০৪. পামিরের আর্তনাদ (পর্ব ৬-৭)

 

পামিরের একটি ছোট্ট গ্রাম। নাম আল্লাহ বকশ। পাহাড়ের ঢালে সুপ্রশস্ত করিডোর। এই করিডোর ঘিরেই গড়ে উঠেছে গ্রামটি। পাশ দিয়েই প্রবাহিত বেগবান ছোট পাহাড়ী নদী। নদীটি নেমে এসেছে সবুজ বনানী ঢাকা পাহাড়ের মাথায় দাঁড়ানো চির বরফ ঢাকা হিন্দুকুশের শৃংগ থেকে। এই আল্লাহ বকশ গ্রামটির সংকীর্ণ পাথুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওপর দিকে চাইলেই দেখা যাবে পাহাড়ের গায়ে ওয়ালনাট বৃক্ষের সারি।
গ্রামটি ছোট হলেও শতাধিক তাজিক মুসলিম পরিবারের বাস এখানে। প্রায় এক মাইল লম্বা গ্রামটি। বেশ পাতলা বসতি। প্রতিটি বাড়ি ঘিরেই রয়েছে বহু কষ্টে গড়া বাগান ও শস্য ক্ষেত। শুকনো সময়ে নদী থেকে সংগ্রহ করা বালু, মাটি দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এ বাগান ও শস্য ক্ষেতগুলো। এ বাগান ও ক্ষেতগুলোতে গমসহ সালবেরী, এপ্রিকট ও পিস ফল প্রচুর পররিমানে জন্মে। তুলাও কিছু কিছু তারা উৎপাদনে করে। এ দিয়েই কাষ্টে-শিস্টে তাদের চলে যায় দিন। পরনির্ভরতা তাদের খুব কম।
গ্রামের পশ্চিম প্রান্ত থেকে একটা সংকীর্ণ গিরিপথ এগিয়ে গেছে উত্তর দিকে। পায়ে হেটেঁ কিংবা ইয়াকে চড়ে এ রাস্তায় যাতায়াত করা যায়। এ রাস্তায় মাইল পাঁচেক এগুলে ঐতিহাসিক পামির সড়কে পৌঁছা যায়। ঐতিহাসিক এ সড়কটি উজবেকিস্তানের ফারগানা থেকে প্রায় একশ মাইল উত্তর-পূর্বে রেল পথের শেষ প্রান্ত থেকে বেরিয়ে ভিয়েনশালা পর্বতামালার মধ্য দিয়ে মালার মত গোটা দুর্গম পামির অতিক্রম করে এসেছে। তারপর পশ্চিমের বকশ নদী অতিক্রম করে স্টালিনাবাদ হয়ে শিরদরিয়া পেরিয়ে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। এই আল্লাহ বকশ গ্রামের সবচেয়ে নিকটবর্তী নগর হল স্টালিনাবাদ। পাঁচশ মাইল দূরে। মাঝখানে বকশ নদীর পানি-বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঘিরে আরেকটি শহুরে জনপদ পাওয়া যায়। তারও দুরত্ব এখান থেকে দু’শ মাইলের মত।
গ্রামে সব মিলে পাঁচ’শ লোকের বাস। তরুণ-তরুণীদের একটা বড় অংশ স্টালিনাবাদ, বোখারা, সমরকন্দ ও তাসখন্দের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে। আরেকটা অংশ পশুপালন ও বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। এরা সবাই গ্রামের বাইরে থাকে। ছুটি ও অবকাশের সময়গুলো তারা গ্রামে এসে কাটায়। বাকীরা গ্রামে পিতামাতার সাথে সংসার দেখাশুনা করে।
গ্রামের একদম পূর্বপ্রান্তে আবদুল গফুরের বাড়ি। তার বয়স এখন ৭০ বছর। বেশ শক্ত-সামর্থ্য। এখনও যুবকদের মতই তিনি শক্ত পায়ে পাহাড় ডিঙাতে পারেন। গ্রামের তাজিক কবিলার প্রধান ছিলেন তিনি। তার মরহুম আব্বাও এ দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এ কবিলার আদি নিবাস ছিল পিয়ান্দজ নদীর উপত্যকা অঞ্চলে। বোখারা, সমরকন্দ দখলকারী কম্যুনিস্টদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রামের সময় এলাকাটি বিধ্বস্ত হয়, জনপদ বিরাণ হয়ে যায়। সেই সময় তাঁর দাদা আবদুর রহমান তাঁর কবিলার অবশিষ্ট লোক সহ এই পাহাড়ে এসে আশ্রয় নেন। তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি এ কবিলার সর্দারী গ্রহণ করেন। কিন্তু তাজাকিস্তানের কম্যুনিস্ট সরকার ততদিনে এ গ্রামেও এসে পৌঁছে। গ্রামের সব যুবক তরুণরা পালিয়ে যায়। তাদের সাথে আবদুল গফুরের বড় ছেলেও পালিয়ে যায়। অনেকেই পরে ফিরে এসেছে, কিন্তু তাঁর ছেলে আর ফিরে আসেনি। গ্রামে কম্যুনিস্ট সরকার আসার পর অনেকের সাথে আবদুল গফুরকেও নিগ্রহের শিকার হতে হয়। তাঁর সর্দারী চলে যায়। কম্যুনিস্ট সরকারের তৈরী একটা রাজনৈতিক ইউনিয়ন গ্রামের সব কিছু দেখার অধিকার পায়। প্রথমে বাইরে থেকে কয়েকজনকে এনে এই রাজনৈতিক ইউনিয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। এখন সে ইউনিয়ন নেই। তার জায়গায় যৌথ খামারের অনুকরণে গঠিত একটা বহুমুখী সমবায় গ্রামের জীবন নিয়ন্ত্রন করে। সমবায় প্রধান আঞ্চলিক কাউন্সিলে এ গ্রামের রাজনৈতিক প্রতিনিধি ও দায়িত্ব পালন করে। হাত ঘুরে আবদুল গফুরের মেজ ছেলে আবদুল্লায়েভের হাতে আজ গ্রাম সমবায়ের দায়িত্ব এসেছে। আবদুল্লায়েভ ছাড়া আবদুল গফুরের আরও তিনটি সন্তান রয়েছে। তৃতীয় ছেলে ইকরামভ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগরে ছাত্র। চতুর্থ ও সর্ব কনিষ্ঠ ছেলে জিয়াউদ্দিন বোখারার মীর-ই-আরব মাদ্রাসার উচ্চ শ্রেণীতে পড়ে। আবদুল গফুরের একটি মাত্র মেয়ে, মেধাবী ছাত্রী। রাষ্ট্রীয় বিশেষ স্কলারশীপ নিয়ে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়ন করছে। নাম ফাতিমা ফারহান।
রাতের আল্লাহ বকশ গ্রাম গভীর ঘুমে অচেতন। নিরব গ্রাম, নিরব বনানী, ততোধিক নিরব আদিগন্ত পাহাড় শ্রেণী। কৃষ্ণা নবমীর চাঁদ উঠেছে পূর্ব দিগন্তে। বনানীতে, পাহাড়ে আলো আঁধারের খেলা। ছোট নদীটির বুকে পাহাড়ের কালো ছায়া কালো করে তুলেছে নদীর সফেদ বুককে।
রাতের তৃতীয় যাম প্রায় শেষ। আবদুল গফুরের বাড়ির উত্তর ভিটার দক্ষিণমুখী ঘরের দরজা খুলে গলে। বেরিয়ে এলেন বৃদ্ধ আবদুল গফুর। তিনি এবং তার স্ত্রী আলিয়া এই ঘরেই থাকেন। প্রাচীরে ঘেরা বিশাল ভেতর বাড়িতে আরও পাঁচটি ঘর রয়েছে। এখানে ছেলেরা থাকে। ভেতর বাড়ির পিছন দিকে প্রাচীরের বাইরে একটু দূরে ভেড়া ও ইয়াকের আস্তাবল। আর দক্ষিণ দিকে প্রাচীরের সাথে মেহমানখানা ও বৈঠকখানা। এর পরেই বাগান, তারপর নদী। বাড়ির অন্য তিন দিক ঘিরে বিস্তৃত ক্ষেত। প্রাচীরের গায়ে মেহমান খানায় যাবার একটা দরজা রয়েছে। এছাড়া রয়েছে বাড়ি থেকে বেরুবার প্রধান ফটক। উত্তর প্রাচীরে আস্তাবলে যাবারও রয়েছে আরেকটা দরজা।
আবদুল গফুরের পর তার স্ত্রী আলিয়াও বেরুলেন ঘর থেকে। দু’জনেই তাহাজ্জুদ পড়েন। তাঁরা অজু করে আবার ঘরে চলে গেলেন। তাহাজ্জুদ নামাযের এই অভ্যাস আবদুল গফুর তাঁর পিতার কাছ থেকে পেয়েছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মত এ নামাযও তাঁর কাজা হয় না। রাতের এই যে তৃতীয় যামে তিনি উঠেন আর ঘুমান না। তাহাজ্জুদ শেষে তিনি বাগানে, নদীর ধারে কিছুক্ষণ বেড়ান। তারপর মসজিদে ফজরের জামায়াতে শামিল হন। চার পাঁচটি বাড়ি পেরিয়ে একটু পশ্চিমে এগুলেই মসজিদ। আগে মসজিদ আবদুল গফুরের বাড়ির সীমার পরেই যেখানে ফাঁকা জায়গাটা সেখানে ছিল। কম্যুনিস্টরা এ গ্রামে ঢোকার পর এ সমজিদ ভেঙে ফেলে। কয়েক বছর পর গ্রামবাসীদের চাপে তদানিন্তন রাজনৈতিক ইউনিয়ন মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দেয়, কিন্তু আগের জায়গায় তা নির্মানের অনুমতি মেলেনি।
প্রতিদিনের মতই তাহাজ্জুদ পড়ে ঘর থেকে বেরুলেন তিনি। কিন্তু নিত্যকার মত সোজা বাইরে না গিয়ে তৃতীয় ছেলে ইকরামভের ঘরের দরজায় দাঁড়ালেন। একটু দাঁড়িয়ে নক করলেন দরজায়। তারপর ডাকলেন ইকরামভ।
অল্পক্ষণ পর ঘর থেকে আওয়াজ এল, জ্বী আব্বা।
উঠ, ভোর হয়েছে নামায পড়।
দু’দিন হলো গ্রীষ্মের বন্ধে বাড়ি এসেছে ইকরামভ ও ফাতিমা ফারহানা। কম্যুনিস্ট যুগের চলমান ধারায় মানুষ ওরা। কিন্তু যত দিন ওরা বাড়িতে ছিল পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য তারা পুরোপুরিই মেনে চলেছে। আরবী শিক্ষার কোন সুযোগ নেই বটে, কিন্তু বাড়িতে ও গ্রামের মক্তবে তারা দোয়া-দরুদ ও কুরআন শরীফ পড়া খুব ছোট বেলাতেই শিখেছে। মসজিদে তারা বেসরকারীভাবে এখনও মক্তব চালায়। প্রথম দিকে কম্যুনিস্ট সরকার এ মক্তব বন্ধ করে দিয়েছিল। সরকারী খাতায় মসজিদটির মত এখনও বন্ধই আছে। জনমতের চাপে স্থানীয় ও আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ গোপনে মক্তবের সম্মতি দিয়েছে।
ইকরামভ ও ফারহানা তাসখন্দ ও মস্কোতে গিয়ে চলমান ধারার সাথে মিশে গেছে বটে, কিন্তু অতীতকে ভুলে যায়নি। বিশেষ করে পিতার প্রতি শ্রদ্ধা ভালবাসা তাদের অপরিসীম। তাই বাড়ি এলে এবং এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে হোস্টেলের নিভৃত কক্ষে তাদেরকে অনেক সময় নামায পড়তে দেখা যায়।
দরজা খুলল ইকরামভ।
ইকরামভকে সালাম দিলেন আবদুল গফুর। লজ্জায় লাল হয়ে গেল ইকরামভ। বলল, মাফ করুন আববা, আমার ভুল হয়েছে।
দেখা হলেই সালাম দেয়া এ সমাজের এক অতি পরিচিত সামাজিকতা। কিন্তু তাসখন্দ, আর মস্কোর সমাজ একে নির্বাসন দিয়েছে। তাই এ ভুল হওয়া স্বাভাবিক। আবদুল গফুর সস্নেহে হেসে বললেন, আল হামদুলিল্লাহ, তুমি অজু কর আমি ফাতিমাকে ডাকি।
ফাতিমা ফারহানাকে ডেকে দিয়ে আবদুল গফুর বেরিয়ে এলেন বাগানে, তারপর গেলেন নদীর ধারে। নদীর তীর থেকে পাথর আর কাদায় গড়া সিঁড়ি নেমে গেছে পানিতে। ঘাটের দু’পাশটা বেড়া দিয়ে আড়াল করা যাতে মেয়েদের কাজ ও গোসল করতে কোন অসুবিধা না হয়।
ঘাটে এসে দাঁড়িয়ে ঘাটের দিকে তাকাতে গিয়ে ঘাটের পূর্ব পাশে বেড়ার দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন আবুদল গফুর। একটা বড় কাঠের বাক্স বেড়ায় আটকে পানিতে দুলছে। এগিয়ে গেলেন আবুদল গফুর। নেমে গেলেন পানির কিনারে। সাত-আট ফিট লম্বা একটা কাঠের বাক্স। ভাঙা, পরিত্যক্ত নয়- একদম নতুন। হাঁটু পরিমাণ পানিতে নেমে তিনি বাক্সটিকে টানলেন। টেনে কিনারে আনলেন। বাক্সের একটা মাথা মটিতে তুললেন। বেশ ভারি।
চলে এলেন আবদুল গফুর। ইকরামভ ও ফাতিমাকে বাক্সটির কথা বলে নামাযে চলে গেলেন তিনি।
নামায পড়ে এসে দেখলেন ওরা ধরাধরি করে টেনে বাক্সটি বাগানে নিয়ে এসেছে। আবদুল গফুর আসতেই ইকরামভ বলল, আব্বা বাক্সটা কম্যুনিজমের বিশ্ব রেড সংস্থা ‘ফ্র’-এর। দেখুন, পাঠানো হয়েছে বোম্বাই থেকে তাসখন্দে। পাঠিয়েছে ভারতস্থ বিশ্ব রেড সংস্থা ‘ফ্র’-এর দুতাবাস।
কিন্তু বাক্সটা এখানে নদীতে এল কি করে?
ফাতিমা ফারহানা বাক্সের গায়ের লেখাগুলো দেখছিল। তখন ফর্সাও হয়ে এসেছে অনেকখানি। একটা লেখা ভালো করে দেখে বলে উঠল, এখানে দেখুন আব্বা, তারিখটা গতকালের।
অর্থাৎ গতকাল বোম্বে থেকে পাঠিয়েছে? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন আবদুল গফুর।
অবাক লাগছে আব্বা! চিন্তাম্বিত স্বরে বলল ইকরামভ।
চিন্তা করছিলেন আবদুল গফুরও। ফাতিমা ফারহানা তখনও বাক্সটি নেড়েচেড়ে দেখছিল। বলল, দেখুন আব্বা, বাক্সের এই মাথায় অনেকগুলো ফুটো।
ফুটো? চমকে উঠলেন আবদুল গফুর।
তারপর তিনি ঝুঁকে পড়ে বাক্সটি ভালো করে পরীক্ষা করলেন। তারপর বাক্সের দৈর্ঘ্যের দিকে আরেকবার নজর করলেন। চোখ বুঁজে মুহুর্তকাল চিন্তা করে বললেন, মনে হয় এর মধ্যে জীবন্ত কোন কিছু আছে, মানুষও হতে পারে।
আঁৎকে উঠল ইকরামভ ও ফাতিমা ফারজানা দুজনেই।
আবদুল গফুর গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ইকরামভ, বাক্সের বাঁধনগুলো কেটে দাও। বাক্স খুলে ফেল।
ইকরামভ বলল, সরকারী বিমানের জিনিস খোলা কি ঠিক হবে?
আমরা কিছুই জানি না, এই খোলাটা সরকারী প্রয়োজনও হতে পারে।
বাক্স খুলছিল ইকরামভ। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল ফাতিমা ফারহান ও আবদুল গফুর। বাক্স খোলা হলো। খুলেই আঁৎকে উঠে দু’পা পিছিয়ে গেল ইকরামভ। বলল, আব্বা মানুষ!
দ্রুত বাক্সটির ওপর ঝুঁকে পড়লেন আবদুল গফুর। সূর্য ওঠার তখনও বেশ বাকী থাকলেও ফর্সা হয়ে গেছে। ভোরের সাদা আলোয় আবদুল গফুর দেখলেন, মুখের অংশটা ছাড়া সর্বাঙ্গ পুরো স্পঞ্জে আবৃত। কালো দাঁড়িতে আবৃত সুন্দর একটি মুখ। চোখটি তার বোজা। নাকে হাত রাখলেন আবদুল গফুর। চোখটি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল, না লাশ নয়। জীবিত মানুষ, জীবিত আছে।
তিনি মুখ তুলে ইকরামভ ও ফাতিমার দিকে চেয়ে বললেন, মানুষটি এখনো বেঁচে আছে। বলে তাড়াতাড়ি স্পঞ্জ তুলে টেনে খুলে ফেললেন। তারপর বললেন একরামভ, এস ধর। একে মেহমান খানায় নিয়ে চল। আর ফাতিমা ফারহানার দিকে চেয়ে বলল, মা তুমি যাও, মেহমান খানার এ দিকের দরজাটা খুলে দাও।
মেহমান খানায় শুইয়ে দিলেন অজ্ঞান যুবকটিকে। ত্রিশ বছরের সুন্দর ও সুঠাম দেহী বলিষ্ঠ যুবক। কপাল ও মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। জলপাই রংয়ের ইউনিফর্ম গায়ে। কোন দেশের কিংবা কোন জাতির পোষাক চিনতে পারলেন না আবদুল গফুর। কিন্তু চুল, রং ও দেহের গড়ন দেখে তার মনে হলো, এই দেশেরই ছেলে সে। একরাশ বিষ্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইকরামভ ও ফারহানার দিকে চেয়ে বললেন, তুর্কিস্তানেরই কোন কবিলার ছেলে আমার মনে হচ্ছে।
হঠাৎ আবদুল গফুরের নজরে পড়ল জামার কলার ব্যান্ডে ক্ষুদ্র একটা মনোগ্রামের মত। ঝুঁকে পড়ে দেখলেন, নতুন এক চাঁদের বুক ভরে জড়ানো অক্ষরে কি যেন লেখা। অক্ষরগুলো মনে হচ্ছে আরবী। চোখ দু’টি তার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ইকরামভকে বললেন, দেখতো কি লেখা এখানে?
ইকরামভ দেখে বল, না আববা, পড়া যায় না। এটা মনে হচ্ছে কোন কিছুর প্রতীক চিহ্ন-মনোগ্রাম। লেখাগুলো আরবি বলে মনে হয়।
ভাবছিলেন আবুদল গফুর। বললেন, একরামভ তুমি বাক্স, স্পঞ্জ সব কিছু বাড়ির ভেতরে নিয়ে গোডাউনে রাখ। কেউ দেখুক আমি চাই না। সরকারী লোকদের কি খবর দেয়া দরকার নয়?
সময় যায়নি ইকরামভ। লোকটার জ্ঞান ফিরে আসুক। সবই জানা যাবে। তখন প্রয়োজনীয় সব কিছুই করা যাবে।
আর কোন কথা না বলে ইকরামভ চলে গেল। আবদুল গফুর মেয়ে ফাতিমার দিকে চেয়ে একটা গাছের নাম বলে দিয়ে বললেন, সাত-আটটা পাতার রস করে নিয়ে এস। এর জ্ঞান ফিরাতে হবে।

ধীরে ধীরে চোখ খুলল আহমদ মুসা! চিৎ হয়ে শুয়েছিল। চোখ দুটি খুলতেই সামনের দেয়ালে গিয়ে চোখ পড়ল। দেয়ালে একটি ছবি টাঙানো-কাবা শরীফের ছবি। চোখ বুজলো আহমদ মুসা। মুহূর্তকাল পরেই আবার চোখ খুললেন। চোখ এবার নিজের উপর। গায়ের ওপর সাদা একটা উলের চাদর, নরম বিছানা। আবার তার চোখ দু’টি গিয়ে পড়ল সেই কাবা শরীফের ছবির ওপর। সেখান থেকে ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলাতে গিয়ে ডান দিকে ঘুরতেই চোখ গিয়ে পড়ল আবদুল গফুরের ওপর। জগতে সব উৎসুক্য নিয়ে উজ্জ্বল চোখে তাকিয়ে থাকা কাঁচা-পাকা চুলের শক্ত সুঠাম পুরুষ। মাথায় কাজ করা টুপি, ঢিলা পোষাক- মধ্য এশিয়ার তুর্কী মুসলমানরে একটা প্রতিচ্ছবি। ভ্রু-কুঁচকে উঠল আহমদ মুসার। পাশেই বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ইকরামভ ও ফাতিমা ফারহানা। আহমদ মুসার চোখ তাদের ওপর দিয়েও ঘুরে এল, ফাতিমা ফারহানার ওপর চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে নিলো আহমদ মুসা। চোখ ঘুরে আবার গিয়ে পড়ল আবদুল গফুরের ওপর।
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ। প্রথমে মুখ খুললেন আহমদ মুসা।
ওয়া আলাইকুমুস সালাম। জবাব দিলেন আবদুল গফুর।
আবার ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল আহমদ মুসা। গ্রামের একটা কুটির বৈ নয়। কাঁচা দেয়াল, কাঁচা মেঝে। ঐ তো দরজা দিয়ে বালু পাথরের কাঁচা উঠান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তাকে তো বাক্সে পুরে বিমানে করে তাসখন্দে আনা হচ্ছিল।
আহমদ মুসা উঠে বসতে যাচ্ছিল। ইকরামভ তড়িৎ এসে আহমদ মুসাকে উঠে বসতে সাহায্য করল। আহমদ মুসা উঠে বসে তার দিকে চেয়ে বলল, শুকরিয়া।
ধন্যবাদ। বলল ইকরামভ।
আহমদ মুসা আবদুল গফুরের দিকে চাইল। তারপর চোখ দু’টি নিচে নামিয়ে বলল, আমি কোথায়? আপনারা কে? কেমন করে আমি এখানে এলাম?
এটা তাজিকিস্তানের একটা পাহাড়ী গ্রাম। বললেন আবদুল গফুর। তাজিকিস্তান! একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ল আহমদ মুসার কন্ঠে। তার চোখ দু’টি বুঁজে এল মুখটিও তার যেন রক্তিমাভ হয়ে উঠল। ঠোঁটেও কেমন যেন একটা কাঁপন।
চোখ দু’টি খুলল সে। হঠাৎ দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার দু’গন্ড বেয়ে। তাড়াতাড়ি মুছে নিয়ে বলল, মাফ করবেন, আমি অভিভুত হয়ে পড়েছি কি করে এলাম এখানে!
নদীতে একটা বাক্স আমরা পেয়েছি। বললেন, আবদুল গফুর।
নদীতে? বাক্স? আজ কয় তারিখ?
৪ঠা সেপ্টেম্বর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত উত্তর দিল ইকরামভ।
তাহলে কি ওরা আমাকে বিমান থেকে ফেলে দিয়েছে, না বিমান ক্রাশ করেছে? আহমদ মুসার একরাশ বিস্ময়।
কি হয়েছে, ঘটনা কি বলুন? বললেন আবদুল গফুর।
গত সন্ধায় ওরা আমাকে বিমানে তুলেছে। আমাকে তাসখন্দে নিয়ে যাবার কথা বলে আমি জানি।
এমন সময় কিসের যেন ক্ষীণ একটা আওয়াজ ভেসে এল। সবাই উৎকর্ণ হল- জমাট বাঁধা একটা আওয়াজ।
অনেকগুলো হেলিকপ্টার এক সাথে উড়ছে। বলল আহমদ মুসা।
সবাই আহমদ মুসার দিকে তাকাল। কিসের আওয়াজ তারা এখনও তা ধরতে পারেনি।
ইকরামভ দৌড়ে বেরিয়ে গলে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, কিছুই দেখা যায় না। ততক্ষণে শব্দও মিলিয়ে গেছে।
হেলিকপ্টারের শব্দ আপনি কি করে বুঝলেন? প্রশ্ন করল ইকরামভ।
আমার কান ভুল না শুনলে ও শব্দ হেলিকপ্টারেরই। শুয়ে পড়তে পড়তে বলল আহমদ মুসা। মাথাটা তার বেদনায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
আপনার পরিচয় কি, কে আপনি? প্রবল উৎসুক্য ঝরে পড়ল ইকরামভের কন্ঠে।
আহমদ মুসা কথা বলার আগে কথা বলে উঠলেন আবদুল গফুর। বললেন, থাক এ প্রশ্ন এখন। উনি অসুস্থ। বলে আহমদ মুসার কাছে সরে এসে নরম গলায় বললেন, অসুস্থ বোধ করছেন?
আহমদ মুসা আবদুল গফুরের দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, আপনাদের পরিচয় জানি না। কিন্তু আপনি আমার পিতার বয়সের। আপনি বলে সম্বোধন করে আমাকে লজ্জা দেবেন না।
চমকে উঠলেন বৃদ্ধ আবদুল গফুর। একটি মুখ তার চোখে ভেসে উঠল, সেই হারানো বড় ছেলে। ঠিক এই বয়সেরই ছিল। ঠিক এমনই ছিল তার সুঠাম শরীর। আনমনা হয়ে পড়লেন তিনি।
কষ্ট দিলাম আপনাকে? বলল আহমদ মুসা।
‘না বাবা’ হঠাৎ মুখ থেকে বেরিুয়ে এল বৃদ্ধের। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বলছিলাম তুমি অসুস্থ বোধ করছ কিনা?
না তেমন কিছু নয়। মাথায় ব্যথা। গায়ে কিছু ব্যথা বোধ হচ্ছে। আবদুল গফুর ফাতিমা ফারহানার দিকে ফিরে বললেন, দেখ গরম পানি হয়েছে কি না, হলে দিয়ে যেতে বল। একটু গরম দুধও আনতে বল।
হঠাৎ আবার সেই শব্দ ভেসে এল। এবার আর ও স্পষ্ট। ইকরামভ ছুটে বেরিয়ে গেল আবার। বৃদ্ধ আবদুল গফুরও উঠানে দিয়ে দাড়ালেন। অল্পক্ষণ পর ফিরে এল সবাই।
আহমদ মুসা ইকরামভের দিকে তাকালো। ইকরামভই কথা বলল প্রথম। বলল, চারটি হেলিকপটার এসে আবার চলে গেল।
চোখ দু’টি বন্ধ হয়ে এল আহমদ মুসার পরিস্কার এখন তাঁর কাছে, বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। অজান্তেই শিউরে উঠলেন তিনি। বিধ্বস্ত বিমান থেকে তাহলে তাঁকে বহনকারী বাক্স নদীতে এসে পড়েছে!
আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করেছেন, তিনি শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন আল্লাহর দরবারে।
সবাই তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। সবাই বুঝছে, ভাবছে আহমদ মুসা, কিছু বলবেন তিনি। আহমদ মুসা চোখ খুললেন। বললেন এ্যারোফ্লোটের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে আশেপাশে কোথাও।
একটু থামলেন আহমদ মুসা। আবদুল গফুর, একরামভ ও ফাতিমা ফারহানা সাবর চোখেই উদ্বেগ ঝরে পড়ল। একটা বিষন্নতা এসে ছড়িয়ে পড়ল সবার চোখে মুখে।
আহমদ মুসা আবার শুরু করলেন, বুঝতে পারছি, ঐ বিমান থেকেই আমাকে নিয়ে বাকা্রটি ছিটকে পড়েছে নদীতে।
‘আ’! করে একটা অস্ফুট শব্দ তুলে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল ফাতিমা ফারহানা। আবদুল গফুর ও ইকরামভের চোখও বিস্ময়ে বিস্ফারিত। কেউ কোন কথা বলতে পারলো না। কথা বললো প্রথম আহমদ মুসাই। বললেন, পাহাড়ে পড়লে কি হত আল্লাহই জানেন। আল্লাহ যাকে রক্ষা করতে চান এভাবেই রক্ষা করেন।
ঠিক বলেছ, আল্লাহর কুদরত বলা ছাড়া এর আর কোন ব্যাখ্যা নেই। বললেন আবদুল গফুর।
এ এক চমৎকার কাহিনী হবে। বলল ইকরামভ।
ফাতিমা ফারহানার চোখ থেকে বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। এ সময় গরম পানি এল। আবদুল গফুর আহমদ মুসাকে বললেন, গরম পানি দিয়ে ভালো করে অজু করে নাও। নাস্তার পরে কথা বলব।
আহমদ মুসা কথা শেষ করলেন। বললেন, কিভাবে কারকভে বন্দী হলেন কিভাবে বোম্বাইয়ে আনা হল, তাসখন্দে তাঁকে চালান দেয়া হচ্ছে কিভাবে। তার সব কিছুই কারকভের বৃদ্ধের কাছে জানলেন।
আবদুল গফুর, একরামভ এবং ফাতিমা ফারহানা উদগ্রীব হয়ে শুনছিল তাঁর কথা। আহমদ মুসার কথা শেষ হয়ে কথা বলে উঠল ইকরামভ। বলল, কিন্তু বিশ্ব রেড সংস্থা ‘ফ্র’-এর সাথে আপনার শত্রুতা কিসের? আপনি কে তা তো বললেন না?
ম্লান একটা হাসি খেলে গেল আহমদ মুসার ঠোঁটে। চাইল ইকরামভের দিকে। শুয়ে শুয়ে কথা বলছিল আহমদ মুসা। উঠে বসলো ধীরে ধীরে। আবদুল গফুর, ইকরামভ ও ফাতিমা ফারহানার তিন জোড়া উৎসুক চোখ আহমদ মুসার ওপর নিবদ্ধ। যেন সবাই জানতে চায় এ প্রশ্নের উত্তর।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে মুখ খুলল। তার শূন্য দৃষ্টি জানালা দিয়ে বাইরে নিবদ্ধ। যেন অতীতের কোন অতলে হারিয়ে গেছে। বলল, কম্যুনিস্টদের বিশ্ব রেড সংস্থা ‘ফ্র’-এর সাথে কোন শত্রুতা আমার নেই। আমি এ সরকারের কোন ক্ষতি করিনি। আমার অপরাধ একটাই, আমি আমার মুসলিম জাতিকে জীবনের জীয়নকাঠির পরশে ঘুম থেকে জাগাতে চেয়েছি, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে তাদের মুক্ত করতে চেয়েছি।
হৃদয়ের কোন তলদেশ থেকে কথাগুলো বেরিয়ে এল। আবেগ ও মমতায় মাখানো শেষের কথাগুলো বড্ড ভারী শোনাল।
তিনজনই কিছুক্ষণ নিরব। ইকরামভই আবার নিরবতা ভাঙল। বলল, আপনার পরিচয় কি, দেশ কোথায়, বলবেন কি?
আহমদ মুসা আবার চাইল ইকরামভের দিকে। ঠোঁটে আবার সেই ম্লান হাসি। বলল, আমার দেশ কোথায়, এ প্রশ্নের উত্তর কোনদিন আমি ভেবে দেখিনি মিঃ ইকরামভ। একটু থামল। তারপর বলল, কোন দেশকে আমার দেশ বলব? আমার কোন দেশ নেই। গোটা মুসলিম বিশ্বই আমার ঘর।
আবদুল গফুর ও ফাতিমা ফারহানার চোখে বিস্ময়। ইকরামভের চোখে তীক্ষ্ণ কৌতুহল।
কিন্তু কথাটা…..। কথা শেষ না করেই থেমে গেল ইকরামভ।
আহমদ মুসা বললো, বিশ্বাস করার মত নয় অবশ্যই, কিন্তু আমার জন্য এটাই বাস্তবতা। জন্ম আমার সিংকিয়াং-এ। তারপর একদিন উদ্বাস্ত্ত হয়ে ছিটকে পড়েছি বাইরে।
থামল আহমদ মুসা।
ফাতিমা ফারহানার মুখটি নিচু। ইকরামভের চোখে আরও অনেক জিজ্ঞাসা। আর বৃদ্ধ আবদুল গফুরের বুকটি তোলপাড় করছে। ফেলে আসা অতীতটা ভেসে উঠেছে তার চোখে। সব হারানো পাহাড় পর্বত, অভিমুখী উদ্বাস্ত্ত সারি চোখ বুজলেই দেখতে পান তিনি। অনেকেই তো সিমান্ত ডিঙ্গিয়ে চলে গেছে আফগানিস্তান, ইরাক, তুরস্ক ও ভারত উপমহাদেশে। তাঁর ছেলে আল্লাহ বকশ। কোথায় সে! বেচে থাকলে সে তো এখনও এমনি ঠিকানাহীন উদ্ধাস্ত্ত। বুকটি মোচড় দিয়ে উঠল বৃদ্ধের। চোখ তুলে তাকালেন আহমদ মুসার দিকে। এমন বয়সেই আল্লাহ বকশ হারিয়ে গেছে। এমনি করে জাতির জন্যই সে ঘর ছেড়েছে, সব ছেড়েছে।
আবার কথা বলল ইকরামভ। বলল সে, থাক, এ বিষয় পরেও জানা যাবে। আপনার নাম কিন্তু এখনও জানতে পারিনি।
সবাই তাকাল আহমদ মুসার দিকে মনে এ প্রশ্নটা সবারই।
আহমদ মুসা। তার নাম জানিয়ে দিল আহমদ মুসা।
নামটা শুনে ফাতিমা ফারহানা কি যেন ভাবল। তার চোখে জিজ্ঞাসা জেগে উঠতে দেখা গেল। মুখটা কিঞ্চিত আরক্ত হল তার। প্রথম কথা বলল সে, জিজ্ঞেস করল, আপনি ফিলিস্তিনে ছিলেন?
আহমদ মুসা তাকাল ফাতিমা ফারহানার দিকে। ফারহানার চোখে চোখ পড়ল। চোখ নামিয়ে নিল আহমদ মুসা।
ছিলাম। বললো আহমদ মুসা।
সাইমুমের সাথে আপনার সম্পর্ক ছিল?
বিস্মিত চোখে চাইলো আহমদ মুসা ফারহানার দিকে। বললো, ছিল।
ফাতিমার ফারহানর চোখেও বিস্ময়। একটা চাঞ্চল্যও তার চোখেমুখে। আবার প্রশ্ন করল ফাতিমা ফারহানাই, আপনি কি ফিলিস্তিন থেকে মিন্দানাও যান?
‘হ্যাঁ, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল আহমদ মুসা।
পিসিডার সাথে সেখানে আপনি কাজ করেছেন?
হ্যাঁ।
ফাতিমা ফারহানা অভিভূতের মত তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে।
তার চোখে যেন জগতের বিস্ময়। আহমদ মুসার বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি।
আপনি এসব জানেন কি করে? বললো আহমদ মুসা।
ফাতিমা ফারহানা একবার ইকরামভের দিকে চেয়ে বলল, সাম্প্রতিক এক সামিজদাদে (সোভিয়েত ইউনিয়নে গোপনে প্রচারিত সাইক্লোস্টাইল করা পত্রিকা) এ সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ আমি দেখেছি।
ইকরামভ ফাতিমার দিকে চেয়ে বলল, আমরা কিন্তু কিছুই বুঝলাম না, ফারহানা!
ফাতিমা ফারহানা একবার আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, আববা, ভাইয়া, ইনি ইসলামী বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার মিন্দানাওয়ের মুসলিম মুক্তি সংস্থা পিসিডার নেতৃত্বে ইনি ছিলেন।
সকলেরই বিস্মিত দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে। আহমদ মুসা বলল, সবই আপনারা জেনেছেন। আরেকটা খবরও আপনাদের দেই। গত পরশু মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জ মুসলমানরা মুক্ত করেছে এবং মুসলমানদের স্বাধীন ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কিন্তু সেখান থেকে ‘ফ্র’ এর হাতে আপনি গ্রেপ্তার হলেন কেমন করে? জিজ্ঞেস করল ফাতিমা ফারহান।
এ বিষয়টা পরিষ্কার করতে হলে আমাকে অনেক কথাই বলতে হয়-বলে আহমদ মুসা কাগায়ানে তার আহত হওয়া থেকে শুরু করে হেলিকপ্টারে জাম্বুয়াংগো থেকে কারকভের শিপে আসা পর্যন্ত ঘটনাগুলো সংক্ষেপে বলে গেল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল ইকরামভ। হঠাৎ প্রধান ফটক থেকে করাঘাতের শব্দ এল। ভ্রু কুঁচকে উঠল আবদুল গফুরের। অসময়ে এমন করে কে এল! সবাইকে ইংগিতে বসতে বলে আবদুল গফুর উঠে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বললেন, দেখে আসি।
অল্পক্ষণ পর ফিরে এল আবদুল গফুর। চিন্তিত দেখা দেল তাঁকে। বসতে বসতে বললেন তিনি, রাজনৈতিক সেক্রেটারী সাহেব এসেছিলেন। দু’টো খবর দিয়ে গেলেন। স্টালিনাবাদ থেকে আবদুল্লায়েভ জানিয়েছে তার আসতে আরও দু’দিন দেরী হবে। উল্লেখ্য আবদুল গফুরের ছেলে আবদুল্লায়েভ এখানকার গ্রাম প্রশাসক সংস্থা বহুমুখী সমবায়ের সভাপতি। একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য দু’দিন আগে স্ট্যালিনাবাদ গেছে। আজই তার ফেরার কথা।
আবদুল গফুর বললেন, দ্বিতীয় খবরটি হল রেডিওতে বলে দেয়া হয়েছে, বিধ্বস্ত বিমানের কোন অংশ কিংবা বিমান থেকে ছিটকে পড়া কোন জিনিস যদি কেউ কোথাও পায় বা দেখতে পায়, তাহলে অবিলম্বে যেন তা নিকটবর্তী কোন সরকারী প্রশাসনকে জানায়।
ইকরামভ এবং ফাতিমা ফারহান দু’জনেই এক সংগে পিতার মুখের দিকে চাইল। তাদের মুখে শংকা। আহমদ মুসার মুখে কোনই ভাবান্তর নেই।
দূর থেকে আকাশে অনেকগুলো হেলিকপ্টার ওড়ার একটা জমাট শব্দ কানে আসছে।
ইকরামভ এবং ফতিমা ফারহানা তাদের আব্বার ঘরে বসে। আবদুল গফুর বাড়ির সবাইকে তার ঘরে ডেকেছেন। অন্য কেউ এখনও পৌঁছায়নি। মেঝেয় ভেড়ার পশমে হাতে বোনা কার্পেট। এ কার্পেটেই বসেছে ইকরামভ এবং ফাতিমা ফারহানা।
ইকরামভ ফাতিমাকে প্রশ্ন করল, যে সামিজদাদের কথা তুই ওখানে বললি, তা পেয়েছিলি কোথায়? ওগুলো তুই পড়িস নাকি?
ফাতিমা ইকরামভের দিকে এক পলক চেয়ে একটু হেসে বলল, কেন, পড়তে দোষ কি? আর পাওয়ার কথা বলছ, মস্কো ইউনিভার্সিটির মুসলিম ছাত্র মহলে ওটা নিয়মিতই বিলি হয়। কে বিলি করে কোনদিন দেখেনি, জানিনা। আংগুলে গোনা দু’চারজন ছাড়া সব মুসলিম ছাত্র ছাত্রীই এ সামিজদাদ গোপনে গোপনে পড়ে। তুমি তাসখন্দে এটা কখনও পাওনি, ভাইয়া?
দেখেছি। কিন্তু আমি ওগুলো পড়ি না। ধরা পড়লে জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। গতে মাসেই তো দু’জন ধরা পড়ল! ওদের সংশোধন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সংশোধন না হলে চিরদিনের জন্য সাইবেরিয়ার দাস শিবিরে যেতে হবে।
একটু থামল ইকরামভ। তারপর আবর বলল, তুই এগুলো পড়া এখন থেকে বাদ দিবি। ধরা পড়লে আর রক্ষে থাকবে না।
কিন্তু ভাইয়া, এ ভয়টা যত বাড়ছে, ঐ সামিজদাদের জনপ্রিয়তা ততই বাড়ছে। এখন এ সামিজদাদের জন্য মুসলিম ছাত্র ছাত্রীরা অধীর ভাবে অপেক্ষা করে। আমি এমন অনেক মুসলিম স্যারকে জানি যারা এ সামিজদাদ পড়েন।
অন্যে যাই করুক তুই এসব পড়িস না।
তুমি ভেব না ভাইয়া আমি এ ব্যাপারে খুব সাবধান আছি। আমি কখনও কোনদিনই কারো সামনে এটা পড়ি না, কারো কাছ থেকে নিই না।
কেমন করে ওগুলো তোর কাছে আসে?
আসে না, আমি প্রতিমাসের পনের তারিখে লাইব্রেরীর নির্দিষ্ট একটা বইয়ের মধ্যে পাই। আমি পড়ে ওখানেই রেখে আসি।
অদ্ভুত ব্যাপার!
অদ্ভূতই ভাইয়া, একটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।
আমি তো এত কিছু খেয়াল করি না!
করবে কেমন করে, পড়ার বাইরে কি তুমি কিছু বুঝ?
বুঝে লাভ নেই। বেশী বুঝার ভালো পরিণতি আমি দেখি না।
অর্থাৎ?
আমি তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি দু’বছর। এই দু’বছরে আমার জানা মতেই দু’শ মুসলিম ছাত্র হারিয়ে গেছে যাদের খোঁজ কেউই কোনদিন পায়নি। আর জেল ও সংশোধন ক্যাম্পে যাদের পাঠানো হয়েছে, তাদের সংখ্যা আরও বেশি।
ভাইয়া একটা কথা বলতো, এমন অত্যাচার দিয়ে গতি শীল কোন কিছুর অগ্রগতি কি রোধ করা যায়?
আমি এতকিছু বুঝি না, বুঝতে চাই না ফারহানা। তোর প্রশ্নের জবাব আহমদ মুসা ভালো দিতে পারবেন। একটু থামল ইকরামভ। তারপর বলল, আচ্ছা ফারহানা লোকটাকে তোর কি মনে হয়?
তুমি আমি তার সম্পর্কে যা ধারণা করছি, তার চেয়ে তিনি অনেক-অনেক বড়। সামিজদাদ পত্রিকায় তাকে বিশ্ব মুসলিম মুক্তি সংগ্রামের নেতা হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। তিনি ফিলিস্তিন এবং মিন্দানাওয়ে যা করেছেন তাতে আমেরিকা ও আমাদের সরকারের পিলে চমকে গেছে বলতে হবে। তার নার্ভটা দেখ? আব্বার বলা দ্বিতীয় খবরটা শুনে আমরা শংকিত হয়েছিলাম, কিন্তু দেখছ তো তাঁর চোখের পাতাটাও নড়েনি!
এ সময় আবদুল গফুর ঘরে ঢুকলেন। ইকরামভ ও ফাতিমা ফারহানাকে দেখে বললেন, তোমরা এসেছ, বেশ। যাও, তোমাদের মা আর ভাবীকে ডাক।
সবাই এসে প্রশস্ত মেঝের কার্পেটে আসন নিয়েছে। আবদুল গফুর একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসেছেন আর সবাই তার সামনে।
সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবদুল গফুর বললেন, আমাদের পিতা-পিতামহরা কোন সমস্যা দেখা দিলে সিদ্ধান্ত নিতেন গোত্রের সবাইকে ডেকে পরামর্শ করে। কিন্তু এখন সেদিন নেই। কোন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার প্রকৃতপক্ষে কোন স্বাধীন ক্ষমতাও আমাদের সমাজের নেই। সে যাক আজ আমি এক সমস্যায় পড়েছি। তোমাদের পরামর্শ চাই। জিয়াউদ্দিন, আবদুল্লায়েভ ওরা কেউ নেই। আবদুল্লায়েভ থাকলে খুবই ভাল হতো। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করার উপায় নেই।
থামলেন আবদুল গফুর। তারপর আবার শুরু করলেন, আকস্মিক ভাবে আমরা একজন মেহমান পেয়েছি। মেহমানকে কেমন করে পেলাম তোমরা জান। এখন সমস্যা দাঁড়িয়েছে সরকারী নির্দেশ অনুসারে এখনি তাকে সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে, অন্যদিকে তাকে সরকারের হাতে তুলে দেয়ার অর্থ তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া। বিপদ হল, তাকে সরকারের হাতে তুলে না দিলে এটা প্রকাশ হয়ে পড়লে যেমন আমাদের পরিবারের ওপর বিপদ আসবে, তেমনি মেহমানকে, অর্থাৎ যে আমাদের শুধু মুসলিম ভাই নয়, যাঁর গোটা জীবনটাই কওমরে জন্য বিলিয়ে দেয়া, তাকে শত্রুর হাতে তুলে দেয়া আমাদের ঐতিহ্য ও ঈমানের দিক দিয়ে চরম দায়িত্বহীনতা হবে। এখন তোমরা চিন্তা করে বল, কোন সিদ্ধান্ত আমরা নেব। সবাই নিরব। সবাই মাথা নিচু করে ভাবছে যেন।
প্রথম মাথা তুলল ইকরামভ। সবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, আব্বা যদিও মেহমানের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও দুর্বলতা আছে, তবু তাকে সরকারের হাতে তুলে দেয়াই সংগত। সরকারের কাস্টোডি থেকেই আমরা তাকে পেয়েছি, আবার সরকারের কাছেই আমরা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি, এতে অন্যায় কিছু আমাদের জন্য নেই। এটা না করলে আমাদের পারিবারিক বিপদের যে আশংকা আছে, তার ঝুঁকি আমরা নিতে পারি না।
থামল ইকরামভ। আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। এবার কথা বলল ফাতিমা ফারহানা। বলল সে, মেহমানের পরিচয় না জানলে ভাইয়া যা বলেছেন তা করা যেত, কিন্তু তাঁর যে পরিচয় আমারা পেয়েছি তাতে তাঁকে সরকারের হাতে তুলে না দিয়েও কি করে আমরা আমাদের পরিবারকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারি সেটাই আমাদের দেখা দরকার।
এবার কথা বলল আবদুল্লায়েভের স্ত্রী আতিয়া। বলল সে, সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদেরকে বাস্তববাদী হতে হবে। এই সরকারের আইন আমাদের ভাল লাগুক বা না লাগুক, তার নির্দেশ আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক, আমরা কিন্তু সবই মেনে চলছি। কারণ এ আদেশ অস্বীকার করার শক্তি আমাদের নেই। এ ক্ষেত্রেও তাই, সরকারী আদেশ লংঘন করার কোন সামর্থ্য ও সুযোগ যেহেতু আমদের নেই, তাই সরকারী আদেশ মানাই ভাল।
আবদুল গফুরের স্ত্রী স্বামীর দিক চেয়ে বললেন, যেটা ন্যায়ত হয়, সেটাই করুন।
মাথা নিচু করে ভাবছেন আবদুল গফুর। সবাই নিরব। এক সময় মাথা তুললেন তিনি। কথা বললেন। স্থির এবং ধীর কন্ঠ তাঁর।
তোমাদের কথা শুনলাম! তোমরা বলেছ, যুবকটিকে আমরা সরকারের কাস্টোডি থেকে পেয়েছি, কথাটা ঠিক নয়। সে ‘ফ্র’-এর কাস্টোডিতে ছিল। সুতরাং তাকে সরকারের হাতে না দেয়ায় দোষ নেই। তারপরও আমি বিষয়টা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কিন্তু মেহমান যুবককে সরকারের হাতে তুলে দেবার চিন্তা যতবারই করতে গেছি, গোটা সত্তা আমার যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। যুবকটি আমাদের জাতির এক অতি মূল্যবান সম্পদ বলেই শুধু নয়, আমি ওর মধ্যে আমাদের আল্লাহ বকশকে খুঁজে পেয়েছি। বেদ্বীন শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ না করে আমাদের আল্লাহ বকশ তো জাতির জন্য এই যুবকটির মত করেই ঘর ছেড়েছে, সুখ-শান্তি সব বিসর্জন দিয়ে হারিয়ে গেছে অনিশ্চিত অন্ধকারে।
বলতে বলতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল বৃদ্ধের। থামলেন তিনি। তাঁর দুচোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
কারও চোখ শুষ্ক নেই। সবার চোখেই পানি। আল্লাহ বকশ এ বাড়ির বড় আদরের সন্তান। এ গ্রামে হিজরত করার পর এ বাড়ির প্রথম সন্তান সে। আবদুল গফুরের পিতা গ্রামের নাম রেখেছিলেন আল্লাহ বকশ। এ গ্রামে এসে প্রথম পাওয়া নতিরও আদর করে নাম রাখেন আল্লাহ বকশ। দুঃসাহসী স্বাধীনচেতা যুবক আল্লাহ বকশ আল্লাহ ছাড়া অর কোন কিছুকেই ভয় করত না।
রুমালে চোখের দু’কোণ মুছে নিয়ে আবর শুরু কররেলন আবদুল গফুর, পরিবারের বিপদের কথা আমিও চিন্তা করেছি। একটা সামাধানও বের করেছি। আমি যুবককে নিয়ে চলে যেতে চাই। পাহাড়ের ওপাশেই তো আফগানিস্তান। তোমরা জান, সীমান্তের এপারেও আমাদের তাজিক, কিরঘীজ, উজবেক ও তুর্কমেন এলাকায় অনেক মুজাহিদ ঘাঁটির পত্তন হয়েছে। একটা আশ্রয় আমরা খুজে পাবই। ‘ফ্র’ এ ঘটনার কখনও খোজ পেলে তোমরা বলে দিও, আমার সাথে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই।
‘আব্বা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল ফাতিমা ফারহানা।
ইকরামভ উঠে গিয়ে তার আব্বার হাত ধরে বলল, আব্বা আমাকে মাফ করুন। আমি আল্লাহ বকশের ভাই। কি করতে হবে আমাকে আদেশ করুন।
ইকরামভের দু’গন্ড বেয়ে নামছে অশ্রু ধারা। ঠোঁট দুটি তার দৃঢ় সংবদ্ধ। চোখে শপথের দীপ্তি।

আহমদ মুসা গভীর মনোযোগের সাথে মধ্য এশিয়ার একটি মানচিত্র দেখছিলেন। বেশ একটু রাত হয়েছে তখন। হারিকেনের হালকা আলো ঘরে। আহমদ মুসার হাতে একটি স্কেল। মাঝে মাঝে মেপে দেখছিলেন মানচিত্রের বিভিন্ন অংশ।
ফাতিমা ফারহানা একটা ট্রেতে এক গ্লাস গরম দুধ এবং কিছু ঔষধ নিয়ে ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। আহমদ মুসা টের পায়নি। মানচিত্রের ওপর ঝুঁকে আছে তাঁর মুখ। মুখটা হরিকেনে আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসার এই মনোযোগ ভাঙতে দ্বিধা করছিল ফাতিমা ফারহানা। কিন্তু আব্বা বলে গেছেন ঠিক সময়ে ঔষধ খাওয়াতে। ফাতিমা ফারহানা একটু শব্দ তুলে ট্রেটা টেবিলে রাখল। চমকে মুখ তুললেন আহমদ মূসা।
মাফ করবেন, বিরক্ত করলাম। ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে। বলে দুধের গ্লাস এবং ঔষধ আহমদ মুসার দিকে এগিয়ে দিল ফারহানা।
আহমদ মুসা নিতে নিতে বললেন, ইকরামভ কোথায়?
বাইরে।
আপনার আব্বা?
জনাব, আপনি আমাকে ‘তুমি’ বললে খুশী হব। একটু থেমে ফারহানা বলল, কম্যুনিটি অফিস থেকে আব্বাকে ডেকে পাঠিয়েছে, তিনি সেখানেই গেছেন।
তারপর দু’জনেই চুপ। আহমদ মুসা ঔষধ খেয়ে নিলেন। আবার কথা বলল ফারহানা। বলল, মানিচত্র দেখেই কি আপনি এ অঞ্চলটা চিনে নিতে পারবেন?
যাতে পারি সে জন্যই দূরত্ব সম্পর্কে নতুন করে জানতে চেষ্টা করছি।
একটু প্রশ্ন করতে চাই।
কর।
আপনি তো ইচ্ছার বিরুদ্ধে এদেশে এসেছেন? কেমন বোধ করছেন?
কে বলল আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে এসেছি?
আপনি তো বন্দী হয়ে, এদেশে এসেছেন!
বন্দী হয়ে এসেছি বটে, কিন্তু হতে পারে তো তাদের দিয়ে আল্লাহ আমার মনের একান্ত আকাংখাই পূরণ করেছেন!
বুঝলাম না। আপনি কি তাহলে আপনার কর্মক্ষেত্র হিসাবে এদেশকে বেছে নিয়েছেন? গলাটা যেন একটু কেঁপে উঠল ফারহানার।
আল্লাহ রাববুল আলামীনের ইচ্ছা বোধ হয় তাই।
ফাতিমা ফারহানার গোটা শরীরে শিহরণ খেলে গেল। তার স্মরণ হলো ফিলিস্তিনের কাহিনী, মিন্দানাওয়ের কাহিনী, সেই সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতুল শক্তিধর এখানকার কম্যুনিস্ট বিশ্ব রেড সংস্থা ‘ফ্র’ এর বিশাল বীভৎস চেহারা। অন্তর কেঁপে উঠল ফারহানার। তার মুখে কোন কথা নেই।
আহমদ মুসা বলল, ভয়ের কিছু নেই ফারহানা। প্রতিটি কান্নার একদিন শেষ আছে। অনেক বছর ধরে এখানে মুসলমানরা কাঁদছে। কাঁদছে আর্তনাদ করছে এই পামির। আমুদরিয়া, শিরদরিয়ায় দেখবে তারই চোখের পানি। এ কান্নার ইতি হবে, হতেই হবে। নিরস্ত্র আফগানদের সাহস এবং সংগ্রাম আজ এরই শুভ বার্তা বয়ে এনেছে।
হাতের স্কেলটা দিয়ে মানচিত্রের ওপর আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছিলেন আর মাথা নিচু করে অনেকটা স্বগতঃ কন্ঠেই ঐ কথাগুলো বলছিলেন আহমদ মুসা। মনে হচ্ছিল হৃদয়ের কোন তলদেশ থেকে তার কথাগুলো উঠে আসছিল। ফারহানার কাছে কথাগুলো শুধু নতুন নয়, বিস্ময়কর নয়, যেন অপার্থিব একটা ব্যাপার। সে বলল, ভয়ের চেয়ে আমার কাছে বড় সম্ভাবনার ব্যাপারটা। সম্ভব কি আসলে?
তোমাদের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস আদালত, কলকারখানা ও কলেজগুলোতে মুসলিম তরুন, যুবক ও বৃদ্ধদের বুকে কান পেতে তাদের হৃদয়ের কথাগুলো শোন, তাহলে যাকে অসম্ভব মনে করছ তা অসম্ভব মনে হবে না।
আপনি এত সব জানেন কি করে? ফতিমা ফারহানার চোখে এক মুগ্ধ ঔজ্জ্বল্য।
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় ঘরে ঢুকলেন আবদুল গফুর।
আব্বা, আপনি কম্যুনিটি অফিস থেকে আসছেন? জিজ্ঞেস করল ফারহানা।
‘হ্যাঁ’ বলে চেয়ারে এসে বসলেন। বসতে বললেন ফারহানাকেও। ‘হ্যাঁ, অফিস থেকে এলাম, বলে একটু থামলেন। তারপর শুরু করলেন, আবার খবর এসেছে ওরা আগামী কাল নদী ও আশপাশের গ্রামগুলো সার্চ করবে।
আবদুল গফুরের মুখ শুকনো। ফাতিমা ফারহানার মুখটাও মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে গলে। ইকরামভও ঘরে ঢুকল এ সময়। সেও এসেই আব্বার কাছে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা জানল।
আহমদ মুসা শান্ত স্বরে বলল, বাক্স অথবা বাক্সের মধ্যকার লাশ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বস্তি পাবে না, এটা আমি জানি।
আহমদ মুসা মুহুর্ত থামল। সবার চিন্তাকাতর ও মলিন মুখের দিকে একবার চাইল, তারপর বলল, আমার উপস্থিতি আপনাদের ক্ষতি করবে, ক্ষতি করতে পারে এ মুসলিম জনপদেরও, আমার বোধ হয় এটা চাওয়া ঠিক নয়।
আহমদ মুসার এ কথা শুনে চমকে উঠলেন আবদুল গফুর। আরো অন্ধকার হয়ে গেল ফাতিমা ফারহানার মুখ।
আবদুল গফুর বললেন, তোমার কথা এখনও কেউ জানতে পারেনি। আর যা ঘটবার তাতো ঘটবেই। অতীতে অনেক কিছু ঘটেছে আমরা ঠেকাতে পারিনি বাবা।
না তা হয় না, মুসলমানদের জীবন ও সম্পদকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করি। এর ক্ষতি যতটা এড়ানো যায়, সেটাই আমাদের দেখা দরকার।
পরাধীনতার গ্লানি বহন ছাড়া এ জীবনের আর কি মূল্য আছে। এ জীবনের নিরাপত্তা চিন্তা করে কি হবে। আল্লাহ বকশের মত করে তোমাকে চলে যেতে আমি দেব না মনে রেখ।
আবদুল গফুরের শেষের কথাগুলো আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল।
আপনার স্নেহ আমাকে অভিভুত করেছে জনাব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি চলে যাবার জন্য আসিনি। আমি স্থান পরিবর্তন করতে চাচ্ছি মাত্র।
এ কথা তুমি ঠিক বলছো বাবা?
জি হ্যাঁ।
আবদুল গফুর মাথায় জড়ানো রুমালের কোণা দিয়ে চোখের কোণ মুছে নিল। তারপর বললেন, এবার বল তোমার বৃদ্ধ পিতাকে কি করতে হবে।
আহমদ মুসা ভাবছিল। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে বলল, আমার কয়েকটি অনুরোধ। নদীর যেখানে আপনারা বাক্সটি ওপরে তুলেছেন, সেখানে নদীর নরম মাটির ওপর বাক্সের দাগটা মুছে ফেলবেন এবং সেখানে কিছু আবর্জনা ফেলে জায়গাটা ঢেকে দেবেন। আর আমি চলে যাবার পর এই ঘরে খাট, দরজা মেঝে ধুয়ে দেবেন যাতে কোথাও আমার হাত-পায়ের ছাপ না থাকে। বাক্সটা পুড়িয়ে দিয়েছেন, আমার পোষাকটাও পুড়িয়ে দেবেন। আমি জানি, এত কিছুর দরকার হবে না। ওদের উপগ্রহ ক্যামেরা যদি বাক্সের লোকেশন নির্দিষ্ট করতে পারতো, তাহলে এই সার্চ করার খবর গ্রামবাসীদের তারা জানাতো না, আকস্মিক এসে হানা দিত। তবু সাবধান হওয়া ভাল।
সবাই তাকিয়ে ছিল আহমদ মুসার দিকে। আবদুল গফুরের অন্তরের বেদনা তার চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে। ইকরামভ ভাবছে, ছোট খাট ব্যাপারেও কি অদ্ভুত দূরদৃষ্টি! অন্যের নিরাপত্তা প্রশ্নেও কত সতর্ক! তার চোখে সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার একটা আমেজ। দরজার চৌকাঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ফাতিমা ফারহানা। বাতাসে এক গোছা চুল এসে তার বাঁ চোখের একাংশ ঢেকে দিয়েছে। তার একটা আঙুল অস্থিরভাবে ওড়নার কোণাটা পেঁচাচ্ছিল, আবার খুলছিল।
আহমদ মুসা আবার কথা বলল, আজ রাতেই আমি যেতে চাই।
আজ রাতেই? শুষ্ক কন্ঠে বললেন আবদুল গফুর।
জি হ্যাঁ, আজ রাতেই।
কিন্তু তুমি তো অসুস্থ।
ও কিছু না, ভাববেন না আপনি। ঈষৎ হেসে বললো আহমদ মুসা।
মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল আবদুল গফুরের। বোঝা গেল ভাবছেন তিনি। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে স্বগত বললেন, কোথায় যাওয়া যায়। ইকরামভের দিকে ফিরে বললেন, পিয়ান্দজ নদীর উপত্যকায় আমাদের পুরোনো বসতিতে যাওয়া যায়, কি মনে কর?
যাওয়া যায়, কিন্তু ওখানে সরকারী চোখ বড় বেশী সক্রিয় আব্বা।
ঠিক বলেছ- বলে আবার ভাবনায় ডুবে গেলেন আবদুল গফুর।
এবার নিরবতা ভাঙলো আহমদ মুসা। আহমদ মুসা বললো, হোজা ওবি কাম মাজার এবং হিসার দুর্গের পবিত্র স্থানে আপনারা কখনো গেছেন?
চমকে মাথা তুললেন আবদুল গফুর! বললেন, তুমি চেন কেমন করে?
চিনি না, জানি মাত্র।
তুমি ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। হিসার দুর্গের মোতাওয়াল্লী মোল্লা আমীর সুলাইমান আমার পরিচিত। আমি ওখানে গেছি। ওখানকার মুসলিম জনপদটা বেশ বড়। বেচারা আমীর সুলাইমান বছর খানেক আগে ছ’মাস জেল খেটেছেন। স্থানীয় কলখজই অনেক বলে কয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে এনেছে। ওখানে যাওয়া যায়।
কথাগুলো লুফে নিচ্ছিল আহমদ মুসা। আবদুল গফুরের কথা শেষ হতেই বলল, কেন জেল খেটেছেন? সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য?
হ্যাঁ, তাই।
ঠিক আছে, ওখানেই যাওয়া ঠিক হলো।
আবদুল গফুর ইকরামভের দিকে চেয়ে বললেন, তুমি গিয়ে দুটো ইয়াক তৈরী রাখতে বল, আমরা রাত ১২টায় যাত্রা করব।
আহমদ মুসা মুহুর্ত দ্বিধা করল তারপর বলল, দুটো ইয়াক কেন?
একটা আমার ও একটা তোমার জন্য।
কিন্তু আমাকে একাই যেতে হবে তো।
বিস্ময়ে হা হয়ে গেল আবদুল গফুরের মুখ। একাই যাবে? রাস্তা চিনবে কি করে? তার ওপর রাতে। আর আমরা একা তোমায় ছাড়ব কেন?
অসুবিধা হবে না। পামির পথ ধরে আমাকে ৫০ মাইল পূর্বে যেতে হবে, তারপর নিচে উপত্যাকার দিকে মাইল পঞ্চাশেক।
আবদুল গফুর অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আহমদ মুসার দিকে। ধীরে ধীরে বললেন, ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি আহমদ মুসা। তুমি আর দশজনের মত নও। কিন্তু আমরা তোমাকে একা ছাড়ব কেমন করে, কিভাবে বুঝাব মনকে?
আবদুল গফুরের চোখে অশ্রু টলমল করে উঠল।
আহমদ মুসা আবদুল গফুরের হাত ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আজ যে কারণে গ্রাম থেকে সরে যাচ্ছি, ঠিক সে কারণেই আপনাদের কাউকে আমি সাথে নিচ্ছি না। আগামী কয়েকদিন ওরা পাহাড় এলাকা ঘিরে রাখবে, যাতে কেউ কিংবা কিছু বাইরে যেতে না পারে। আমার সাথে যদি আপনারাও তাদের চোখে পড়ে যান, তাহলে আপনার গোটা বসতির ওপরই বিপদ আসবে।
আবুদল গফুর রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, বুঝতে পারছি, তুমি কত বড়, বাবা। আল্লাহ তোমাকে বিজয়ী করবেনই। কিন্তু বাবা তুমি আমাদের নিরাপত্তার কথা যতটা ভাবছ নিজের কথা কিন্তু ততটা ভাবছ না।
আহমদ মুসার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। বলল, আমি বড় কিছু নই, আমি মুসলিম সমাজের সেবক মাত্র। দোয়া করুন আমার জন্য। আর নিরাপত্তার কথা? আমার জ্ঞান ও বিবেক অনুসারে কাজ করব, বাকিটা আল্লাহ দেখবেন।
ফাতিমা ফারহানা দু’হাতে চৌকাঠ ধরে যেন তার সাথে মিশে গেছে। স্বপ্নের সম্মোহনকারী এক দৃশ্য দেখছে যেন সে। রুপকথার এক নায়ক যেন সামনে উপস্থিত।
মেহমানখানার পাশে আবদুল গফুর ও ইকরামভ ইয়াক সাজিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। গ্রাম তখন গভীর ঘুমে অচেতন। কোন আলো নেই কোথাও। কেবল আবদুল গফুরের মেহমান খানায় আলো জ্বলছে। ফাতিমা ফারহানা একটা ব্যাগে রুটি, অনেকগুলো পনির ও ফলমূল সাজিয়ে নিয়ে মেহমান খানায় ঢুকল। আহমদ মুসা তৈরী। তিনি ঐতিহ্য বাহী তাজিক পোষাক পরেছেন। মাথায় তাজিকদের কাজকার ঐতিহ্যবাহী টুপি। টুপিটা ব্যান্ডেজকে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে।
ফাতিমা ফারহান তাকে বলল, চলুন। দু’জনে মেহমান খানার বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে পথ চলছিল।
ফারহানা বলল, একটা প্রশ্ন করতে পারি?
কর। বলল আহমদ মুসা।
আপনার কে কে আছে, পিতামাতা ভাই বোন কিংবা…..
একট আড়ষ্টতা এসে ফাতিমা ফারহানাকে কথা শেষ করতে দিল না। অন্ধকার না হলে দেখা যেত তার মুখ লাল হয়ে উঠেছে।
আহমদ মুসা বুঝল, ফারহানার পরবর্তী শব্দটা কি যা উচ্চারণ করতে পারল না। আহমদ মুাসর ভ্রুটা কুঞ্চিত হয়ে উঠল। জবাব দিল, নেই।
একটা অনুরোধ করতে পারি?
কর।
আপনার পোষাকটা আমি না পুড়িয়ে রেখে দিতে চাই।
কেন? আগের মত ভ্রুটা কুঁচকে গেল আহমদ মুসার।
এটা একটা স্মৃতি, একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে পিসিডার অধিনায়কের এই পোষাকের।
যারা নেতাদের যাদুঘরে সংরক্ষন করে, তাদের জন্য এটা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা ইসলামের অনুসারীরা ভিন্ন পথের যাত্রী। এখানে ব্যক্তির কোন মূল্য নেই, আসল হলো তার কাজ এবং শিক্ষা। তাই এখানে ব্যক্তি সংরক্ষিত হয় না, অব্যাহত রাখা হয় তার ভালো কাজ ও শিক্ষাকে।
অন্ধকারেই একবার চোখ তুলে চাইল ফাতিমা ফারহানা আহমদ মুসার দিকে। ভাবল, এই ব্যক্তি যে কত বড় তার ক্ষুদ্র জ্ঞান তা আন্দাজই করতে পারে না। একটা আনন্দ, তারই পাশে একটা অপরিচিত বেদনাও টন টন করে উঠল তার হৃদয়ে।
দুজনে অন্ধকারে পথ চলছিল আবদুল গফুর ও ইকরামভ যেখানে ইয়াক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে দিকে। কিছুক্ষণ দু’জনেই নিরব। এই নিরবতা ভেঙে ফাতিমা ফারহানাই আবার জিজ্ঞেস করল, আমার জন্য আপনার কোন নির্দেশ আছে?
হঠাৎ এ প্রশ্নে বিব্রত বোধ করল আহমদ মুাসা। কাউকে কোন নির্দেশের চিন্তাই সে করেনি। ফাতিমা ফারহানাকে কি বলবে আহমদ মুসা? অথচ প্রশ্নটা তার সঙ্গত। এতে খুশিই হল আহমদ মুসা। বলল, খুশী হলাম ফারহানা এদেশে প্রথম তুমিই পাশে এসে দাঁড়ালে। তবে নির্দেশ দেয়ার সময় এখনও আসেনি।
আনন্দে-গর্বে ফাতিমা ফারহানার ছোট্ট হৃদয়টি যেন ফুলে উঠল। শুকরিয়া জানাতে ইচ্ছা হল তার। কিন্তু মুখ খুলতে পারলো না হঠাৎ করে। আরো কিছুক্ষণ পর ফাতিমা ফারহানা বলল, ছুটি শেষ হলে আমাকে মস্কো যেতে হবে, তারপর আপনাকে কোথায় পাব?
এর উত্তরে আমি এখন দিতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমার কথা তোমাদের কাছে পৌঁছবে।
দু’জনেই এসে পৌঁছল ইয়াকের কাছে। তারপর ইয়াকসহ চারজন এগিয়ে চলল গ্রামের প্রান্ত সীমায়। দাঁড়াল সেই সরু পথটির মুখে যা গিয়ে মিশেছে পামির সড়কের সাথে।
তাঁবু-কম্বলসহ একজনের জন্য যা প্রয়োজন তা দিয়ে ইয়াক সাজানো। ইয়াকের লাগাম আহমদ মুসার হাতে তুলে দিতে দিতে আবদুল গফুর বললেন, আমাদের ভুলে থেকো না। এই বাড়ি, এই বাড়ির সবকিছু তোমার নিজের মনে করবে। কাঁপছিল বৃদ্ধের কথাগুলো।
আহমদ মুসা বলল, আমি আপনাদের কথা, এই নিরাপদ আশ্রয়ের কথা ভুলবো না। আমি সুযোগ পেলেই আসব। আমার জন্য দোয়া করুন। তারপর আহমদ মুসা ইকরামভের দিকে একটু এগিয়ে তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ভাই ইকরামভ, তোমাদের কাছে জাতির অনেক দাবী। জাতির এ দাবীর কথা কখনও ভুলো না।
কেঁদে ফেলল ইকরামভ। বলল, আল্লাহ বকশের ভাই আমি, আমাকে আপনার সাথে নিন।
ইকরামভের কপাল চুম্বন করে বলল আহমদ মুসা, ভেব না ভাই, আল্লাহ আমার সাথে আছেন।
ফারহানা তার পিতার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিকে একটু এগিয়ে আহমদ মুসা বলল, আসি ফারহানা। বলে আহমদ মুসা ইয়াকে উঠে বসল। লাগাম টেনে ইশারা করল ইয়াককে। দুলে দুলে ধীরে যাত্রা শুরু হল ইয়াকের। অল্পক্ষণই কালো অন্ধকারের বুকে হারিয়ে গেল ইয়াক।
সবারই চোখে পানি। ফাতিমা ফারহানা বসে পড়েছিল মাটিতে। আবুদল গফুর গিয়ে তার মাথায় হাত রাখতেই কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। আবদুল গফুর তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, কাঁদিস না মা, আমাদের চেয়ে তুই তো তাকে বেশী জানিস?



হাসান তারিক এখন ছোট্ট একটা সেলে। একটা দরজা এবং অনেক ওপরে একটা ছোট্ট জানালা ছাড়া আর ফুটো নেই ঘরে। মেঝেতে পাতা এক কম্বল ছাড়া আর কোন উপকরণ নেই! সেদিন লাইব্রেরী থেকে ফিরে আসার পর তাকে এখানে সরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি জানেন সর্বোচ্চ শাস্তি যাদের বরাদ্দ করা হয়, তারাই এসব সেলে আসে। ভিকটরের সাথে আগের মত কথা আর হয় না। দরজার গায়ের ছোট্ট জানালা খুলে সে খাবার দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, শরীর ভাল তো স্যার! ভিকটরের চোখটাকে তখন বড় বিষন্ন দেখায়। শুকনো রুটি, শুকনো কয়েক টুকরো গোশত তার দু’বেলার জন্য বরাদ্দ। নাস্তা তিনি আর পান না। গোশত হালাল হতে নাও পারে মনে করে গোশত তিনি নেন না, শুধু রুটিই খান। ভিকটর সেই ফুটো দিয়ে চোখে একরাশ মিনতি নিয়ে বলে, স্যার এভাবে খেলে তো আপনার শরীর থাকবে না।
কম্বলে বসে একটি চিঠি পড়ছিলেন হাসান তারিক। চিঠিটা কয়েক বার পড়েছেন। আবারও পড়ছেন। আজ দুপুরে খাবারের প্যাকেটে এই চিঠি পেয়েছেন। দুই রুটির মাঝখানে অতি সাবধোনে চিঠিটি লুকিয়ে রাখা ছিল। চিঠির নিচে কারো নাম নেই। তবে সম্বোধন ও সব মিলিয়ে বুঝা যায় চিঠিটি ভিকটরের কাছ থেকেই এসেছে।
চিঠি পড়ে প্রথমে স্তম্ভিত হয়েছেন, তারপর আনন্দিত হয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে আজ রাত আটটায় আপনার দরজা খুলে যাবে। যাকে সামনে পাবেন অনুসরণ করবেন। সব ব্যবস্থাই হয়ে গেছে, এর পরও কোন বাধা আসলে তা মুকাবিলা করেই পেছনের অফিসার্স গেট দিয়ে কারাগার থেকে বেরুতে হবে। বেরিয়ে রাস্তার ওপাশে স্টার্ট নিয়ে থাকা ৭৮৬৭ নং গাড়িতে উঠে বসতে হবে।
অন্ধকার কুঠরীতে বসে সময় বুঝার উপায় নেই। তবে সময়টা আটটার কাছাকাছিই হবে। বহুদিন পর একটা এ্যাকশনের গন্ধে হাসান তারিকের মাংসপেশীগুলো যেন সজীব হয়ে উঠেছে। এর মাঝেও একটা জিজ্ঞাসা মাঝে মাঝেই মনের কোণে উঁকি মারছে। কারা এটা করছে? আজিমভ ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবার পর ভিকটর হাসান তারিকের দেয়া খাবার জনৈক খাদি ইসমাইলকে দিত। ভিকটরের কাছে হাসান তারিক শুনেছিলেন আজিমভকে গ্রেপ্তারের সূত্র ধরেই খাদি ইসমাইল ও আরও তিনজনেক গ্রেপ্তার করে এনেছে। অর্থাৎ তারা একই দলের লোক।
হাসান তারিক দু’রাকাত নামায পড়ে নিয়ে প্রস্ত্তত হয়েই বসেছিলেন। দরজার তালা খোলার শব্দ কানে এল। সবগুলো ইন্দ্রীয় সজাগ হয়ে উঠল হাসান তারিকের। ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে ভিকটর। হাতে সেই সার্ভিস ট্রে। তাতে চায়ের কাপ সাজানো। চোখাচোখি হতেই ইশারা করে হাঁটতে শুরু করল।
দরজাটা টেনে দিয়ে তার পিছনে হাঁটতে শুরু করলেন হাসান তারিক। একটা করিডোর দিয়ে চলছিলেন তারা। করিডোরের মুখেই একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। মুষ্টিবদ্ধ হলো হাসান তারিকের হাত। কিন্তু না, কিছু হলো না। পুলিশকে হাসান তারিকের দিকে তাকাতে দেখেই ভিকটর বলল, হুকুম আছে। আর কিছু বলল না পুলিশ। এবার তারা ডাইনে মোড় নিয়ে আরেকটা বিল্ডিংয়ের ছায়া ধরে এগিয় চলল। দ্রুত হাঁটছে ভিকটর। হাসান তারিকও তার সাথেই আছেন।
বড় ফটক ওয়ালা একটা ঘরের সামেন গিয়ে পৌঁছলেন তাঁরা। ফটকের ওপরে লাল অক্ষরে লেখা আছেঃ ‘অফিসার্স প্যাসেজ’’। এখানে জানালা দিয়ে প্রথমে আইডেনটিটি কার্ড দেখাতে হয়, তারপর এখান থেকে গেট পাশ পাওয়া যায়। গেট পাশ নিয়ে ফটক দিয়ে ঘরে ঢুকতে হয়। দরজাটা ইলেকট্রনিকের। যিনি গেট পাশ দেন, তিনিই তার বাঁ পাশের কি বোর্ডে লাল বোতামটা টিপে দেন, দরজা খুলে যায়। এ ঘর পেরুলেই একটুখানি খালি জায়গা। তারপরই গেটের সাথে লাগানো গার্ড রুম। গার্ড রুমে গেট পাশ দেখালেই বোতাম টিপে গেট খুলে দেয়া হয়। ভিকটর এবং হাসান তারিক সেই ফটক ওয়ালা ঘরের সামেন পৌঁছতেই ফটকের ইলেকট্রনিক দরজা খুলে গেল। তাঁরা ঢুকতেই আবার তা বন্ধ হয়ে গেল। হাসান তারিক দেখলেন ভেতের তিনজন লোক। হাসান তারিককে দেখে একজন এগিয়ে এল। ভিকটর পরিচয় করিয়ে দিল, ইনি খাদি ইসমাইল।
গেট পাশ দেয়া অফিসারকে হাসান তারিক তার চেয়ারের পাশেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলেন। তার ডান হাতের কাছে পড়ে আছে আধ পোড়া সিগারেট। বুঝলেন, সিগারেটের সাথে কিছু খাইয়ে ভিকটর তাকে আগেই কাবু করেছে।
এতক্ষণ বহন করে আনা চায়ের ট্রেটা মেঝেয় রেখে দিয়ে ভিকটর টেবিল থেকে ৪টা পাশ তুলে নিয়ে খাদি ইসমাইলের হাতে দিতে দিতে দ্রুত বলল, তুমি চা নিয়ে গার্ড রুমে ঢোকার পর একজন গেট পাশগুলো জানালা দিয়ে গার্ডকে দেবেন। গার্ড যখন ওগুলো চেক করতে শুরু করবে, তখন দু’জনে মিলে গাডরুমের গার্ড দু’জনকে কাবু করতে হবে। গেট খোলার জন্য বোতাম টেপার দায়িত্ব আমার। ওদেরকে এ্যালার্ম বাজাবার সুযোগ দেয়া যাবে না।
ভিকটর চলতে শুরু করেছে। হাসান তারিক চলতে গিয়ে হঠাৎ ফিরে এলেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা অফিসারের টেবিলে। টান দিয়ে তার ডান পাশের ড্রয়ারটা খুলে ফেললেন। চোখটা হাসান তারিকের উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হ্যাঁ, আছে রিভলভর। লোডেড। রিভলভরটি পকেটে পুরলেন হাসান তারিক। খুলে ফেললেন বাঁ পাশের ড্রয়ারও। নিকশ সাদা রংয়ের আরেকটা রিভলভর। অপেক্ষাকৃত ছোট। হাতে তুলে নিলেন। অস্বাভাবিক ভারী। ব্যারেল ও ট্রিগারের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন হাসান তারিক। এ তো ল্যাসার রিভলভর। ট্রিগার বোতামটি লাল। অর্থাৎ রিভলভরটি লোডেড। রিভলভারটি পকেটে রাখতে যাবেন এমন সময় জানালার ওপাশ থেকে পায়ের শব্দ এল। চোখ তুলতেই চোখাচোখি হলো এক পুলিশ অফিসারের সাথে। অফিসারটি চোখে বিস্ময় বিমূড়তা, কিন্তু তা মুহুর্তের জন্য। পরক্ষনেই সে হাত দিল পকেটে। এর অর্থ হাসান তারিক বুঝেন। সাদা রিভলভর ধরা ডান হাতটি হাসান তারিক ওপরে তুললেন। পরের অবস্থাটা চিন্তা করে নিজেই শিউরে উঠলেন হাসান তারিক। কিন্তু উপায় নেই। পুলিশ অফিসারটির চোখ ভয়ে বিস্ফারিত দেখা গেল। হাসান তারিক চোখ বন্ধ করে শাহাদাৎ আঙুল দিয়ে চাপ দিলেন লাল বোতামটায়। মাত্র দু’তিন সেকেন্ড। চোখ খুললেন হাসান তারিক। পুলিশ অফিসারের দেহটা গড়াগড়ি যাচ্ছে। কিন্তু মাথাটা নেই। আরেকবার গোটা শরীর শির শির করে উঠল হাসান তারিকের।
মিনিটের মধ্যেই ঘটে গেল গোটা ব্যাপারটা। ভিকটর বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল এদিকে। রিভলভরটা পকেটে রেখে হাসান তারিক বললেন, ভিকটর তাড়াতাড়ি। এক্ষণি সব জানাজানি হয়ে যাবে।
ভিকটর চা নিয়ে গার্ডরুমের দিকে এগুল দ্রুত। করিডোরের মত বেশ লম্বা ঘর। কিন্তু আর কেউ নেই ঘরে। আজ উজবেকিস্তানে নতুন ফসল উঠার উৎসব। ঈদের বিকল্প আনন্দ অনুষ্ঠান হিসাবে কম্যুনিস্টরা একে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। তাই সরকারী ভাবে বিভিন্ন প্রকার আনন্দানুষ্ঠানের ব্যাপক ব্যবস্থা করা হয় এদিনে। আজ উজবেকিস্তানে সাধারণ ছুটির দিন। তাই কারাগারের অফিসেও অপরিহার্য কিছু কর্মচারী ছাড়া আর কেউ নেই। ভিকটর ঘর পেরিয়ে ফাঁকা চত্বরটায় গিয়ে নেমেছে। হাসান তারিকরা দরজা থেকে উঁকি মেরে দেখলেন, ভিকটর চায়ের ট্রে নিয়ে গার্ডরুমে প্রবেশ করছে।
হাসান তারিক খাদি ইসমাইলকে বললেন, আপনি এদের নিয়ে গার্ডরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ান অমি গার্ডরুমে ঢুকব।
হাসান তারিক পকেটে হাত পুরে গার্ডরুমের দিকে এগুলেন। নির্লপ্ত গতি। গার্ডরুমের জানালা দিয়ে একজন গার্ডকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। ভিতরে তাকিয়ে কার সাথে যেন আলাপ করছে। ভিকটরের সাথে কি? এই তো সুযোগ। হাসান তারিক গার্ডরুমের পাশ ঘুরে দ্রুত গার্ডরুমে প্রবেশ করলেন। গার্ডরুমের দরজায় পা দিয়েছেন এমন সময় তীব্র সুরে বিপজ্জনক বিউগল বেজে উঠল। চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল দুজন গার্ড। ভয়াবহ ধরনের অটোমেটিক কারবাইন টেনে নিল ওরা। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। হাসান তারিকের রিভলভর দ্রুত গতিতে দু’বার অগ্নি বৃষ্টি করল। গুঁড়িয়ে গেল দুটি মাথা। ভিকটর মুহুর্তের হন্য হতচকিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই ছুটে গেল জানালার পাশের কি বোর্ডে। চেপে ধরল নির্দিষ্ট বোতাম।
দরজা খুলে গেল। দ্রুত গতিতেই গেট থেকে বেরিয়ে এল তারা পাঁচজন। রাস্তার ওপারে স্টার্ট নেয়া একটা জীপ। লাল রিয়ার লাইটের উপরে জ্বলছে নাম্বার-৭৮৬৮। তারা গাড়ীর কাছে যেতেই দরজা খুলে গেল। দ্রুত গাড়ীতে উঠে বসলেন।
বিউগল কেঁপে কেঁপে তখনো বেজেই চলেছে। ভিকটর বলল, এদিকে আসার ইলেকট্রনিকের দরজা বন্ধ। এ গেটে আসার জন্য ওদের ঘুরে আসতে হবে। ততক্ষনে গাড়ীটি চলতে শুরু করেছে। মাত্র পঞ্চাশ গজ সামনেই একটা রাস্তা পশ্চিমে বেরিয়ে গেছে এ জেল রাস্তা থেকে। দ্রুত জীপটি জেলখানার পাশের এ বিপজ্জনক রাস্তা ছেড়ে ঐ রাস্তায় গিয়ে পড়ল। জেলখানার দিকে থেকে তখন অনেকগুলো পুলিশের গাড়ীর একটানা ইমারজেন্সী সাইরেন ভেসে আসছে। বিউগলের তীব্র চিৎকার ইতিমধ্যে অনেকটা নেমে গেছে।
হাসান তারিকের পাশেই বসেছিল আমির উসমান। সে বলল, ভাই হাসান তারিক, মুবারকবাদ আপনাকে। আমি অভিভূত হয়েছি। তার কথা শেষ না হতেই ভিকটর বলে উঠল, আমি স্যারকে গোবেচারা ভদ্রলোক মনে করতাম, কিন্তু তিনি তো আগুন।
হাসান তারিক এদিকে কান না দিয়ে বললেন, ওরা অয়্যারলেসে গোটা পুলিশ নেটওয়ার্ককে জানিয়ে দেবে। গাড়ি সার্চ করা শুরু করবে ওরা। আমাদরে গাড়ি ওরা দেখেনি, গাড়ীতে আমরা আছি তাও জানে না। কিন্তু তার আগেই সরে পড়তে হবে।
এবার ড্রাইভার কথা বলল। বলল সে, সামনের ব্রীজটা পার হলেই আর কোন ভয় নেই ইনশাআল্লাহ। পরের যে পুলিশ পোস্ট তার আগেই মেইন রোড ছেড়ে দিয়ে আমরা পাশে চলে যাব।
সামনে দুরে একটা লাল আলো জ্বলছে। ড্রাইভার বলল, ওটাই ব্রীজের মুখ। লাল আলো দেখে মুখটা বিষন্ন হয়ে উঠল হাসান তারিকের। চেকিং কি শুরু হয়েছে? না ওটা রুটিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের আলো? হেড লাইটের আলোতে ব্রীজটা এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। স্টিল হেলমেটওয়ালা দু’জন পুলিশ। হাতে তাদের সাব মেশিনগান। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে হাসান তারিক বললেন থামতে বললে থামানই উচিত হবে।
কিন্তু….. কিছু বলতে শুরু করল ড্রাইভার।
হাসান তারিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাদের থামানোটা রুটিন চেকও হতে পারে, না থামলে তারা সন্দেহ করবে। তাতে ব্রাশ ফায়ারের মুখোমুখি হতে পারি আমরা।
আর যদি রুটিন চেক না হয়? বললড্রাইভার।
তাহলে পুলিশ দুটোর দায়িত্ব আমার। বললেন হাসান তারিক।
গাড়িটি ব্রীজের মুখে এসে পৌঁছেছে। ততক্ষণে ব্রীজের মুখের সবুজ আলো আবার জ্বলে উঠেছে। গাড়ীর ভীড় নেই বললেই চলে। চলতে শুরু করেছে গাড়ীগুলো। একজন পুলিশ অয়্যারলেসে কথা শুরু করল। আরেকজন পুলিশ ধীর গতি গাড়ীগুলোর দিকে একনজর চেয়েই চলে যেতে ইশারা করছে। হাসান তারিকদের গাড়ীও ঐভাবে চলে যাবার ইশারা পেল। ততক্ষণ প্রায় রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিল একটা কোন কিছুর। এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সাদা রিভলভরটা পকেটে চালান করে দিলেন হাসান তারিক।
হাসান তারিকদের গাড়ি ব্রীজে প্রবেশ করেছে। এমন সময় অয়ারলেসে কথা বলা পুলিশটি উত্তেজিতভাবে অন্য পুলিশকে কি যেন বলল। তারপর তারা রাস্তায় ছুটে এল, বন্ধ করে দিল গাড়ীর অগ্রসরমান গতি। জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন হাসান তারিক।
শুকরিয়া আদায় করলেন সকলেই।
মাইল খানেক যাবার পর গাড়ীটি হাইওয়ে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি রাস্তা ধরে শহরের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলল। পেছনের বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। হাসান তারিক কিছুক্ষণ পেছনের দিকটা পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হলেন, না কেউ অনুসরণ করছে না।
গাড়িটি দক্ষিণ পূর্বে প্রায় মিনিট দশেক চলার পর দক্ষিণ দিকে আরেকটা বাঁক নিয়ে একটা সরু গলির মধ্যে ঢুকে গেল। একটা গ্যারেজের গেটে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়িটা। সংগে সংগে খুলে গেল গ্যারেজের গেট। ভেতরে ঢুকল গাড়ি।
গাড়ি থামতেই ছুটে এল কয়েকজন। এদিকে গাড়ি থেকে সবাই নেমে পড়লেন। প্রথমেই ড্রাইভার জড়িয়ে ধরল হাসান তারিককে।
ড্রাইভারের নাম আনোয়ার ইব্রাহিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতায় সে ইব্রাহিমভ। দু’বছর আগে তাসখন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে ইতিহাসে ডিগ্রী নিয়ে বেরিয়েছে। পেশা হিসাবে নিয়েছে শিক্ষকতা। সে একটি বিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক। ড্রাইভিং লাইসেন্সও তার আছে। সাইমুমের তাসখন্দ ব্রাঞ্চের প্রধান।
আনোয়ার ইব্রাহিম হাসান তারিককে নিজের পরিচয় দেবার পর পরিচয় করিয়ে দিল খাদি ইসমাইলের সাথে। খাদি ইসমাইল উজবেকিস্তান সাইমুমের অপারেশন স্কোয়াডের আমুদরিয়া সেক্টরের একজন কমান্ডার। আজিমভের কমান্ডেই সে কাজ করত। আজিমভ ধরা পড়ার ১৫দিন পর সেও ধরা পড়ে যায় একজন কর্মীর সামান্য ভুলের কারণে।
হাসান তারিককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলে উজবেকিস্তান সাইমুমের গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্বশীল আমির উসামনের সাথে। আনোয়ার ইব্রাহিম জানান, ভিকটরের সাথে যোগাযোগ করা এবং আজকের অপারেশনের প্ল্যানটা তারই তৈরী। আমির উসমানের বয়স ৪৫ এর মত। উজবেক পুলিশের গোয়েন্দা শাখার একজন ডাইরেক্টর হিসাবে কাজ করেছে প্রায় ১৫ বছর। স্বাস্থ্যগত কারণে অব্যাহতি নিয়েছে চাকুরী থেকে। চাকুরীর সময় থেকেই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সহায়তা দিয়ে আসছে। সরকারী চাকুরীতে যারা আছে তাদের সাথে যোগাযোগের সে একটি বড় সূত্র।
হাসান তারিক আমির উসমানকে বুকে জড়িয়ে ধরে মোবারকবাদ জানিয়ে বললেন, আল্লাহ আপনাকে আরও কাজের শক্তি দান করুন। আমির উসমান বলল, আপনার দোয়া আল্লাহ আমাদের সবার জন্য কবুল করুন।
গ্যারেজের সাথেই একটা বড় তিনতলা বাড়ি। বাড়ি এবং গ্যারেজ দুটোরই মালিক আনোয়ার ইব্রাহিম। কম্যুনিস্ট পার্টির ক্যাডারের বাইরে যে দু’চারজন ভাগ্যবান লোকের তাসখন্দে বাড়ি আছে, আনোয়ার ইব্রাহিম তাদেরই একজন। এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস স্মরণ করতে লজ্জা পায়, দুঃখ পায় আনোয়ার ইব্রাহিম।
আনোয়ার ইব্রাহিমের পিতামহ আবদুল্লাহ কম্যুনিস্ট প্রলোভনে ভূলে লাল ফৌজের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। ১৯৩০ সালে উজবেকিস্তানের এ অঞ্চলে যৌথ খামারের প্রতিষ্ঠা হয়। মুসলিম জনসাধারণ তাদের ধ্বংসাবশিষ্ট শক্তি নিয়েই কম্যুনিস্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিরোধের চেষ্টা করে। তখন কম্যুনিষ্ট লৌহ শাসনের স্থানীয় লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করে আবদুল্লাহ। অবর্ণনীয় অত্যাচার চলে মুসলিম কৃষকদের ওপর। তাদের বাড়ি-ঘর, ঘোড়া এবং কৃষি জমিই শুধু কেড়ে নেয়া হয় না, তাদের স্ত্রী- কন্যাকেও দখল করা হয়। সে সময় পরাজিত অবস্থায় একজন মুসলমানের প্রতি একজন কম্যুনিস্টের বিদ্রুপ উক্তি ছিল এই রকম-
‘আল্লাহর সাহায্যে আমরা তোমাদের থেকে জীবন ধারণের সব সামগ্রী নিয়েছি। এখন তোমাদের স্ত্রীদের পর্যন্ত আমরা যৌথ ব্যবস্থাধীনে আনব। এভাবে আমরা তাদের শয্যা শায়িনী করব। এভাবে পরস্পরে আমরা প্রীতি বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারব’। আবদুল্লাহকে তার কাজের পুরস্কার হিসাবে কম্যুনিস্ট সরকার এই জমি দান করে এবং বাড়ি তৈরীরও ব্যবস্থা করে দেয়। বাড়ীর এই ইতিহাস কখনও আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে তুললে সে বলে, দাদার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার কাজ আব্বা থেকেই শুরু হয়েছে। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমার নাম তিনি রেখেছেন লাল ফৌজের বিরুদ্ধে মুসলমানদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর আনোয়ার পাশা ও ইব্রাহীম বাকেরের নাম অনুসারে। আনোয়ার পাশা লাল ফৌজের সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হন এবং ইব্রাহিম বাকের উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের পাহাড়ে প্রান্তরে দীর্ঘদিন প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানোর পর ১৯৩৫ সালে ধরা পড়েন এবং লাল ফৌজের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। এই নাম রাখা দাদার কাজের বিরুদ্ধে আব্বার নিরব, কিন্তু অত্যন্ত শক্ত প্রতিবাদ। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারী ইতিহাস পড়েছি, কিন্তু তার পাশাপাশি আব্বার কাছে সত্যিকার ইতিহাসও পড়েছি। আব্বা গোপনে লাহোর থেকে এসব আনিয়ে নিয়েছিলেন।
গ্যারেজ এবং বাড়ীটি এখনও সরকারীভাবে আনোয়ার ইব্রাহিমের বটে, কিন্তু এর সব কিছুই আনোয়ার ইব্রাহিম সাইমুমকে দান করেছে। তিন তলার দুটি কক্ষ নিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বাস করেন। এ দুটি কক্ষের উপযুক্ত ভাড়া ইব্রাহিম সাইমুমকে দেয়।
আমির উসমান হাসান তারিক সহ সবাইকে নিয়ে গ্যারেজের মধ্য দিয়ে ঢুকে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। আমির উসমানের অফিস কক্ষে হাসান তারিক ও আমির উসমান গিয়ে বসলেন। অফিসটি দোতলায়। ঘরের বাইরে রুশ ভাষায় বিরাট একটা সাইনবোর্ড- ‘অফিস অফ দি লিগাল কনসালট্যান্ট (প্রাইভেট)’।
হাসান তারিক ও আমির উসমান টেবিলে মুখোমুখি বসে। কথা বলল প্রথম আমির উসমান। বলল, আপনাকে ওরা ধরে এনেছে এটা শুরু থেকেই আমরা জানি। এদেশে আমাদের সব কর্মীই এটা জানে। কিন্তু কোথায় কিভাবে যে আছেন এটা আমাদের জানা ছিল না। অতি সম্প্রতি আমরা এ ব্যাপারে জানতে পারি।
ভিকটরের সাথে কিভাবে আপনাদের যোগাযোগ হলো?
সে একটা ইতিহাস। ‘ফ্র’-এর গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিও’র তাসখন্দের অভ্যন্তর বিভাগের প্রধান উমর জামিলভ আপনার সন্ধান ইসলামিক স্টেট অব ফিলিস্তিনের মস্কোস্থ এ্যামবাসীকে জানায়। সেই সাথে জানায় সহজ শিকার হিসাবে ভিকটরের নাম। এ খবর আমরা পাওয়ার পরেই ভিকটরের সাথে যোগাযোগ করি।
‘রিও’-এর একজন অফিসার এটা করল? তাঁকে আপনারা জানেন? অপার বিস্ময় হাসান তারিকের চোখে।
আমরা তাঁকে জানি না, এখনো খোঁজ নিতেও পারিনি।
আমির উসমান থামল। হাসান তারিক কোন কথা বললেন না। তার ভাবনা এখন অন্য জায়গায়। আয়িশা আলিয়েভার কথা মনে পড়ল তার। উমর জামিলভ তাসখন্দ ‘রিও’ও অভ্যন্তর বিভাগের প্রধান হলে সেই তো ওখানে আলিয়েভার টপ ‘বস’ হবার কথা। তাহলে উমর জামিলভের হাতে কি আয়িশা আলিয়েভার ক্ষতি হতে পারে? আশার একটা আলো জেগে উঠতে চাইলো তার মনে। হাসান তারিকের কাছে আলিয়েভার লেখা চিঠি যে মুহূর্তে ওদের হস্তগত হয়ে যায়, তখন থেকেই হাসান তারিক আলিয়েভার জীবনের আশা পরিত্যাগ করেছিলেন।
হাসান তারিকের চিন্তাজাল ছিন্ন করে আমির উসমানই আবার কথা বলল। বলল সে, আজ রাতের মধ্যেই আমাদের পাহাড়ের ঘাঁটিতে পৌঁছতে হবে। গাড়ীর পথ এখন একটুও নিরাপদ নয়। পাহাড়-মালভুমির দুর্গম পথে আমাদের ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে। সময়ও লাগবে এর জন্য প্রচুর। আমির উসমানের কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকল আনোয়ার ইব্রাহিম। বলল, চলুন খাবার তৈরী।
এই মুহুর্তে এর চেয়ে বড় সুখবর আমার জন্য কিছু নেই, বলে হেসে উঠে দাঁড়ালেন হাসান তারিক। উঠে দাঁড়াল আমির উসমানও।

ঘুম ভাঙতেই উঠে বসল রোকাইয়েভা। ঘরে আলো জ্বলছে তখনও। কেউ আসেনি। তাহলে এ ঘরে ভাইয়া আসেনি? মনটা আনচান করে উঠল। ছুটল ভাইয়ার ঘরের দিকে। শূন্য ঘর। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। দোতলার বারান্দা থেকে গেট দেখা যায়। দেখল, গেট বন্ধ। পূর্ব আকাশে শুকতারা জ্বল জ্বল করছে। এখনও বেশ অন্ধকার। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কালকের রাতের আশংকাটা আবার মনে জাগল। দাদীর ঘরে এলো রোকাইয়েভা। দাদী ফজরের নামায শেষ করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। রোকাইয়েভা বলল, দাদী ভাইয়া….. কথা শেষ করতে পারল না। গলাটা যেন বন্ধ হয়ে এল তার ।
চিন্তা করছিস কেন, আসবে।কত কাজে কত জায়গায় যেতে পারে।
কিন্তু টেলিফোন-ভাইয়ার টেলিফোন নিরব কেন? এমন তো কোনদিন হয়নি। ভাইয়া বাড়িতে না জানিয়ে তো কোথাও থাকেন না!
তোর ভাইয়া যে কাজ করে, অনেক সময় বলার সুযোগ নাওতো পেতে পারে?
কিন্তু তার অফিস? তিনি না পারলে অফিস তো জানিয়েছে? দাদী কোন উত্তর দিলেন না। তাঁর চোখেও চিন্তার একটা কালো ছায়া। সত্যিই উমর জামিলব এমন তো কোন দিন করেনি। সে ডিউটি পাগল সত্য, কিন্তু বাড়ীর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যে সে বিন্দুমাত্রও অবহেলা করে না। মনের এ চিন্তা চাপা দিয়ে দাদী বললেন, এখনও তো নামায পড়িসনি। যা নামায পড়ে আয়, মনটা ভালো হবে।
দাদী কুরআন শরীফ পড়ছিলেন। রোকাইয়েভা নামায পড়ে এসে তার পাশে বসল। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল রোকাইয়েভার। ভাইয়ার কোন খবর? ছুটে গেল সে বাইরে। একটি খাম হাতে ঘরে ফিরে এল। বন্ধ খাম। কারো নাম নেই খামে।
কে দিল? জিজ্ঞেস করলেন দাদী।
দারোয়ানকে কে যেন দিয়েছে। আপনাকে দিতে বলেছে।
পড়তো দেখি।
খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করল রোকাইয়েভা। চার ভাঁজ করা চিঠি খুলে পড়তে লাগল সে।
চিঠি পড়তে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল রোকাইয়েভা। তার হাত থেকে পড়ে গেল চিঠি। বিছানায় লুটিয়ে পড়ল রোকাইযেভার দেহটা। দাদী কুরআন শরীফ বন্ধ করে টেবিলে রেখে রোকাইয়েভার পাশ থেকে চিঠি তুলে নিলেন। পড়লেন-
দাদী, আমি জামিলভের এক ভাই। জামিলভ নেই। আপনারা, আমরা কেউ কোন দিন আর তাকে খুঁজে পাব না। তাসখন্দ জেল থেকে সাইমুম নেতা হাসান তারিক, তিনজন বিদ্রোহী নেতা এবং ভিকটর নামের একজন জেল কর্মচারী পালিয়েছে। ভিকটরের সন্দেহজনক গতিবিধি রিপোর্ট হওয়ার পরেও জামিলভ তাকে সুযোগ দিয়েছে, ব্যবস্থা গ্রহণের কোন নির্দেশ দেয়নি। অর্থাৎ জেল পালানোর ঘটনার সাথে তার যোগসাজস ছিল। সুতরাং বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে জামিলভ দন্ডিত হয়েছেন।
দুঃখ করবেন না দাদী। এ দেশে জামিলভদের সারি বড় দীর্ঘ। আরও কত দীর্ঘ হবে কে জানে!
যুবায়েরভ।

চিঠি পড়া শেষ করলেন দাদী। কিন্তু মনে হচ্ছে চিঠি পড়া শেষ হয়নি তাঁর। চিঠি ঐভাবেই তাঁর হাতে ধরা। চোখ দুটি চিঠির ওপরই নিবদ্ধ। স্থির অচঞ্চল তিনি। দৃষ্টি শূন্য। যেন তিনি পাথর হযে গেছেন।
পল পল করে সময় কেটে গেল। পাশে বিছানায় পড়ে কাঁদছে রোকাইয়েভা। এক সময় মুখ ফিরিয়ে দাদী সেদিকে তাকালেন। দাদীর দুচোখে দুফোঁটা অশ্রু টলমল করে উঠল। রোকাইয়েভার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাঁদিস না বোন, আমার জামিলভ বীরের মৃত্যুবরণ করেছে। শহীদ সে। ওর জন্য গর্ব কর।
তারপর দাদী ধীরে ধীরে উঠলেন। জামিলভের কক্ষে এলেন। টেবিলের ওপর জামিলভের একটা বাঁধানো ফটো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যখন ডিগ্রী নিয়ে বেরোয়, তখনকার তোলা। ফটোটি হাতে তুলে নিয়ে বললেন, কাজ দিয়ে প্রমাণ করে যাবি বলেই কি মুখে কিছু কোনদিন বলিসনি?
দাদীর চোখের এক ফোঁটা পানি ফটোর স্বচ্ছ কাঁচে গিয়ে পড়ল। জানালা দিয়ে আসা সকালের এক টুকরো রোদে তা জ্বল জ্বল করে উঠল।
রোকইয়েভা দাদীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চেখের পানিতে গোটা মুখ তার ধোয়া। তার দিকে চেয়ে দাদী বললেন, জামিলভ তার পূর্ব পুরুষের মান রেখেছে। তোদের মুসলিম পূর্ব পুরষেরা জান দেয়াকে ভয় করেনি, যেদিন থেকে এ ভয় দানা বেঁধে বসল, সেদিন থেকেই আমাদের সর্বনাশের ঘোর অমানিশা শুরু।
আবার কলিং বেল বেজে উঠল। বেরিয়ে গেল রোকাইয়েভা। ফিরে এল হাতে একটি কাগজ নিয়ে। একটা সরকারী নির্দেশ পত্র। রোকাইয়েভার মুখটা যেন বেদনায় আরো নীল দেখা গেল।
কি ওটা? জিজ্ঞেস করলেন দাদী।
একটা নির্দেশ পত্র।
সরকারী নির্দেশ পত্র? কি আছে ওতে?
বিশ্বাসঘাতক জামিলভের সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।
কান্নায় ভেঙে পড়ল রোকাইয়েভা। দাদী রোকাইয়েভাকে টেনে নিয়ে পাশে বসালেন। বললেন, মন শক্ত কর বোন। আরো অনেক কিছুর জন্য আমাদের প্রস্ত্তত থাকতে হবে।
একটু থামলেন দাদী। তারপর বললেন, জাতিকে ভালোবাসার বড় বড় কথা অনেক বলেছি, ভালোবাসি যে তার পরীক্ষাও তো দিতে হবে! তোর ভাই তা পেরেছে, তুই পারবি না রোকাইয়েভা?
‘পারবো’ বলে দাদীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রোকাইয়েভা।
তাসখন্দ কম্যুনিস্ট পার্টির সেক্রেটারীয়েটের কমিটি রুম। নিরাপত্তা কমিটির বৈঠক। মস্কো থেকে ছুটে এসেছেন ‘ফ্র’-এর প্রতিরক্ষা প্রধান কলিনকভ, গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিও’-এর চীফ কুলিকভ এবং মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের প্রধান সার্জি মোকলভ। এই মিটিংয়ে হাজির আছে উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানের ‘ফ্র’-এর ফাস্ট সেক্রেটারীদ্বয় এবং দুই রাজ্যস্থ ‘ফ্র’-এর গোয়েন্দা ও পুলিশ প্রধানরা।
‘রিও’ চীফ কুলিকভ বলল, দেশের এই দক্ষিণাঞ্চলে সাম্প্রতিককালে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যা আমাদের কম্যুনিস্ট ব্যবস্থাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এই বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্যই আজকের বৈঠক। মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কলিনকভ এখন এ ব্যাপারে কিছু বলবে।
কলিনকভ নড়েচড়ে বসল। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, দেশের এ অঞ্চলে সম্প্রতি এক সংগে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যাকে খুব ছোট করে দেখা যাচ্ছে না। জামিলভ ও আলিয়েভার বিশ্বাসঘাতকতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করতে পারছি না। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার চরিত্র একই রকম- ধর্মীয় স্বকীয়তা বোধের উন্থান। এই উথানটা ডেনজারস। আগুনের মত তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। বহুদিন এই চেতনা উৎখাতের জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা উৎখাত হয়নি। গোপনে গোপনে তা সজীব সবল হয়ে উঠেছে। আগে এটা তেমন একটা নজরে পড়তো না, কিন্তু তা এখন নজরে পড়ার মত প্রবল হয়েছে। এ কথাগুলো আপনাদের কারো অজানা নয়, গত দু’বছরের পরিসংখ্যান আপনাদের সবারই নজরে আছে।
একদিকে এই অবস্থা, অন্যদিকে হাসান তারিকের জেল থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং আহমদ মুসা গায়েব হওয়া আমাদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আপনারা জানেন, হাসান তারিক সাইমুমের একজন প্রথম সারির নেতা- যারা ফিলিস্তিনে একটা অসাধ্য সাধন করেছে্ আর আহমদ মুসাতো ফিলিস্তিন ও মিন্দানাও বিপ্লবের নায়ক। সংগঠন গড়ে তোলার একটা যাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে তার। এ ছাড়া গোটা মুসলিম বিশ্বে তার এমন একটা ইমেজ গড়ে উঠেছে যে, সে যেখানেই যায় একটা অপ্রতিরোধ্য আবেগ ও প্রাণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেই আহমদ মুসা প্লেন-ক্রাশের পর রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে গেছে। তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধানের পর আমরা নিশ্চিত হয়েছি, বাক্স সমেত আহমদ মুসাকে কে বা কারা উদ্ধার করেছে। বিধ্বস্ত বিমানের সব কিছুই আমরা পেয়েছি, একমাত্র ঐ বাক্স ছাড়া। বাক্স উদ্ধারের জন্য পাহাড়, উপত্যকা, নদী এবং নদী তীরবর্তী এলাকা সবই অনুসন্ধান করা হয়েছে। ‘ফ্র’- এর বিশ্বাস, সে এদেশেই আছে।
সুতরাং সব মিলিয়ে আমরা একটা উদ্বেগজনক অবস্থারই আলামত দেখতে পাচ্ছি। এ অবস্থায় আমাদের করনীয় কি তা নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করব।
কলিনকভ থামল। এবার কথা বলল মিলিটারী ইন্টেলিজেন্সের প্রধান সার্জি মোকলভ। সে বলল, বর্তমান অবস্থার পেছনে আফগানিস্তানও একটা ফ্যাক্টর। এ সম্পর্কে স্যার কিছু বললে ভালো হত।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। বলল কলিনকভ, ‘তবে এ ব্যাপারে একথা বলাই যথেস্ট যে, আমরা সেদিক থেকে একটা অকল্পণীয় বিপদের সম্মুখীন যা আপনারা সকলেই জানেন। ভাষা, বংশ ও জাতিগত একটা সাদৃশ্যের কারণে আফগানদের ভাব ও মানসিকতা শুধু নয় সেখান থেকে গেরিলা ও চরদের অনুপ্রবেশের ঘটনাও বেড়ে গেছে। তারা ব্যাপকভাবে এদেশে আশ্রয়ও পাচ্ছে।
থামল কলিনকভ। সবাই কিছুক্ষণ নিরব। তারপর প্রথমে কথা বলল কুলিকভ। বলল, ফিলিস্তিন ও মিন্দানাওয়ে সাইমুম যে পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ করেছে সেটা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তাদের ব্যাপারে আমাদের কর্মকৌশল ঠিক করা হোক এটা আমাদের প্রস্তাব।
ঠিক বলেছেন। আমি এটা নোট করলাম। কিন্তু এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইতিমধ্যে আমাদের কি করা দরকার?
কুলিকভই আবার কথা বলল। বলল সে, আমরা জামিলভ ও আলিয়েভার ক্ষেত্রে যে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি সেটা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের মুসলিম কর্মচারীদের এ কথা বুঝাতে হবে, বিদ্রোহ তৎপরতার প্রতি বিন্দুমাত্র দুর্বলতা পেলেও তার শাস্তি মৃত্যুদন্ডের নিচে হবে না। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আমাদের যেটা আছে, ঠিকই আছে। শুধু অতুর্কি অফিসারের সংখ্যা এখানে বাড়াতে হবে। যারা অন্য সব কিছুর সাথে স্থানীয় গোয়েন্দা অফিসারসহ স্থানীয় সকল কর্মচারী ও দায়িত্বশীলের কাজের প্রতিও গোপনে নজর রাখবে। আফগানিস্তানের পথে আসা এবং দেশের গোপন ছাপাখানায় ছাপা ইসলামী সাহিত্যর উৎস ও প্রচার বন্ধের লক্ষ্যেও অত্যন্ত কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একে বিদ্রোহ তৎপরতার সাথে শামিল করে এ অপরাধের জন্য মৃত্যুদন্ডেরই ব্যবস্থা করা উচিত হবে। থামল কুলিকভ।
উজবেক ‘ফ্র’-এর ফার্স্ট সেক্রেটারী বলল, আমি মনে করি বর্তমান অবস্থায় এসব দমনের জন্য কঠোর শাস্তি ও মুসলিম কর্মচারী ও দায়িত্বশীলদের ওপর চোখ রাখার ব্যবস্থা করা হলেই চলবে। একটা ভীতি সৃষ্টি করা গেলেই সাধারণ মানুষের কাছে বিদ্রোহীরা আর কোন আশ্রয় পাবে না।
তাজিক ‘ফ্র’-এর ফার্স্ট সেক্রেটারী চেরনেংকো মাথা নেড়ে উজবেক সেক্রেটারীর কথায় সায় দিল।
কুলিকভ বলল, উজবেক সেক্রেটারী ভালো প্রস্তাব করেছেন। আমরা স্থানীয় কর্মচারীদের অবিস্বাস করবো না, তবে তাদের ওপর নির্ভর করবো না, এই নীতি আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হেসে ‘ফ্র’-এর প্রতিরক্ষা প্রধান কলিনকভ বললো, কুলিকভ সুন্দরভাবে একবাক্যে উজবেক সেক্রেটারীর কথাটাকে প্রকাশ করেছেন। আর আমি আনন্দের সাথে বলছি, আমাদরে বিশ্ব রেড সংস্থা ‘ফ্র’- এর মনের কথাটাই আমাদের মুখে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। চিন্তার এই ঐক্যই আমাদের শক্তি। কথা শেষ করে কলিনকভ উঠে দাঁড়াল। উঠে দাঁড়াল সবাই।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.