর যে, তাঁকে শিপে করে অন্য কোথাও নিয়ে যায়নি, যা ছিল খুবই স্বাভাবিক। তবে তাঁকে অতি শীঘ্রই এখান থেকে সরিয়ে ফেলবে, তাতে কিছুমাত্রও সন্দেহ নেই। ইরগুন জাই লিউমি এবং বিশ্ব রেড ফোর্স (W.R.F.) তাঁকে হাতে পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে আছে। মনে হয় মিন্দানাওয়ের কু-ক্লাক্স-ক্লান আহমদ মুসার কাছ থেকে প্রথমেই ‘রেডিয়েশান বম্ব’ এর খবর উদ্ধার করতে চায় বলেই সম্ভবতঃ নিজেদের হাতের মধ্যে জাম্বুয়াংগোর আর্মি ইনটেলিজেন্স হেড কোয়াটার্সে এনে তুলেছে।
একটু দম নিল এহসান সাবরী। তারপর বলল, আমরা শত্রুকে কোন সময় দিতে পারি না। আজকে রাতের মধ্যেই উদ্ধার করতে হবে আমাদের নেতাকে, সেই সাথে আজই নির্ধারিত হবে শুধু জাম্বুয়াংগোর নয়, গোটা মিন্দানাওয়ের ভবিষ্যত।
এহসান সাবরীর শেষের কথাগুলো যেন সাগর বক্ষের মতই অতলান্ত ও স্থির, বুলেটের মতই দৃঢ়-শক্তিমান। বলতে বলতে তাঁর চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।
এহসান সাবরীর ডান পাশে বসা নূর আহমদ প্রথমে কথা বলল। বলল সে বোধহয় ওরাও এটা আঁচ করেছে। বন্দর এলাকায় বলতে গেলে কারফিউ এর মত। অপরিচিত সকল নৌযানের বন্দরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। শহরগামী সবগুলো সড়ক বন্ধ। শহরের তিনদিক ঘিরে সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড।
নূর আহমদ জাম্বুয়াংগো পিসিডা’র গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান। তার কথা শুনে একটু হাসলেন এহসান সাবরী। বললেন, তোমার কথা ঠিক নূর আহমদ। তবে ফাইনাল খেলার জন্য ওরা তৈরী নয়। ওরা যা করছে সেটা সতর্কতার জন্য। আহমদ মুসাকে হাতে পাওয়ার পর তাদের এটুকু সতর্কতাকে আমি খুব স্বাভাবিক বলে মনে করি। কিন্তু ওরা যা কল্পনা করেনি, সেই আঘাত আমরা দিতে চাই। কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোর পর তাদের শক্তির শেষ শক্ত গাছটি আমরা উপড়ে ফেলতে চাই।
থামলেন এহসান সাবরী। মুখ তুলল এবার হামিদ উনিতো। উনিতো এখানে এহসান সাবরীর প্রধান সহকারী। সে বলল, পুলিশ বাদ দিলে জাম্বুয়াংগোতে ওদের সৈন্য সংখ্যা আজকের দিন পর্যন্ত পাঁচ হাজারে পৌঁছেছে।
আমরা পুলিশ ফোর্সকে তাদের সাথে ধরেই হিসেব করছি -বললেন এহসান সাবরী।
এই সংখ্যা শক্তি মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাগায়ান, দিবাও কোটাবাটো সহ হাজারো জায়গায়, হাজারো বার এটা প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে রাতের গেরিলা যুদ্ধে ওরা অকেজো। তার ওপর মানসিকভাবে ওরা আজ খুব দুর্বল। কথাগুলো বললেন মাইকেল সুনম ওরফে সালেম ইব্রাহিম। ইনি জাম্বুয়াংগো পুলিশের একজন উর্ধতন অফিসার। গত দশ বছর ধরে তিনি মরো মুক্তি আন্দোলনের সাথে জড়িত। তিন বছর আগে তিনি পিসিডা’য় যোগ দেন। আজ তিনি পিসিডা’র প্রথম সারির একজন নেতা।
তবু আমাদের প্রস্তুতিতে কোন দুর্বলতা আমরা রাখতে চাই না। ত্রিশটি গানবোটের আমাদের নৌ-ইউনিট রাত ন’টার মধ্যে জাম্বুয়াংগো বন্দরে এসে পৌঁছবে। তারা বন্দরে পৌঁছার আগেই কোটাবাটো এলাকার পিসিডার একটা ইউনিটকে শহরের পূর্ব প্রান্তে নামিয়ে দিয়ে আসবে। ওরা পূর্ব দিক দিয়ে শহরে ঢুকবে। আর উত্তর ও পশ্চিম দিক দিয়ে শহরে ঢুকছে লুকমান রশিদের বাহিনী। শহরে আমাদের দায়িত্ব হলো শহরের গোটা ব্যবস্থাকে অচল করে দেয়া, সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও ভারি যানবাহনের গতিরোধের জন্য সেনা ব্যারাক থেকে বহির্মূখী সব ব্রিজ-কালভার্ট ধ্বংস করে দেয়া। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেয়ার দায়িত্ব নিল সালেহ ইব্রাহিম। আর টেলিফোন ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নষ্ট করার দায়িত্ব নূর আহমদের। নূর আহমদের কাজ দিয়ে আজ রাত ন’টায় আমাদের অপারেশন শুরু হবে- থামলেন এহসান সাবরী। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, জাম্বুয়াংগো শহরের সকল পিসিডা ইউনিট এখন থেকেই এ্যাকশনের জন্য তৈরী। অন্ধকারে ডুবে যাওয়া জাম্বুয়াংগো নগরীতে অপারেশন শুরু হবার সংগে সংগে প্রতিটি ইউনিট তাদের স্ব স্ব এলকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে এবং সকল বাধা কাঠোর হাতে নির্মূল করবে।
আবার একটু থামলেন এহসান সাবরী। বোধ হয় ঢোক গিললেন একটা। তারপর টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে ধীরে গম্ভীর কন্ঠে বললেন, আমি সেন্ট্রাল স্কোয়াড নিয়ে যাব মিলিটারী ইনটেলিজেন্স হেড কোয়াটার্সে। আমার সাথে থাকবে হামিদ উনিতো। আমি ন’টায় ইনটেলিজেন্স হেড কোয়াটার্সের গেটে পৌঁছব। সার্বিক অপারেশন শুরুর সময়ও এটাই। তাদের কিছু অপ্রস্তুত ও কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থার আমি সুযোগ নিতে চাই।
কথা শেষ করে এহসান সাবরী নূর আহমদের দিকে তার প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তুলে ধরলেন।
বুঝতে অসুবিধা হলো না নূর আহমদের। বলল, আমরা প্রস্তুত হচ্ছি, ইনশাআল্লাহ কোন অসুবিধা হবে না। অয়্যারলেস ভবন ও বিদ্যুৎ স্টেশনের পিসিডা কর্মীরা তাদের ডিউটি বদল করে রাতের ডিউটি নিয়েছে খবর পেয়েছি। আর আল্লাহর হাজার শোকর, মাত্র একজন ছাড়া আমাদের সব রেডিও কর্মীরই ডিউটি রাতে।
নূর আহমদের কথা শেষ হতেই সালেহ ইব্রাহিম বলে উঠলেন, আমার পুলিশ ইউনিটের কর্মীরা ও তৈরী। তাছাড়া পুলিশের ইউনিফরমও যোগাড় করেছি প্রচুর। আমার কাজের জন্য এগুলোই যথেষ্ট হবে।
এতক্ষণে কথা বললেন হাজী উমর- বন্দরে পাঁচটি সওদাগরী জাহাজ নোঙর করা আছে। নৌ ঘাঁটিতে গোটা পাঁচেক গানবোট এবং দূর পাল্লার কামানবাহী একটি যুদ্ধ জাহাজ আছে। তাছাড়া রয়েছে ডজন দুয়েক পেট্রোলবোট। আমার মতে শহরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিার আগে আমাদের গানবোটগুলোকে এ্যাকশনে নেয়া ঠিক হবে না। নৌঘাঁটি এবং উপকূলের কামান শ্রেণী হাতে পাওয়ার পর আমাদের গানবোটগুলো কাজ শুরু করলে ওদের নৌ শক্তিও আমাদের কাছ আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে।
এহসান সাবরী বলল, এ পরিকল্পনা ঠিক আছে। তবে একটা জিনিস নিশ্চিত করতে হবে, রাত ন’টার পর কোন জাহাজই যাতে বন্দর ত্যাগ করতে না পারে।
হাজী উমর মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। উল্লেখ্য, হাজী উমর পিসিডার বন্দর কামান্ডের প্রধান। এহসান সাবরী ঘড়ির দিকে চাইলেন। তারপর বললেন, এবার আমরা উঠি। তার আগে আসুন আমরা আমাদের মহান ভাই, আমাদের নেতা আহমদ মুসার জন্য দোয়া করি, আল্লাহ তাঁকে ভাল রাখুন। কাগায়ানে তিনি আহত হয়েছিলেন। জাম্বুয়াংগো আসার পথে সংঘর্ষে তিনি মনে হয় আরও আঘাত পেয়েছিলেন। তিনি কি অবস্থায় আছেন আমারা জানি না। বলতে বলতে এহসান সাবরীর কন্ঠ ভারি হয়ে উঠল। তিনি থামলেন। সেই সাথে সাত জোড়া হাত প্রভূর সমীপে মুনাজাতের জন্য উত্তোলিত হলো।
পর্বঃ ৩
জাহাজ থেকে স্ট্রেচারে তোলার সময় জাম্বুয়াংগো বন্দরেই আহমদ মুসার জ্ঞান ফিরে আসে। জ্ঞান ফিরে আসার সংগে সংগেই অনুভব করেন হাত পা তার বাঁধা। বুঝতে পারেন তিনি এখন স্বাধীন নয়। পেছনের ঘটনা একবার স্মরণ করতে চেষ্টা করেন তিনি। মনে পড়ে, জাহাজের বেষ্টনি থেকে তো তাঁর বোট বের হয়ে আসতে পেরেছিল। কিন্তু তারপর কি ঘটল? মনে পড়ে এক প্রচন্ড ধাক্কার কথা। তারপর আর কিছু মনে নেই। তাহলে তিনি ঐখানেই জ্ঞান হারান? কিন্তু সাথীরা কোথায়? মনটা তাঁর আনচান করে ওঠে। সেই সাথে মাথায় তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করে।
একটা পিকআপ ভ্যানের ফ্লোরে এনে আহমদ মুসাকে নামানো হলো।
ঠিক নামানো তো নয়, স্ট্রেচার থেকে তাঁকে গড়িয়ে ফেলা হলো গাড়ীর মেঝেতে। মাথাটা ঠক করে বাড়ি খেল গাড়ির মেঝের সাথে। বেদনায় টন টন করে উঠল মাথাটা। গোটা শরীরে বেদনার একটা স্রোত বয়ে গেল। আহামদ মুসা ভাবলেন, তার অনুমান সত্য হলে কু-ক্ল্যাক্স ক্লানের হাতেই তিনি বন্দী। বুঝতে চেষ্ট করলেন, কোথায় এখন তিনি? চার পাশের প্রহরীদের দেখে বোঝা যাচ্ছে, এরা ফিলিপিনো আর্মির সদস্য। স্থানটা কি জাম্বুয়াংগো হবে? ভাবলেন আহমদ মুসা। জাম্বুয়াংগোর কথা মনে আসতেই ব্যথায় চিন চিন করে উঠল মনটা। শিরীকে তিনি মুক্ত করতে এসে নিজেই এখন বন্দী। মনটা তাঁর খুব দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল অবস্থার নাজুকতায়। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর কন্ঠে নিঃশব্দে উচ্চারিত হলো, আল্লাহ সর্বজ্ঞ, আমি সব ব্যাপারে তাঁর ওপরই নির্ভর করছি।
গভীর প্রশান্তি নেমে এল আহমদ মুসার মনে। গাড়ি তখন চলতে শুরু করেছে। আর কোন বন্দী যখন তার পাশে উঠল না আহমদ মুসা ধরে নিলেন বন্দী তিনি একাই। সাথীরা কি তাহলে সরে যেতে পেরেছে? অথবা তারা সবাই …..। আর ভাবতে পারেন না আহমদ মুসা। এক অবরুদ্ধ উচ্ছাস যেন তাঁর বুকটা ভেংগে দিতে চাইল।
বোধহয় একটু তন্দ্রা এসেছিল আহমদ মুসার। একটা ঝাঁকুনিতে সন্বিত ফিরে পেলেন। দেখলেন, তাকে একটা স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে। দু’জন সৈনিক স্ট্রেচারটি আর্মি ইনটেলিজেন্স হেডকোয়াটার্সের প্রশস্ত এবং অন্ধকার একটা ঘরে নিয়ে রাখল। দরজা সশব্দে বন্ধ হয়ে যাবার সময় একটা কণ্ঠ ভেসে এলঃ ডঃ কর্নেল ফ্রেসারকে নিয়ে এস, উনি একে দেখবেন।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আর কোন কথা কানে এল না।
কণ্ঠটা আহমদ মুসার পরিচিত। স্মার্থার কণ্ঠ। সারা দেহে একটা উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল আহমদ মুসার। তাহলে শিরীও এখানেই বন্দী? অজান্তেই হাত দুটি তার মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল। ভাবনার গভীরে চলে গেল তাঁর মন।
লুকমান রশিদ, এহসান সাবরীরা কি জানতে পেরেছে সব। কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোর পর ওদের সর্বশেষ আশ্রয় জাম্বুয়াংগো। কাগায়ান, দিবাও ও কোটাবাটোতে যেমন করে আল্লাহর সাহায্য পিসিডা অঝোর ধারায় পেয়েছে, সে সাহায্য কি তারা জাম্বুয়াংগোতেও পাবে না? সব নির্ভরতা আমাদের তার ওপর! চোখ দু’টি তাঁর গভীর প্রশান্তিতে মুদে এল।
সশব্দে সেই দরজাটি খুলে গেল আবার। সুইচ টেপার শব্দও শোনা গেল সেই সাথে। আলোতে ভরে গেল ঘরটা। প্রথম দৃষ্টিতেই আহমদ মুসার পরিস্কার মনে হলো, ঘরটা গোয়েন্দা দপ্তরের একটা অপারেশন রুম। পশ্চিম, উত্তর ও পূর্বদিকে একটি করে দরজা ও ছোট জানালা।
পশ্চিমের খোলা দরজায় দু’জন প্রহরী। হাতে সাব মেসিনগান।
দরজা দিয়ে দু’জন ঘরে ঢুকল। একজনকে মনে হল ডাক্তার। আরেকজন দীর্ঘাকৃতি, পেটা শরীর, চোখের দৃষ্টি তীব্র। ছোট করে ছাটা চুল। দু’হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকানো। লোকটি আহমদ মুসার পরিচিত নয়। তবে মনে হয় বড় কর্মকর্তাদের একজন।
লোকটি এগিয়ে এসে বলল, কেমন বোধ করছেন আহমদ মুসা?
আহমদ মুসা কোন জবাব দিলেন না। হাল্কাভাবে উড়ে আসা এ বিদ্রুপবাণের জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজনও ছিল না। আহমদ মুসা তাঁর দৃষ্টি স্থিরভাবে লোকটির দিকে তুলে ধরলেন শুধু।
লোকটি আবার মুখ খুলল। বলল, আমি জনপল, আমাকে চিনতে পারেন?
আপনি জনপল, তবে পোপ নন। কিন্তু পোপের চেয়ে বড়।
আপনি আমাদের পোপকে অসম্মান করলেন – বলল জনপল।
আমি বরং পোপকে সম্মান করেছি জনপল, বলল আহমদ মূসা ।
কেমন করে ?
পোপ স্বয়ং যা করছেন না, করতে বলছেন না, ততটা পর্যন্ত করে আপনারা খৃস্টধর্মকে কলংকিত করছেন, একথা বলে আমি পোপকে সম্মানই করছি।
আপনার ইংগিত কোন দিকে আহমদ মুসা?
আমি কি বলতে চাই কু-ক্ল্যাক্স-ক্লানের পূর্বাঞ্চালীয় বর্তমান প্রধান জনপল অবশ্যই বুঝেছেন।
ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হয়ে উঠল জনপলের। বলল সে, আপনি কোথায় আছেন তা বোধহয় ভুলে গেছেন আহমদ মুসা।
না ভুলে যাইনি। কিন্তু শ্বেতাংগ খৃস্টানরা তাদের ধর্ম ও বর্ণ স্বার্থের জন্যে যে শ্বেত সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছে আমি তার বিরুদ্ধে।
আমরা তা জানি আহমদ মুসা। জানি বলেই আপনি এখানে এসেছেন। একটু থামল জনপল। বোধহয় একটা ঢোক গিললো। শুরু করলো আবার, বিরুদ্ধে বলেই সেদিন কাগায়ানে হত্যা করলেন আমাদের নেতা মাইকেল এ্যাঞ্জেলোকে, এ পর্যন্ত হত্যা করেছেন আমাদের হাজার হাজার কর্মীকে এবং আমাদের অস্তিত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের রেডিয়েশন বোমা আপনারা কুক্ষিগত করেছেন।
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল জনপল। একটু থেমে বলল, সে বিচারে আমরা পরে আসব। তারপর ডাক্তারের দিকে ফিরে জনপল বলল, ডঃ ফ্রেসার, আপনার কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে আপনি আসুন।
গট গট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জনপল। ডাক্তার এগিয়ে এল আহত আহমদ মুসার দিকে। হাতে তাঁর ছুরি, কাঁচি, তুলা, ঔষধ।
আহমদ মুসা তার দিকে চেয়ে বললেন, ধন্যবাদ ডাক্তার, আসুন। মানবতাবোধ একেবারে মরেনি তাহলে? স্মার্থাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।
সেই হল ঘর। একটা দীর্ঘ ও প্রশস্ত তক্তপোষের সাথে নাইলনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আহমদ মুসার দেহ। তাঁর সামনে এক চেয়ারে বসা জনপল। উত্তেজিত দেখাচ্ছে তাকে। তার কপালে বিন্দ বিন্দু ঘাম। সে বলছিল, আমি জানি, আপনি সোজাভাবে কথা বলবেন না। কথা বলাবার যন্ত্রও আমাদের আছে। পাশেই বিদ্যুৎ আসন, দেখুন ছোবল দেয়ার জন্য কেমন হা করে আছে। ঐ পথে যেতে আমাদের বাধ্য করবেন না। শুধু আমাদের বলুন, রেডিয়েশন বোমাগুলো কোথায় রেখেছেন? এটা আমাদের জানালে আর কোন প্রশ্নই আমরা আপানাকে জিজ্ঞেস করব না।
আহমদ মুসা বললেন, তোমাদের এ বিদ্যুৎ আসনকে আমি চিনি। এর ভয় দেখিয়ে রেডিয়েশন বোমার কোন খবর আমার কাছ থেকে পাবে না। নিজে বাঁচার জন্য লাখো মানুষকে মারার অস্ত্র আমি তোমাদের হাতে তুলে দিতে পারি না।
থামুন আহমদ মুসা। বাঘের মত গর্জন করে উঠল জনপল। উঠে দাঁড়াল সে। হাত দু’টি তার মুষ্টিবদ্ধ, চোয়াল দুটি মনে হচ্ছে পাথরের মত শক্ত। চোখে আগুন। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে সে। এক সময় সে হো হো করে হেসে উঠল। হাসিটা মনে হলো চাবুকের চেয়েও তীক্ষ্ণ।
সে এসে আহমদ মুসার সামনে দাঁড়াল। বলল, তাহলে কথা বলবেন না, আহমদ মুসা? রেডিয়েশন বোমার কোন খবর তাহলে দেবেন না আমাদের? একটু থেমে বলল, জানেন আপনার শিরীও এখানে বন্দী আছে?
তুমি কি বলতে চাচ্ছ, জনপল?
কি বলতে চাই দেখাচিছ। বলে হাতে দু’টো তালি দিল সে। সংগে সংগে দু’জন প্রহরী সামনে এসে দাঁড়াল। জনপল তাদের দিকে ফিরে বলল, তোমরা শিরীকে নিয়ে এস।
অল্পক্ষণ পরে শিরীকে নিয়ে দু’জন প্রহরী ঘরে ঢুকল। শিরীর পরনে মরো রাজকুমারীর সেই পোষাকই রয়েছে। মলিন চেহারা। চোখ দু’টি লাল, ফোলা। কেঁদেছে অবিরাম।
আহমদ মুসাকে ঐভাবে দেখে দু’হাতে মুখ ঢাকল শিরী। টলতে লাগল তার দেহ। বসে পড়ল সে।
জনপল আবার আহমদ মুসার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, আহমদ মুসা, মরো রাজকুমারীর দিকে চেয়ে দেখ। এই মেয়েটি আপনার কি আমরা জানি। এখন বলুন এই মেয়েটিকে দুনিয়ার জাহান্নামে ঠেলে দিয়ে আপনার জেদ ঠিক রাখবেন না এ মেয়েটিকে রক্ষার জন্য আমাদেরকে রেডিয়েশন বোমার খবর দেবেন?
কেঁপে উঠল আহমদ মুসার গোটা দেহ এক অজানা আশঙ্কায়। বললেন আহমদ মুসা, তুমি কি বলতে চাও জনপল?
আমি বলতে চাই, আমি কথা শেষ করার পর এক মিনিট অপেক্ষা করব। এর মধ্যে যদি আপনি আমাদের কথায় সম্মত না হন, তাহলে এক মানুষ গেরিলার হাতে এই মরো রাজকুমারীকে তুলে দেব। আপনার চোখের সামনে সে নির্দয়ভাবে লুন্ঠন করবে মরো রাজকুমারীকে। শত চাবুকের ঘা যেন এক সাথে জর জর করে তুলল আহমদ মুসার দেহকে। মগজের প্রতিটি তন্ত্রী, মনের প্রতিটি পরতে এবং স্নায়ুর প্রতিটি কোষে যেন আগুন ধরে গেল। আহমদ মুসার লৌহ হৃদয়ও থর থর করে কেঁপে উঠল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। দাঁতে দাঁত চেপে মনটাকে স্থির করলো আহমদ মুসা। বলল, জনপল, যেটাকে আমার জেদ বলছ সেটা আমার জেদ নয়, আমার দায়িত্ব।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল জনপল। বলল, ৩০ সেকেন্ড পার হয়েছে আহমদ মুসা, আর ৩০ সেকেন্ড বাকী।
আহমদ মুসা শিরীর দিকে তাকালেন। দেখল শিরী তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার পাতলা রক্তাক্ত ঠোঁট দু’টি কাঁপছে। কিন্তু চোখে অশ্রু নেই, তার জায়গায় দৃঢ়তার এক আলোক দীপ্তি। অপার্থিব যেন সেই নূর – আলো ।
আহমদ মুসা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন, ভয়ে কোন মুসলিম কখনও আত্মসমর্পণ করেছে এমন নজীর ইসলামরে সোনালী ইতিহাসে নেই।
আহমদ মুসা বললেন, আমি তোমার প্রস্তাবে সম্মত নই, জনপল। একটু থেমে বললেন আবার, আমি এবং শিরী- আমার, তোমার এবং সকলের রব যিনি সেই আল্লাহর ওপরই নির্ভর করছি।
কি ভয়াভহ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন আহমদ মুসা এখনই টের পাবেন। বলে জনপল আবার হাতে তালি বাজাল। ঘরে ঢুকল সেই প্রহরী দু’জন।
টমকে নিয়ে এসো। দ্রুত কন্ঠে বলল জনপল।
অল্পক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকল টম নামের গেরিলা সদৃশ মানুষ। হেলে দুলে এগিয়ে এল সে। হো হো করে হেসে জনপল বলল, বহুদিন পর তোর ভাল খোরাক জুটিয়েছি টম। এদেশের একজন আনকোরা রাজকুমারী। এগিয়ে আয়!
বীভৎস এক হাসি দেখা গেল টমের মুখে। চিৎকার করে চোখ বুজল শিরী। দেহ জুড়ে এক অদম্য উচ্ছাস আছড়ে পড়ল আহমদ মুসার। প্রতিটি পেশী ফুলে উঠল তার ধাক্কায়। নির্দয় নাইলনের রাশিগুলো তাতে আরো কেটে বসে গেল মাংসপেশীর ভেতরে। টম এগুচ্ছিল শিরীর দিকে। আহমদ মুসা চোখ বন্ধ করে অন্তরের অন্তহীন আকুতি তুলে ধরলেন প্রভূর সামনে প্রভূ হে, তুমি তো এমনি অবস্থায়ই সাহায্য করেছিলে লুতকে, মুসাকে, শুয়াইবকে …।
দ্রুত পায়ের খট খট শব্দে চোখ খুললেন আহমদ মুসা। দেখলেন স্মার্থা ঘরে ঢুকছে। ঘরের মাঝখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল স্মার্থা, মিঃ জন, থামতে বলুন টমকে।
মিঃ জন ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, স্মার্থা তুমি কেন এখানে?
আপনার দেয়া কথা আপনি লংঘন করছেন মিঃ জন।
কি কথা?
শিরীর কোন অমর্যাদা হবে না এ শপথ আপনি আমার কাছে করেছিলেন।
হো হো করে হেসে উঠল জনপল। বলল, তুমি তো আচ্ছা ছেলেমানুষ স্মার্থা। তারপর হাসি থামিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল আমার কাজের মধ্যে এসো না, যাও এখান থেকে। তারপর টমকে বলল, দাঁড়িয়ে কেন?
টমকে থামতে বলো মিঃ জন। এবার স্মার্থার কন্ঠে যেন আদেশের সুর।
না টম থামবে না। এবার জনপলের কন্ঠও তীব্র হয়ে উঠল।
টম এগুচ্ছিল। মুহূর্তে একটি হাত স্মার্থার ওপরে উঠে এল। হাতে চকচকে রিভলবার। স্মার্থার চোখে আগুন। পর পর দু’বার ধুম্র উদগীরণ করল রিভলবার। বিরাট দেহের ছোট্ট মাথাটা একেবারে গুঁড়িয়ে গেল টমের।
বিস্ময়ে হতবাক জনপল একবার ভুলূন্ঠিত টমের দিকে তাকিয়ে তড়িত ঘুরে দাঁড়াল স্মার্থার দিকে। জনপলের হাতে রিভলবার। কিন্তু জনপলের রিভলবারটি উঁচু হবার আগেই স্মার্থার রিভলবার আরো দু’বার অগ্নিবৃষ্টি করল। নির্ভূল নিশানা। গুঁড়িয়ে যাওয়া মাথা নিয়ে মিঃ জনপল হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে।
স্মার্থা রিভলবার মাটিতে ফেলে দিয়ে ছুটে গেল আহমদ মুসার কাছে। কোন দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেকটা পাগলের মতই যেন আহমদ মুসার বাঁধন খুলে দিতে শরু করল।
দরজায় দু’জন প্রহরী কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে ছিল। হন্তদন্ত হয়ে কয়েকজন এসে দরজায় দাঁড়াল। তাদের একজনের হাতে রিভলবার। তারাও প্রথমে এসে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই। পরক্ষণেই আগন্তুক লোকটির পিস্তল উঠে এল স্মার্থাকে লক্ষ্য করে।
দরজায় পায়ের শব্দ পেয়ে শিরী ফিরে তাকিয়েছিল। স্মার্থার দিকে রিভলবার তাক করতে দেখে শিরী ‘স্মার্থা গুলী’ বলে চিৎকার করে উঠে ছুটে গেল স্মার্থার দিকে। মনে হল যেন স্মার্থাকে আড়াল করতে চায় সে।
সঙ্গে সঙ্গে গুলীরও শব্দ হলো। গুলী গিয়ে বিদ্ধ করল শিরীর পৃষ্ঠদেশে। উপুড় হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল শিরী স্মার্থার ওপর। স্মার্থা দরজার দিকে এক পলক তাকিয়ে শিরীর দেহটাকে এক পাশে ঠেলে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে কাছেই পড়ে থাকা জনপলের রিভলবার তুলে নিল। কিন্তু আর ফিরতে পারল না। এক ঝাঁক গুলী তার দিকে ছুটে এল। হামাগুড়ি অবস্থাতেই স্মার্থার দেহটা নেতিয়ে পড়ল মেঝের ওপর।
এই সময় দূরে কোথাও প্রচন্ড বিস্ফোরণে ঘরটা কেঁপে উঠল। মুহূর্তকাল পরে আরও একটা, তারপর আরও একটা। অন্ধকারে ডুবে গেল ঘরটা। তারপর খুব কাছ থেইে এক পশলা মেশিনগানের গুলীর শব্দ কানে এল। মুহূর্তকাল বিরতি, তারপর অবিরাম শুরু হলো মেশিগানের গুলী বর্ষণ। আহমদ মুসা বুঝতে পারল, পিসিডা শহরে প্রবশ করেছ, প্রবেশ করেছে এ বাড়িতেও। আনন্দে বুকটা ফুলে উঠল, ইয়াআল্লাহ, পিসিডাকে সাহায্য কর, বিজয়ী কর। জাম্বুয়াংগো বিজয়ের মাধ্যমে আমাদের মিন্দানাও বিজয় সম্পূর্ণ কর।
শিরীর কথা মনে পড়ল। মুহূর্তে আনন্দের রেশটা মুছে গেল আহমদ মুসার। শিরীর দেহটা আহমদ মুসার পাশে এসেই পড়েছিল। কিন্তু হাত নাড়াতে পারে না সে, কোন রকম পাশ ফেরার সাধ্যও তাঁর নেই। অস্ফুটে ডাকলেন, শিরী!
কোন জবাব নেই। বুকটা কেঁপে উঠল আহমদ মুসার। তাহলে কি ….। তবু আবার ডাকলেন, শিরী! এবার স্বরটা একটু বড়। এবার ও কোন উত্তর নেই।
আহমদ মুসার মনে হচ্ছে, একটা হাল্কা কি যেন তার ডান বাহুটা আঁকড়ে আছে। কি এ বস্তু। কিন্তু তা দেখার সাধ্য আহমদ মুসার নেই। এই সময় ঘরে অনেকগুলো পায়ের ত্রস্ত শব্দ শোনা গেল। জ্বলে উঠল একটা টর্চ।
দ্রুত কন্ঠে একজন নির্দেশ দিল, তক্তা সমেত তুলে নাও আহমদ মুসাকে। ছুটে এল কয়েকজন। টর্চের আলোতে আহমদ মুসা দেখতে পেল, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শিরীর দেহ। তার পাশেই উপুড় হয়ে পড়ে আছে সে। আর তারই একটা হাত উঠে এসে আঁকড়ে ধরে আছে আহমদ মুসার ডান বাহু। যেন একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে শিরী।
প্রহরীরা ছুটে এল। তুলে নিল তক্তা সমেত আহমদ মুসাকে। শিরীর হাতটা খসে পড়ল মেঝেতে। এই সময় মুর হামসারের মুখটা ভেসে উঠল আহমদ মুসার চোখের সামনে। আকস্মাৎ চোখ দু’টো ভারি হয়ে উঠল আহমদ মুসার। নেমে এল দু’চোখ থেকে অশ্রুর দু’টো ফোঁটা। মন নিঃশব্দে আওয়াজ করল, পারলাম না বন্ধু তোমার কাছে তোমার বোনকে ফিরিয়ে দিতে।
গোটা বাড়ি জুড়ে তখন সংঘর্ষ। ক্রমশঃই শব্দ আরও কাছে আসছে। আহমদ মুসা বুঝল, বাড়ি নিয়ন্ত্রণ পেতে পিসিডার আর দেরী নেই। কিন্তু এরা তাকে নিয়ে ওপরে ওঠছে কেন? কি করবে এরা? হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, এরা কি ছাদ দিয়ে পালিয়ে যাবে? ছাদে কি তাহলে হেলিকপ্টার আছে?
আহমদ মুসার অনুমান সত্য হলো। চিলেকোঠার কাছাকাছি আসতেই হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের পরিচিত শব্দ কানে এল। হেলিকপ্টার স্টার্ট নিয়েই ছিল। আহমদ মুসাকে নিয়ে ওঠা মাত্র হেলিকপ্টার উড়াল দিল।
সামনের সিট থেকে কে একজন বলল, আমাদের কামান্ডোরা অসাধ্য সাধন করেছ। তারা এতক্ষণ ওদের ঠেকিয়ে রাখতে না পারলে হেলিকপ্টার আনা যেত না।
এখন কি নির্দেশ থাকল আমাদের ছেলেদের ওপর? বলল আরেকজন। উত্তরে পূর্বোক্তজন বলল, কর্নেল কর্ক-ই সে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে মোটামুটি কথা, আমাদের ছেলেরা এখন পেছন দরজা দিয়ে সরে পড়বে।
ভারি গলায় কে একজন বলল, কোথায় সরে পড়বে, গোটা শহরটা ওদের জালের মধ্যে। দেখলে না, কেমন করে গোটা শহর একসাথে জ্বলে উঠল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর একজন বলল, কোথায় যাচ্ছি আমরা?
কাগনোয়াভিচের শিপে। খবর পেয়েছি আমাদের শিপটা বন্দরে আটকা পড়েছে।
আহমদ মুসা অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করল, যে কাগনোয়াভিচ উচিন ভর মাধ্যমে আলী কাউসারের সাথে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল ইনটেলিজেন্স সার্ভিস ‘রিও’ (Red Intelligence Organisation-RIO)- এর ফিলিপাইন শাখার প্রধান সেই কাগনোয়াভিচ?
আর্মি ইনটেলিজেন্স হেডকোয়াটার্স এতখানি সুরক্ষিত হবে তা ধারণা করেননি এহসান সাবরী। ঠিক ন’টাতেই তিনি পৌঁছে গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে গার্ড রুম থেকে একটি গুলীর শব্দ আসে। পরক্ষণেই গেটটি খুলে যায়। আরেকটি গুলীর শব্দ আসে এই সময় গার্ড রুম থেকে। সেই সাথে মেশিনগানের একঝাঁক গুলি আসে গেট লক্ষ্য করে। এইভাবে শুরুতেই তাদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়।
আড়ালে থাকা সুনির্দিষ্ট অবস্থান থেকে তারা গুলী বৃষ্টি করছিল। বিস্ফোরণের পর বিদ্যুৎ চলে গেলেও তা খুব উপকারে আসেনি এহসান সাবরীর- আকাশে দ্বাদশীর চাঁদ থাকায়। এহসান সাবরীরা ওদের দেখছিল না কিন্তু ওরা তাদের ঠিকই দেখছিল। সবচেয়ে মুস্কিল হয়েছে, এই বিশাল বিল্ডিংটিতে ঢোকার একটি মাত্র প্যাসেজ এবং একটি মাত্র দরজা।
পিসিডার বেপরোয়া ইউনিট গুলী বৃষ্টির মধ্যেই এগিয়ে যায় এবং ওদের পরাভূত করে। কিন্তু প্রবেশ দরজায় গিয়ে ধাক্কা খায় তারা। কথা ছিল, আবু সালেহ এ দরজা খোলারও ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তা হয়নি। অবশেষে দরজা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে হয়।
এভাবে প্রতি দরজায়, প্রতি বাঁকে বাধার সাথে যুঝে এহসান সাবরী যখন সেই হলকক্ষে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন হল ঘর খালি। টর্চের আলোতে ব্যাকুল ভাবে তিনি লাশগুলো পরীক্ষা করলেন, না আহমদ মুসা নেই। বুকের কাঁপুনি একটু কমল তাহলে কি আহমদ মুসা সরতে পেরেছেন? চোখের কোণায় তার এক উজ্জ্বল আনন্দ ঝিলিক দিয়ে উঠল।
লাশের ওপর টর্চের আলো ঘুরাতে গিয়ে একজনের পোষাক দেখে তিনি চমকে উঠলেন। গায়ে মরো মেয়েদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক। তার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। শিরী নাতো? ভালো করে দেখার জন্য তিনি ঝুঁকে পড়লেন।
এই সময় একজন ছুটে এসে বলল, ছাদে হেলিকপ্টার……।
শোনার সঙ্গে সঙ্গে এহসান সাবরী উঠে দাঁড়িয়ে ছুটলেন সিঁড়ি ভেঙে ছাদের দিকে। কিন্তু ছাদে গিয়ে যখন পৌঁছলেন, তখন হেলিকপ্টারটি অনেক ওপরে এবং বাড়ীর চৌহদ্দির বাইরে। হাত থেকে স্টেনগানটা খসে পড়ল এহসান সাবরীর। বসে পড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে শিশুর মত কেঁদে উঠলেন এহসান সাবরীঃ আমার অভিযান ব্যর্থ, আমি ব্যর্থ হয়েছি, শিরী মৃত, আহমাদ মুসাকে ওরা নিয়ে গেল’।
হামিদ উনিতো এসে এহসান সাবরীর মাথায় হাত রাখল। মাথা তুলে হামিদ উনিতোকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমরা পারলাম না, হামিদ। কান্নায় ভেঙে পড়ল শেষের শব্দগুলো।
হামিদ উনিতো বলল, এহসান সাবরী ভাই, কান পেতে শুনুন, গোটা জাম্বুয়াংগো নগরীতে পিসিডা’র বন্দুকগুলো আনন্দ উৎসব করছে। আমরা বিজয় লাভ করেছি। এ বিজয় দিয়ে আমরা মিন্দানাওয়ের শহরাঞ্চলগুলো থেকেও উচ্ছেদ করলাম ফ্যাসিবাদীদের অবৈধ শাসনকে।
একটু থামলো হামিদ উনিতো। তারপর বলল, এই বিজয়ের স্থপতি যিনি, তিনি এই মুহূর্তে আমাদের মাঝে নেই হয়তো, কিন্তু তিনি তো আছেন, এটাই আমাদের সান্তনা।
আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল হামিদ উনিতোর কন্ঠও।একটু থামল হামিদ উনিতো। তারপর বলল, যেখানেই তাঁকে নেয়া হোক, বিশ্বজোড়া ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মীদের চোখের বাইরে নেয়া তকে সম্ভব হবে না। আল্লাহ তাঁর নিগাহবান।
হেলিকপ্টারের শব্দ তখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে। পশ্চিম দিগন্তে কালো এক বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে হেলিকপ্টারটিকে। এহসান সাবরী, হামিদ উনিতো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেদিকে।